কাশীর অলি-গলি : ইতিহাস-সমাজ-সংস্কৃতি। পর্ব ৭। শোভন সরকার

0
গত পর্বে: দর্শন হল কাল ভৈরবের, দেখলাম মন্দির ও তার অভ্যন্তরের নানা খুঁটিনাটি। এরপর আমরা চলেছি বেনারসের অন্যতম এক গুরুত্বপূর্ণ ভৈরবের দর্শনে।

সেই যেবার কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দিতে কলকাতা যাচ্ছিলাম, সেবারই বোধ করি পথ আমাকে পেয়ে বসল। ‘পথের পাঁচালী’র অপু পথের দেবতার কাছে আকূল হয়ে প্রার্থনা করেছিল যেন তার নিশ্চিন্দিপুর যাওয়া হয়। সে আর হল কই? পথের দেবতা মুচকি হেসে সেই মূর্খ বালককে নিয়ে চলল দূর-দূরান্তে… ‘শুধুই সামনে… দেশ ছেড়ে বিদেশের দিকে, সূর্যোদয় ছেড়ে সূর্যাস্তের দিকে, জানার গণ্ডী এড়িয়ে অপরিচয়ের উদ্দেশে…।’ আমাকেও তেমনি আমার পথের দেবতা শিকড় উপড়ে তুলে নিয়ে এল, বের করে নিয়ে এল পথের মধ্যিখানে, বলল ‘এগিয়ে যাও।’ এই পথে পিছিয়ে যাওয়ার উপায় নেই, চোখ কেবলই সামনের দিকে। সেদিন চেনা-অচেনা লোকের অযথা কোলাহল থেকে বেরিয়ে চলছিলাম, বর্ষার ঘন কালো মুখ দেখতে দেখতে এগিয়ে চলছিলাম, কৈশোরের উচ্ছ্বলতা ছাড়িয়ে যৌবনের উদ্দামতায় বন্ধনহীন পানসির মত ভাসতে ভাসতে চলছিলাম, ঢেউয়ের তালে দুলতে দুলতে রাজঘাট ব্রিজ পেরিয়ে চলছিলাম। ঠিক তারপরে চোখ খুলতেই দেখি পথের দেবতা আমায় এনে ফেলেছে গঙ্গার ঘাটে। পুরোনো গণ্ডীর মানুষদের মজা করে বলেছিলাম, ‘কাশীবাসী হলাম।’ সেই যে শুরু, তার শেষ এখনও হয়নি, নিঃশ্বাসে মিশে গেছে হরিশ্চন্দ্র ঘাটের গন্ধ, মনে লেগে গিয়েছে কাশীর গ্রীষ্মের দুপুরের দহন-ব্যথা আর পূর্ণিমা রাতে ঘাটে বসে লেবু-চা খাওয়ার স্বাদ — সেই কাশীতে আজও আমার মানসবাস।  

ট্রেনে করে বেনারস যাওয়ার সময় আমার ট্রেন মুগলসরায় (বর্তমানে দীনদয়াল উপাধ্যায়) স্টেশন ছাড়িয়ে বারাণসী ক্যান্ট যাওয়ার পথ ধরে। ধীরে ধীরে চলে, অনেকটা সময় নিয়ে। তারপর একটা সময় সেই ট্রেন এসে পড়ে গঙ্গার উপরে, চলতে থাকে রাজঘাট ব্রিজ ধরে। এই ব্রিজটি ১৮৮০ সালের জুন মাসে তৈরি শুরু হয়ে সমাপ্ত হয় ১৮৮৭ সালের অক্টোবর মাসে। তখন অবশ্য এর নাম ছিল ডাফরিন ব্রিজ; তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড ডাফরিনই এই সেতু জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য খুলে দেন। স্বাধীনতার পরবর্তীতে পণ্ডিত মদন মোহন মালব্যের নামানুসারে এর নতুন নাম হয় মালবীয় সেতু ১৯৪৮ সালে। তবে এই সেতু রাজঘাটে অবস্থিত বলে লোকমুখে এর নাম হয়ে গিয়েছে রাজঘাট সেতু। এইটি যেন কাশীর একটা পরিচিতি চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর দু’টো অংশ, উপর দিয়ে চলেছে গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড , নিচ দিয়ে ট্রেনের পথ। এক অদ্ভুত অনুভূতি আমাকে ঘিরে ধরত প্রতিবার বাড়ি যাতায়াতের পথে যখন আমি এই সেতু পেরোতাম। ট্রেন গুরুগম্ভীর শব্দ করতে করতে এগিয়ে চলে। ট্রেনের কামরার সবার চোখ আটকে যায় জানালায়, আমরা সবাই মিলে চেয়ে থাকি সেই বিস্তৃত নদীর দিকে, বেনারসের দিকে। মনে আছে সত্যজিৎ রায়ের ‘অপরাজিত’ সিনেমার একেবারে শুরুর দৃশ্য? ঠিক যেন সেই দৃশ্যই খুঁজে পেতাম নিজের চোখের সামনে। সেই সময় কামরার ভেতরের কেউ বিড়বিড় করতে করতে মাথায় হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করে নিত, কেউ আবার খোলা জানালা দিয়ে পয়সা ছুঁড়ে দিত গঙ্গার জলে। 

আর্থার পার্কার এই স্থানের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখছেন, ‘ট্রেন যতই সুবিস্তৃত গঙ্গাবক্ষের উপর স্থিত  ব্রিজের দিকে এগোতে থাকে, ততই ধীরে ধীরে নদীর উত্তরের দিকের দালানবাড়িগুলো দৃশ্যমান হতে থাকে।  ক্রমেই সেই দালান, সেই শহর সমস্ত ঘাট জুড়ে রানীর মত বসে পড়ে গঙ্গার ধারে, ঠিক যেন নিজের সিংহাসন। ঝকঝকে নীল আকাশের প্রেক্ষাপটে সেই ঘাটের সমস্ত উঁচু উঁচু চূড়া ও মিনার যেন রানীর মাথার মুকুট। আর ঘাটে ঘাটে পাথরের থাককাটা সিঁড়ি ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে গঙ্গার জলে — এই মনোহারী দৃশ্য ভারতের সমস্ত সেরার অন্যতম।’ 

গঙ্গা পেরোতেই কাশী স্টেশন। 

চলুন, আজ আমরা এখানেই নেমে যাই। স্মৃতির পথ বেয়ে আপনাদের এতখানি নিয়ে এলাম। ইচ্ছে করছে আপনাদের এক বিশেষ জায়গা থেকে, কাশীর ইতিহাসের এক বিশেষ পাতা থেকে ঘুরিয়ে আনি। লোকের ভিড় থেকে দূরে লুকিয়ে থাকলেও কাশীর স্মৃতিতে এর গুরুত্ব এখনও এতটুকু কম হয়নি।

কাশী স্টেশনে নেমে সেখান থেকে বেরিয়ে গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরে জালালিপুরা ক্রসিং থেকে সামান্য এগোলেই আমাদের গন্তব্যে এসে পৌঁছানো যায়। দেখা যায় একটা চারপাশ বাঁধানো পুকুর, পুকুরের মাঝখানে ফোয়ারা, ঘাটে নামার ফটকের উপর দাঁড়িয়ে দু’টো কুকুরের মূর্তি। এই পুকুরটিই বর্তমানে ‘কপালমোচন তীর্থ’ নামে পরিচিত। অনেকেই একে আবার ‘লাট ভৈরবের তালাও’ বলেন। কিন্তু আমরা এখানে এসেছি এই পুকুরের জন্য নয়। এরই একপাশে উত্তরের দিকে কয়েক ধাপ সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলে একটা খোলা চাতাল পাওয়া যায়। চলুন সেখানে যাই। এই চাতালের একপ্রান্তে গাছপালার ছায়াতে এক ভাঙ্গাচোরা দেওয়াল ঘেরা একটা জায়গা। সেই ঘেরা জায়গার মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রায় সাত-আট ফুট লম্বা, এবং তিনফুট মত চওড়া এক স্তম্ভ। তবে সেটাকে শুধু ‘স্তম্ভ’ বললে দৃশ্যটা পরিষ্কার হয়না। সেটি জড়ানো রয়েছে রঙিন কাপড় দিয়ে, সাজানো রয়েছে ফুলের মালায়, পরানো রয়েছে এক রূপোলি মুখ। ইনিই হলেন কাশীর লাট ভৈরব। কাশীর ইতিহাসের এক ভয়ংকর দাঙ্গার সাক্ষী এই লাট ভৈরবকেই আমরা আজকে এখানে দেখতে এসেছি। এরই চারপাশ দিয়ে সেই ঘেরা জায়গার মধ্যেই দেখা যায় ছোট ছোট বেদী, এক জায়গায় কৃষ্ণবর্ণ এক দেবীমূর্তি, অন্যত্র এক গণেশের মূর্তি। কোথাও কোথাও ঝুলছে ঘন্টা। লোকজন খুবই কম, যারা আসছে তারা ঘন্টা বাজিয়ে ‘জয় বাবা লাটভৈরব’ বলে জয়ঘোষ করছে, চোখ বুঝে হাতজোড় করে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছে। কাছেই এক জায়গায় লাল রঙের ফলকে খোদাই করে হিন্দিতে লেখা: “শ্রী কপাল ভৈরব (লাট ভৈরব) মন্দির। শ্রী কপাল ভৈরব ভগবান ভৈরবের জটাধারী, ত্রিনয়ন, শান্ত, যুবারূপ। এঁর প্রতিমার গায়ের রঙ হলুদ। শ্রী কপাল ভৈরব ভগবান ভৈরবের বজ্রযুদ্ধধারী রূপ, এঁর হাতে রয়েছে খড়্গ এবং জলের কমণ্ডলু। ইনি ইন্দ্রাণী শক্তির স্বামী, গজের উপর আসীন।মনে করা হয় শ্রী কপাল ভৈরব নিজের উপাসকদের কার্যসিদ্ধি লাভের জন্য সাহায্য করেন। এঁকে উত্তর-পশ্চিম দিকের সংরক্ষক বলে মনে করা হয়।”  

পুরাণাদিতে লাট ভৈরব নামে কোন ভৈরবের অস্তিত্ব নেই, বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই স্তম্ভকে ‘কপালী ভৈরব’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিছু কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন কপালী ভৈরব ও লাট ভৈরব প্রকৃতপক্ষে আলাদা। পূর্বে কপালী ভৈরব কর্কোটীক বাপী বা নাগকূপের কাছেই বাসুকী কুণ্ডের এক কোণে অবস্থিত ছিল।পরবর্তীতে এই সকল কূপ ইত্যাদি ধ্বংস হলে কপালী ভৈরবের স্থানান্তরণ হয় এবং লাট ভৈরবের সাথেই পূজিত হন। কোন কোন পুরাণে এটি ‘মহাশ্মশান স্তম্ভ’ এবং ‘কুলস্তম্ভ’ বলে অভিহিত। ‘লাট’ শব্দটি ‘লাঠি’ বা ‘লগুড়’ শব্দের অপভ্রংশ। লাট ভৈরবকে দণ্ডপাণির মতই কালভৈরবের দণ্ড বা লাঠিস্বরূপ বলে মান্য করা হয়। তাই এর নাম হয়ে গেছে লাট ভৈরব। 

রিচার্ড ল্যানয়ের তোলা লাট ভৈরবের ছবি (রঙ আরোপিত)

মন্দিরে একের পর এক দর্শনার্থীরা এসে মন্দিরের ঘন্টা বাজাচ্ছে, ভেঙে পড়ছে আশেপাশের নির্জনতা। সেই ঘন্টার শব্দ হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে না যেতেই পাশ থেকেই ভেসে আসে আজানের সুর। আপনি চাতালে দাঁড়িয়ে একদিকে মাথা ঘোরালেই দেখতে পাবেন সাদা রঙের এক ঈদগাহ। দলে দলে মানুষ সাদা টুপিতে মাথা ঢেকে ওজু করে সেখানে এসেছে নামাজ পড়বে বলে। কাছেই রয়েছে মাজার, রঙিন কাপড়ের ঝালরে ঢাকা। ঈদ ও বিশেষ দিনে এই সমস্ত চত্ত্বর জুড়ে মানুষ বসে নামাজ পড়তে। বেনারসের বাইরে থেকে যারা আসে, তারা অনেকেই লাট ভৈরবের চত্ত্বরে দুই ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যে এই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চাক্ষুষ করতে চায়। কারণ, তাদের কাছে এই সহাবস্থান অভূতপূর্ব। তবে এখানে এই অভূতপূর্ব ব্যাপারটি আজকের নয়। দুই ধর্মাবলম্বী মানুষদের স্বাভাবিক ও মানবিক সহাবস্থান বহুদিনের চর্চার বিষয়। তবে জালালিপুরায় দাঁড়িয়ে গাছপালায় ঘেরা এই যে এলাকা বর্তমানে শান্ত, আপাত নিশ্চিন্তে বাস করছে, এর ইতিহাস এক সময় বড়োই অশান্ত হয়ে উঠেছিল, হয়ে উঠেছিল নির্মম, হিংস্র, রক্তাক্ত ও নিষ্ঠুর। 

এই ঘটনার ইতিহাসের জন্য বেশ কিছু সূত্র পাই। যথা — ১৮৪৮ সালে প্রকাশিত বেনারসে আসা মিশনারি রেভারেণ্ড উইলিয়াম বায়ার্স-এর ‘রিকালেকশন্স অফ নর্দান ইণ্ডিয়া, ১৮৬৮ সালে প্রকাশিত রেভারেণ্ড এম. এ. শেরিং-এর ‘সেক্রেড সিটি অফ দ্য হিন্দুস্‌’, ১৮৭৭ সালে প্রকাশিত ‘দ্য ক্যালকাটা রিভিউ, খণ্ড ৬৫’, ১৯৮২ সালে প্রকাশিত ডায়না ইকের বহুলোল্লিখিত বই ‘বানারস: দ্য সিটি অফ লাইট’, ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত সান্দ্রিয়া বি. ফ্রাইট্যাগ সম্পাদিত সংকলন ‘কালচার অ্যান্ড পাওয়ার ইন বানারস: কমিউনিটি, পারফরম্যান্স, অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট, ১৮০০-১৯৮০’ ইত্যাদি অন্যতম। এগুলোর পরেও বেশ কিছু লেখক/গবেষক এই নিয়ে লিখেছেন। সমস্যা হল এই সূত্রগুলোয় মূল ঘটনা বা ঘটনাক্রম এক থাকলেও বেশ কিছু ক্ষেত্রে এর পরস্পরবিরোধী বিবরণ পাওয়া যায়।* তাছাড়াও অধিকাংশ সমালোচকেরা এই ঘটনার উপর লেখাগুলোকে বিশেষ পক্ষপাতদুষ্ট বলে মনে করেছেন। তাঁদের মতে এই লেখাগুলোর বেশিরভাগই ঔপনিবেশিক ঐতিহাসিকদের একচোখা দৃষ্টিভঙ্গিরই নানাবিধ অনুরণনমাত্র। আপাতঃদৃষ্টিতে এই দাঙ্গা ‘হিন্দু’ ও ‘মুসলিম’-এর মধ্যে হলেও এর শিকড় আরও গভীরে ছিল।

(ক্রমশ)

* জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে তাঁর ‘দ্য কন্সট্রাকশন অফ কমিউনালিসম ইন কলোনিয়াল নর্থ ইণ্ডিয়া’ (১৯৯৯) বইতে কিছু সূত্রের তালিকা দিয়েছেন যাদের বর্ণনা বহুক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী। সেগুলো হল যথাক্রমে — এইচ আর নেভিল, বেনারস: এ গ্যাজেটিয়ার, খণ্ড ২৬, ডিস্ট্রিক্ট গ্যাজেটিয়ারস্‌ অফ ইউনাইটেড প্রভিন্সেস অফ আগ্রা অ্যান্ড ওউধ, লখনৌ, ১৯২৯ (১৯০৭ এ সংকলিত), পৃষ্ঠা ২০৭-২০৯; আর হেবার, ন্যারেটিভ অফ আ জার্নি থ্রু দ্য আপার প্রভিন্সেস অফ ইণ্ডিয়া, ফ্রম ক্যালকাটা টু বম্বে, ১৯২৪-২৫, খণ্ড ১, লণ্ডন, ১৮২৮, পৃষ্ঠা ৩২৩; জে প্রিন্সেপ, বেনারস ইলাস্ট্রেটেড, লণ্ডন, ১৯৩১, ১৯৩২, ১৯৩৪; জে মিল, এইচ এইচ উইলসন, দ্য হিস্ট্রি অফ ব্রিটিশ ইণ্ডিয়া, খণ্ড ৭, লণ্ডন, ১৯৫৮, পৃষ্ঠা ৩৩৫; ডাব্লিউ বায়ার্স, রিকালেকশন্স অফ নর্দার্ন ইণ্ডিয়া, লণ্ডন, ১৮৪৮, পৃষ্ঠা ২৭৩।  

পরবর্তী পর্ব

Disclaimer
The views and opinions expressed in this series are solely those of the author and do not represent the views, policies, or positions of any organisation, institution or society of any kind or the government. The content of this series is written in the author’s personal capacity and does not reflect any official information or stance.

Author

Leave a Reply