কাফিরনামা । পর্ব ২। লিখছেন রাণা আলম
শহর কলকাতার কবিরা শুধু যে বর্ষাকাল নিয়ে আদ্যিখেতা করেন অ্যামনটা নয় কিন্তু, জোব চার্ণকের শহরে নস্টালজিয়ার প্রোপাইটর অঞ্জন দত্তের দিব্যি, তারা শীতকাল নিয়েও সমানে এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে যান। তার সবচেয়ে ভালো প্রমাণ হচ্ছে মে মাসের গরমেই তারা সোসাল সাইটে ডাকাডাকি শুরু করে দ্যান,
“শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা’
ভেবে দেখুন সার, আদ্যিখেতার একটা লিমিট থাকা উচিত। শীতকাল কবে আসবে তা সুপর্ণা ক্যামন করে জানবেন? তিনি কি আলিপুর আবহাওয়া দপ্তরে চাকরি করেন? আর যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই, ভাস্কর চক্রবর্তী বর্ণিত সুপর্ণা কপালদোষে সেখানেই চাকরি করেন তাহলেও কি প্রশ্ন থাকা উচিত নয় যে কিভাবে ১৯৭১ থেকে তিনি একই পোস্টে চাকরি করে যাচ্ছেন?
তবে, পিকচার এইখানেই শেষ নয় কর্তা। বাঙালি তো একলাইনে থামার বান্দা নয়। কবি কে কোট করে তাপ্পর বাঙালি লেখে,
‘আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকবো’।
এইটে সার ‘ডাহা মিহা কহ্যা’। বাঙালি মোটেই তিনমাস ঘুমোনোর জন্য সুপর্ণাকে শীতকালের হদিস জানাতে বলেনা। তার উদ্দেশ্য আরও মহৎ। শীতকাল এলে বাঙালি জল সংরক্ষণে নামে। চানঘরে গান কোনোদিনই শীতকালের কথা ভেবে লেখা হয়নি। সে রোজ শীতের সকালে গামছার দিকে আতঙ্কে তাকিয়ে কড়ে আঙ্গুলে হিসেব কষে ডিও আর পারফিউম স্প্রে দিয়ে ঠিক কদিন চান ব্যাপারটাকে ঠেকিয়ে রাখা যায় আর চানঘরের দরজার দিকে আকুল নয়নে ব্যকুল চিত্তে দৃষ্টিপাত করে শক্তি চাটুয্যে টুকে নিজের মনকে শুধায়,
‘যেতে পারি, কিন্তু ক্যানো যাবো?’
তবুও শেষরক্ষা হয় না। মাঘ মাসের কনকনে শীতে কখনও সখনও যখন গায়ের গন্ধে নিজের নাককেই প্রবোধ দেওয়া যায়না, তখন দায়ে পড়ে গায়ে জল ঢালতেই হয় আর বাঙালি গুরুর শরণ নেয়।
‘হরি হে, দীনবন্ধু, তুমিই ভরসা’।
মুশকিল হচ্ছে এই যে দু-কিস্তি ধরে কবিদের নিয়ে অ্যাত্তো কিছু বকে যাচ্ছি এর কারণ টাও বলে রাখা দরকার। নইলে বলা যায় না, পেনাল কোডে আটকাতে পারে কি বলা যায় না মাননীয়া রাণাওয়াতের মত ধরে বেঁধে একটা ‘শ্রী’-ফিও গছিয়ে দিতে পারে, তখন আবার হাজারো বখেড়া হুজুরে হাজির হবে। তার আগে, এই বেলা কথাগুলো সোজাসুজি কয়ে নেওয়া ভালো।
সচরাচর কবিরা অমর, অজর, অবধ্য এবং কিছু ক্ষেত্রে অবোধ্যও বটে। আর বাঙালি কবিরা হচ্ছেন সর্বত্রগামী। আরশোলা থেকে অ্যাটম বোম, কিয়োটো চুক্তি থেকে বিশ্ববঙ্গ সম্মেলন, হেন জিনিস নেই যা নিয়ে তারা কবিতা লেখেন না। মুশকিল হচ্ছে যে তারা তো সাত কি সতেরো লাইন কবিতা লিখেই বইমেলায় দাঁত কেলিয়ে ছবি তুলতে যান। এদিকে বোর্ডের পরীক্ষায় দুলাইন কবিতা তুলে কোশ্চেন আসে যে কবি এইখানে কি বলতে চেয়েছেন?
তা কবি কি বলতে চেয়েছেন, ক্যানোই বা বলতে চেয়েছেন তা সটান কবি বাবাজীকেই জিজ্ঞেস করলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। খামোখা তেঁতুলিয়ার উমাসুন্দরী উচ্চবিদ্যালয়ের মাধ্যমিকের ছাত্র পনেরো বছরের আশুতোষ প্রামাণিক কে তার দশ নাম্বারের ব্যখ্যান দিতে বলা ক্যানো বাপু?
যেমন ধরুণ, কবিগুরু লিখেছেন, ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ’। আপনি শিওর ওটা সবুজ?? এরাজ্যে তো নীল-সাদার বাইরে কোনো রঙই হয় না কিনা। আর ‘চেতনা’ বলে কোনো রঙের কোম্পানির নামই বা কবি পেলেন কোথায়?
এইখানেই শেষ নয় সার। কবি লিখেছেন ‘সাঁকোটা দুলছে’। ক্যানো দুলছে, কোথায় কি ঘাপলা হয়েছে তার জবাবদিহি তো পূর্ত দপ্তরের দেওয়ার কথা, ক্লাস টেনের ওলিউল সেখ দিতে যাবে কোন দুঃখে? এসব আর্থিক দূর্নীতির ব্যাপারে সরলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের টেনে আনারই বা দরকার কিসের?
গড়পড়তা বাঙালির জীবনে কবিতাপ্রেম এবং মাধ্যমিক সচরাচর একবারই আসে। এবং বাঙালি মাধ্যমিক পরীক্ষা স্বেচ্ছায় দ্যায় না, তাকে দেওয়ানো হয়। ওই যে তারাপদ রায় লিখেছিলেন তার গল্পে সেই খুকিটির কথা যে গাল ফুলিয়ে বলেছিল,
‘আমি ইস্কুলে যাই না। আমাকে পাঠানো হয়’।
আমাদের মত আধ-বুড়ো যারা দু-দশক আগে মাধ্যমিক কোনোক্রমে পর্ষদের অপার ব্যর্থতায় একচান্সেই উতরে গেছে তাদের ঝুলিতে মাধ্যমিক নিয়ে কিসসা কিছু কম থাকার কথা নয়। আমাদের সময়ে ইংরেজি থেকে বাংলায় একটা অনুবাদ করার প্রশ্ন আসতো যেটা অনেকের কাছেই আতংক ছিল। সাধারণতঃ, আমরা, প্রফেশনাল ব্যাক বেঞ্চাররা মুখস্থ করে যেতাম ‘অব্যর্থ সাজেশন’ বা ‘শিওর সাকসেস’ থেকে। এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কিছু না বুঝেই। পরবর্তীকালে কলেজে পড়ার সময় আমার এক সহপাঠীও একই পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। কোশ্চেন পেপারের কোথাও তিনি ‘রেপ’ শব্দটা দেখলেই আলেকজান্দার পোপের ‘রেপ অফ দ্য লক’ এর চারপাতার উত্তর লিখে আসতেন। ফলাফল সবসময় সুখকর হত না, সেটা বলাই বাহুল্য।
ইশকুল মাস্টারিতে ঢুকে পোস্টিং পড়েছিল রাজবংশী অধ্যুষিত একটি প্রত্যন্ত গ্রামে। এক ছাত্রের নাম ছিল বিশু রবিদাস। বাবা প্লাস্টিকের কারখানায় কাজ করতেন। অসুস্থ। তাই বিশু টিফিনের পর ইশকুল পালিয়ে বড় রাস্তার ধারে ঝুরিভাজা বিক্রি করতো। টিফিন অব্দি অপেক্ষা করতে হত কারণ মিড ডে মিল না খেলে তাদের দুবেলা ভাত জুটতো না। খিদে বিষয়টা যে কোনো রোমান্টিক নস্টালজিয়ার উদাহরণ হতে পারেনা সেটা ব্যক্তি অভিজ্ঞতা না থাকলে হয়ত বোঝা সম্ভব নয়।
একদিন স্কুল শিক্ষা দপ্তরের আপিসে যাওয়ার সময় রাস্তা পার হবো। দেখলাম দামী বেসরকারি ইস্কুলের বাস ছাত্রদের নিয়ে এসে থামলো। আর ছেঁড়া জামা, হাফ প্যান্ট আর খালি পায়ের বিশু রবিদাস হাতে ঝুরিভাজা নিয়ে প্রাণপনে লাফিয়ে বাসের জানালা অব্দি পৌঁছাতে চাইছে যাতে আর দু প্যাকেট বিক্রি করা যায়। জানালার দুপাশে দুটো ভারতবর্ষ দাঁড়িয়েছিল সেদিন।
ইশকুলের চাকরি ছেড়ে মহানগরের পথে পা রাখার বছর তিনেক পর একদিন একটি অচেনা নাম্বার থেকে ফোনে রিং হচ্ছিল সমানে। একটু বিরক্ত হয়েই ধরলাম,
‘কে বলছেন?’
‘সার। আমি বিশু। বিশু বলছি’।, ওপার থেকে জোরে গলাটা ভেসে এলো।
‘কোন বিশু? চিনতে পারছি না তো?’
‘সার। আমি ঘোড়শালার বিশু রবিদাস। আপনার কাছে ইশকুলে পড়েছি’।
এবার চিনতে পারলাম। জিজ্ঞেস করলাম,
‘হ্যাঁরে বল। কি খবর?’
‘সার। আজ রেজাল্ট বেরিয়েছে। আমি মাধ্যমিক পাশ করেছি’।
এত আনন্দ আমার তুচ্ছ জীবনে খুব কমই পেয়েছি। মন ভরে আশির্বাদ করলাম। বললাম,
‘বাবা, পড়াটা ছাড়িস না’।
‘না সার। আমি পড়বো। কাজ করেই পড়বো। কলেজ অব্দি পড়বো’। , ওপার থেকে বিশুর আত্মপ্রত্যয়।
সালটা ২০২১ । বছর ছয়েক আগের সেই ছেঁড়া জামা, খালি পা আর হাফ প্যান্টের ঘোড়শালার বিশু রবিদাস আজ উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছে।
সব লড়াই কাগজে লেখা হয় না। সব লড়াই চোখে দেখে বোঝা যায় না।