কাগজের নৌকো। পর্ব ১৮। ধারাবাহিক উপন্যাস। লিখছেন সায়ন্তন ঠাকুর
মূর্তির জল থাকে না এসময়, পাথর বিছানো নদীগর্ভে অপরাহ্নের আলো অলস যুবতির মতো শুয়ে আছে। পশ্চিমাকাশে কে যেন কাজল লতার মতো মেঘ বিছিয়ে দিয়েছে, বাতাস আজ পূর্বগামী। ওদিকে ডায়না বিট থেকে মাঝে মাঝে ময়ূরের ডাক ভেসে আসছে, কতগুলি সাদা বক দিনান্তের মলিন আলোয় সেদিকে উড়ে গেল।
নদী পেরিয়ে একখানি ছোট বনবাংলো, মাথায় টালির চাল, সামনে চওড়া বারান্দা, পাশাপাশি দুটি ঘর,পেছনে আরও একটি। পর্যটক তেমন কেউ একটা আসে না, আর এই খর চৈত্রে কেই বা আসবে! বাংলোর হাতায় দুটি শিরীষ গাছ দ্বাররক্ষীর মতো দাঁড়িয়ে আছে, অদূরে কতগুলি আমলকি আর খয়েরও চোখে পড়ে। তবে এই বনাবাসের আসল অহঙ্কার হল জারুল গাছ, প্রায় অষ্টসখীর মতো তারা ঘিরে আছে বাংলোটিকে! শেষ চৈত্রের বাতাসে রুক্ষ বাতাসে অনবরত খসে পড়ছে জারুল ফুল, সামনের শীর্ণ রাস্তাটি যেন বেগনী রঙের ছায়াপথ, সামনে একটু এগিয়েই হারিয়ে গেছে অরণ্য-নক্ষত্রের দেশে। এক যুবক রেঞ্জার অনেকদিন আগে এই বাংলোটির নাম দিয়েছিলেন, ‘জারুল-বন’, এখনও সেই নামটিই রয়েছে।
জারুল-বনের হাতায় ধুলার উপরেই বসে আছে চৌকিদার ভীমা টোকবি। বয়স হয়েছে কিন্তু শরীরের বাঁধুনি আলগা হয়নি, ঘোলা সরু দুটি চোখ, একমাথা কোঁকড়ানো চুল, পরনে একখানি পুরাতন সুতির প্যান্ট আর ফুলহাতা জামা। অনেক ছোটবেলায় ভীমা আসাম থেকে বাবার সঙ্গে এদিকে এসেছিল, তখন এখানে গৌরিপুরের রাজাবাবু লালজীর খুব হাঁকডাক, দু চারটে হাতি সবসময় বাঁধা থাকত ওই মূর্তি নদীর ধারে। তারা যেন সব লালজীর বশংবদ ভৃত্য ছিল। ভীমার এখনও মনে আছে নদীর জলে হাতির গা ঘষে ঘষে পরিস্কার করছেন লালজী, পরনে খাকি হাফপ্যান্ট, খালি গা আর মাথায় একখানি নেপালিদের মতো টুপি! টুপির সামনে দুটি কুকরি লাগানো। চারপাশে খর দ্বিপ্রহর, হয়তো এমনই চৈত্র মাস তখন, লালজী ভাঙা গলায় গান ধরেছেন, হস্তীর নড়ান হস্তীর চড়ান হস্তীর গলায় দড়ি!
ঝড়ের মতো আগুনরঙা বাতাস বইছে, শুকনো পাতার দল পাখা মেলে কোথায় যেন উড়ে যাচ্ছে, শাল কুসুমে ভরে উঠেছে পথ, কেউ কোথাও নাই শুধু হাতিদের রাজা আপনমনে গান গাইছেন! আর তাঁর বিবাগী সুরটি নদীর হাত ধরে দূর অরণ্যের দিকে এগিয়ে চলেছে।
ভীমার আজকাল খুব লালজীর কথা মনে পড়ে, বয়স হলে নূতন কথা বোধহয় মানুষ ভুলে যায়! হাতি আর কই এখন! সেই গেলবার চাপড়ামারিতে একটা দাঁতাল বেরিয়েছিল, তখন ভীমা মধুমালতীকে নিয়ে তাকে খেদিয়ে এখানে নিয়ে এসেছিল। মধুকেও তো নিজের হাতে দুধ খাইয়েছে, তাও হয়ে গেল প্রায় সাত আট বছর, জঙ্গলে দলছুট হয়ে পড়েছিল, সঙ্গে করে এখানেই নিয়ে এসেছিল। মধু এখন দেখলে চিনতেও পারে না, জলদাপাড়ায় বেশ আছে, শুনেছে হলংএর পিলখানায় রাণীর মতো থাকে। তা থাকুক, বিটি সুখে থাকলেই বাপের খুশি।
পুটুসের ঝোপে ও কে চলে গেল ? একবার তাকিয়েই ভীমা নিজের মনেই বলে ওঠে, ও নাগরাজ, এলি বাপ!
সে বহুদিন আছে এখানে, ভীমা ওর নাম রেখেছে নাগরাজ। কিছু করে না, করবে কেন, এখানে ভীমা ছোজুন পুজো করে ফি বছর, বারিথি দেওতা থাকতে ভয় কী!
এলোঝেলো বাতাস বইছে, মেঘের ছায়ায় ম্লান হয়ে এসেছে চৈত্র অপরাহ্ন, পুটুস ফুলগুলি বাতাসের দোলায় কেমন থিরথির করে কাঁপছে। পথ থেকে একমুঠি ধুলি তুলে উড়িয়ে দিয়ে বাতাস দেখল ভীমা, দু এক বার নাক টেনে শ্বাস নিল, বৃষ্টি আসছে!
বৃষ্টি সত্যি আসছে, হয়তো তিনি এখন ওই দূরে ডায়না নদীর তীরে আঁচল পেতে বসেছেন, টলটলে জলের দিকে তাকিয়ে দেখছেন নিজের মুখখানি, কী একটা বনকুসুম দিয়ে সাজালেন একরাশ খোলা চুল, সারা অঙ্গে তাঁর জলের সুবাস, পায়ের রিণিঝিণি মল বাজিয়ে তিনি আসছে। ওই যে পশ্চিম আকাশে জেগে উঠেছে তাঁর সজল দুটি চোখ, দেখেই মনে হয় এখনই অশ্রুধারায় ভেসে যাবে জগত!
দূরে একটি গাড়ির শব্দ পেয়ে মুখ তুলে তাকায় ভীমা। ধুলামাখা পথ বেয়ে এদিক পানেই আসছে, একটি ধণেশ পাখা মেলে মূর্তি পার হয়ে ঘন অরণ্যের দিকে উড়ে গেল। উঠে দাঁড়িয়ে ভীমা বাংলোর দিকে এগিয়ে গেল, ঘর পরিস্কার করাই আছে, দরজা জানলাগুলি হাট করে খুলে দিল।
আজ বুধবার, জারুল-বনে আগামী চারদিনের বুকিং আছে ঐন্দ্রীর। প্রতি চৈত্রে সে অরণ্যে আসে, নির্জন বাংলোর হাতায় চুপ করে বসে থাকে। কোনও কথা বলে না, যেন এখানে শব্দ করা মানা, দূর থেকে তখন ঐন্দ্রীকে দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়, জঙ্গলের মধু যার মনে একবার লেগেছে তার আর নিস্তার নাই!
ভীমা নিজের মনেই একটু হাসে।সে জানে সন্ধ্যা হলেই আগুন জ্বালাতে বলবে দিদিমণি, নিভু নিভু অগ্নিকুণ্ডের ধারে বসে ভীমা তখন লালজীর গল্প করবে, হাতি খেদানোর গান ধরবে নিজের ভাষায়।
কিন্তু আজ দিনটি একটু অন্যরকম, বনদেবী একটি ভিন্ন জগত সাজিয়ে রেখেছেন ঐন্দ্রীর জন্য। গাড়িটি এসে থামল বাংলোর সামনে, আর ঠি ক তখনই ডায়না নদীর পারে উঠে দাঁড়ালেন বৃষ্টি, বাতাসে শোনা গেল তাঁর পায়ের নূপুরধ্বনি।
রোগা মূর্তি নদীর টলটলে জলের নীচে শুয়ে আছে নানা রঙের নুড়িপাথর, গোড়ালি আর পায়ের পাতা ভেজে শুধু, চৈত্র মাসের ভোরবেলায় মূর্তিকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে থাকে নরম মিহি ঢাকাই মসলিনের মতো কুয়াশা। ওপারে কিছুটা সমতল ভূমি, দুপাশে শাল খয়ের আর গামহার গাছের দল, পুটুস ঝোপ, আর এপারে সবুজ মখমলি ঘাসের উপর অভিমানিনী যুবতির মতো’জারুল-বন’, ঘরে ঘরে মেহগনি কাঠের আসবাব, জানলা খুললেই যতদূর দৃষ্টি যায় সফেন সবুজ সমুদ্র, ঢেউয়ে ভাসে জংলা পাতার সুবাস, মোটা গদি পাতা নরম শয্যা, সাদা চাদর বিছানো তার ওপর,সুতো দিয়ে লতাপাতা বোনা মাথার বালিশে, ঐন্দ্রীর লজ্জাই লাগে ওরকম যত্ন করে সাজানো বিছানা স্পর্শ করতে, যেন পরপুরুষ!
জানলার কাছে লেখার টেবিল, লেসের কাজ করা জামা, কাচের গেলাস ভর্তি তৃষ্ণার জল, গদি-আঁটা চেয়ার, কিছুক্ষণ বসে থাকলেই তার কাগজে খসখস করে চিঠি লেখার ইচ্ছে হয়, সেই যার সঙ্গে আর কখনও দেখা হবে না, কথা হবে না, তার নাম লিখতে মন চায় সাদা কাগজে। দুপুর গড়ালে সবজে আলো এসে পড়বে কাগজের উপর, উড়ে আসবে কুসুম রেণু, বন-সুবাসে টলোমলো করে উঠবে অক্ষর-কলোনি!
বাংলোর হাতায় লোহার গেটের দুপাশে দুটো নকল গাছ, একটার মাথায় বসে আছে এক অতিকায় ঈগল। কোনও এককালে নাকি বাজপড়া শিমুল গাছের মাথায় সত্যি এসে বসে থাকতো এক বুড়ো ঈগল, বিকেলে যখন অস্ত সূর্য শেষবারের মতো আলো ছিটিয়ে নিজের রথ নিয়ে ফিরে যাওয়ার তোড়জোড় করতো তখনই নাকি ধুলোর গন্ধ দুটি প্রাচীন ডানায় মেখে সে আসতো, সারা দিনের শেষে কিছুক্ষণের বিশ্রাম, তারপর পুনরায় উড়ে যাওয়া অন্ধকারের দিকে।
গেট পার হয়ে কাঁচা পথ, আরও সাত কিলোমিটার উজানে হাঁটলে তবে বড় পিচ ঢালা রাস্তা, গয়েরকাটা, বীরপাড়া পার হয়ে ভুটানের দিকে বয়ে গেছে, ওই পথের প্রান্তে ভুটানি বস্তিও রয়েছে, লুঙ্গির মতো করে কাপড় পরা ভুটানি যুবতি বিক্রি করে দিশি রাম, ঝাল ঝাল লঙ্কার আচার মাখানো শুয়োরের মাংস, আরও রাতে নীল পাহাড়ের সেই মেয়ে গেয়ে ওঠে পাহাড়ি গান। কেন তার মরদ তাকে ফেলে আরও দূর পাহাড়ে চা বাগানে চলে গেল ! অন্য আশনাই হল নাকি তার ? নতুন মানুষকে নিয়েই তবে ঘর বাঁধবে সে ? এমনই সব গানের কথা। সুর ফেলে রেখে ওই বেদনা উড়তে থাকে শীতবাতাসে, দুটো পাখা মেলে জারুল-বন অবধি ধেয়ে আসে, শুয়ে থাকে নদীর জলে শরীর ভিজিয়ে, রাতচরা পাখি কেঁদে কেঁদে উড়ে বেড়ায় সারারাত, নরম ঘাসের লোভে গণ্ডার আসে, বাসি গোবরের গন্ধ তার গায়ে, সম্বর হরিণের দল ছুটে এসে কিছুক্ষণ কী যেন দ্যাখে চোখ মেলে, তারপর আবার ছুটে পালায়, ব্বাক ব্বাক শব্দে ডেকে ওঠে কোটরা হরিণ।
বাংলোর কাছেই কুনকি হাতিদের পিলখানা, পায়ে মোটা শেকল তাদের, আকাশে তখন হেলে পড়েছে কালপুরুষ, কোনও কোনওদিন ভাঙা চাঁদ ওঠে, হলদে আলোয় নিরালম্ব এক ভুতুড়ে কুয়াশা ঘিরে থাকে চরাচর, সে-সময় শুঁড় তুলে করুণ আর্তনাদ করে পোষা হাতি নার্গিস। মায়া-কৌমুদী সুবাসে তার কি নিজের ঘরের কথা মনে পড়ে তখন ? সেই যে একবার মাকনার সঙ্গে পালিয়েছিল, এমনই রাতে নিশ্চুপ ঝর্ণার ধারে ভালবেসেছিল দুজন পরস্পরকে। মাকনার নাম কি তবে ছিল রাজ ? কে জানে! এখন নার্গিসের পায়ে লোহার অনতিক্রম্য শেকল!
এমন জ্যোৎস্নায় ঐন্দ্রীর অরণ্যকে বারবার সমুদ্র বলে ভ্রম হয়, মুহূর্তে তার মনে পড়ে যায় সমুদ্র-কথা, থইথই সমুদ্র বাতাসের ঝাপট গায়ে লাগলেই কেমন নির্জন হয়ে ওঠে মন। ভেজা বালির উপর কত মানুষের পায়ের ছাপ, কয়েক মুহূর্ত মাত্র সেই পদচিহ্নের আয়ু, ফেনা ফেনা জলের ঢেউ ছুটে এসে মুছে দিয়ে ফিরে যায় আবার, কেউ বালি চুড়ো করে ঘর বানায়, মূর্তি গড়ে, ওই অপার জলরাশির সামনে কতক্ষণই বা থাকবে সেসব! তবুও মানুষের খেলা করতে ভালো লাগে। মনে মনে হাসে ঐন্দ্রী, নিজেকেই যেন বলে, খেলনাপাতি নিয়েই তো আমাদের হাসি গান প্রেম ও বিষাদ। একবার ভাবে, ছবিটি আঁকবে ক্যানভাসে, পরক্ষণেই মনে হয়, কী হবে, ক্ষণস্থায়ী রূপজগতের মায়ায় নিজেকে বেশি না-জড়ানোই ভালো!
এদিকে সমুদ্র বড় একা, লোকজন তেমন আসে না, বিকেল ফুরিয়ে আসে জলের উপর, লাল কমলা হলুদ রঙ গুলে আকাশ আর সাগর কে যেন একাকার করে দিয়েছে, ভুস করে জলে ডুব দেবে এবার সূর্য,শনশন বাতাসে আঁশটে গন্ধ, একটা গম্ভীর ট্রলার ভোঁ বাজিয়ে চলে যাচ্ছে অস্পষ্ট দিকচক্রবাল রেখার দিকে। সামনে একটা সরু পথ বেঁকে গেছে কাজুবনের দিকে। ওইখানে একটি পোড়ো বাড়ি আছে, ভাঙা দালান, ছাদ ধসে পড়েছে নোনা বাতাসের ধাক্কায়। শোনা যায় এক গোয়ান সাহেব তার দিশি বউকে নিয়ে কোনকালে নাকি সংসার পেতেছিল সেখানে।
মুগ্ধ চোখে ঐন্দ্রী ভাবে, কত পালতোলা ক্যারাভেলা ভেসে ভেসে ওই অনন্ত সমুদ্র বেয়ে এসেছিল আমার দেশে একদিন। তার ডেকে দাঁড়িয়ে লবণ আর মসলিনের লোভে চকচক করে উঠেছে ফিরিঙ্গিদের চোখ, পরনে আঁটো কামিজা, মাথায় শাপিও বা চোঙার মতো টুপি, সপ্তডিঙা মধুকর নিয়ে দূর বিদেশে পাড়ি দিয়েছিল কত বেনের পো, তাদের কেউ ঘরে ফিরেছিল কেউ আবার ফেরেনি কোনওদিন, ছুটে এসেছে হার্মাদদের পানসি, তাল সুপুরির ছায়ায় আচ্ছন্ন বঙ্গালদেশের নিভৃত জনপদ ছারখার করে মিলিয়ে গেছে ঢেউয়ের আড়ালে।
বালির উপর হাঁটতে হাঁটতে ঐন্দ্রীর পায়ে ঠেকে ছোট ছোট শামুকের খোল, ধুলো ঝেড়ে গোটাচারেক হাতে তুলে নেয়, কড়ি, কেউ কেউ কপর্দকও বলে, চারটে কড়ি মানে এক গণ্ডা, ২০ গণ্ডায় এক পণ, চার পণে এক আনা, চার আনা মেলালে এক কাহন, আর চারটে কাহন জুটলেই গোল রুপোর টাকা, ওপরে ফার্সি ভাষায় লেখা থাকে শাহেনশার নাম, কবেকার সব হিসেব!
পাঁচটা রুপোর ওমন টাকা দিলেই পাওয়া যায় সোমত্থ দাসী, বঙ্গালদেশের অপরূপা যুবতি, আফ্রিকার হাটে বিক্রি হয় ভালো দামে। কেউ ভালবেসে কিনে নিয়ে যেত তাদের ? আদর করে বাঙালিনীর গর্ভে ঢেলে দিত বিদেশি বীজ ?
হয়তো হতো এমনই। তারপর অনেকদিন পর সেই ছেলে নীল চোখ আর তামাটে চুল নিয়ে ফিরে আসতো ওই কাজুবনের গৃহে!
সন্ধে এসেছে, কালো জলের ওপর চকচক করছে ফসফরাসের আলো, মেঘ জমেছে অল্প, রাত্রে হয়তো ঝড় বাদলে ফুঁসে উঠবে শান্ত সমুদ্র, তার পূর্বেই ফিরতে হবে ঐন্দ্রীকে, হয়তো নিজের কাছে!
(ক্রমশ)