কাশীর অলি-গলি : ইতিহাস-সমাজ-সংস্কৃতি। পর্ব ১। শোভন সরকার
কালভৈরবের সন্ধানে
ঠিক তখনই বুঝতে পারলাম আমরা রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি। মোড় ঘুরতেই সামনে কানা গলি, এরপর কোন দিকে যাব সেটা সত্যিই গুলিয়ে গেলো। গুগল ম্যাপ খুলেই চলা শুরু করেছিলাম, কচৌরি গলি পেরিয়ে শীতলা গলিতে ঢুকেছিলাম, অন্ততঃ এইটুকু আঁচ করতে পেরেছি। একটা সময় পর ম্যাপের সেই জারিজুরি আর খাটলনা। এখানে ম্যাপ যেন অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র; তার কাছ থেকে সাহায্যের আশা বৃথা। যখন আমরা দশ কদম এগিয়ে গেছি, গুগল ম্যাপ তখনও পনের কদম পিছে গলি হাতড়ে বেড়াচ্ছে। অগত্যা একরকম জেদ নিয়েই শেখর আর আমি মনে মনে মানচিত্র এঁকে নিয়ে মূল রাস্তায় পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে পিছোতে শুরু করলাম। কিন্তু সেই যে একবার খেই হারালাম, তা খুঁজে পাওয়া রীতিমত গলদঘর্ম বিষয় হয়ে দাঁড়াল। লজ্জার মাথা খেয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করতেই হবে এবার।
শেখর ও আমার পরিকল্পনা ছিল কাশীর গলির অভিজ্ঞতা নিতে নিতে কালভৈরব মন্দিরে গিয়ে পৌঁছাব। কী এমন আছে এইসব সরু সরু নোংরা গলিতে যে এত শুনি এর কথা? এর উত্তর সন্ধানই ছিল প্রেরণা। তাছাড়া সবাই বলে কাশীর গায়ে জড়াজড়ি করে থাকা গলিগুলোতে রাস্তা হারানো নাকি নতুন লোকের পক্ষে স্বাভাবিক। সেটা মিথ্যে প্রমাণ করার সুপ্ত বাসনা ও অহংকার নিয়েও এই পথে পদার্পণ এবং অবশেষে এই পদস্খলন। হাতে যথেষ্ট সময় নিয়েই বেরিয়েছিলাম। তবুও ঘটল অঘটন। পরবর্তীকালে অবশ্য অভিজ্ঞদের কথায় এবং নিজের অনুসন্ধান থেকে বেশ বুঝতে পারি যে বেনারসের এই নিবিড় গলিগুলো একেবারে উদ্দেশ্যহীন নয়, বরং প্রায় সমস্ত গলিই হয় গঙ্গার সঙ্গে সমান্তরালে বা গঙ্গার অভিমুখে চলেছে। এই ব্যাপারটি একবার মাথায় ঢুকে গেলে কাশীর গলিতে দিশাহারা হতে হয়না। তবে সেই ভীষণ সরু গলির ভেতর রাস্তা হারানোর রোমাঞ্চই আলাদা। উঁচু উঁচু বাড়িগুলো একে অন্যের গায়ে গিয়ে হেলে পড়ছে — ঠিক যেন সন্ধ্যে বেলায় পাড়ার বৌগুলি একসঙ্গে বসে পান চিবুতে চিবুতে রঙ্গরসিকতা করছে। সারা আকাশ যেন ঘিরে রয়েছে তাদের মাথার ঘোমটায়। দিনের বেলাতেও আলো আঁধারির খেলা চলে সেখানে। দু’জন মানুষ পাশাপাশি হেঁটে যাওয়ার সময় কাত হয়ে চলতে হয় কোন কোন জায়গায়। কোথাও আবার দেখা যাবে বিশাল আকারের এক ষাঁড় সমস্ত গলি জুড়ে বসে বসে আধবোজা চোখে জাবর কাটছে। হয়তো কখনও আপনি চলতে চলতে দেখলেন সামনে গিয়ে রাস্তা দু’ভাগ হয়ে গিয়েছে। আপনার মন বলছে ডান দিকে গেলে আপনি বড় রাস্তায় গিয়ে পড়বেন, কিন্তু ম্যাপ বলছে অন্য কথা। মনের কথা মেনে নিয়ে এগিয়ে দেখলেন সামনের রাস্তা বড় রাস্তায় এসে মেশেনি ঠিকই, কিন্তু লোকজনের আনাগোনা রয়েছে। কেউ তাকিয়ে রয়েছে আপনার বিভ্রান্ত চোখের দিকে, সেই সময় আপনি যতই সপ্রতিভ হওয়ার ভান করুন না কেন, তাদের অন্তর্ভেদী দৃষ্টি আপনার মনের কথা ঠিক জেনে নেয়। আবার একটু এগোলেই দেখবেন কেউ বসে রয়েছে তার বেনারসি শাড়ির দোকানে খরিদ্দারের আশায়। বড় দোকান নয়, কিন্তু তাদের সেই দোকানের পেছনেই কোথা থেকে কানে ভেসে আসে যন্ত্রচালিত তাঁতের শব্দ — কোন এক দেওয়ালের পেছনে বসে সেই যন্ত্রগুলি আপনার জন্য বেনারসের শাড়ির ভাণ্ডার সাজিয়ে তুলছে। আবার অন্য এক কানা গলিতে হয়তো দেখবেন নিস্তরঙ্গ নীরবতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কেউবা নিজের হাতে কোন মানুষের স্বপ্ন বুনে চলেছে বেনারসি শাড়ির জমিনে, বেনারসের নিজের ভঙ্গিতে। সত্যি বলতে কি, এসব দৃশ্য কেবল কাশীরই একান্ত, আর কোথাও এইসব দেখা যায়না, গেলেও তা স্থানবিচারে সেইসব দৃশ্য নিজের মাহাত্ম্য হারিয়ে ফেলে।
‘রাস্তা হারিয়েছ?’
আমরা সবে সেই কানা গলি থেকে বেরিয়ে একটা মোড়ে এসেছি। এদিক ওদিক তাকিয়ে আর ম্যাপ দেখে বোঝার চেষ্টা করছি কোনদিকে গেলে এই ধাঁধা থেকে বেরোতে পারি। ঘেমে নেয়ে একশা হয়ে গেছি। ঠিক সেই সময় খুব কাছ থেকে এক সুললিত কণ্ঠ পরিষ্কার বাংলায় এই প্রশ্নটি আমাদের দিকে ছুঁড়ে দেয়। আমরা একরকম সম্বিৎ ফিরে পেয়ে মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম এক বৃদ্ধা খানিকটা উঁচু এক চাতালের উপর বসে মৃদু কৌতুকমিশ্রিত মুখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। শান্ত অথচ দৃঢ় তাঁর দৃষ্টি, দেখলে বেশ ভরসা হয়। পরনে সাদা থান, মাথার চুল প্রায় কাঁচা-পাকা মেশানো। বিকেল বেলার সোনালী আলো পাশের এক ম্যাড়মেড়ে হলুদ বাড়ির দেয়ালে প্রতিফলিত হয়ে তার মুখের এক পাশটায় চুঁইয়ে পড়ে কেমন উজ্জ্বল করে দিয়েছে। তাঁর ঠিক পেছনের প্রেক্ষাপটে কবেকার আঁকা কিছু দেওয়াল চিত্র।
‘কোথায় যাবে তোমরা?’
তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন। আমরা এবার তাঁর দিকে এগিয়ে গেলাম। শেখর বলল, ‘কালভৈরবের মন্দির। রাস্তা কি এদিক দিয়েই, দিদা?’
‘কালভৈরব দর্শন করবে? তাতেই বুঝি রাস্তা হারালে?’
বলে ভদ্রমহিলা সামান্য হাসলেন। হাসিতে করুণা মাখা যেন। যেন বলতে চাইছেন, আহারে, অবোধ ছেলেদুটি, কালভৈরবের আশায় ছুটেছে। তিনি আবার বললেন,
‘তিনি তো সবাইকে দেখা দেননা।’
আমরা একটু হকচকিয়ে গেলাম। ঠিক কী বলা উচিত ভাবতে ভাবতেই শেখরকে বলতে শুনলাম,
‘শুনেছি কালভৈরবের আশীর্বাদ ভিন্ন কাশীর দর্শন বৃথা যায়। উনার দর্শন করেই নাকি বাকি যাত্রা শুরু করতে হয়। সেটা কি সত্যি? আমরা ঠিক সেই কারণেই আজ বেরিয়েছি। কালভৈরব দেখে তারপর অন্য সকল দেখব।’
‘তীর্থদর্শনে এসেছো?’
‘তা সেটা বলতেই পারেন। এখানে কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা পড়তে এসেছি। একরকম তীর্থ দর্শন তো বটেই।’
আমি মনে মনে শেখরের কথার প্রশংসা না করে পারলাম না। বেশ সুন্দর করে বলল সে ব্যাপারটা। এর জন্য আমাদের যে সেদিন বেশ লাভ হল, তা কিছুক্ষণের মধ্যেই টের পেলাম।
‘সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তা তোমরা কালভৈরব নিয়ে অনেক পড়াশোনা করে এসেছো মনে হচ্ছে।’
‘বিশেষ নয়, অতি সামান্য। তবে আপনি যদি আমাদের কালভৈরবের ব্যাপারে বলেন তো অনেক কিছু জানতে পারব। বলবেন দিদা?’
‘সে তো দু-পাঁচ মিনিটের কম্ম নয় দাদুরা। একবারে সব বলতে বলতে রাত হয়ে যাবে যে। তোমাদের হোস্টেলের দরজা বন্ধ হয়ে যাবে না?’
আমরা হেসে ফেললাম। আমি বললাম,
‘ছেলেদের হোস্টেল সারারাত খোলা থাকে দিদা, যখন খুশি আসা যাওয়া যায়। ও নিয়ে আপনি ভাববেন না। আমরা এই বসলাম এখানে। কালভৈরব দর্শনের তাড়া নেই। আবার একদিন আসা কোন সমস্যাই নয়।’
ভদ্রমহিলা স্মিত হাসলেন। বললেন,
‘তাহলে এখানে কেন বসবে! এসো, ঘরে গিয়ে বসি।’
আমাদের আর আপত্তি কী? আমরা হোস্টেলে থাকা, বাড়ির আদর থেকে দূরে থাকা, ভবিষ্যতের অনির্দিষ্ট পথে চলতে থাকা পথিক। কেউ এভাবে যখন আমাদের উপর স্নেহবর্ষণ করে, তখন তাকে সৌভাগ্য ছাড়া আর কী-ই বা বলার থাকে? তাকে অস্বীকার করি কী করে? তার উপর বাড়ির তৈরি খাবারের লোভ সমস্ত হোস্টেল অধিবাসীর অর্জিত স্বভাব। আমরাও সেই রিপুর আক্রমণ থেকে বাদ যাইনা, দমনের চেষ্টাও করিনা।
বাড়িতে ঢোকার ফটকটি বেশ সুদৃশ্য। গাঢ় আকাশি নীল রঙের দরজা, তার উপরে সাদা রঙের আলপনা কাটা। দরজার দুইপাশে দুই প্রহরীর ছবি আঁকা। দরজা ঠেলে আমরা বাড়ির উঠোনে এসে ঢুকলাম। খুব বড় নয়, কিন্তু বেশ ছিমছাম। বাড়ির ভিতরে অন্য কাউকে চোখে পড়ল না। উঠোন পেরিয়ে ভদ্রমহিলা আমাদের এক ঘরে নিয়ে এসে বসালেন। ঘরে ঢুকতেই আরও একপ্রস্থ অবাক হওয়ার পালা। দেওয়াল জুড়ে আলমারি, আর আলমারি ভর্তি বই। শেখর আর আমার চোখাচোখি হল, আমরা দু’জনেই সমানভাবে বিস্মিত। ভদ্রমহিলা আমাদের বসার কথা বলে ভেতরে চলে গেলেন। সেই ফাঁকে যে নিজেদের মধ্যে কথা বলব, সেই অবস্থায় আমরা আর ছিলাম না। না বসে ঘরের আলমারিগুলোর দিকে এগিয়ে গেলাম। অনেক রকম বই — ইংরেজি, বাংলা, হিন্দির সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম অনেকগুলো সংস্কৃত বই। ভদ্রমহিলার প্রতি বেশ সমীহ জন্মাল। তার চেয়ে বড় কথা, কে তিনি? এই প্রশ্নটি মনের মধ্যে যখন ঘুরপাক খাচ্ছে, আমি তখন কুবের নাথ সুকুলের বেনারসের উপর লেখা একটা বই হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভদ্রমহিলা হাতে চায়ের তিনটি কাপ আর সঙ্গে বাটিতে কিছু কুচো নিমকি নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। আমাদের অবস্থা দেখে একটু হেসে বললেন,
‘বইগুলোর বেশির ভাগ আমার বাবার সংগ্রহ। উনি কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতের অধ্যাপক ছিলেন। বাবার পরে অবশ্য আজকাল আমিই এগুলোর দেখভাল করি।’
‘আপনিও কি অধ্যাপনা করেন?’
‘না না, সে বয়স আর কোথায়? হিন্দু স্কুলে পড়িয়েছি কিছুকাল। অবসর নিয়ে এখন দিব্যি আছি। আমার কথা বাদই দাও। আমি তো তোমাদের নামই জিজ্ঞেস করিনি এখনও।
আমরা বললাম। তারপর উনি বললেন, ‘বেশ, এই নাও, চা খাও। আমরা চা খেতে খেতে বরং কালভৈরবের গল্প করি।’
(ক্রমশ)
