খড়কুটোর জীবন : বরযাত্রী। পর্ব ২৫। লিখছেন সুপ্রিয় ঘোষ
গত শতাব্দীর নয়ের দশকের শেষের দিক। তখন আমি সদ্য কিশোর। বাড়ির শাসন অগ্রাহ্য করার মানসিকতা গড়ে উঠছে মনের মধ্য। শরীরে- মনে এক নতুনের আগমন বার্তায় উদ্বেলিত হচ্ছি সর্বদা। জগতের যত রূপ-রঙ-গন্ধ-স্পর্শের জন্য আকুলিত অন্তর। রঙিন স্বপ্নেরা ভিড় করে আসে প্রতিনিয়ত। বসন্ত বাতাসে বন্ধুর বাড়ি থেকে ভেসে আসে ফুলের গন্ধ। উদ্দামতার ডানায় ভর করে সময়কে প্রদক্ষিণ করছি। সেই সময় গ্রামে কারোর বিবাহ হলে বাড়িতে বরযাত্রীর নিমন্ত্রণ এলে আমি বরযাত্রী যাওয়ার জন্য বায়না শুরু করতাম। আমাকে বাড়িতে বোঝানোর নানা চেষ্টা হতো। বরযাত্রী যাওয়া ভালো না। মা একটা গল্প বলতো। গল্পটি হলে এরকম – গ্রামের এক জেঠু , তার বিয়েতে বরযাত্রী গিয়েছিলো গ্রামের আরো সকলের সাথে মেজো কাকা। তো এক গোয়ালা গ্রামে তাদের বিবাহবাসর । বিবাহের অনুষ্ঠানে পণ নিয়ে হঠাৎ কন্যাপক্ষের সঙ্গে বিবাদ উপস্থিত হয়। কন্যাপক্ষের লোকজন লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে যায়। তাদের বক্তব্য – ‘ বিয়ে করে তবে পাত্র ছাদনা তলা থেকে উঠবে। না হলে লাঠি দিয়ে সবকটার মাথা ফাঁক করে দেবো। ‘ তো বর, বরকর্তা, বরযাত্রী সবাই বিমর্ষ মনে বসে রইলেন। মেনে নিতে বাধ্য হলেন কন্যাপক্ষের শর্ত। বিবাহ হয়ে গেলে গোল বাধলো পুনরায়। কেউ কন্যাপক্ষের বাড়িতে জলও স্পর্শ করবেনা।অথচ জলযোগের জন্য সারকেলে ধানের চিড়ে,দই, আঁখের গুড়, তেঁতুল, লবণ আর জল প্রস্তুত। বিচালি বিছিয়ে আসন পাতা হয়েছে। কলাপাতা পড়বে বরযাত্রীদের সামনে। কিন্তু কেউ বসতে রাজী নয়। তখন কন্যাপক্ষের লোকজন আবার হাতে তুলে নেন লাঠি। সবাই খেতে বসতে বাধ্য হলেন।এবং কন্যার পিতা তার লোকজনকে বলে দিলেন – ‘ শালাদের চিড়েতে ধান মিশিয়ে দাও। ধানসহ চিড়ে যে না খাবে তার মাথা ফাটিয়ে দাও। ‘ তো সেই ভয়ে বরযাত্রীর দল ধানসহ চিড়ে চর্বণ করতে করতে পিতৃদত্ত প্রাণটা রক্ষা করলেন। কয়েক জন আগে ভাগে পালিয়ে ছিলো। পরদিন বাসিভোজ খাওয়ার অপেক্ষায় না থেকে সকলেই গভীর রাত্রিতে বাড়ির পথে রওনা দেন। শুকসপ্ততির শুক পাখির মতো মা আমাকে বললো – ‘ যদি অমন বরযাত্রী হতে চাস তো যা। তোকে আটকাবো না’।
কিন্তু আর একটু বয়স বাড়তেই বেশ নিয়মিতই গ্রাম তুতো দাদা-কাকা বিভিন্ন সম্পর্কীয় বরের সহযাত্রী হয়েছি। সেসব বিবাহ অভিযান আমার কাছে বেশ রোমাঞ্চকর ছিলো। বাড়িতে বরযাত্রীর নিমন্ত্রণ এলেই সকাল থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করতাম। খোঁজ নিয়ে নিতাম বন্ধুদের মধ্যে কে কে যাচ্ছে। তারপর দুপুরবেলা পুকুর ঘাটে গিয়ে মাথায় শ্যাম্পু লাগিয়ে চুল ফুলিয়ে চলে আসতাম। ভালো জামা-প্যাণ্টগুলো বাক্স থেকে বার করতাম। দুর্গা পূজায় পাওয়া পোশাক পূজার পর মা বাক্সে তুলে রাখতো। সেটাই সারা বছরের বাইরে যাওয়ার পোশাক। তো কুচকে থাকা সেই পোশাক সমান করার জন্য আয়রন ইস্ত্রির অভাবে ঘটিতে গরম জল নিয়ে প্যান্ট বা জামার উপর ঘটি ডলতাম। সে এক দেখার মতো আয়োজন। সন্ধ্যা হতেই বরের বাড়ি থেকে ডাক আসতো – ‘ গাড়ি চলে এসেছে। তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে। অনেক দূরের পথ। তোমাদের বাড়ি থেকে যে যাবে সে যেন তাড়াতাড়ি চলে আসে। ‘ ঘর থেকে একথা শুনতেই প্যান্ট পরে তার মধ্যে জামা গুঁজে বেল্টের হুঁক লাগিয়ে জুতোর ফিতে বেঁধে চুল আঁচড়ে সটান উঠানে। ‘ মা, আসছি ‘ – বলে হাজির হতাম বরের বাড়িতে। তার আগে দেখে নিতাম বরের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ম্যাটাডর। গিয়ে দেখি বরকে ধুতি আর পাঞ্জাবী পরানো হচ্ছে। কেউ কপালে লাগিয়ে দিচ্ছে চন্দনের ফোঁটা। কেউ এগিয়ে দিচ্ছে গেরুয়া রঙের আঙুলকাটা মোজা আর কোলাপুরী চটি। রজনীগন্ধার সেণ্ট বরের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও লাগিয়ে নিতাম একটু।শোলার টোপর চাপানো হতো মাথায়।তারপর বরকে নিয়ে যাওয়া হতো উঠানের ছাদনা তলায়।বরণ করে তুলে দেওয়া হতো ম্যাটাডরের সামনের সিটে। কোলবরকেও বসিয়ে দেওয়া হতো তার পাশে। মেয়েরা দু-একজন জায়গা নিতো ম্যাটাডরের কেবিনে। আমরা মহাদেবের বিবাহ যাত্রার নন্দী-ভৃঙ্গী আর ভূত-প্রেতের দল উঠে পড়তাম ম্যাটাডরের ডালা বেয়ে। বিদায়ের ক্ষণে বর যেই তার মাকে বলতো – ‘ মা, তোমার জন্য দাসী আনতে যাচ্ছি। ‘ অমনি ড্রাইভার দিতেন গাড়িতে স্টার্ট। সমবেত মহিলাদের উলুধ্বনি আর কয়েকটি বুড়িমা চকলেট বোমার বিস্ফোরণে সূচিত হতো সে যাত্রা। বরকর্তা তার আগেই দেখে নিতেন বিবাহের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি গাড়িতে উঠেছে কিনা। বরযাত্রীদের সকলকে সাবধান করে দিতেন বরকর্তা – ‘ এই সকলে গিয়ে ভদ্র আচরণ করবে। কোনো নিন্দা যেন না হয়। ‘ সে যেন ভারতচন্দ্র কথিত ‘ শিব বিবাহ যাত্রার ‘ মতো। —
‘নিজগণ লয়ে বরযাত্র হয়ে
চলিলা যত অমর।
অপ্সরা নাচিছে কিন্নর গাইছে
পুলকিত মহেশ্বর।। ‘
তো ধুলো উড়িয়ে চললো ম্যাটাডর। পিচরাস্তা , মাটির রাস্তা, রাস্তার উপর ঝুঁকে পরা বাঁশঝাঁড় এড়িয়ে যখন কনে বাড়িতে পৌঁছালাম ততক্ষণে পোশাক-আশাক ধূলিধূসরিত হয়ে গৌরিক রঙ ধারণ করেছে। তো গাড়ি থেকে নেমে অনেক ঝাড়াঝুড়োর পর বন্ধুদের কারোর এক চিরুনি দিয়ে মাথা আঁচড়ে কনে বাড়ির দরজায় হাজিরা দেওয়া। কনে পক্ষের লোক বর দেখার জন্য হুড়োহুড়ি শুরু করেছে ততক্ষণ। তাদের মধ্যে কেউ আমাদের দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করলো – ‘ আয় ছাগল পাতা খাবি। ‘ এই চরম ব্যঙ্গোক্তিতে মনে পড়ে গেলো ম্যাটাডরে করে ছাগল নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য। যাক অতসব কথা ধরতে নেই বরযাত্রীদের। তাই বউ দেখবো বলে প্রথমেই হাজির হলাম বাড়ির অন্দর মহলে। একটা চার পায়ার উপর সখী সমাবৃতা হয়ে বসে আছে প্রাক পরিণীতা। সলজ্জ। নত মস্তক। আমাদের খচ্চর বন্ধুরা সবাই কাকীমা হলেও ‘বৌদি’ সম্বোধন করে নাম, বাবার নাম , পড়াশুনা ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করছিলো। তো কনের সখীরা সেসব প্রশ্নের নানান বাঁকা বাঁকা উত্তর দিতে শুরু করলো। জমে উঠলো রঙ্গ- রসিকতা।
তারপর ছাদনা তলায় নতুন কাঁথা বিছিয়ে যেখানে বরকে বসানো হয়েছে আমারা বসলাম তাকে ঘিড়ে । চলে এলো চা আর বিস্কুট। তারপর কাগজের প্লেটে রসগোল্লা, গজা, নিমকি আর বোঁদের টিফিন। টিফিন খেয়ে আমরা গ্রাম পরিক্রমায় বার হতাম। সেই গ্রামে কোনো পরিচিত আত্মীয় পরিজন থাকলে তার বাড়ি গিয়ে কুশল সংবাদ নিয়ে আসতাম। ফিরে এসে বসতাম খেতে । কলাপাতায় সাদা ভাত, লবণ, ভাজা, ডাল, চচ্চড়ি, মাছ, চাটনি, দই, মিষ্টি ভোজনান্তে চলতাম বিবাহ অনুষ্ঠানের কাছে। গিয়ে হয়তো দেখলাম সাতপাক, সিঁদুর দান, শুভ দৃষ্টি চলছে। সেসব দেখে কেটে যেত কতটা সময়। ঘুম চোখে বসে থাকা। কারোর বাড়িতে জায়গা পেলে ঘুমানো হতো। সেটা সব সময় জুটতো না। যেহেতু লোকের ধারণা বরযাত্রী তো নয়, বদযাত্রী । তো ভোর হতেই বর-কনেকে নিয়ে গ্রামে ফিরতো বরযাত্রীর দল। তারপর সারাদিন ঘুম আর ঘুম। তরুণের সে ঘুমের মধ্যে হয়তো প্রজাপতির মতো উড়তো সদ্য দেখা কোনো কিশোরী।
(ক্রমশ)