অক্ষর-চরিত্র ও জ্ঞাপন-বাণিজ্য : এক অন্তহীন এপিটাফ। পর্ব ৪। অনন্ত জানা

0

(গত পর্বের পর)

দ্বিতীয় যাত্রা

হাটতলা পেরিয়ে খানিক এগিয়ে তেঁতুলতলা মোড়ে গোপাল বাড়ুজ্যের শালার বাড়িতে একটা ঘর নিয়ে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হলো। সুধাময় আর তাঁর নবলব্ধ বন্ধুরাই চৌকি-বিছানা, মশারি-বালিশ, লেপ-কাঁথা প্রয়োজনীয় চায়ের সরঞ্জামের ইন্তেজাম করে ফেললেন। দোকানের ফাঁকে ফাঁকে সুধাময় তাঁকে সদরে নিয়ে গিয়ে রং-তুলি ইতি-ইত্যাদি কিনে দিল। আড্ডাড়ুদের মধ্যে কাঠমিস্ত্রি ছিল বাদল মুন্সি। সে-ও সাইন বোর্ড নির্মাণে তাঁর সঙ্গে লেগে গেল। সদর থেকে এক-টুকরো ভালো ও মোটা টিন এনে গোপাল বাড়ুজ্যের বাড়ির পুরোনো কাঠ থেকে বাটাম বের করে তাই দিয়ে বাঁধিয়ে সাইনবোর্ড তৈরি হয়ে গেল।

বাড়ির পেছনে একটু বাগান মতো। একটা বাতাবি, দুটো আম, নাতি-উচ্চ একটা কাঁঠালসহ কয়েকটা এলোমেলো গাছ নিয়ে বাগানের কয়েক শতক পরিধি। সেখানে সকাল থেকে সারাদিন যুগপৎ ছায়া আর আলোর খেলা। সেখানেই  সাইনবোর্ড লেখার অস্থায়ী কর্মশালা খোলা হলো।

কয়েকদিনের শ্রমে সুমন বোর্ডে  হালকা ক্রিম কালার লাগিয়ে ডার্ক-ট্যান রঙে পুরোনো প্রাচীন পঁুথির ঈষৎ কল্পিত হরফে লিখে ফেললেন ‘রাধাকৃষ্ণ টেলার্স’। তার তলায় বিদ্যাসাগরীয় ফেস-ফন্টে টেলার অ্যাণ্ড আউট ফিটার্স। তার তলায় প্রোঃ গোপাল বন্দ্যোপাধ্যায়। ডার্ক-ট্যানের এক-একটি শেডে এক-একটি লাইন। সঙ্গে ডানদিকের কোণায় শ্রীকৃষ্ণের শিখিপুচ্ছ আর রাধার নূপুরের প্রতীকী সাইন!

লেখা শেষ হবার পর সুমন দিন-দুই দূর থেকে, কাছ থেকে, ডান দিক থেকে বাঁ-দিক থেকে নানাভাবে বোর্ডটাকে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন। ইচ্ছা হলো—একটা নিজন লতাকুঞ্জ এঁকে তার মধ্যে নূপুর আর শিখিপুচ্ছের সংকেতমূর্তিটিকে স্থাপন করেন। তুলিতে রঙ নিয়েও সেটা করতে সাহস হলো না। সতর্ক হলেন—টিনের সাইনবোর্ড তো আর ছবির ক্যানভাস নয়! আমজনতা বা বাণিজ্য ও বাণিজ্যোপভোক্তারা অত শিল্প-ইশারা বুঝবেন বলে মনে হয় না।

বোর্ড লেখা হয়ে গেছে, অথচ তা টাঙানো হচ্ছে না শুনে দু-দিন পর গোপাল বাড়ুজ্যে শালার বাড়ি এলেন ব্যাপারখানা দেখতে।

সাইনবোর্ডটা দেখে তিনি একেবারে লাফিয়ে উঠলেন। সুমনকে বললেন—‘এ তো খাসা হইছে!’ তারপর বাদল মুন্সির দিকে ফিরে বললেন—‘ওরে বাদলা, আজকেই এটারে টাঙানোর ব্যবস্থা কর। আমার দোকানের নাম তো এবার ফেটে যাবে রে!’

দু-দিনের মধ্যেই খোকন শেখ লোহার কড়া আর ক্লিপ টিপ দিয়ে দোকানের বাইরে শিরোদেশে দেওয়ালে টাঙিয়ে দিল সেই বোর্ড।

গোটা গঞ্জে সত্যিই ‘রাধাকৃষ্ণ টেলার্স’-এর নাম একেবারে ফেটে গেল।

প্রথমে গোপাল বাড়ুজ্যে আর গোপাল বন্দ্যোপাধ্যায়―নাম নিয়ে একটু খটমট বেঁধেছিল, পরে সেটা জলের মতো হয়ে গেল সাইনবোর্ডে রাধাকৃষ্ণ টেলার্স আর গোপাল বাড়ুজ্যের দোকান দুটোই থাকল। তার সঙ্গে শিখিপুচ্ছ আর নূপুর একবারে হিট করে গেল।

রেলবাজারের ব্যাপারি থেকে শুরু করে গঞ্জের দোকানদারেরা ঘুরে-ফিরে সাইনবোর্ড দেখে গেল, স্থানীয় মানুষও সাইনবোর্ডওয়ালা দর্জির দোকান দেখে অবাক !

এই কাজের জন্য গোপাল বাড়ুজ্যে সুমনকে দিলেন সাজ-সরঞ্জামের দাম ছাড়াও দুশো টাকা নগদ দক্ষিণা। বছর-চৌদ্দ আগে―সে-সময় ও তাঁর অবস্থার বিচারে দুশো টাকা বড়ো কম ছিল না। তিনি নিতে চাননি, কিন্তু গোপাল বাড়ুজ্যে ছাড়েননি।

 

(ক্রমশ)

………………………………………

(রচনার সঙ্গের ডিজাইনগুলি শিল্পীর দ্বারা অঙ্কিত বা পুনরঙ্কিত, আন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত ও সম্পাদিত এবং বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে গৃহীত। রচনার শেষে একটি বিস্তারিত সূত্র পরিচয়ে তা উল্লেখিত হবে)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *