কাফিরনামা । পর্ব ৪। লিখছেন রাণা আলম
সেই ছোট্টবেলায় ইশকুল ফাঁকি দিয়ে কলেজ ঘাটে বসে আড্ডা দিতুম। আর যেদিন গেট টপকে বেরোতে পারতুম না, সেদিন লাস্ট বেঞ্চে বসে লম্বা ঘুম দিতুম। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় অধ্যাপক বিজন সরকার অবাক হয়ে কয়েছিলেন,
‘রাণা, কিভাবে, ঠিক কিভাবে তুমি এইভাবে লাস্ট বেঞ্চে বসে টানা নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে পারো?’
তখনই, প্রণম্য মাস্টারমশাইরা কয়েছিলেন, ওরে হতভাগা, এখনও আকাশে সূর্য-চন্দ্র ওঠে, আমিনিয়াতে রেওয়াজী খাসির মাংস দিয়েই বিরিয়ানি হয়, সুতরাং এই পাপের ফল একদিন ঠিকই ভুগতেই হবে। আজ যে কেলাস কে তুই ফাঁকি দিচ্ছিস, সেইই কেয়ালসঘরই একদিন তোকে তাড়া করে বেড়াবে।
গুরুবাক্য কদাপি মিথ্যা হয় না। একদশক ধরে পেটের দায়ে মাস্টারি করতে হচ্ছে। যে কেলাসঘরে যাওয়ার নামে আমার জ্বর আসতো, সেই কেলাসঘরেই রোজ বক্তিমে দিতে হয়। ছাত্র-ছাত্রীদের তিতকুটে বিরক্ত মুখ দেখে বুঝি, পাপ বাপ কো ভি নেহি ছোড়তা।
তা সেই পাপের ফলভোগেই এখন উত্তর কলকাতার শতাব্দীপ্রাচীন বাড়িটায় রোজ সাতসকালে মাস্টারি করতে যেতে হয়। রাত দুটোর সময় ঘুমিয়ে সকাল সাড়ে পাঁচটায় বাস ধরি।রোজ সকালে যখন পাঁচটায় অ্যালার্ম বাজে তখন উঠে করুণ চোখে ঘড়ির দিকে তাকাই। অ্যাত্তো তাড়াতাড়ি পাঁচটা বেজে গেল? হে ঈশ্বর, তুমি কি কালচক্রটা এট্টু বাঙালির নিয়মমাফিক স্লো করে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। কিন্তু খুদাতলা ফি বছর সেরেফ ঈদের দিকে মৌলানা সায়েবের পিছনে উঠবোস করা বান্দার প্রার্থনা শোনার মত বুরবাক নন। তাই, ঘড়ির কাঁটায় পাঁচটা পার হয়। আমিও ক্লান্ত চোখে বেরিয়ে বাস ধরি। পাড়ার বন্ধ জানালাগুলোর দিকে তাকিয়ে ঘুমন্ত প্রতিবেশীর আয়েসের কথা ভেবে হিংসেয় বেগুনী হয়ে উঠি।
প্রথমদিকে ৪৫নং বাস ধরে যেতাম। তাপ্পর দেখলাম যে ৪৫ সাতসকালে অতি অসভ্য বাস। মাত্তর কুড়ি-বাইশ মিনিটে সে শেয়ালদা পৌঁছায়। বাসে যে এট্টুখানি ঘুমিয়ে নেবো তারও জো থাকেনা। খুদাতলা কি অ্যাতই বেরহম? ফি বছর রোজার মাসে যে নিয়ম করে ইফতারে বসি সারাটাদিন গান্ডেপিন্ডে গেলার পরেও, সে স্যাক্রিফাইসের কি কোনো দাম নেই?
পরে দেখলুম, খুদাতলা আমাদের মত বেফিকর বেশরম বে-হায়া বেতমিজ বে-আদব দেরও কথাও একটু আধটু ভাবেন। যাদবপুর থানা থেকে ২৪০ ছাড়ে। অতি শান্তশিষ্ট বাস। ল্যাজ আছে কিনা খেয়াল করিনি। তবে বাঙালি ভদ্রলোকের উপযুক্ত বাস। সকালে চল্লিশ মিনিটের আগে কিছুতেই শেয়ালদা যেতে চায়না। বেশ ধ্যানী বুদ্ধের মত হালচাল। পাশ দিয়ে বাইক বেরিয়ে যাচ্ছে, একের পর এক ৪৫নং বাস অশালীনের মত বেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ২৪০ ধীর, স্থির, যেন সে খরগোশ আর কচ্ছপের গপ্পোটা পড়েই এসেছে। অ্যামনকি উড়ালপুল দিয়ে নামার সময়েও শক্ত করে ব্রেক ধরে রাখে, পাছে ভুল করে মনে হয় যে বাস জোরে যাচ্ছে। ফলে ঠনঠনিয়া কালীবাড়িতে নামার আগে দিব্যি আধঘন্টা ঘুমিয়ে নেওয়া যায়। মাঝে-মধ্যে যে সেমসাইড করে হাতিবাগানে নামিনি তা নয়, কিন্তু পাভলভিয়ান থিওরি মেনে সচরাচর ওই কলেজ স্ট্রীটেই ঘুম ভেঙ্গে যেত। আর হাতিবাগানে নামলেই বা কি? বাঙালি কি পিছনে হাঁটিতে শেখে নাই?
দিব্যি হেঁটে ফেরার সময় বিহারির দোকানে গরম পুরি আর জিলিপি খেয়ে মনটা অ্যায়সান ভালো করে নেওয়া যায় যে মোহনবাগান গোল খেলেও রেফারি অফসাইড দ্যায়নি বলে চেল্লাতে ইচ্ছে করেনা, ইস্টবেঙ্গল কোনোদিন কোনো সমান্তরাল মহাবিশ্বে আইলিগ জিতলেও জিততে পারে বলে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে ইত্যাদি ইত্যাদি…
গুণীজনেরা কন, আমি নাকি এতটাই অপদার্থ এবং পেটুক যে খাবারের বর্ণণা ছাড়া কিস্যু লিখতে পারিনে। বিরিয়ানির হাঁড়ি লাল কাপড়ে নাকি আমার জন্যেই ঢাকা থাকে যাতে উন্মত্ত ষাঁড়ের মত তেড়ে যাই। ওই যে কবি লিখেছিলেন ‘মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়’, ওটা নাকি আমার কথা ভেবেই লেখা যাতে সারস রোস্ট হবার ভয় পায়। অ্যামনকি ইহুদী নাসারা জুকেরবার্গের ফেসবুক খুললেও আমার জন্য দেশ-বিদেশের সেরেফ খাবারের ভিডিও দেখার সাজেশন আসে।
পাকিস্তানের খাবার সংক্রান্ত একটি পেজ আমি ফলো করি কারণ তারা নিত্য নতুন কাবাব আর পোলাও-বিরিয়ানীর তত্ত্বতালাশ দ্যান। আমাদের দিল্লীর শাহবাবাজি অ্যান্ড কোম্পানি এমনিতেই পাকিস্তান ট্যুরিজম এর অবৈতনিক ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। তাই তারা কথায় কথায় পাকিস্তান পাঠাবার হুমকি দ্যান। তাদের দাড়িওয়ালা গুরুঠাকুর আবার বিনা-নিমন্ত্রণের বিরিয়ানি গিলে এসেছেন সেদেশে। সুতরাং, কালেভদ্রে যদি তারা আমাকেও পাঠান পাকিস্তান তাহলে আর কিছু না হোক, বিরিয়ানি-কাবাব চেখে আসার চান্স মিলবে মুফতে সেই আশায় আছি।
কিছুদিন আগে সেই পেজে দেখি পাকিস্তানের লোকাল পুলিশ একটি বছর ষোল-সতেরোর ছেলেকে কাঁধে করে বিজয় উল্লাসে নিয়ে আসছে। ছেলেটির মুখেও বীরের হাসি। উর্দুতে লেখাটা ট্রান্সলেট করে বুঝলাম সেই ছেলেটি ইসলাম ধর্ম অবমাননা কারী কাউকে হত্যা করেছে। আইন মোতাবেক তাকে গ্রেপ্তার করলেও আদতে কমন পাবলিকের কাছে সে একজন বীর, তাই পুলিশ তাকে কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে। ধর্মান্ধতা মানুষকে কিভাবে হত্যা করতে শেখায় তার উদাহরণ নিশ্চয়ই আমাদের কাছে নতুন নয়। পাকিস্তানে ব্লাসেফেমি সংক্রান্ত একটি আইন আছে যাতে ইসলামের অবমাননাকারী’র মৃত্যুদন্ড হয়। মুশকিল হচ্ছে এসব বিষয় সেদেশে সচারচর আইন-আদালত অব্দি যায় না। অমুকে ইসলাম অবমাননা করেছে, এইটুকু খবর রটলেই লোকাল পাবলিক তাকে পিটিয়ে মেরে ফ্যালে। আর সরকার হত্যাকারীর পক্ষ নিলে কি হয় সেটা আমাদের দেশে গুজরাত দাঙ্গায় এহসান জাফরির হত্যাকান্ডের বিচার দেখলেই বোঝা যায়। তাছাড়া ধর্মীয় ভাবাবেগ আমাদের উপমহাদেশে অতি ‘নাজুক’ বিষয়। ধর্মের দন্ডমুন্ডের কর্তারা সুচিত্রা সেন সিন্ড্রোমে ভোগেন। কখন তারা আহত হবেন আর কল্লা নেবার কি কবর থেকে তুলে ধর্ষণ করার ফতোয়া জারী করে বসবেন তা বোঝা শক্ত।
গতকাল পাকিস্তানের শিয়ালকোটে এক সিংহলি ইঞ্জিনিয়ারকে ব্লাসফেমির দায়ে খুঁচিয়ে মেরে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। তার ছবি সংবাদ মাধ্যমে দেখেও থাকবেন নিশ্চয়ই অনেকে। এইমুহুর্তেও যদি পাকিস্তানে জনমত নেওয়া হয় তাহলে নিশ্চিতভাবেই বড় অংশের সাধারণ জণগন এই ঘটনার পক্ষে থাকবেন। তাদের মতে যা হয়েছে, বেশ হয়েছে, ধর্মের অবমাননাকারীর সাথে এটাই হওয়া উচিত।
মাননীয় পাঠক, আমাদের তো এই ঘটনা থেকে শেখার ছিল যে ধর্ম কে রাষ্ট্র পরিচালনার সাথে জুড়লে কি ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি হতে পারে। প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের রাষ্ট্র হিসেবে ব্যর্থতার নজির থেকে আমাদের বোঝা উচিত ছিল যে কোনটা আমাদের করা উচিত নয়।
কিন্তু, আমরা কি আদৌ শিখছি?
আমাদের মহামহিম শাসককে এখন জিততে গেলে ধর্মীয় বিদ্বেষের জিগির তুলতে হয়, দাঙ্গা থেকে ফায়দা লোটার কথা বলতে হয়। রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যর্থতাকে ঢেকে দেওয়ার জন্য বিভাজনের রাজনীতি করতে হয়। বাঙালি মুসলমান শ্রমিক কে লাভ জিহাদের অভিযোগে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হলে হত্যাকারীকে বীরের সম্মান দেওয়া হয়।
এই দেশটা কি সত্যিই আমরা চাইছি?
(ক্রমশ)