খড়কুটোর জীবন : পড়াপড়া খেলা। পর্ব ২৬। লিখছেন সুপ্রিয় ঘোষ

0

জীবনে প্রথম যে বই দুটো প্রথম পেয়েছিলাম তা হলো গোলাপি মলাটের বর্ণপরিচয় আর ধারাপাত। একটাতে অ, আ আর একটাতে একে চন্দ্র, দুয়ে পক্ষ ইত্যাদি। একদিন সেজো কাকা বনমালী ঘোষের মুদিখানা দেকান থেকে বই দুটো কিনে দিয়ে আমাকে দিয়ে এলো লক্ষীদিদিমণির অঙ্গনওয়ারী স্কুলে। তো সেই বই দুটো বাড়ি নিয়ে এসে তার ভিতরের ছবিগুলি দেখে দেখে পরিচিত জিনিসগুলির মিল খুঁজতাম । অজগর সাপের ছবি আমাকে অবাক করতো। আমার দেখা সাপেদের সঙ্গে তার বিশালত্বের পার্থক্য ছিলো। বন্ধুদের মধ্যে গল্প হতো অজগর সাপ নিয়ে। সে সাপ নাকি আস্ত মানুষ, গরু সব গিলে নিতে পারে। তার নিঃশ্বাসের বিষে বহুদূরের প্রাণীও মারা যায়। আম তো চেনা। বাঙালদের আমগাছে ঝুলতে দেখেছি। মাটির ঘরে ইঁদুর ছানার ভয় কাতার যাতায়াত দেখলেও ঈগল পাখি কখনো দেখা হয়নি। লম্বা গলাওয়ালা উট সম্পর্কে দাদারা বলতো উট হলো মরুভূমির জাহাজ। তো মরুভূমি কী? ছোট্ট মনের প্রশ্ন। দাদাদের বিজ্ঞ উত্তর সেখানে কোনো গাছপালা থাকেনা। আমাদের ময়রা পুকুর বা বীলের মতো কিছু নেই। জল পাওয়া যায়না বললেই চলে। বৃষ্টি হয়না। শুধু বালি আর বালি। তো সেই বালির উপর দিয়ে কোনো গাড়ি চলে না। একমাত্র উট তিনদিন জল না খেয়েও চলতে পারে। অবাক হতাম ঐ গোলাপি মলাটের মধ্যে এত জিজ্ঞাসা আর এত কৌতূহল লুকিয়ে আছে। এক্কাগাড়ি, ঐরাবত, ঔষধ, ওল, কাকাতুয়া, খরগোশ, গরু, চিতা, জাহাজ, টিয়াপাখি, ঠাকুমার শুকনো গাল, ডাব, তাল, দোয়াত, নৌকা, প্রজাপতি, বক, ভালুক, ময়ূর, সিংহ, হনুমান — প্রভৃতি আমার মধ্যে চেনা- অচেনা এক জগতের বিস্ময়-বিহ্বলতা সৃষ্টি করতো। মগ্ন হয়ে থাকতাম পুকুর পাড়ের গাছের ডালে বসে থাকা মাছরাঙার মতো। নিবিষ্ট। আকাশের রামধনু যেমন মনের মধ্যে রঙ ছড়িয়ে দিতো বা নানান ছবি আঁকতো প্রথম পাঠের সেই গোলাপি রহস্য একইরকম করত।

ধারাপাত পড়তে গিয়ে একে চন্দ্রের চাঁদ মামাকে চিনতাম। কেননা সে ছোটো থেকেই আমার কপালে টিপ পড়িয়ে দিত। পক্ষ , নেত্র, বেদ, পঞ্চবাণ, সামুদ্র, গ্রহ, দিক এসব আমার অজানা ছিলো। আটে অষ্ট বসুর নাম বিজ্ঞ দাদা -দিদি দের জিজ্ঞাসা করেও জানতে পারিনি। পরে জেনেছিলাম এরা হলেন সোম, ধ্রুব, অহ, অনিল, অনল ,প্রত্যুষ ,প্রভাস এবং ভীষ্ম। তিনে নেত্রের দুই নেত্র খুঁজে পেলেও আর এক নেত্র খুঁজদাম দেব-দেবীদের কপালের মতো নিজের কপালে। পেতাম না। ঠাকুমা বলেছিলেন – ‘ পাগলা, ওটা জ্ঞান চক্ষু। জ্ঞান অর্জন করলে খুঁজে পাবি। ‘সে যায়হোক সাতে সমুদ্রের ক্ষীর সাগর, মধু সাগর পেরিয়ে যে বইগুলি পেয়েছিলাম তা হলো ‘সহজ পাঠ ‘ আর ‘কিশলয়’। রবিঠাকুরের সহজ পাঠের জাহাজে চেপে যখন একটু উঁচু ক্লাসে উঠলাম তখন পড়তে শুরু করলাম নানান আউট বই। গ্রামে কোনো পাঠাগার ছিলোনা। আমাদের আলফা নিম্ন বুনিয়াদি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অফিস ঘরে ছিলো দুই আলমারি ভর্তি বই। রেণুকা দিদিমণি বা আমাদের হেডমাস্টার শিবেন বাবু মাঝে মাঝে হাতে তুলে দিতেন নানান বই। তখন যে বইগুলো পড়েছিলাম স্মৃতিতে আজো অমলিন। সুকুমার রায়ের ‘ আবোলতাবোল ‘ , ‘ হযবরল ‘ ‘ ঝালাপালা ‘, ‘পাগলাদাশু’ , ‘ খাই খাই ‘ তখন ভর করে থাকতো মগজে। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ‘টুনটুনির বই ‘ পড়েছিলাম তখনি। পড়েছিলাম তাঁর লেখা রামায়ণের সহজ কাহিনী ছেলেদের রামায়ণ। হাসিখুশি, ঠাকুরমার ঝুলি, হাসিরাশি, কত সব বই গ্রোগ্রাসে গিলতাম। পঞ্চম শ্রেণীতে যখন বড়ো আন্দুলিয়া হাইস্কুলে পৌঁছালাম তখন পরিচয় ঘটলো পড়াশুনার এক বিশাল জগতের সঙ্গে। সত্যজিৎ -এর প্রোফেসর শঙ্কু এবং ফেলুদা, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদা, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবু , শরদিন্দুর ব্যোমকেশ এদের সঙ্গে পরিচয় ঘটলো। আমিও হয়ে উঠলাম নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদার এক শাগরেদ। ক্যাবলা, প্যালা , ঢাকাই বাঙাল হাবুলসেনেরা আমার বন্ধু হয়ে গেলো। আমিও মনে মনে তখন তাদের নানান অ্যাডভেঞ্চারের সঙ্গী। মুখে সবসময় বন্ধুদের বলে চলেছি – কান ছিঁড়ে কানপুরে পাঠিয়ে দেবো বা নাক কেটে নাসিকে। কখনো টেনিদার ভাষায় বলছি – ব্যাপারটা পুদুচ্চেরি হয়ে গেল বা ডি লা গ্র্যাণ্ডি মেফিস্টোফেলিস ইয়াক ইয়াক। বন্ধুদের মধ্যে এসব লব্জ বেশ জনপ্রিয় ছিলো। কখোনো দাদাদের পিছনে লেগে বলতাম – ছাড়ন দ্যান মণিদা , সব পোলাপান। মণি দাও মজা করে বলতেন – এসব পোলাপান দিয়া জলপান কইরা ফ্যেলাইমু। তারপর সবার অট্টহাসি।
এরপর কখন পড়ে ফেলেছি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের – বুড়ো আংলা , নালক, ভূতপতরীর দেশ। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের কঙ্কাবতী,  ফোকলা দিগম্বর, ডমরুচরিত, লুল্লু, য জাপানের উপকথা, পিঠে-পার্বনে চীনে ভূত,বিদ্যাধরীর অরুচি, মেঘের কোলে ঝিকিমিকি সীতা হাসে ফিকিফিকি ইত্যাদি বই পড়তে পড়তে এক আশ্চর্য অনুভূতির জগতে পৌঁছে যেতাম। বিশেষ করে ডমরু ধরের আজগুবি অবিশ্বাস্য সব গল্প আমাকেও করে তুলতো আজগুবি প্রবণ। ডমরু ধরের কুম্ভীর বিভ্রাট গল্পের কুমীরের বর্ণনার মতো আমি বন্ধুদের মধ্যে সার্কাসে দেখা হাতির বর্ণনা দিতাম। লুল্লু ভূতের বউ চুরির কাহিনী অবাক করতো। চণ্ডুর নেশায় মশগুল হয়ে লুল্লুর শাস্তি বেশ চমকপ্রদ মনে হতো। শিবরাম চক্রবর্তীর হর্ষবর্ধন আর গোবর্ধন – এর ননসেন্স কাণ্ডকারখানার মধ্যে পেতাম অনাবিল সারল্যের আনন্দ। কথার পিঠে কথা বসিয়ে শব্দ নিয়ে জাগলারি ইংরাজীতে যাকে বলে পানিং তা শিখেছিলাম মুক্তারামের তক্তারামে শুক্তারামে থাকা শিবরামের কাছে।
এরপর কিশলয় থেকে পর্ণে পরিণত হওয়ার পথে পড়া সেইসব বই বা সাহিত্যিকদের নাম বলবো যা খড়কুটোর জীবনের সঞ্চয়।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোরা,শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত, পথের দাবী, বিভূতিভূষণের চাঁদের পাহাড়, সুনীলের সেই সময়, মহাশ্বেতা দেবীর অরণ্যের অধিকার,মুজতবা আলীর শ্রেষ্ঠ রম্যরচনার মতো আরো অসংখ্য বই দাগ কেটে ছিলো মনে।  ঐ স্কুল দশাতেই পরিচয় ঘটেছিলো বনফুল,পরশুরাম ,সমরেশ বসু,শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়,ময়ূখ চৌধুরী, সুমথনাথ ঘোষ, সুধীর চক্রবর্তী, আবুল বাশার, জগদীশ গুপ্ত প্রমুখ লেখকের সঙ্গে।

বাড়ির দেওয়াল আলমারিতে ছিলো বেশকিছু বই। সেসব বই এর মধ্যে পেয়েছিলাম শেক্সপিয়ার এর কমেডি নাটকগুলির অনুবাদ
। আর বেশকিছু রাশিয়ান লেখক যেমন পুশকিন, গোগল, দস্তয়েভস্কি, চেখভ এদের কিছু সাহিত্যকর্মের পাঠগ্রহণের সুযোগ ঘটে। বাড়িতে আসতো শারদীয় গণশক্তি, সমন্বয়, দেশহিতৈষী । সমন্বয় এর পাতায় পরিচয় ঘটে গ্রেস অগোট, ইসমত চুঘতাই, সাদাত হাসান মাণ্টো , কর্তার সিং দুগগাল,অমৃতা প্রীতম, সফদর হাসমি,
আবু ইসাখ, বোরহান উদ্দিন, সেলিনা হোসেন প্রভৃতির সঙ্গে। বাড়ির সংগ্রহে পেয়েছিলাম কাফেলা নামক এক পত্রিকা। এসবের পাশাপাশি আমি গ্রামের মুদি দোকানগুলিতে জিনিসপত্র বিক্রির জন্য যে খবরের কাগজ নিয়ে আসা হতো সেগুলির মধ্য থেকে বেছে বেছে রবিবারের কাগজগুলো কিনে নিয়ে আসতাম। সমসাময়িক সাহিত্যের হালহকিকত জানার এটিও ছিলো আমার একটা উপায়।  পাঠ্য বইয়ের বাইরে আমার কিশোর বেলায় বইয়ের নেশা লেগেছিলো এভাবেই। এই নেশা যেন মৃত্যু পর্যন্ত বহমান থাকে। পৃথিবীটা যেন এই নেশা মুক্তির কেন্দ্রে পরিণত না হয়।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *