মেদিনীপুর লোকাল। পর্ব ২। “নমস্কার! আমি ইউনিয়নের লোক।” লিখছেন আদিত্য ঢালী
দূরপাল্লার ট্রেনে চড়ার আনন্দ আমায় মাঝে মাঝেই গ্রাস করে। কিন্তু এই পোড়া কপালে সেই আনন্দ কখনই ঘনঘন ফিরে আসে না। অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘমাস। একসময় ইচ্ছে ছিল এমন কিছু একটা করব যেখানে ঘনঘন ট্রাভেল করতে হয়। বাড়িতে যখন বলেছিলাম সিনেমা বানানোর টিমে কাজ করব আর এদিক ওদিক শুটিং করতে যাব মাঝেমাঝেই, বাড়ির লোক বলেছিল, “ওহ, এই জন্যই এমসিএ-টা করলি না! কোনো কিছু করতে হবে না আর কোথাও যেতেও হবে না।” যেমন হয় মধ্যবিত্ত বাবা-মা আর কী! আমার বাবা-মা’ও ঠিক সেরকমই। ব্যাঙ্কে চাকরি পাওয়ায় আমার থেকে আমার বাবা ও মা বেশি আনন্দ পেয়েছিলেন। কারণ, স্টেডি চাকরি। পেনশন আছে। আর কী চিন্তার! বাকি যা কিছু অসুবিধা হবে সেগুলোকে মেনে নেওয়াই নাকি ভালো। কোনো জ্যোতিষী তো আর হাত দেখে বলে না কখনও, “এ ছেলে লেখক হবে। কবিতা ছুঁড়ে মারবে যখন তখন।”
‘গ্রামের মানুষ মানেই খুব বোকাসোকা, একদম মাটির কাছাকাছি’ — এই তথ্য যতই বইয়ের পাতায় পাতায় ঘুরে থাকুক না কেন তা আদতে আংশিক সত্য। কথাটা এমন হওয়া উচিত, ‘গ্রামের কয়েকজন মানুষ খুব বোকাসোকা এবং একদম মাটির কাছাকাছি।’ কানের কাছে মশার গুনগুন শুনতে শুনতে রাতে ব্যাঙ্কের মধ্যেই ঘুমাতে হচ্ছে শুনে আমার বাবা খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। এখনই এখানে আসতে চাইছেন। ইতিমধ্যে একটা ঘরের সন্ধান আমি পেয়েছি। কথাও বলে এসেছি। ব্যাঙ্কে কাজ করি আবার কলকাতা থেকে আসছি শুনে তারা বেশ গদগদ। বেশি গদগদ হওয়ার কারণটা যদিও পরে বুঝতে পারব। দোতলায় দুটো ঘর, বাথরুম, রান্নাঘর সবই আছে। ভাড়াও মোটামুটি, এক প্রকার সেট্ল করেই আমি সেবার বাড়ি ফিরেছিলাম। কারণ আগামী তিনদিন আমাদের ট্রেনিং। স্থান বহরমপুর। শিয়ালদহ থেকে চেপে বসলাম ‘রূপসী বাংলা’-তে। যেহেতু ট্রেনিংয়ের ট্রাভেল আল্যাউন্স ব্যাঙ্ক দেবে, অতএব এসি সেকেন্ড সিটিং। আমার সঙ্গে একই ট্রেনের জেনারেল কামরায় পার্থ। আমরা দুজনেই জয়েন করেছি এই জেলায়। এসির ঠাণ্ডা হাওয়া খেতে খেতে বৈশাখের গরম থেকে একটু মুক্তি পেয়ে ছুটে চলা ট্রেনের জানলা দিয়ে পার হয়ে যাওয়া এক একটা আলোর রাশি দেখতে দেখতে বেশ কবিতা লিখতে ইচ্ছে হয়। ততদিনে আমার হাতে স্মার্টফোন চলে এসেছে। বাংলাতে টাইপ করা যায় জবরদস্ত।
রাত দশটায় বহরমপুর স্টেশনে নেমে রিক্সায় উঠে যখন বললাম, “অমুক লজে নিয়ে চলুন।” রিক্সাওয়ালা বলল, “ঐ নামে এখানে দুটো লজ আছে। কোনটায় যাবেন?” পার্থ বলল, “দাঁড়া ফোন করি।” কাকে একটা ফোন করে কী শুনল বুঝলাম না। ফোন রেখে রিক্সাওয়ালাকে বলল, “দাদা সস্তারটায় চলুন।” আমি বোকার মতো পার্থর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। রিক্সা লজে নামাল। ভিতরে ঢুকে রিসেপশনে নাম বলাতে রুমের চাবি দিল। একটা রুমে দুজন করে থাকা যাবে। দুটো সিংগেল বেড আর তাতেই সব যায়গা শেষ রুমের। বিছানায় ব্যাগ রেখে খেতে চললাম। ডাইনিং-এ ঢুকেই দেখলাম সেলফ সার্ভিস। থালায় ভাত ডাল আলুর চিপ্স আর দুটো করে ডিমের কারি নিয়ে টেবিলে ফিরে এলাম। আমাদের মতো আরও অনেকে তখনও খাচ্ছে। পার্থ ফিসফিস করে বলল, “এরাও আমাদের ব্যাচের, আমাদের আগেই সবাই চলে এসেছে।” শুধু আমরা দু’জনেই দেখলাম সবার থেকে আলাদা। বাকি সবাই সবার সঙ্গে দিব্যি কথাবার্তা বলছে হাসিঠাট্টা করছে। আমরা দুজনেই মাথা নিচু করে খেয়ে যাচ্ছি। একজন এগিয়ে এসে বলল, “ট্রেনিং তো?” আমরা দু’জনেই নকল হাসি হেসে বললাম “হ্যাঁ।” সে প্রশ্ন করল, “কোল্ডড্রিংক্স খাবে তো?” আমরা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম। সে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর দু’হাতে দুই গ্লাস কোল্ডড্রিংক্স নিয়ে এসে বলল, “ওরা দিয়ে গেছে। শুধু তোমরা দু’জনেই বাকি ছিলে। কাল সকালে ট্রেনিংয়ে দেখা হবে। এখন চলি। গুডনাইট।” আমরাও গুডনাইট বলে আবার খাবারে মনোনিবেশ করলাম। কিন্তু কারা এই কোল্ডড্রিঙ্কস দিয়ে গেছে সেটা ভেবেই কুল পেলাম না। পার্থ বলল, ব্যাঙ্ক থেকেই সন্ধ্যেবেলা এসে দিয়ে গেছে বোধহয়। আমার মনে যদিও একটা খটকা থেকেই গেল। যারা গোটা দু’দিন হেড অফিসে বসিয়ে রেখে এক কাপ চা পর্যন্ত খেতে দিল না তারা ট্রেনিং করতে উপস্থিত হওয়ার আগেই কোল্ডড্রিংক্স রেখে গেল আমাদের জন্য! এ তো চাঁদ না চাইতেই জ্যোৎস্না দেখতে পাওয়ার মতো ব্যাপার।
অফিসে যাব বলে খাদির দোকান থেকে একটা সাদা জামা কিনেছিলাম। একেবারে ধবধবে সাদা আর কী! প্রথমদিন পরেও গিয়েছিলাম। কিন্তু সারাটাদিন আমায় কোনও কাজ না করে ঠিক চেয়ারে এমন ভাবে বসে থাকতে হয়েছিল যাতে সাদা জামায় কোনও ধুলোর দাগ না লাগে। সারা ব্রাঞ্চ খুঁজে খুঁজে শুধুমাত্র ম্যানেজারের চেয়ারখানা পেয়েছিলাম যার হাতলে হাত দিয়ে বসার পর জামায় কোনও দাগ লাগেনি। গোবেচারা ম্যানেজার আমাকে নিজের চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে অম্লান বদনে পাশবই প্রিন্ট করতে লেগে পরেছিলেন। আমার কাজ ছিল চুপচাপ বসে ব্যাঙ্কের কাজ পর্যবেক্ষণ করা। কারন তখনও জানতাম না যা কিছু শিখতে হবে এই ব্রাঞ্চে বসেই শিখতে হবে। ট্রেনিং তো আসলে একটা মেকওভার, ধুলেই উঠে যাবে।
সকাল সকাল উঠে স্নান সেরে জামা গুঁজে পরে সানগ্লাস চোখে দিয়ে টোটো চেপে বেরিয়ে পড়লাম ট্রেনিংয়ে। অপেক্ষায় ছিলাম কেমন যায়গায় ট্রেনিং হয় সেটা দেখার। কারণ আর যাই হোক কোনও কনফারেন্স রুম যে পাব না সেটা ততক্ষণে মাথায় গেঁথে গেছে। টোটো যে যায়গায় নামিয়ে দিল সেটা সরু একটা রাস্তা। এখানে কোথায় ট্রেনিং ইনস্টিটিউট হবে ভেবে ভেবে মাথা নিচু করে দেখলাম সুয্যি মামার প্রবল তাপের ঝলকানিতে জামা প্রায় ঘামে ভিজে গেছে। সানগ্লাস খুলে রুমাল দিয়ে মুখ মুছে যেই তাকালাম, দেখলাম পার্থ ডাকছে। ও ব্যাটা আগেই পৌঁছে গেছে। আমি মাঞ্জা মারতে গিয়ে দেরি করে ফেলেছি। রাস্তার পাশের একটা সরু গলি দিয়ে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে ক্যান্টিন লেখা একটা ঘরের পাশেই কাচের দরজা দেওয়া একটা ঘরে দেখলাম সবাই বসে আছে। বুঝতে অসুবিধে হল না ইহাই আসলে আমাদের ট্রেনিং রুম। পাঁচ-ছয় খানা বেঞ্চ রাখা পরপর। প্রতিটা বেঞ্চে তিনটে করে কম্পিউটার রাখা। যাক, তাহলে টেকনিক্যাল বিষয়ে নিয়ে শেখানো হবে ভেবে একটু যেই নিশ্চিত হয়েছি, লাস্ট বেঞ্চে বসার পর বুঝতে পারলাম আরে এ কম্পিউটার তো বন্ধ! পাসওয়ার্ড দেওয়া। খোলাও যাবে না। আর এদিকে যিনি ট্রেনিং নেবেন তিনি এসে ততক্ষণে বলাও শুরু করে দিয়েছেন। অগত্যা বুঝতে বাকি রইল না এই কম্পিউটারগুলো শুধুই আমাদের সামনে দেখার জন্য। আমাদের কাজ শুধুই বসে বসে শোনা।
সেমিনারে যাওয়ার অভ্যেস আমার সেই বিশ্ববিদ্যালয় দিন থেকেই ছিল। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই অধিকাংশ সেমিনারে গিয়েই আমি এসির ঠাণ্ডা হাওয়ায় একদম শেষের চেয়ারে বসে ঘুমিয়েছি। হয় যিনি বলতেন তিনি পেপার দেখে পড়ে যেতেন টানা, নয়ত এত অঙ্গভঙ্গি করে কঠিন ইংরাজিতে বলে যেতেন যে কিছুই বুঝতাম না। আর কিছু না বুঝলে ক্লান্তিতে আমার ঘুম চলে আসে সেই স্কুল জীবন থেকে। আমাদের এক জীবন-বিজ্ঞানের স্যার নাকি সুরে সারা পিরিয়ড জুড়ে যে কী পড়িয়ে যেতেন ফার্স্ট বেঞ্চে বসেও আমি তা বুঝতে পারিনি কখনও। শেষমেশ লাস্ট বেঞ্চেই ফিরে এসেছিলাম। টিফিনের পরের পিরিয়ডে ঘুমটা ভালো আসত। এই ভদ্রলোকও অনেক কিছু বলে যেতে থাকলেন কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। বেশ কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করলাম। যে ইংরাজিটা উনি বলছেন সেটা আমার আয়ত্তের মধ্যেই। কিন্তু যে বিষয় নিয়ে বলছেন সেই বিষয় নিয়ে কেন বলছেন সেটা কিছুতেই উদ্ধার করতে পারলাম না। অগত্যা পিছনের বেঞ্চে বসে গুলতানি করা ছাড়া আমার আর কোনও কাজ রইল না। পরে বুঝেছিলাম আজ পর্যন্ত যেটুকু কাজ আমি শিখেছি সেটা শুধুমাত্র আমার নিজের দৌলতেই আর সিনিয়র কর্মীদের সৌজন্যেই। ঐ ট্রেনিং-এর কোন কীর্তি নেই এতে। কিন্তু ট্রেনিংটা দরকার ছিল শুধুমাত্র এই কারনেই যাতে সবার সঙ্গে সবার পরিচয় হয়।
দুপুরে আবার ডিমের ঝোল দিয়ে খেতে খেতে যাঁরা আমাদের দেখাশোনা করতে এসেছিলেন তাঁদের জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, আজকেও ডিম? তিনি সহাস্যে বললেন, রাতে বোধহয় চিকেন হবে। মাংসের কথা শুনলেই কেমন একটা পৈশাচিক আনন্দ হয় কেন জানি না। মনে হয় মাংস চিবিয়ে খাওয়ার সাথে সাথে সমস্ত দুঃখ, যন্ত্রণা, মনখারাপ ও ডিপ্রেসনকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলা যায় কিছুক্ষণের জন্য হলেও।
সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ট্রেনিংয়ের সময়। হোটেলের রুমে ফিরে ফ্রেশ হয়ে কিছু খেতে বেরিয়ে গেলাম। বিকেলের টিফিন দেওয়ার রেওয়াজ নেই এখানে। আশপাশ ঘুরে একটা সস্তার মোমোর দোকান থেকে খান পাঁচেক মোমো গিলে হোটেলে ফিরে এসে দেখি খান পঞ্চাশ লোক হোটেলের মধ্যে আমাদের ট্রেনিদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি দূর থেকে ওত পেতে থেকে কী হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুই আঁচ করতে পারলাম না। মনে মনে বললাম নির্ঘাত ওই বাচাল ছেলে-ছোকড়াগুলোর কাজ। আজ দুপুরের ক্যান্টিনেই ‘গৌড়ভঙ্গের মাল’ নিয়ে ওরা খুব উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল। নিশ্চয় বামাল সমেত ধরা পরেছে। এরা নিশ্চয়ই পুলিশের লোক। এবার যদি ধরে নিয়ে যায়? চাকরিটা থাকবে তো? দুপুরের খাওয়ার পরে সুখটান দেওয়ার সময় আমিও তো বলে এসেছিলাম রাতে রুমে গিয়ে ছিলিম ধরব। এবারে আমাকেও যদি ধরে নিয়ে যায়? এইসব প্যাঁচাল যখন মাথার মধ্যে দানা পাকাচ্ছে হঠাৎ খুব ধীর গলার শব্দ কানে এল। “ঐ তো আদিত্য, এই এদিকে আয়”— পার্থ দূর থেকে ডাকছে। আমি খুব ধীরে ধীরে সবার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর আগেই দেখলাম বাচাল ছোকড়াগুলো সব দিব্যি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। আমি ওদের দেখে একটু অবাকই হলাম। পুলিশি জেরাতেও এরা খুবই স্বাভাবিক ভাবে আছে। আমি হলে তো প্যান্টেই… সাধে কি আর বলে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের পোড় খাওয়া মাল পুরো। দেখলেই বোঝা যায়।
আমি সামনে যেতেই পাঁচজন আমার সামনে চলে এল। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার সামনে এত প্রশ্ন চলে এল যে কোনটার উত্তর দেব বুঝে উঠতে পারলাম না। “কী নাম তোমার? বাড়ি কোথায়? পোস্টিং কোন রিজিয়ন? কোন ব্রাঞ্চ? ম্যানেজার কে? কোথায় থাকো? এতক্ষণ কোথায় ছিলে?”
আমি কোন প্রশ্নের উত্তর দেব না বুঝে মাথা চুলকে বললাম, মোমো খাচ্ছিলাম।
“ও আচ্ছা খেতে গিয়েছিলে। কেন দুপুরের খাবার ঠিকঠাক ছিল না?”
“না আসলে খিদে পেয়ে গিয়েছিল।”
‘আচ্ছা’ বলে আমায় নিয়ে চেয়ারে বসাল। এরপর ধীরে ধীরে আমায় আবার পুনরায় আগের সমস্ত প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করল। আমি ধীরে ধীরে মাথা ঠাণ্ডা রেখে সমস্ত প্রশ্নের সঠিক জবাব দিলাম। মনে মনে ভাবতে লাগলাম এই পুলিশ কেসের কথা বাড়িতে যখন জানতে পারবে কতটাই না সম্মানহানি হবে। সেই কলেজ পড়ার সময় মানিব্যাগে সযত্নে রাখা কতগুলো গাঁজা গাছের বীজ পেয়েছিল বলে আমার মা ও বাবা দরজা বন্ধ করে সেকি কান্না। ওদের কান্না দেখে আমারও এমন কান্না পেয়ে গিয়েছিল যে আমি ওদের ধরে ঠাকুর ঘরে ঢুকে বাবা ভোলানাথের চরণ স্পর্শ করে বলেছিলাম, “আজ থেকে শিবঠাকুরের দিব্যি দিয়ে বলছি আর এসব রাখব না পকেটে কোনওদিন।” সেই থেকে আমি ওসব ছুঁই না। বন্ধুরা নিজেরা বানায়, আমায় শুধু পাস করে, আমি আবার ঘুরিয়ে পাস করে দিই। কিন্তু এখন কিছু না করেই যদি পুলিশ কেসে ধরা খাই সমাজে মুখ দেখাব কী করে? কিন্তু আমার এইসব ধারণা প্রায় ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে গেল এবং আমি আনন্দে চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে পরলাম যখন ওরা আমার শেষ উত্তরটা শুনে জবাব দিল। নাম, ধাম, কোন রিজিয়ন, কোন ব্রাঞ্চ ইত্যাদি প্রশ্নের পর আমায় যখন জিজ্ঞেস করল ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজার কে এবং আমি যখন ওনার নামটা বললাম ওরাও রিল্যাক্সে বলল, “ও উনি! উনি তো আমাদের লোক। তোমার কোনও অসুবিধেই হওয়ার কথা নয়।” আমি ভিরমি খেয়ে জিজ্ঞেস করলাম “আআআ… আপনাদের লোক মানে? আপনারা পু…” “আরে, আমাদের লোক মানে আমাদের ইউনিয়নের লোক।” এইবার আমার বুঝতে আর বাকি রইল না যে এরা কোন পুলিশ নয়। এরা ইউনিয়নের লোক। খুব ভালো করে যদি এদের মুখের দিকে দেখা যায় তাহলে বোঝা যায় এদের চোখ মুখের অভিব্যক্তি মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের সেইসব ক্লাব কর্তাদের মতন যারা ডুরাণ্ড খেলে বা সন্তোষ ট্রফি খেলে ফেরা সেরা প্লেয়ারদের ক্লাবে সই করাতে ছুটে যেতেন হাওড়া ষ্টেশনে। ট্রেন থেকে নামলেই গলায় মালা পরিয়ে সই করিয়ে নিতেন। এক্ষেত্রে যদিও আমাদের সই করত হল না। কিন্তু অনেক কিছু শুনতে জানতে এবং বুঝতে হল। এদিকে ইশারায় চলতে লাগল কখন রুমে পৌঁছাব সেইসবের হিসেব নিকেশ। এদিকে এরা তো ছাড়তেই চায় না। অগত্যা রাতের খাবার খাওয়ার বাহানা বানিয়ে সরে আসতে হল।
রাতে কখন রুমে ফিরেছি সে খেয়াল নেই কারণ খেয়াল থাকার মত হুঁশ ছিল না। পার্থ আমার মতো অত বাচাল ছেলে-ছোকরা নয়। ওর উঁচুতে ওঠার নেশা আছে, আর আমার নেশা করে ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে আছে। তাই ও অনেক আগেই রুমে ফিরে শুয়ে পড়েছিল। সকালে ঘুম ভাঙল দরজা ধাক্কানোর শব্দে। এমনভাবে কেউ ধাক্কা দিচ্ছে যেন এখনই খুব জরুরি দরকারে আমাদের ডাকতে এসেছে। আমি মনে করার চেষ্টা করলাম কাল রাতে আর কোনও ঝামেলা হয়েছিল কিনা? শুধু এইটুকু মনে পড়ল কেউ একজন ট্যাঙ্কের উপর উঠে আকাশ দেখার কথা বলেছিল। কিন্তু আমরা গিয়েছিলাম কিনা মনে করতে পারলাম না। পার্থ দরজা খুলতে উঠে গেল। আমি মোবাইলে দেখলাম সবে সাতটা দশ। দরজা খুলতেই একজন লম্বা টাকমাথা ভদ্রলোক হনহন করে ঘরে ঢুকে এসে আমার খাটে বসে পড়ল। আমি তখনও শুয়ে আছি। পার্থ ফিরে খাটে বসল। আমাকে ইশারা করে উঠতে বলল। আমি উঠে বসলাম। পার্থকে জিজ্ঞেস করল, “পার্থ, কেমন লাগছে ট্রেনিং?”
পার্থ আমতা আমতা করে বলল, “হ্যাঁ, ভালোই তো চলছে।”
— সব বুঝতে টুঝতে পারছো তো?
হ্যাঁ বুঝতে তো পারছিই। কিন্তু সবটাই থিয়োরি। আমাদের তো গিয়েই ক্যাশ কাউন্টারে বসতে হবে। তাই যদি সফটওয়্যার চালানোটা একটু শিখিয়ে দিত খুবই ভালো হতো আসলে।
সফটওয়্যার না… এদের প্রতিবারই একই সমস্যা সবটাই থিয়োরি বেসড। দেখছি আমি কী করতে পারি। জানো তো আমি কিন্তু জেআইআইবি, সিআইআইবি পাশ করা। তোমরাও বসে যাবে। আমি সব নোটস দিয়ে দেব তোমাদের। দু’বছর আগেই প্রমোশন পেয়ে যাবে পাশ করলে।
আমি এতক্ষণ সবটা ঘুম জড়ানো চোখে শুনছিলাম। কিন্তু এই ভদ্রলোককে ঠিক চিনতে পারলাম না। কাল রাতেও এনাকে দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না। অগত্যা প্রশ্ন করেই ফেললাম, “আপনাকে ঠিক চিনতে পার…” আমার বলা শেষ হওয়ার আগেই উনি জবাব দিলেন “আমি তো আজ সকালে এলাম। কাল রাতে আমি আসতে পারিনি। মালদা থেকে আসছি তো তাই। মালদা ব্রাঞ্চের ম্যানেজার আমি। তোমার ডেপুটি ম্যানেজার আমার ইউনিয়নের লোক।”
আমি মাথা নাড়লাম। আমি কিছু বলার আগেই উনি নিজেই বলে উঠলেন, “তোমরা বোধহয় আমাকে ঠিক চিনতে পারোনি, না? পার্থকে তো আমি তোমাদের জয়নিংয়ের দিনই ফোন করেছিলাম।” পার্থ সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল। আমার দিকে ঘুরে উনি বললেন, “তোমাকে তো ফোনেই পাইনি।” আমি কী বলব না বুঝে একটা ব্যাঁকা হাসি হাসলাম।
ওনার কথাবার্তা চলতে লাগল। ব্যাঙ্কের ম্যানেজমেন্ট কেমন, ওনার সাথে যোগাযোগ রাখলে কতটা সুবিধা হবে, ওনার কী কী অ্যাচিভমেন্ট আছে ইত্যাদি ইত্যদি। কিছুক্ষণ পর আমি বুঝতে পারলাম গতকাল রাতে যারা এসেছিল উনি তাদের দলের নয়। ওনার অন্য দল। উনিও আমাদের নিজের দলে টানবার উদ্দেশ্যেই যে এসেছেন সেটা ক্রমশ প্রকাশ হতে লাগল। এদিকে সময় ক্রমশ বয়ে যেতে লাগল আর আমাদের ট্রেনিংয়ে যাওয়ার সময় হয়ে এল। এদিকে স্নান খাওয়া কিছুই হয়নি। কিন্তু উনি ওঠার নামই নেন না। বারবার এটাই বলার চেষ্টা করে চললেন যে ওনার কত ভালো আর ওনাদের দলে থাকলে আমরা কী কী সুবিধা পাব। কিন্তু আমরা যে ওনার এই কথা আর শুনতে আগ্রহী নই সেটা উনি কিছুতেই বুঝতে পারলেন না। অগত্যা পার্থ বলেই বসল, “স্যার আমাদের তো ট্রেনিংয়ে যেতে হবে। দেরি হয়ে যাচ্ছে। আসলে স্নান খাওয়া কিছুই হয়নি তো।” ভাগ্যিস পার্থ বলল, নাহলে উনি ওঠার নাম গন্ধ কিছুই করছিলেন না। আমাদের পিঠে হাত দিয়ে আবার দেখা হবে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে উনি বিদায় নিলেন। আমরা যেন একটু হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
ট্রেনিংয়ে যাওয়ার পর থেকেই মন উচাটন। আজ বিকেলের ট্রেন যেভাবে হোক ধরতেই হবে। তাহলে রাতের মধ্যে বাড়ি পৌঁছে যাব নাহলে আজ রাতেও এখানে থাকতে হবে। আজ বাড়ি ফিরতে পারলে একটা দিন একটু বেশি থাকতে পারব। সপ্তাহ শেষ হলে তো আবার সেই ফিরে যেতে হবে, যেখান থেকে পুরোপুরি ফিরে আসার উপায় আমার এখনও হয়নি। বিকেলের ট্রেন পেয়ে গেলাম। রাতের মধ্যেই বাড়িও পৌঁছে গেলাম। কোনও অসুবিধে হয়নি।
কিন্তু এতদূর পর্যন্ত ধৈর্য্য ধরে পড়ে আপনি যদি ভাবেন মোরাল অফ দ্যা স্টোরি কী, তাহলে সরাসরি উপসংহারে চলে আসি। এরপর প্রায় একমাস কেটে যাওয়ার পর আমিও একটি দলের সদস্যপদ গ্রহণ করি এবং সেটা আমার রাজনৈতিক মতাদর্শের কথা মাথায় রেখেই। অন্য কোনও আলাদা সুবিধা পাওয়ার লোভে নয়। যদিও আজ পর্যন্ত কোনও সুবিধা নিতে হয়নি এখনও এবং সমস্ত দাবীর লড়াইতেই সম্মুখে থেকেছি বারবার। কিন্তু এটা মোরাল নয়। সেই টাক মাথা লম্বা করে সকালবেলা ঘরে ঢুকে পরা ভদ্রলোক এর বেশ কিছু মাস পর দেখি ওনার নিজের দল ছেড়ে আমাদের দলে যোগদান করলেন এবং ওনাকে খুবই সম্মান সমারোহ করে দলে নিয়ে আসা হল। কিন্তু এতেই উনি ক্ষান্ত রইলেন না। আরও কিছু মাস পর আমাদের দল ছেড়ে আবার একটি অন্য দলে যোগদান করলেন এবং শুধু যোগদান করেই ক্ষান্ত রইলেন না সেই দলের সভাপতির পদেও উপনীত হলেন। পুনশ্চঃ আমাদের দলে যখন এলেন তখন ওনাকে কিন্তু পদ দেওয়া হয়নি তৎক্ষণাৎ। হয়ত পরে দেওয়া হতো বা হতো না এসব দলের মাথারা জানেন। এখন আমরা যখন কৃষকদের আন্দোলনকে সাপোর্ট করে তাদের ডাকা বনধে নিজেদের মাইনে কাটিয়ে মোরাল সাপোর্ট জানাচ্ছি, উনি তখন সোশ্যাল সাইটে এই আন্দোলন কতটা কৃষকদের আর কতটা অ্যান্টিন্যাশনালদের সেই বিষয়ে জ্ঞান দিচ্ছেন।
(ক্রমশঃ)