মেদিনীপুর লোকাল। পর্ব ১০ । দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাস । লিখছেন আদিত্য ঢালী
একটা বসার ঘর দেখলাম খোলা আছে একতলায়। ঢুকে পড়লাম। সুইচ দিয়ে লাইট ফ্যানগুলো চালিয়ে ফ্যানের তলায় একটু জিরিয়ে নিতে বসলাম। মুশকিল হল গরম থেকে এসে সোজা ফ্যানের তলায় বসার সাথে সাথে চোখটা লেগে এল। ঘুমটা ভাঙল খচখচ আওয়াজে। চোখ মেলে দেখি একজন লোক জল ভরছে কল থেকে। আর কেমন সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আড়মোড়া ভেঙে উঠে জিজ্ঞেস করলাম “আচ্ছা ভোটের ডিউটি কোথায় কাটায় বলতে পারবেন?” তখনও আমার মাথায় চলছে যে এখনও বোধহয় সম্ভব ডিউটি থেকে নিস্তার মেলার। কারণ আমার কাছে তো মেডিক্যাল রিজন আছে। ভদ্রলোক কাঁচুমাচু করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল “আমি কিছু জানি না। রবীন্দ্র ভবনে যান ওখানে সবাই আছে”। রবীন্দ্র ভবন শুনে আমার টনক নড়ল আরে কাগজে তো লেখা ছিল ট্রেনিং সেন্টার ‘রবীন্দ্র ভবন’। বাইরে বেড়িয়ে এলাম। বিডিও অফিসের বাইরেটা বেশ নিস্তব্ধ এখন। রাস্তার দুইদিকে সার দিয়ে গাছ। ফলত ছায়া। গ্রীষ্মের এই প্রখর দাবদাহতেও বেশ ঠান্ডাই লাগছে এখানে। মিনিট খানেক দাঁড়ালাম। রাস্তা প্রায় ফাঁকাই। দূর থেকে এক ভদ্রমহিলাকে আসতে দেখলাম। কোথাও ঘুঁটে শুকাতে দিয়েছিল হয়ত সেগুলি নিয়েই ফিরছে। কাছে আসতে জিজ্ঞেস করলাম “আচ্ছা রবীন্দ্র ভবনটা কোন দিকে”? আঙুল দিয়ে দেখিয়ে ভদ্রমহিলা হনহন করে এগিয়ে চলে গেল। আমিও ওনার পিছু পিছু যেতে লাগলাম। এই গরমে এইটুকু হেঁটে আমি যখন হাঁসফাঁস করছি ভদ্রমহিলা খালি পায়ে এই পিচগলা রাস্তায় ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে এগিয়ে চলেছে। আসলে আমাদের যাদের নিজের পরিসর থেকে একটু বের হলেই খারাপ লাগার হিড়িক লেগে যায়, আমরা যারা অ্যাডজাস্ট বলতে শুধু বাসের সিট সহযাত্রীর সাথে শেয়ার করা বুঝি তাদের কাছে বিরামহীন এরম একজন গেঁয়ো ভদ্রমহিলাকে দেখে একটু অবাক লাগবেই। আমার অতটা লাগেনি। কারণ ততদিনে আমি একবছর কাটিয়ে দিয়েছে গ্রামে। গ্রামের সমাজ, আচার অনুষ্টান ইত্যাদির সাথে পরিচিত হয়েছি। কাজেই ভদ্রমহিলার উদাস চিত্তে শুধু হাত দিয়ে ঠিকানা দেখিয়ে দেওয়ায় আমি অবাক হইনি। কারন ততদিনে আমি জেনে গিয়েছি অভাবে উদাস থাকতে হয়। নাহলে লোভে পাপ আর পাপে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়।
রবীন্দ্র ভবন পৌঁছে দেখি কয়েকজন ততক্ষণে উপস্থিত হয়ে গিয়েছে। এদিকে আমি তো তখনও ধান্দা করে যাচ্ছি কীভাবে এই ডিউটি থেকে নিস্তার মিলতে পারে। ভিতরে ঢুকে গদিওলা চেয়ারে একটু আরাম করে বসলাম। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক দেখে পাশে বসা এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম “আচ্ছা বলছিলাম যে মেডিক্যাল গ্রাউন্ডে ডিউটি কাটাতে গেলে কী করতে হবে?” ভদ্রলোক আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল “কী হয়েছে?” আমি বললাম “নার্ভের সমস্যা। কোমর থেকে নীচ অবধি প্রচন্ড যন্ত্রণা হয় একটানা বসে থাকলে। আমার কাছে ডাক্তারের রিপোর্ট আছে”। ভদ্রলোক মুখে একটা সরল হাসি এনে মুখের অবয়বটা সারল্যে ভরিয়ে তুলে অত্যন্ত ধীরে সুস্থে বলল “তিন মাস আগে ব্যাঙ্গালোর থেকে বাইপাস সার্জারি করে এসেছি। দুসপ্তাহ হল স্কুলে জয়েন করেছি। আমাকে ছাড়ল না আপনাকে ছাড়বে বলে ভাবছেন?” আমি আর কথা বাড়ালাম না। বুঝে গেলাম নিয়তিতে কী আছে। এখনও আশায় থাকলে কষ্ট আমারই বাড়বে।
মিনিট পনেরো পরে অডিটোরিয়ামের ভিতরে নিয়ে যাওয়া হল সবাইকে। আমি বাদে আরও জনা দশের লোক এসেছে এই স্পেশাল ট্রেনিংএ। প্রজেক্টর লাগানোর কাজ চলছে। বাকি লোকজনের সাথে কথা বলে যা বুঝলাম আমার মত তারা কেউ শোকস খেয়ে আসেনি। নতুন করে আরও লোক লাগার জন্য তাদেরকে ডেকে নেওয়া হয়েছে। তাই তাদের জন্য স্পেশালই এই একদিনের ট্রেনিংএর ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেখানে আমাকেও ডেকে নেওয়া হয়েছে। ব্যালট বাক্সে ভোট হবে। প্রজেক্টরে কীভাবে ভোটগ্রহণ করা হবে তাঁর বিবরণ দেওয়া হল। যদিও যেভাবে প্রেজেন্ট করা হল তাতে কিছুই বোঝা গেল না গোটা প্রসেস্টা কেমন। শেষে শুধু প্রেজেন্টার বলে দিলেন আপনাদের চিন্তা নেই ডিসি আরসি তে লোক থাকবে কোনো অসুবিধে হলে ফোন করলেই সমাধান হয়ে যাবে। আমার সঙ্গে ট্রেনিংএ আসা বাকিরা বিভিন্ন অনর্থবহ প্রশ্ন করতে লাগলেন। যেমন ‘খামের আঠা যদি বাঁদিক দিয়ে না শুরু করে ডান দিকে লাগানো শুরু করি তাহলে কি প্রবলেম হবে?” বা “ব্যলট বক্স কী চাগিয়ে নিয়ে যেতে হবে নাকি লোক আসবে দিতে?”। অর্বাচিনদের প্রশ্ন শুনে আমি খানিক বিরক্ত হয়েই জিজ্ঞেস করলাম “আচ্ছা সিকিউরিটির কি ব্যবস্থা আছে?” নতুন লোকের মুখে প্রশ্ন শুনে সবাই আমার দিকে ঘুরে তাকাল। এমন ভাবে তাকাল যেন আমি যা জিজ্ঞেস করেছি তা জিজ্ঞেস করা অন্যায়। আমার সমবয়সি একটি লোকাল ছেলে ছিল। সেই সামনে এসে বলল “যখন সমস্ত কিছু ডিসি থেকে নেবেন তখন আপনাকে পুলিশিও ট্যাগ করাতে হবে। পুলিশ ট্যাগ করলা আপনার সাথে পুলিশও যাবে। চিন্তার কিছু নেই”। উত্তর শুনে আমি খানিক নিশ্চিন্ত হলাম। কিন্তু সে নিশ্চিন্তি যে পরে কত বড় চিন্তার কারন হয়ে দাঁড়াবে তা ক্রমশ প্রকাশ্য।
ট্রেনিং শেষে বাইরে বেড়িয়ে আসতেই গরম হল্কা বাতাস যেন ছিটকে এসে লাগল। তাপের প্রভাব এতটাই যে কয়েক মিনিটের মধ্যে বাথরুমে গিয়ে চোখ মুখ ধুয়ে নিতে হল। ছাতা নিয়ে গরমে ক্লান্ত শরীরটাকে হেলিয়ে হেলিয়ে কোনরকমে হেঁটে হেঁটে বাস স্ট্যান্ডে নিয়ে এলাম। জলের দোকান দেখতে পেয়ে যেন হাতে চাঁদ পেলাম। এক ঢোকে এক বোতল জলের অর্ধেক শেষ করে দিলাম। এদিকে বাসের পাত্তা নেই। বেলা দ্বিপ্রহর ছাড়িয়ে গেছে। সকালের খাবার হজম হয়ে নতুন করে আবার পেটে ছুঁচোয় ডন দেওয়া শুরু করেছে। এইসময় ভুলভাল খেয়ে খিদেটাকে মেরে ফেলার কোনো কারণ আমি দেখছি না। ঠিক করলাম এই সময়ের একমাত্র খাবার হল ভাত। কিন্তু এখানে কোথায় পাব? ঠিক করলাম যা হবে ষ্টেশনে গিয়ে হবে। ওখানেই যা পাব খাব। আশা করি অত বড় ষ্টেশনে অন্তত রেলের খাবার দোকান হবে। কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পর বাস এল। কিন্তু একি? এ যে এই গরমের দুপুরেও ভিড়ের থেকে নিস্তার নেই। উঠে পড়লাম। বেশ কিছুটা পথ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়ার পর সিট পেলাম একদম পিছনের সারিতে। জানালার ধারে। গরম হাওয়া খেতে খেতে ষ্টেশনের উদ্দ্যেশ্যে চললাম। ক্লান্তিতে কখন যে চোখ লেগে এসেছিল মনেই ছিল না। কন্ডাকটরের চিৎকারে ঘুম ভাঙল। বাস ততক্ষণে খড়গপুর টাউনে ঢুকে গেছে। উষ্ণ আবাহাওয়া, রাস্তা জুড়ে লাল মাটির ধুলো, শ্যাম বর্ণের মানুষ, রাস্তার মোড়ে মোড়ে ছাতুর দোকানের স্টল, কাঁধে সবার অলচিকি কাজ করা গামছা, প্রয়োজনে সেই গামছা দিয়ে মুখ মুছে নেওয়া এসবই আমাদের শহর কলকাতা থেকে এই রাঢ় বাংলার শহরকে আলাদা করেছে। এখানকার কালার টেম্পারেচারও আমার শহর থেকে অনেক বেশি ওয়ার্ম। ছবি জুড়ে শুধুই হলুদের প্রভাব। আকাশের কোনো কোণাতেই মেঘের লেশ মাত্র নেই। ঘামে ভিজে যাওয়া জামার আরও একটা বোতাম খুলে দিয়ে বাস থেকে নেমে পড়লাম। এখান থেকে পাঁচশ মিটার হেঁটে ষ্টেশন। টিকিট কেটে ষ্টেশনে ঢুঁকে একটা কুলিকে জিজ্ঞেস করলাম “হাওড়া যাওয়ার ট্রেন কোন প্ল্যাটফর্মে দেবে?” হিন্দিতে উত্তর এল “কোনসা ট্রেন? এক্সপ্রেস ইয়া প্যাসেঞ্জার?” আমার হিন্দি খুবই খারাপ। ছোটবেলা থেকে হিন্দি সিনেমা ও সিরিয়াল দেখে দেখে হিন্দি বোঝাটা আয়ত্তে এনেছি ঠিকই। কিন্ত বলাটা নৈব নৈব চ। বেনারস থেকে ফেরার সময় পিঠের ব্যাগ, মায়ের ঠাকুরের জামাকাপড়ের ব্যাগ, পাড়ার সকলের জন্য নিয়ে যাওয়া রাবড়ির হাঁড়ি ও ট্রলি টানতে টানতে একদিকে হেলে সেবার এক কুলিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম “হাওড়াকা ট্রেন কোন দিককা প্ল্যাটফর্মমে আসেগা?” কুলি এটা শুনে এমন খেঁকিয়ে উঠে তাড়িয়ে দিয়েছিল যে তারপর থেকে একটা ফোবিয়া চলে এসেছে। হিন্দি বলতে গেলেই বুকটা দুরুদুরু কেঁপে ওঠে প্রতিবার। বলার আগে মনে মনে প্র্যাকটিস করে নিই তারপর বলি। প্রয়োজনে গুগলেরও সাহায্য নিই। কিন্তু এ যাত্রায় আর কোনো রিস্ক নিলাম না। উত্তরে বললাম “লোকাল ট্রেন”। প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকিয়ে কুলি ভদ্রলোক বলল “ও তো একঘন্টা বাদ মে হ্যাঁয়। তিন নাম্বার মে আয়েগা। আভি বহুত ওয়াক্ত বাকি হ্যাঁয়”। আমি হেসে ওনার থেকে বিদায় নিলাম। তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে নেমে এসে খাবারের দোকান খুঁজতে লাগলাম। পেয়েও গেলাম। ভিতরে গিয়ে দাম দেখে তো চক্ষু চড়ক গাছ। এত দাম! কিন্তু খিদের সময় উপায় তো নেই। ঐ যে শুরুতেই বললাম অভাব না দেখা মানুষেরা অ্যাডজাস্ট বলতে শুধু ট্রেনে বাসে সহযাত্রীর সাথে সিট শেয়ার করাই বোঝে। পকেট থেকে দু-পয়সা বেশি খসবে ভেবেও খাবারের অর্ডার দিয়ে দিলাম। শুধু দুপিস মাংস, ঝোল আর ভাত। খেয়ে তৃপ্তি এল। এরম তৃপ্তির পর ফ্যানের তলায় বসে এক গ্লাস কোলড্রিঙ্কস নিয়ে বান্ধবীকে ফোন করতে হয়। কারণ এখনই প্রেম আসবে। তৃপ্তি না থাকলে শুধুই খিটখিট লেগে থাকে। দুদন্ড প্রেমের কথা বলে কতটা পরিশ্রম করে আমি ট্রেনিং করে এলাম সেই গল্প করতে করতেই ট্রেন আসার ঘোষণা হয়ে গেল। খেয়ে তৃপ্তি পাওয়ার পর যেমন প্রেম করতে হয় তেমনই প্রেমে তৃপ্তি আসার পর ঘুমাতে হয়। এই ভরা গরমে জানালার হাওয়া খেতে খেতে দুঘন্টার পথ পারি দেওয়ার সময় একমাত্র কাজ হতে পারে ঘুমানো। ট্রেনে চেপেই জানালার ধার খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু একি! গোটা ট্রেনেই তো ফাঁকা। শুয়ে শুয়ে যাওয়া যাবে। ব্যাগটা জনালার ধারে দিয়ে যেই শরীরটা সিটে ঠেকিয়েছি অমনি তড়াক করে উঠে পড়লাম। সিটে রোদে পুড়ে তেতে গেছে এতই যে শরীর ঠেকানো মাত্রই আমার মনে হল আমার চামড়াও বুঝি পুড়ে গেল। কিন্তু এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম। পুড়ে যায়নি কিছুই। কিন্তু শুতে আর পারলাম না। দুপা মেলে ব্যাগটাকে উপরের বাঙ্কারে উঠিয়ে দিয়ে চোখ বুজলাম। অল্প সময়ের মধ্যেই ট্রেনের দুলকি জার্নিতে ঘুম এসে গেল। ঘুম ভাঙল মেসেজ আসার শব্দে। মোবাইল বের করে মেসেজ খুলে দেখলাম তাতে লেখা আছে “ইউ আর সাকসেসফুলই কমপ্লিটেড ইউর ইলেকশন ট্রেনিং। রিগার্ড ইলেকশন কমিশন অফ ইন্ডিয়া”। চোখ জুড়িয়ে এল। ঘুমিয়ে পড়লাম আবার। ট্রেন তপ্ত হল্কা বাতাস ঠেলে এগিয়ে চলল।
(ক্রমশ)