কাশীর অলি-গলি : ইতিহাস-সমাজ-সংস্কৃতি। পর্ব ৪। শোভন সরকার

0
গত পর্বে: আমরা বোঝার চেষ্টা করলাম কাশীর চিত্রচরিত্রে কালভৈরবের গুরুত্ব, মিথ ও সত্যের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া, জানলাম ভৈরবী যাতনার তত্ত্ব।

কালভৈরবের মন্দির বর্তমানে কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের কয়েক কিলোমিটারের মধ্যেই ঘাসি টোলার গোলঘর এলাকায় ভট-কি-গলিতে অবস্থিত। সরু সরু গলি এদিক ওদিক ঘুরে শেষে গিয়ে পড়ে কালভৈরব মন্দিরপ্রাঙ্গণে। অনেকে কালভৈরবকে আদর করে ভৈরোঁনাথ বলেন। তাই এটি ভৈরোঁনাথজি কে মন্দির নামেও বহুল পরিচিত। নাগরা শৈলীতে তৈরি বর্তমান এই মন্দিরটি পেশোয়া বাজিরাও এর প্রধান সেনাপতি সর্দার ভিঞ্চুরকার স্থাপন করেন। একবার তিনি কাশীতে নিরাপদে পৌঁছানোর জন্য মানত করেন। তাঁর ইচ্ছে পূরণ হলে ১৮২৫ সালে তিনি মন্দিরটি তৈরি করে নিজের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেন।   

বর্তমান এই মন্দিরটি তৈরির পূর্বে কালভৈরব কি তবে ছিলনা? ছিল, কিন্তু অন্যত্র। পাঠানি টোলায় ওঙ্কারেশ্বর মন্দিরের কাছে এর আদি অবস্থান। ত্রয়োদশ শতকের শুরুর দিকে কালভৈরবের স্থানান্তরণ হয় বর্তমান স্থানে। তবে পাকা মন্দির তখনও ছিল না, বরং ছিল ছোটখাট খড়ের ছাউনি দেওয়া একটা ঘর। নিতান্ত সাদামাটা। কুবের নাথ সুকুল তাঁর বইতে লিখছেন, “কোন মন্দির নেই, কোন আড়ম্বর নেই, কোন জাঁকজমক নেই। সবার নজরের আড়ালে থাকার কারণেই নানা সময়ে কাশীতে যে মূর্তিপূজাবিরোধী আক্রমণ হয়, তার থেকে এই মন্দির বা বিগ্রহ রক্ষা পায়।” সুকুল দাবি করেন যে কালভৈরবই হল একমাত্র ভৈরব যে কাশীর নিজস্ব। পরবর্তীকালে যখন কাশীতে শাক্ত উপাসনার উত্থান হয়, তখনই অন্যান্য অষ্টভৈরবের প্রতিষ্ঠা হয় কাশীর নানা স্থানে। 

মন্দিরে যাওয়ার পথ আমাদের অনেক ঘুরে ঘুরে নিয়ে গেল। সরু গলিপথ, পাণ্ডা, দোকানদার, পূজার উপকরণ-বিক্রেতাদের চিৎকার ও আহ্বান এড়ানো মুশকিল। রাস্তার এখানে ওখানে, মোড়ে দোকানে দোকানে সাজানো রয়েছে ভৈরবের মুখোশ, ফ্রেমে বাঁধানো ছবি, কালো সুতো ইত্যাদি। এরকম কোন এক দোকানের কাছাকাছি পৌঁছাতেই আপনাকে অত্যন্ত জোর দিয়ে বলা হবে যে ঠিক এই সীমার পরে জুতো-চপ্পল আর নিয়ে যাওয়া যাবে না। আপনি দেখতেও পাচ্ছেন যে নানা জায়গা থেকে, দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ভয় আর বিশ্বাস চেহারায় মেখে নিয়ে মন্দির চত্ত্বরের ভিতরে অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্ত বস্তুগুলোকে এইসব দোকানগুলিতে রেখে দিচ্ছে। আপনার মনেও দুশ্চিন্তা বা ভয় আসতে বাধ্য — যদি আপনাকে সামনে এগোতে না দেওয়া হয়, যদি আবার ফেরৎ আসতে হয়, আবার নতুন করে লাইনে দাঁড়াতে হয় বা প্রহরায় থাকা বাহিনীদের কাছ থেকে ধমক খেয়ে সবার সামনে লজ্জিত হতে হয়? ধরে নিলাম আপনি এই সমস্ত অগ্রাহ্য করে আরও একটু এগিয়ে গেলেন। তখনই চোখে পড়বে যে অনেক লোক তখনও নিজেদের জিনিস নিজেদের সাথে নিয়েই চলছে, জুতো-চপ্পলও। আমরা ছাত্র, সঙ্গে ‘সম্পত্তি’ নেই বিশেষ। রাস্তায় যাওয়া আসার জন্য যতটুকু দরকার, তার চেয়ে বেশি সঙ্গে রাখার ক্ষমতাও ছিল না। পুজো দেবার পরিকল্পনা আমরা সেবার করিনি, কেবল ভেতরে যাওয়া, দর্শন করা — এই ছিল আমাদের ইচ্ছে। শুরুতেই এত হাঙ্গামা অবশ্য মফস্বল থেকে আসা আমাদের পক্ষে সেই বয়সে অত্যন্ত উদ্বেগজনক। অনেকে যারা পুজো দিতে এসেছে তাদের হাতে রয়েছে নানা আকারের নানা উপকরণে ভরা ডালা, তাতে নানা ফুল-মালা, বিশেষ করে অপরাজিতা ফুল, সরষের তেলের প্যাকেট, প্রসাদ, কালো বা হলুদ রঙের ডোর ইত্যাদি। আশেপাশের দোকানে এইরকম অনেক সুতো হাতে বাঁধার জন্য রয়েছে, নানা রঙের। দেদার বিক্রি হয় এগুলো। মন্দিরের এক পুরোহিত বললেন, এই সুতোগুলো কালভৈরবের গলায় পরা মুণ্ডমালার প্রতীক। তার আশির্বাদ নিয়ে সেই সুতো বা ‘দণ্ডমালা’ পরলে নাকি বিপদ কেটে যায়। যাই হোক, আমরা তো লোকজন ঠেলে ঠেলে এগোতে শুরু করলাম। সেদিন আবার একটু ভিড়ও ছিল, কিছুটা এগোতেই দেখলাম অনেক লম্বা লাইন পড়ে গেছে। পকেটে ফোন ছিল, ম্যাপ বের করে দেখলাম মন্দিরটা কাছেই, কিন্তু সেখানে পৌঁছতে এদিক ওদিক অনেক ঘুরে যেতে হবে। ভিড়ের অবশ্য একটা কারণ সেদিন মঙ্গলবার ছিল। মঙ্গলবার কালভৈরবের বিশেষ দিন। আর অনেক লোক ভোরের মঙ্গলারতির আগেই এসে দাঁড়িয়ে যায়। মঙ্গলারতি ভোর সাড়ে তিনটে-চারটেয় শুরু হয়। আমরা অত ভেবে আসিনি। অগত্যা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতেই হবে। অগ্রহায়ণ মাসের অষ্টমী তিথিকে কালভৈরবের কাশীতে আগমণের দিন বলে মানা হয়। ভৈরবাষ্টমী বলে এই দিনকে। ভৈরবাষ্টমী ছাড়াও প্রত্যেক রবিবার ও প্রতি মাসের চতুর্দশীর দিনেও অনেক মানুষের ভিড় হয় সেখানে। 

লাইন ধরে ধরে এগোতে এগোতে এক সময় কোন এক অত্যন্ত সংকীর্ণ গলিতে এসে পড়লাম। দেখলাম লোকজনের দু’চার তলা উঁচু ঘরবাড়ি আসেপাশে। সেই গলিতেই লোকে সাইকেল বা বাইক নিয়ে চলছে। সেখানে কোন এক জায়গায় চোখে পড়ল দণ্ডপাণির মন্দির। এই দণ্ডপাণিকে কালভৈরবের দণ্ডস্বরূপ বলে মনে করা হয়। কালভৈরব যদি ম্যাজিস্ট্রেট হন, তো দণ্ডপাণি হলেন শেরিফ। কালভৈরব শাস্তির বিধান দেন, আর দণ্ডপাণি তার সম্পাদন করেন। মজার ব্যাপার যে এই দণ্ডপাণিই আবার অন্নপূর্ণার ভিক্ষা বিতরণের সময় কালভৈরবের সাথে মিলে দেবীকে সাহায্যও করেন; কিংবা যারা কাশীতে বসবাস বা এখানে মৃত্যুর পর মুক্তির অধিকারী নয়, তাদের কাশী থেকে বিতাড়িতও করেন দণ্ডপাণি। অর্থাৎ, ভেবে দেখুন, এর থেকে একটা সিদ্ধান্তে আসা যায় — পাপীরা কাশীতে এসে কালভৈরবের মত পাপমুক্ত হতে পারে ঠিকই, কিন্তু তার জন্যও তাকে যোগ্য হতে হয়। ধরুন কোন ঘোরতর পাপী সারাজীবন পাপ করে শেষ বয়সে মনে করল কাশীতে এসে পাপমুক্ত হবে। সেটা কি সম্ভব? না। দণ্ডপাণির কৌশলে সে কাশী থেকে তার মৃত্যুর আগেই বিতাড়িত হবে, কাশীর সীমানার মধ্যে সে থাকতেই পারবে না! দারুণ ব্যাপার, তাইনা? 

কাশীখণ্ডে মহাশ্মশান স্তম্ভ বলে একটি স্তভের উল্লেখ পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে কোন এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় এই মহাশ্মশান স্তম্ভ ভেঙে ফেলা হয়। তারই এক অংশ এখন দণ্ডপাণি হিসেবে পূজিত হয়। একই মহাশ্মশান স্তম্ভের উপরের দিকের অংশ চক্রপাণি ভৈরব হিসেবে পূজিত হয়। 

বেনারসের ইতিহাসে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কেবল এইবারই হয়নি। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই বেনারস কেঁপে উঠেছিল এক ভয়ংকর দাঙ্গায়। ঠিক কী ঘটেছিল সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে কাশীখণ্ডে দণ্ডপাণির আবির্ভাবের পেছনে যে বেশ সুন্দরএকটি গল্প আছে, সংক্ষেপে সেটা বলি।

(ক্রমশ)

পরবর্তী পর্ব (৯ই নভেম্বর ২০২৫)

Disclaimer
The views and opinions expressed in this series are solely those of the author and do not represent the views, policies, or positions of any organisation, institution or society of any kind or the government. The content of this series is written in the author’s personal capacity and does not reflect any official information or stance.

Author

Leave a Reply