কাশীর অলি-গলি : ইতিহাস-সমাজ-সংস্কৃতি। পর্ব ৯। শোভন সরকার

0
গত পর্বে: ১৮০৯ সালের কাশী এক ভয়ংকর দাঙ্গার সাক্ষী হয়ে রইল। রক্তে রাঙ্গা হলে উঠল শহরের মাটি। চেনা মানুষও হয়ে উঠল অচেনা।

১৭৯৪ সাল। বেনারসের রাজনৈতিক ইতিহাসে তখন টালমাটাল অবস্থা চলছে। আনুষ্ঠানিকভাবে বেনারসের রাজনৈতিক ক্ষমতা রাজার হাত থেকে ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া কোম্পানির হাতে সদ্য হস্তান্তরিত হয়েছে। কিন্তু শহরের মানুষ এই বদল তখনও আন্তরিকভাবে মেনে নিতে পারেনি। ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের উপর রাজার প্রভাব কমতে শুরু করেছে। সেই সুযোগে শহরে মারাঠা এবং রাজপুতেরা ধীরে ধীরে নিজেদের শক্তি পুঞ্জীভূত করতে থাকে।  এরা ছিল বহু জমিজমার মালিক এবং দক্ষ যোদ্ধা। কাজেই রাজা দুর্বল হয়ে পড়তেই ক্ষমতার নেশা জাঁকিয়ে বসল এই দুই জাতির মধ্যে। কিন্তু এই পরিবর্তনের দামামা বাজার আগে বেনারসের রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি কেমন ছিল সেটা একবার দেখা যাক। স্থানীয় গোস্বামী সম্প্রদায় এবং মহাজন সম্প্রদায়ের মানুষদের সঙ্গে রাজার হৃদ্যতা ছিল। গোস্বামীরা ধর্মীয় ক্ষেত্রে জনমানসে বিপুল প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম ছিল স্বাভাবিকভাবেই — ধর্ম বরাবরই মানুষের দুর্বল জায়গা, তাই ধর্মকে কেন্দ্র করে বহু মানুষকে সম্মোহিত করার চেষ্টা নতুন নয়। তার সঙ্গে যোগ হল মহাজনদের অর্থনৈতিক প্রভাব। তাছাড়া রাজার নিজের অস্তিত্বের কিছু প্রভাব তো ছিলই। স্বাভাবিকভাবেই এই তিনের শক্তির বিরুদ্ধে মারাঠা-রাজপুতদের শক্তি অর্জন স্থানীয় রাজনীতিতে এক অস্থিরতা তৈরি করে। এরা ছাড়াও স্থানীয় তাঁতী ও ব্যবসায়ীদের গুরুত্ব বেনারসের মত শহরে অত্যধিক। শহরের বাণিজ্য, সংস্কৃতি ও শিল্পকলার উন্নতি ও বিকাশের ক্ষেত্রে রাজা পদগতভাবেই দায়বদ্ধ। তাই শহরের শান্তি ও সাম্য বজায় রাখার কর্তব্য অনেকাংশেই রাজার উপর বর্তায়। দুই ভিন্ন ধর্মের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও তাঁতী ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব না হতে দেওয়া শহরের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সচল রাখার জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এক্ষেত্রে তাই অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল রাজার নিরপেক্ষ অবস্থান। তিনিই ছিলেন শহরের শান্তি ও সাম্যের প্রতীক। ঠিক এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর, রাজার প্রভাব হ্রাস ইত্যাদি শহরের স্বাভাবিক ছন্দকে ব্যাহত করে। বিভিন্ন স্থানীয় গোষ্ঠীদের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব, দ্বেষ কেবল সময়ের অপেক্ষায় ছিল আগুন হয়ে ফেটে পড়ার।  

এমতাবস্থায় ১৮০৯ সালের দাঙ্গা সত্যিই কতটা ধর্মীয় কারণে উদ্ভূত তা প্রশ্নাতীত নয়। এই সম্প্রদায়গুলির মধ্যে ইতিমধ্যেই বারুদ-উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়েই ছিল। ধর্ম সেই বারুদে আগুন লাগিয়ে দেয়। ধর্ম তো চিরকালই নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হয়ে এসেছ — সেটা যে কোন খোলা মনের ইতিহাস-সচেতন মানুষমাত্রেই জানেন। ১৮০৯ সালের এই দাঙ্গায় স্থানীয় বিভিন্ন গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের মধ্যে ধর্মীয় বিভেদ তাই অবশ্যম্ভাবীভাবে নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শন, অন্য গোষ্ঠীর উপর নিজেদের ক্ষমতা বিস্তারের উপকরণ হয়ে উঠতে দেরি হয়না। বর্তমানকালেও যখন বহু মানুষ বিশ্বাস করে যে এই দাঙ্গা কেবল ধর্মভিত্তিক, তখন আমাদের ভারতবাসীদের নিজেদের চিরাচরিত ধর্মীয় সহনশীলতার পরিচয়ের উপর আমরা নিজেরাই প্রশ্ন তুলে বসি। তবে তার মানে এই নয় যে উল্লিখিতি দাঙ্গায় যে হিংস্রতা ও নাশকতা সেই রাতগুলিতে বেনারসের পুন্যতোয়া গঙ্গাকে রক্তাক্ত করে তুলেছিল, তা যথাযথ ছিল। অবশ্যই নয়। যে কোন মৃত্যুই, যে কোন হিংসাই মানবতাবাদের বিরুদ্ধে, এবং তা কোনমতেই গ্রহণযোগ্য নয়, ঘটনার পেছনে কারণ সে যাই থাকুক না কেন। 

বেনারসের ইতিহাসে এই দাঙ্গার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। ব্রিটিশ রাজ বেনারসের উপর নিজেদের ক্ষমতার দৃঢ়বন্ধনী আরও কঠিন করে তোলে। স্থানীয় পুলিশদের নিজেদের অধীনস্থ করে নেয়। আইনশৃঙ্খলার নিয়ন্ত্রণ কার্যত তাদের হাতেই চলে যায়। দাঙ্গার পর বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিনিধিস্থানীয় কিছু নির্বাচিত নেতাদের শাস্তি বিধান করা হয়। এই নেতাদের দমন করার মাধ্যমে কৌশলগতভাবে বিভিন্ন গোষ্ঠীদেরও নিজেদের নিয়ন্ত্রণের অধীনে আনার চেষ্টা করে তারা।   

তবে ব্রিটিশদের সেই কাজ সহজ হয়নি। তাদের বিভেদের রাজনীতি উপেক্ষা করে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ নিজেদের মধ্যে স্বাভাবিক আদানপ্রদান বজায় রাখতেই থাকল। ব্রিটিশ রাজের কাছে এই ঐক্য বিপজ্জনক ছিল। তখন তারা আরও কিছু নিয়ন্ত্রণবিধি লাগু করল — যেমন, প্রকাশ্য জনসমাগমে আইনের কড়াকড়ি, অতিরিক্ত বাসস্থান কর আরোপ ইত্যাদি। এর ফলাফল ভাল হল না। ১৮০৯ সালের দাঙ্গার চৌদ্দ মাসের মাথায় ১৮১০ সালে এবার বেনারসবাসী নিজেদের সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ভুলে সকলে একত্রিত হয়ে চটে উঠল খোদ ব্রিটিশ রাজের নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে। কিন্তু এবার কোনরকম হিংসা নয়, বরং অহিংস উপায়ে সমস্ত কাশীবাসী শুরু করল হরতাল — মূলতঃ অতিরিক্ত বাসস্থান কর আরোপ করা নিয়ে। সমস্ত বেনারস যেন থমকে দাঁড়াল। দোকানপাট থেকে শুরু করে শ্মশানের কাজ অব্দি স্থগিত রইল। নিজেরাই টাকা-পয়সা তুলে খাবার-দাবারের আয়োজন করতে থাকল অত্যন্ত সুগঠিত ও সুনিয়ন্ত্রিতভাবে। অবশেষে জনপ্রতিনিধিরূপে কাশীরাজের মধ্যস্থতায় ব্রিটিশ রাজ ও কাশীবাসীর পারস্পরিক সমঝোতা করা সম্ভব হয়। 

ব্রিটিশ রাজ যে সাম্প্রদায়িক বিভেদ তৈরি করে ভারতীয় উপনিবেশে তাদের নিয়ন্ত্রণ আরও দৃঢ়ভাবে স্থাপন করার জন্য বরাবর সচেষ্ট ছিল, তা আজ প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। কাশীর ক্ষেত্রে ব্রিটিশ রাজের নীতি তাদের স্বার্থের ঊর্ধ্বে কখনোই ছিল না। ২০০২ সালে ‘ইকনমিক ও পলিটিকাল উইকলি’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে গবেষক মার্জিয়া কাসোলরি বলছেন, ‘হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে যে ‘দ্বন্দ্বের প্রবণতা’ তুলে ধরা হয়েছে (দাঙ্গা নিয়ে বিভিন্ন ব্রিটিশ লেখকের লেখায়), তা ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যকেই সমর্থন করে। তাই বলাই যায়, সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে ঔপনিবেশিকতার যে চেহারা আমরা দেখি তা তাদের ‘ডিভাইড অ্যাণ্ড রুল’ পলিসি তথা ‘বিভেদীকরণ ও শাসন’ নীতিরই অংশ। ‘হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব স্বাভাবিক’ — এই প্রেক্ষিতে নিজেদের উপনিবেশে শান্তি বজায় রাখার অজুহাতে ধীরে ধীরে ব্রিটিশ রাজ নিজেদের শাসন কায়েম করে। কিন্তু এভাবে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে গিয়ে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ প্রশমিত করার বদলে তাকে বরং আরও উসকে দিয়েছিল। বলা যায় যে, তারা প্রকৃতপক্ষে সাম্প্রদায়িকতাকেই বৈধতা দিয়েছিল।’

সাম্প্রতিককালে যখন বেনারসে যাই, দেখি অনেক কিছু বদলে গেছে — চাকচিক্য বেড়েছে, রঙিন হয়েছে। নতুন নতুন ইমারত তৈরি হচ্ছে, রাস্তা খালি হচ্ছে, চওড়া হচ্ছে, তাকে জায়গা করে দিতে উঠে যাচ্ছে লঙ্কার সেই চাচীর কচৌরির দোকান, পেহলওয়ান লস্যির দোকান। সেখানে গিয়ে মনের ভেতরটা কেমন করে ওঠে। মনে হয়, যদি তারা চলে যাওয়ার আগে আরও একবার সেই রাস্তার ধারে পুরোনো তেলের টিনের উপর বসে কচৌরি-জিলাপি খেতে পারতাম, বা দুই-তিনটে পেহলওয়ানের মধ্যে কোনটা আসল সেটা যাচাই না করেই যে কোন একটায় ঢুকে গিয়ে চেখে নিতাম রাবড়ি-লস্যির স্বাদ, বেশ হত তবে। দেখি সুগম রাস্তায় লোকজনের ভিড় বেড়েছে, যান বেড়েছে, মান বেড়েছে, জৌলুষ বেড়েছে। এত কিছুর মাঝেও যখন মদনপুরার গলিতে হারিয়ে গিয়ে খুঁজে পাই তাঁতকলের শব্দ, দেখি বহু মানুষ যখন সেই তাঁতকল থেকে কোন এক জুলাহার তৈরি সূক্ষ্ম কাজের বেনারসি শাড়ি কিনে নিয়ে যায় নিজের বাড়ির মেয়ের বিয়ের জন্য, কোন এক ঘাট থেকে ফেরার পথে যখন দেখি দুই ভিন্ন ধর্মের ছোট দুই ছেলে কুকুরছানা নিয়ে খেলায় মজে রয়েছে, কিংবা সকালবেলায় শ্যামাচরণ লাহিড়ী মার্গের মুখের দোকানে চোখে পড়ে সাদা পাঞ্জাবী ও গেড়ুয়া কুর্তা পরা দুই মানুষ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কচৌরি জিলাপি খাচ্ছে, মনের মাঝে বিশ্বাস জেগে উঠতে চায় অনন্ত সমুদ্রের গভীরতা থেকে। সেই বিশ্বাস চিরাচরিত ‘বানারসিপন্‌’ বা বানারসীয়ানাতে, বহিরঙ্গে বদল এলেও হয়ত অন্তরে সেই একই রক্ত। রাজনীতি যখন মানুষের চেয়ে বড় হয়ে যায়, তার ফলাফলকে ইতিহাস কখনোই সুনজরে দেখেনি। লাট ভৈরবের ব্যাপারে জানতে গিয়ে এই প্রতীতি আরও দৃঢ় হয়।

(ক্রমশ)

পরবর্তী পর্ব

Disclaimer
The views and opinions expressed in this series are solely those of the author and do not represent the views, policies, or positions of any organisation, institution or society of any kind or the government. The content of this series is written in the author’s personal capacity and does not reflect any official information or stance.

Author

Leave a Reply