কাশীর অলি-গলি : ইতিহাস-সমাজ-সংস্কৃতি। পর্ব ৫। শোভন সরকার

0
গত পর্বে: এবার একদিন দেখতে গেলাম কালভৈরবের মন্দির। কত গলি ঘুরে ঘুরে এগোতে থাকলাম, দেখলাম লোকজন, জানলাম গল্প, অথচ মন্দিরের দেখা নেই। এসে পরলাম দণ্ডপাণির মন্দিরের সামনে। কে সেই দণ্ডপাণি?

গন্ধমাদন পর্বতে বসবাস করতেন যক্ষ পূর্ণভদ্র তাঁর স্ত্রী কনককুণ্ডলা। মহাদেবের আরাধনা করে তাঁরা হরিকেশ নামে এক পুত্রলাভ করেন। অল্প বয়স থেকেই হরিকেশ মহাদেবের ধ্যানে মগ্ন হয়ে থাকত, ভুলে যেত অন্য সব কিছু। পিতা পূর্ণভদ্র উপদেশ দিলেন আগে সংসার ধর্ম করতে, পরে সময় হলে এরকম উপাসনা করতে। হরিকেশ শুনল না। রেগে তিরস্কার করলেন পূর্ণভদ্র। ভয়ে-দুঃখে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল হরিকেশ। অনেক ভাবনার পর বারাণসীতে এসে মুক্তিলাভের আশায় কঠোর তপস্যা শুরু করে। এরপর একবার মহাদেব সস্ত্রীক তাঁর আনন্দকানন বিহারে আসেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, একটা সময় কাশীর বহুলাংশ অরণ্যময় ছিল। এই জন্যই কাশীর অন্য এক নাম ‘আনন্দবন’ বা ‘আনন্দকানন’। যাই হোক, কাননবিহারে এসে পার্বতী হরিকেশের এই অবস্থা দেখে মহাদেবকে বলেন তার কিছু একটা গতি করতে। মহাদেব হরিকেশের তপস্যা ভেঙে তাকে আদেশ করলেন যে সে-ই কাশীতে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করবে। সে হবে অপরাধীকে শাস্তির দণ্ড হাতে ‘দণ্ডপাণি’। তখন থেকেই হরিকেশ দণ্ডপাণিরুপে কাশীতে অবস্থান করে। তার দুই সঙ্গী হল সম্ভ্রম (বিভ্রান্তি) ও উদ্ভ্রম (সন্দেহ)। 

মৎস্যপুরাণেও দণ্ডপাণির প্রাথমিক জীবনের কাহিনি বলা আছে। তবে সেখানে কিছু ফারাক দেখা যায়। এখানে হরিকেশের পিতা কিন্তু শিবের অনুরাগী নয়, বরং হরিকেশের প্রতি তার ব্যবহার অনেকটা ধ্রুবের প্রতি হিরণ্যকশিপুর ব্যবহারের মতই। হরিকেশ অন্য যক্ষদের মত না হয়ে শিবের উপাসনা করছে সেটা পূর্ণভদ্রের সহ্য হত না। তাতেই হরিকেশ গৃহত্যাগ করতে বাধ্য হয়। উল্লেখযোগ্য এই যে, মৎস্যপুরাণ কাশীখণ্ডের থেকেও পুরোনো। 

বেনারসের দেবদেবীর সভায় নানা লোকদেবতা বা উপদেবতাদের প্রবেশের ইতিহাস বুঝতে গেলে দণ্ডপাণির কাহিনি আরও একটু গভীরে গিয়ে দেখা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আমি ডায়না ইক-এর ব্যাখ্যাই তুলে ধরছি। মৎস্যপুরাণের গল্পে যক্ষরা শিবের ভক্ত নয়, অর্থাৎ এইসব স্থানীয় লোকদেবতারা তখনও বহুল প্রচলিত শৈবধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয়নি, তারা স্বাধীন-স্বতন্ত্র। হরিকেশ বরং পরবর্তীতে নিজের সাধ্য-সাধনার দ্বারা শিব পূজার মূল ধারার মধ্যে নিজের জায়গা করে নেয়, সেই সঙ্গে বৃহত্তর সমাজেও। আবার কাশীখণ্ডে দেখি হরিকেশ শিবভক্ত পরিবারে বড় হচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু তারা বর্ণাশ্রমে বিশ্বাস করত। অর্থাৎ এ থেকে এই ধারণা করা যায় যে এখানে প্রচলিত ধারার শিব পূজা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন স্থানীয় উপদেবতা বা লোকদেবতাদের উপর নিজের প্রভাব বিস্তার শুরু করেছে। ধীরে ধীরে হয় শৈবধর্ম বা বৈষ্ণব ধর্ম এই উপ বা লোকদেবতাদের নিজেদের সঙ্গে আত্মস্থ করে নেয়। ঠিক যেমন দেখি হরিকেশের মত এক যক্ষ এখন দণ্ডপাণি রূপে শৈবধর্মের মানুষের কাছে এক অন্যতম আরাধ্য শিবগণ। এখানে যোগ করা প্রয়োজন যে, সব ক্ষেত্রে কিন্তু শৈব বা বৈষ্ণব ধর্ম নিজের প্রভাব খাটিয়ে স্থানীয় দেবদেবীকে আত্মস্থ করতে পারেনি। বেনারসেই এর উদাহরণ রয়েছে। যেমন লহুরা বীর, দৈত্রা বীর প্রভৃতি। মনে পড়ল আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগের কাছেই একেলা বাবার মন্দির। মন্দিরের সঙ্গে ফলকে নামের সঙ্গে লেখা রয়েছে ‘গ্রাম দেবতা’। উনিও কি এমনই কোন স্থানীয় দেবতা যিনি সবার ভিড়ে নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পেরেছেন? উত্তর পাইনি।   

দণ্ডপাণির মন্দিরে মূর্তির কেবল মুখটিই দেখা যায়, বাকি সমস্ত দেহ কাপড় ও ফুলের অলঙ্কারে ঢাকা। এই মন্দিরের ভেতরে বাঁ পাশে রয়েছে আরও একটি অদ্ভূত কূপ — কালকূপ। মন্দিরের পুরোহিত বললেন এই কূপের জলে কেউ যদি দুপুরবেলায় নিজের প্রতিচ্ছায়া দেখতে না পায়, তাহলে পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যেই সেই ব্যক্তির মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। 

সত্যি বলতে কি, একটু ভয়ই করল। তখন আমি কাশীতে নতুন, মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা কম, ভয়টা বেশি। কিন্তু পরবর্তীতে কাশীর রাস্তা-ঘাটে, অলিতে-গলিতে অহরহ দেখলাম শববাহীর দল হেঁটে চলেছে অনন্ত পথের যাত্রীকে কাঁধে করে, দেখলাম খাটিয়ার সঙ্গে প্রায় মিশে থাকা কিছু ফুল, কাপড়ের জটলা আর এক জোড়া পা। সেই শীর্ণ নিষ্প্রাণ পা-জোড়া দুলে চলেছে বাহকের চলার তালে তালে, এ পাশ আর ও পাশ, তারা এগিয়ে যেতেই পেছনে ছিটে ছিটে পড়ছে রাশি রাশি খই — সেই মৃতের শেষ পারানির কড়ি, কানে শুনতে পেলাম ‘রাম নাম সত্য হ্যায়’ — ধীরে ধীরে সময়ের সাথে আমার চোখ ও মন দুইই সয়ে গেল কাশীতে মৃত্যুর সরব, অমোঘ উপস্থিতিতে। বুঝলাম কাশীতে মৃত্যু উৎসবের, আনন্দের, অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি নয়, একেবারে ঘরের মানুষ। একবার কর্ণাটকের কোন এক গ্রামে চলার পথে দেখেছিলাম একদল মানুষ নানা রকম বাদ্য সহকারে এগিয়ে চলছে, সঙ্গে চলছে নাচ, ফাটছে বাজি। কাছে এগোতেই দেখলাম সেটা কোন বিয়ের বা রাজনৈতিক দলের বিজয়োৎসব নয়, বরং তারা এক মৃতদেহকে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে চলেছে দাহ করার উদ্দেশ্যে। আমার কাছে সেদিন সেটা এক ধরণের সাংস্কৃতিক অভিঘাত (cultural shock) তো ছিল বটেই, কিন্তু তারপর এই নিয়ে যখন একটু ঘাঁটাঘাঁটি করি জানতে পারি ভারতের নানা প্রান্তে প্রিয়জনের মৃত্যু শোকের নয়, বরং মুক্তির আনন্দে উদ্ভাসিত। কাশীতে এসেও কি তাই দেখলাম না? 

যাই হোক, কালকূপের কথায় ফিরি। পুরোহিত বললেন যে এই কূপে স্নান করে কালভৈরবের পুজো দিতে হয়। এতে স্নান করলে উদ্ধার হয় পিতৃগণ। কিছু মানুষকে দেখলাম আগ্রহী হতে। পুরোহিত দক্ষিণার বিনিময়ে তাদের গায়ে ছিটিয়ে দিলেন কালকূপের জল — প্রতীকি স্নান আর কি।   

কিন্তু এ কী, রাস্তা যেন আর শেষ হয়না। ঘন্টা দুই-তিন বোধহয় পেরিয়ে গেছে ততক্ষণে। একটা গলির মোড়ে পেরোতেই অন্য আরও গলির আবির্ভাব হয়। যেন শেষ নেই। কখন পৌঁছাব কালভৈরবের মন্দিরে? 

মন্দিরের সামনে পৌঁছাতে লেগে গেল আরও কিছুটা সময়। ভেতরে ঢোকার সামান্য আগে এক জায়গায় দেখলাম অনেক লোকজন নিজের জুতো-চপ্পল ইতি-উতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে খুলে রেখে মন্দিরের ভিতরে দর্শনে গিয়েছে। চুরি হওয়ার ভয় নেই নাকি এদের? নাকি বাঘের ঘরে (পড়ুন কালভৈরব) ঘোগেরা বাসা বাঁধতে ভয় পায়?

আমাদের চপ্পল এমন কিছু মহার্ঘ্য ছিল না। শেখর আর আমিও তাই নিজেদের চপ্পলজোড়া একপাশে খুলে রেখে দিলাম। মনে মনে এরকমই ভাবনা ছিল। ছোটবেলা থেকেই ট্রেইনিং দেওয়া হয়েছিল যে এরকম কোন বারোয়ারি জায়গায় যাওয়ার সময় নতুন নয় বরং পুরোনো চলনসই জুতো পরতে, যাতে হারিয়ে বা অদল-বদল হয়ে গেলেও দুঃখ না থাকে। একবার তো হলও তাই। স্লিপার ট্রেনে করে বেনারস থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। আমার উপরের বার্থ, সময় হতেই আমি আমার বহু ব্যবহৃত চপ্পলজোড়া নিচের বার্থের তলায় রেখে শুয়ে পড়লাম। নিচের বার্থে ছিলেন এক বয়স্ক মহিলা। মাঝরাতে একবার জেগে গেলে বুঝলাম ওই মহিলা কোন একটা স্টেশনে নেমে গেলেন। যাই হোক, ভোরবেলায় যখন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেব বলে নেমে এসে আমার চপ্পলজোড়া পরতে যাব, কেবল একখানা পাটিই পায়ে ঠেকল। ভেতরের দিকে ঢুকে গেছে বোধ হয় আর এক খানি। খুঁজলাম, সমস্ত সম্ভাব্য জায়গায়, তন্ন তন্ন করে, কিন্তু আমার চপ্পল জোড়ার অন্য পাটি কোথাও পেলামনা, পেলাম অন্য এক চপ্পল জোড়ার একটিমাত্র পাটি। এটা তো সেই বৃদ্ধার! অন্ধকারে তিনি নিশ্চয়ই আমার একপাটি নিজের ভেবে পায়ে গলিয়ে চলে গেছেন। কী আর করি, সেদিন বৃদ্ধার আশির্বাদ গ্রহণ করে এক পায়ে আমার, অন্য পায়ে ওই বৃদ্ধার ছোট সাইজের চপ্পলখানি পরে বাড়ি ফিরলাম। 

ওহো, আবার ধান ভানতে শিবের গীত গাইতে শুরু করলাম দেখছি। শিবের গীত ছেড়ে এবার কালভৈরবের মন্দিরে ফিরে যাই।

(ক্রমশ)

Disclaimer
The views and opinions expressed in this series are solely those of the author and do not represent the views, policies, or positions of any organisation, institution or society of any kind or the government. The content of this series is written in the author’s personal capacity and does not reflect any official information or stance.

Author

Leave a Reply