কাফিরনামা । পর্ব ১২। লিখছেন রাণা আলম
আমাদের, যাদের পেটের দায়ে ফি হপ্তায় রোববার করে কলকাতা শহরটায় ফিরতে হয় তাদের প্রত্যেকের আকাঙ্ক্ষা থাকে ট্রেনের নন এসি কামরাতে একটি উইন্ডো সিটের। কিন্তু রেল দপ্তর তো আর শাসক দলের নেতাদের জন্য এসএসকেএম নয় যে চাইলেই আপনার কপালে অনলাইন রিজার্ভেশনে একটা পছন্দসই উইন্ডো সিট জুটবে।
আর এমনিতেই রেল দপ্তর যারা চালান তারা আজকাল সিটিং রিজার্ভেশনের হাল অ্যামন করে দিচ্ছেন যাতে তিন নম্বর সিটে আমার সাইজের বপু নিয়ে কেউ বসলে তার দুই-তৃতীয়াংশ বাইরে ঝুলে থাকতে বাধ্য। ফলে পুরো ট্রেন জার্নি ফেরিওয়ালা আর বাকি প্যাসেঞ্জারদের গুঁতো খেতে খেতে আপনার নিজেকে বঙ্গীয় লিবারাল মনে হতে পারে।
বা ধরা যাক, কপালগুণে আপনি উইন্ডো সিট পেয়েই গেলেন। জনাব, দাঁত ক্যালানোর আগে ট্রেনে উঠুন। দেখবেন, কারুর হয়ত বাচ্চার জানালার ধারের সিট টা খুবই দরকার। কারুর বা সদ্য বিবাহিতা বউ এর পাশে বসার জন্যই আপনার উইন্ডো সিট লাগবে, আপনি কোন জাতের হাড্ডি হয়ে সেখানে বসতে পারেন অথবা অন্য কোনো মহাজাগতিক কারণেই উইন্ডো সিট টা আপনার ছাড়া দরকার।
ওই মুহুর্তে আপনি ‘এ আর অ্যামন কি, আমি তো এসি কামরাতেও উইন্ডো সিট ছাড়তে পারি’ গোছের বিনয় অবতার সেজে শাসক দলে বর্তমানের রাজীব ব্যানার্জির মত মুখ করে তিন নম্বর সিটে বসতে যাবেন।
এর থেকেও খারাপ ঘটতে পারে। কহপ্তা আগে এরমই একটা উইন্ডো সিট পেয়ে বেশ জম্পেশ করে ঘুম দেবো ভাবছিলাম। পরের স্টেশনে এক ভদ্রমহিলা উঠলেন। তার ধারণা ছিল যে উইন্ডো সিট টা তারই। সেটা যে নয় তা স্পষ্ট হবার পর মুঠোফোনে গজগজ মুখে কাউকে ধরে কড়া গলায় ধমকে কইলেন,
‘হ্যাঁগো, তোমায় যে এত করে বল্লুম উইন্ডো সিট ছাড়া আমি বসতে পারিনে। তাও এই মাঝের সিটের টিকিট কেটেছো। এই গরমে এট্টু বাতাস না পেলে আমি যাবো কি করে? তোমার কি আক্কেল বলে কিছু নেই? একটা এসি টিকিট কাটতে কি হচ্ছিল? নিজের বেলা হলে তো ঠিক কাটতে। আমি বাপের বাড়ি যাচ্ছি বলেই কি ইচ্ছে করে নন এসি’র মিডল সিটের টিকিট কেটেছে?’
ওপারের ভদ্রলোক নিশ্চয়ই কিছু মিনমিন করে বলার চেষ্টা করছিলেন নিজের ডিফেন্সে। কিন্তু এপারের ভদ্রমহিলা কিছুতেই তা শুনতে রাজী ছিলেন না। কিছুক্ষণ এই একতরফা মিসাইল হানা চলার পর ফেলোফিলিং এ বাধ্য হয়েই ভদ্রমহিলাকে বললাম,
‘দিদি, আপনি এই উইন্ডো সিটে বসুন। আমি ওপাশের থার্ড সিটে গিয়ে বসছি’।
এইখানেই শেষ নয় সার।
ওপাশে এক দম্পতি যাচ্ছেন। সাথে তাদের বছর পাঁচের সন্তান। কলকাতা ফিরছেন তারাও। খানিক আলাপ হবার পর জানালেন তাদের সন্তান অত্যন্ত ব্রাইট। এখনই ইস্কুলে যে পরিমাণ মেডেল পাচ্ছে তাতে আইনস্টাইন না হোক সত্যেন বোস হওয়া কপালে একরকম বাঁধাই আছে বলা চলে। এখন সবার বাবা-মায়েরই মনে হয় যে তার সন্তান কালেক্রমে তালেবর হবে, হয় হাইকোর্টের জজ নয় তো তৃণমূলের ওয়ার্ড কাউন্সিলর।
এবং এইরম প্রতিভাবান বাচ্চাদের বাবা-মা’দের নিয়ে বেশ আতংকে থাকি আজকাল। তারা দেখা হলেই বাচ্চাকে ডেকে বলেন,
‘ আংকেল কে একটা রাইম শোনাও তো’।
ওইটুকু বাচ্চা বাড়ির অতিথির সামনে ‘রাইম’ না শোনালে মহাভারত অশুদ্ধ হবার কথা ছিল না। কিন্তু বাচ্চা কত প্রতিভাবান সেইটে প্রমাণ করার দায় অভিভাবকরা স্বেচ্ছায় তুলে নিয়েছেন।
এবং মোটা মাথায় আরেকটা জিনিস বোধগম্য হয় না, বাঙালি বাবা-মা তার সন্তানকে প্রথমেই কোনোকিছুর ইংরেজি প্রতিশব্দ শেখানোর দিকে জোর দ্যান ক্যানো? আম কে আম হিসেবে না চিনে ;ম্যাঙ্গো’ নামে ডাকলে কি সোসাল এলিটিজম এ এন্ট্রি পাওয়া যায়?
অথচ, এদের অনেকেই সোসাল সাইট ভরিয়ে লিখবেন, ‘আমি গর্বিত বাংলা মিডিয়াম’।
কিন্তু তাদের ছেলে মেয়ে বাংলা অনেক ক্ষেত্রেই প্রথম ভাষা হিসেবে শিখবে না। ওটা তখন আর প্রয়োজনীয় মনে হয় না।
আর ক্লাস টুয়ের বাচ্চারও গোটা পাঁচেক করে ট্যুইশনি থাকে আজকাল। সে মনের আনন্দে মাঠে খেলতে যায় না কি ছবি আঁকেনা, অ্যামনকি অলস দুপুর বারান্দায় বসে রাস্তার দিকে তাকিয়েও থাকে না। তাকে ড্রয়িং কি ক্যারাটে ক্লাসে পাঠানো হয়, তার জীবন থাকে ঘড়ির কাঁটায় বাঁধা। এইট কি নাইনে উঠতেই সে আকাশ অথবা অন্যকোনো কোচিং ক্যাম্পে নীটের জন্য ভর্তি হয়ে যায়। সে কখনও কাটা ঘুড়ির পিছনে ছোটেনা, গরমের ছুটিতে গল্পের বই পড়েনা, তার বাবা-মা তার জীবন থেকে শৈশব আর কৈশোরের অনেকখানি চুরি করে নেন। মানুষ হবার বদলে কেরিয়ার সর্বস্ব মেশিন তৈরী হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে।
এক সমাজকর্মী শুনিয়েছিলেন পরের গল্পটা। কলকাতার কোনো ‘পশ’ জায়গায় পরপর দোতলা বড় বাড়ি। আলো জ্বলে হয়ত একটা বা দুটো ঘরে। বাকি বাড়ি অন্ধকার ভূতের মত দাঁড়িয়ে। ছেলে মেয়ে বিদেশে। দু বছর বা তিন বছরে একবার ফেরে। বাড়িতে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা একা থাকেন। পাড়ার লোক আর সমাজকর্মীরা খোঁজ রাখেন। সকালে বা বিকেলে পাড়ার মোড়ে চায়ের দোকানে নতুন লোক পেলে বৃদ্ধ বাবা হাসিমুখে জানান,
‘জানেন, আমার ছেলে আমেরিকায় থাকে’।
‘আমেরিকা???’, আগন্তুকের গলায় সমীহ ঝরে পড়ে।
সেই ‘সমীহের দৃষ্টি’ টুকু নিয়ে একা বৃদ্ধ বাড়ির দিকে হেঁটে চলেন।
প্রশস্ত রাজপথের নিয়ন আলোয় অকথিত শূন্যতা ঝরে পড়ে। পৃথিবী এইভাবেই রোজ আরেকটু করে গরীব হয়।
আর, আমরা বাচ্চাদের নতুন থেকে নতুনতর ইঁদুর দৌড়ে নামিয়ে যাই।
হতে পারে তারা খুন হচ্ছে রোজ, কিন্তু এই রক্ত তো বাইরে দেখা যায় না। তাই ভাবনাও থাকে না।
(ক্রমশ)