ইতিহাসের পথে পথে : একটি ক্রিকেট আলেখ্য। পর্ব : সাতাশ। লিখছেন সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়

0

(গত পর্বের পর)

অস্ট্রেলিয়া ১৯৮৬/৮৭ সাল নাগাদ ভারতে খেলতে এসে প্রথম টেস্টেই ইতিহাস সৃষ্টি করে অস্ট্রেলিয়া। মাদ্রাজ টেস্টের কথা না বলে থাকা খুব কঠিন। বুন (১২২), জোন্স (২১০) ও বর্ডারের (১০৬) সেঞ্চুরী অস্ট্রেলিয়াকে ৫৭৪/৭ এ নিয়ে যায়। শিবলাল যাদব (৪/১৪২) কেবল মাত্র ভালো বল করেন। জবাবে ভারত দ্রুত গতিতে রান তুলতে শুরু করে। যদিও গাভাস্কার, অমরনাথ ও শ্রীকান্ত (৫৩) ৬৫ রানের মধ্যে আউট হয়ে যান, কিন্তু আজহার (৫০), শাস্ত্রী (৬২) ও পন্ডিত (৩৫) দলকে টেনে নিয়ে যান। যদিও মোরে (৪) আউট হতে ভারত বেশ সমস্যায় পড়ে যায়। তখন ২৪৫/৭। তখনও ১২৬ রান বাকি ফলো অন বাঁচাতে। কপিলদেব ও চেতন শর্মা তৃতীয় দিনের শেষে ভারতকে পৌঁছে দিলেন ২৭০/৭ এ। চতুর্থ দিনের সকালে কপিল বিধ্বংসী হয়ে ওঠেন। চেতন (৩০)  ৩৩০ রানের মাথায় আউট হলেন। জুটিতে উঠলো ৮৫ (৭৫ মিনিটে)। নবম উইকেটে শিবলাল যাদব (১৯) কে সঙ্গে নিয়ে ৫৮ মিনিটে ৫৭ উঠলো। শেষে মনিন্দর সিং শূন্য করে অপরাজিত থাকলেন। ভারত ৩৯৭। কপিল ১৩৮ বলে ১১৯। অস্ট্রেলিয়া ১৭৭ রানে এগিয়ে গেলো। গ্রেগ ম্যাথুজ ১০৩ রানে ৫ উইকেট পান।

অস্ট্রেলিয়া দ্রুত গতিতে ৪৯ ওভারে ১৭০/৫ তুলে ইনিংস ঘোষণা করে দেয়। পঞ্চম দিন ভারতকে জিততে হলে সারা দিন ব্যাট করে ৩৪৮ করতে হবে। শ্রীকান্ত (৩৯) যথারীতি আক্রমন শুরু করলেন। ৭৫ মিনিটের মধ্যে ৫৫ রান ওঠার পর শ্রীকান্ত আউট হলেন স্টিভ ওয়র হাতে ক্যাচ দিয়ে ম্যাথুজের বলে। নামলেন মহিন্দর অমরনাথ (৫১)। লাঞ্চের আধ ঘণ্টা বাদে তিনি যখন আউট হলেন তখন ভারত ১৫৮। গাভাস্কার তখনও ব্যাট করছেন। নামলেন আজহার (৪২)। চা পান বিরতির আধ ঘণ্টা আগে আউট হলেন গাভাস্কার। তখন ভারত ২০৮/৪। গাভাস্কার ৯০ করেন। এইবার ভারতের মনে হলো বাকি সময়ে ১৪০ রান, হার্ড হিটার ব্যাটার আছে, হাতে প্রায় ৪০/৪৫ ওভার (একটু বেশিই হতে পারে); চেষ্টা করে দেখা যাক। আজহার ও পন্ডিত (৩৭ বলে ৩৯) ৪৭ রান তুলে ফেললো। আজহার আউট হলেন ২৫১ রানের মাথায়। চায়ের পর আধঘন্টা কেটেছে। তখনও প্রায় ৩০ ওভারের বেশী বাকি। কপিল এবার ব্যর্থ। নামলেন শাস্ত্রী এবং পন্ডিত কে সঙ্গে নিয়ে ২৯১ রান অবধি টানলেন। পন্ডিত আউট। তখনও প্রায় এক ঘণ্টা খেলা বাকি। পরের আধ ঘন্টা খানেক সময়ে ভারত ৪০ রান যোগ করলো। চেতন শর্মা (২৩) যখন আউট হলেন তখন ৩৩১/৭। আর ২০/২৫ মিনিটে দরকার ১৭ রান। মোরে এলেন আর গেলেন। কিন্তু যাদব (৮) ১৩ রান যোগ করে যখন আউট হলেন তখন ভারত ৩৪৪। শেষ দশ মিনিটে দরকার ৪ রান। ম্যাথুজের বলে মনিন্দর এলবিডব্লিউ হন, যদিও আউট নিয়ে সন্দেহ আছে; কিন্তু ঘটনা হলো তখন ভারত ৩৪৭। শাস্ত্রী অভূতপূর্ব আক্রমনাত্মক (৪০ বলে ৪৮ অপরাজিত) ব্যাট করেন। সেই আউটই ম্যাচটিকে পৃথিবীর ক্রিকেটের ইতিহাসে দ্বিতীয় (অদ্যাবধি) টাই টেস্টে পরিণত করেছে।

বৃষ্টির জন্য দ্বিতীয় টেস্টে শেষ দিন ছাড়া খেলা হয়নি। ম্যাচ ড্র হয়। বোম্বের তৃতীয় টেস্টে অস্ট্রেলিয়া যাদব (৪/৮৪) ও অভিষেক টেস্ট খেলতে নামা রাজু কুলকার্নির (৩/৮৫) জন্য বেশি রান তুলতে পারেনি (৩৪৫)। জিওফ মার্শ কেবল ১০১করেন। জবাবে ভেঙ্গসরকার (অপরাজিত ১৬৪), গাভাস্কার (১০৩) ও শাস্ত্রী (অপরাজিত ১২১) করায় ভারত ৫১৭/৫ তোলে। ষষ্ঠ উইকেটে শাস্ত্রী ও ভেঙ্গসরকার ২৯৮ রানের অপরাজিত জুটি গড়েন। এরপর অস্ট্রেলিয়া ২১৬/২ রান তোলার পর ম্যাচ ড্র হয়। বর্ডার অপরাজিত ৬৬, জোন্স অপরাজিত ৭৩ করেন।

অস্ট্রেলিয়া যখন ভারতে খেলছে, ইংল্যান্ড তখন অ্যাসেজ খেলতে অস্ট্রেলিয়া পৌঁছে গেছে। ভারতে খুব বেশি সফল না হয়ে দেশে ফিরে নভেম্বরে ব্রিসবেনের প্রথম টেস্টে মুশকিলে পড়লো অস্ট্রেলিয়া। বোথাম (১৩৮), অ্যাথে (৭৬), গ্যাটিং (৬১), গাওয়ার (৫০) এর জন্য ইংরেজরা ৪৫৬ তোলে। কিন্তু ডিলে (৫/৬৮) ডমিনিয়ন স্ট্যাটাস পাওয়া অ্যান্টিপোডিয়ান গ্রীষ্মের দেশটিকে ২৪৮ রানে ফেলে দেয়। জিওফ মার্শ (৫৬) ও ম্যাথুজ (অপরাজিত ৫৬) ছাড়া কেউ দাঁড়াতেই পারেনি। ফলো অন খেয়ে অস্ট্রেলিয়া জিওফ মার্শের ১১০ এর জন্য কোনমতে ২৮২ করে। এম্বুরি (৫/৮০) ও ডেফ্রিয়াস (৩/৬২)। ব্রিটিশরা ২২.৩ ওভারে ৭৭/৩ তুলে ৭ উইকেটে জয়ী হয়।

পার্থের দ্বিতীয় টেস্ট ছিল রানের পিচ। ক্রিস ব্রড (১৬২), গাওয়ার (১৩৬), জ্যাক রিচার্ডস (১৩৩) ও অ্যাথে (৯৬) দারুন ব্যাট করায় ইংল্যান্ড ৫৯২/৮ তোলে। ব্রুস রিড (৪/১১৫) ও ম্যাথু (৩/১১২) মোটামুটি ভাল বল করেন। বর্ডার (১২৫) ও স্টিভ ওয় (৭১) ছাড়াও বাকিরা ভালো সঙ্গত দেওয়ায় অস্ট্রেলিয়া ৪০১ করে। ডিলে (৪/৭৯) বল হাতে সফল হন।

দ্বিতীয় ইনিংসে গ্যটিং (অপরাজিত ৭০) করে দলের ১৯৯/৮ এ ইনিংস সমাপ্তি ঘোষণা হয়। স্টিভ ওয় ৬৯ রানে ৫ উইকেট নেন। অস্ট্রেলিয়ার লক্ষ্য ছিল ৩৯১ রান (এক যুগ পর ইতিহাস উল্টে যাবে; এই অতি সাহস ইংল্যান্ডের পতন ও অস্ট্রেলিয়ার উত্থান ঘটাবে)। জোনস (অপরাজিত ৬৯) ও মার্শ (৪৯) করেন। ৯৭ ওভারে ১৯৭/৪ তোলার ম্যাচ ড্র হয়।

এডিলেটের তৃতীয় টেস্টও ড্র হয়। অস্ট্রেলিয়া ৫১৪/৫ করে। বুন (১০৩), মার্শ (৯৩), বর্ডার (৭০), ম্যাথু (অপরাজিত ৭৩), স্টিভ ওয় (অপরাজিত ৭৯) প্রচুর রান করেন। ইংল্যান্ড ও ৪৫৫ তোলে। ব্রড (১১৬), গ্যাটিং (১০০), অ্যাথে (৫৫), এম্বুরী (৪৯) করেন। রিড ৬৪ ও স্লিপ ১৩২ রানে ৪ টি করে উইকেট নেন। এরপর অস্ট্রেলিয়া ২০১/৩ তোলে। বর্ডার অপরাজিত ১০০ করেন। ইংল্যান্ড দ্বিতীয় ইনিংসে ২৩ ওভারে ৩৯/২ তোলার পর ড্র হয়। কোনও চেষ্টাই করেনি তারা।

এরপর মেলবোর্নের বক্সিং ডে টেস্টে (চতুর্থ টেস্ট) ইংল্যান্ড ইনিংসে হারিয়ে দেয় অস্ট্রেলিয়াকে ও সিরিজ জয় করে। বোথাম (৫/৪১) ও স্মল (৫/৪৮) অস্ট্রেলিয়াকে ১৪১ রানে ফেলে দেয়। ব্রডের ১১২ ইংল্যান্ডকে ৩৪৯ অবধি নিয়ে যায়। ম্যাকডরমট (৪/৮৩) ও রিড (৪/৭৮) প্রচুর লড়াই করেন। মার্শ (৬০) ও স্টিভ ওয় (৪৯) প্রচুর লড়লেও ১৫৩/৩ থেকে ১৯৪ এ পতন আটকাতে ব্যর্থ হন।

সিডনির পঞ্চম টেস্টে ঘুরে দাঁড়ালো অস্ট্রেলিয়া। জোনসের অপরাজিত ১৮৪ অস্ট্রেলিয়াকে ৩৪৩ অবধি নিয়ে যায়। স্মল ৭৫ রানে ৫ উইকেট নেন। এডমন্ডস ৭৯ রানে ৩ উইকেট নেন। জবাবে ইংল্যান্ড মার্ভ হিউজের বোলিংয়ের সামনে (৬/৭৮) আত্মসমর্পন করে। গাওয়ার (৭২) আর এমবুরি (৬৯) কিছুটা টানেন। রিচার্ডস (৪৬) সামান্য লড়াই করেন। ইংল্যান্ড ২৭৫ করে। এরপর অস্ট্রেলিয়া স্টিভ ওয় (৭৩), বর্ডার (৪৯) আর পিটার টেলরের (৪২) জন্য ২৫১ তোলে। এম্বুরে (৭/৫১) অসাধারণ বল করেন। ইংল্যান্ডের চতুর্থ ইনিংসে দরকার ছিল ৩২০ রান। গ্যাটিং এর ৯৬ সত্বেও ২৬৪ রানে তাঁরা অল আউট হয়ে ৫৫ রানে হেরে যান। স্লিপ ৭২ রানে ৫ উইকেট নেন।

প্রায় এক বছর পর অস্ট্রেলিয়া আবার টেস্ট খেলতে নামে ১৯৮৭ সালের ব্রিসবেনে। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাকডরমট (৪/৪৩) আর কিম হিউজ (৩/৪০) বিধ্বংসী হওয়ায় ১৮৬ রানেই কিউই দল ইনিংস শেষ করে। মরিসন (৪/৮৬) আর হ্যাডলি (৩/৯৫)  দারুন বোলিং করলেও বুন ১৪৩ করলে অস্ট্রেলিয়া ৩০৫ রান করে। রিড (৪/৫৩) আর ম্যাকডরমট (৩/৭৯) ভালো বল করলে কেবল দীপক প্যাটেলের (৬২) জন্য দল ২১২ করে। অস্ট্রেলিয়া ১ উইকেট হারিয়ে রান তুলে নেয়।

অস্ট্রেলিয়া এডিলেট টেস্ট অবশ্য ড্র করে। ব্যাপক রান ওঠে। নিউজিল্যান্ড প্রথম ইনিংসে ৪৮৫ তোলে। জোনস (১৫০) আর মার্টিন ক্রো (১৩৭) শতরান করেন। জবাবে অ্যালান বর্ডারের ২০৫ ও স্টিভ ওয় (৬১), স্লিপ (৬২), ডায়ার (৬০) মিলে অস্ট্রেলিয়া কে ৪৯৬ অবধি নিয়ে যায়। জোনসের ৬২ রানের দৌলতে নিউজিল্যান্ড ১৮২/৭ তোলার পরে ম্যাচ ড্র হয়ে যায়।

মেলবোর্নের তৃতীয় টেস্ট ও ড্র হয়। তবে নিউজিল্যান্ড প্রায় জিতে যাচ্ছিল। প্রথমে ব্যাট করে নিউজিল্যান্ড ৩১৭ তোলে মার্টিন ক্রো (৮২) ও জন রাইটের (৯৯) জন্য। ম্যাকডরমট (৫/৯৭) ও হুইটনি (৪/৯২) মিলে উইকেট ভাগাভাগি করে নেন। হ্যাডলির দাপটে (৫/১০৯) ১৭০/৬ হয়ে গেলেও ৩৫৭ করে অস্ট্রেলিয়া; মূলত স্লিপ (৯০), স্টিভ ওয় (৫৫) ও ডোডমেড (৫০) এর জন্য। এরপর মার্টিন ক্রো (৭৯) লড়াই করে নিউজিল্যান্ডকে ২৮৬ অবধি টানেন। ডোডমেড ৫৮ রানে ৬ উইকেট নেন। ২৪৭ করলে জিতবে এই অবস্থায় ২২৭/৯ হয়ে গিয়ে শেষ উইকেটে ২৩ মিনিটে প্রায় ৫/৬ ওভার কাটিয়ে ২৩০/৯ এ শেষ করে অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ ড্র করে। বুন কেবল ৫৪ করেন। হ্যাডলি আবার পাঁচ উইকেট নেন (৫/৬৭)।

এরপর ইংল্যান্ড এক ম্যাচের অ্যাসেজ খেলতে এসে ড্র করে। জানুয়ারির শেষে সিডনিতে ইংল্যান্ড প্রথমে ব্যাট করে ৪২৫ করে। ব্রড ১৩৯ করেন। টেলর (৪/৮৪) ভালো বল করেন। এরপর অস্ট্রেলিয়া ২১৪ রানে অল আউট হয়ে যায়। জোনস কেবল ৫৬ করেন। ফলো অন করে অস্ট্রেলিয়া ৩২৮/২ করে ম্যাচ ড্র করে। বুন অপরাজিত ১৮৪ করেন।

আগামী ৮ মাস কোনও টেস্ট ছিল না।

(ক্রমশ)

 

 

 

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *