ধূসর চিলেকোঠা। পর্ব ১। লিখছেন শেখর সরকার

0

অবিনাশ সবে তখন চোদ্দর গণ্ডিতে পা দিল। তার সহপাঠীরা যখন স্ব-স্ব নব্য যৌবনের রকমারি কারসাজিতে ব্যস্ত, সমস্ত নিয়ামতপুর যখন নিদ্রালু দুপুরের ঘুমে নাক ডাকছে — কিছু অসাদৃশ্য ঘটনা এই গ্রামে ঘটছিল। সেসব ঘটনা আজও তাকে দুঃস্বপ্নের মত তাড়া করে।

গ্রামের একমাত্র প্রাইমারি স্কুল যাওয়ার রাস্তায় শিবচণ্ডী পাট নামে একটি  কৃত্রিম হ্রদ তৈরি হয়েছিল। নিয়ামতপুর গ্রাম উন্নয়ন প্রকল্পের একশো দিনের কাজের আওতায় এলাকার গ্রামের প্রধান নিজের নিচু জমির উপর এই জলাশয়ের জন্ম দেন। বিভিন্ন লোকপূজার জন্য এলাকার লোকজন এই হ্রদের ধারে কালি পূজায় অমাবস্যার রাতে জড়ো হত নিজের নিজের মনস্কামনা পূরণ করার জন্য। এই সমাবেশ আজ এক ছোটোখাটো বার্ষিক মেলাতে পরিবর্তিত হয়েছে । কিন্তু অতীতে নিয়ামতপুর গ্রামে মেলার অস্তিত্ব বলতে কিছু ছিল না। দশরথ চক্রবর্তী ঘোষণা করলেন যে, পাটে শুধু কালি পূজার মেলাই হবে। গ্রামে ব্রাহ্মণদের প্রতাপ থাকা সত্ত্বেও, গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান সদানন্দ দাস লৌকিক দেবতা মাশান  পূজাতে সম্মতি প্রদান করলেন।

সমস্ত ভারতবর্ষের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে অনেক পিছিয়ে পড়েছে নিয়ামতপুর। শুধুমাত্র দৈনিক সংবাদপত্র হল গ্রামের সাথে বহির্বিশ্বের যোগাযোগের একমাত্র রাস্তা।  তাও আবার সেই কাগজ একদিন পর সদানন্দ বাবুর দোকানে প্রকট হয়। অবিনাশ মনে করে নিয়ামতপুর যেন আমেরিকাতে। কারণ সে ভূগোলে পড়েছে আমেরিকা ভারতের থেকে সবসময়ই একদিন পিছিয়ে থাকে। বাবার অবর্তমানে অবিনাশ নিজেদের দোকান চালায়। গ্রীষ্মের ঝিরিঝিরি বর্ষা যখন চণ্ডীপাট ও নিকটবর্তী এলাকাতে সবুজের সঞ্চার করছে, সেই সময়ে অবিনাশের চোয়াল জুড়ে হাল্কা হাল্কা পুরুষত্বের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। সদানন্দ বাবু একদিন দুঃখভরে বললেন, “অভির মা যদি আজ বেঁচে থাকত, তাহলে আজ হয়ত জন্মদিনটা ভাল করে পালিত হত।” কিন্তু অবিনাশ জানে এসব হল এক ছুতো। সে তার বাবার কৃপণতাকে হাড়ে হাড়ে চেনে। দিন যত এগোতে থাকে সময় আরও পেছয় নিয়ামতপুর গ্রামে।

ইন্দিরা গান্ধির হত্যার একদিন পর, অবিনাশদের দোকানে যখন দৈনিকটি আসল, ততক্ষণে গ্রামে দু’জন লোকের হৃদরোগে মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। হঠাৎ করে প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুর খবর কীভাবে একটি পুরো গ্রামকে শোকে বিহ্বল করে তুলল, অবিনাশ তা আন্দাজ করতে পারল না। সেরাতে ঘুমানোর সময় তার বাবার গায়ের উপর একটা পা তুলে দিয়ে বলল, “বাবা, প্রধানমন্ত্রী মরলে কী হয়? দেশ কি অচল হয়ে পড়ে?” সদানন্দ তাঁর স্বভাবচিত ভঙ্গিতে অবিনাশের পা-টিকে নামিয়ে দিয়ে বললেন, “তুই কী বুঝবি রে মূর্খ ! তিনিই একমাত্র মহিলা যিনি পুরুষ ছিলেন।” অবিনাশ বাংলা ব্যাকরণে বিশেষ পোক্ত নয়, তবুও তার কাছে এই ‘পুরুষোচিত মহিলা’-র ধারণাটি এক নতুন চিন্তার জন্ম দিয়েছিল। আসন্ন কালিপূজার মেলা যখন ইন্দিরা গান্ধির শোক যাপনের জন্য স্থগিত রাখা হল, গ্রামের সাঁওতাল লোকেরা এই খবর ছড়িয়ে দিল যে সমস্ত গ্রামবাসী মিলে মাশান পূজার বিরুদ্ধে একজোট হচ্ছে। দশরথ চক্রবর্তীর উপস্থিতিতে গ্রামের সবাই এবার মাশান পূজা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিল। আর এতে গ্রামে দশরথ চক্রবর্তীর প্রতাপও বজায় থাকল।

নিয়ামতপুর গ্রাম চারটি অঞ্চলে বিভক্ত। গ্রামের মুসলিম ও সাঁওতাল লোকের বসতি রাস্তার পূর্বদিকে। এই মুসলিম এবং সাঁওতাল পাড়ার ঠিক মাঝখানে একটি প্রাইমারি বিদ্যালয়। গ্রামের পশ্চিম দিকে রয়েছে চাষি সম্প্রদায়ের বসতি। আর গ্রামের দক্ষিণ কোণে রয়েছে কিছু ব্রাহ্মণ পরিবারের বাস। আগত কালিপূজার মেলার হঠাৎ করে বন্ধের খবর শুনে শুধু অবিনাশ নয়, পুরো গ্রামের চেহারার বদল হয়ে গেল। একে অপরের ওপর তির্যক চোখ উঠল। ধীরে ধীরে সারা গ্রামকে দাগ কেটে ভাগ করা হল অদৃশ্য সমান্তরাল রেখাতে। অবিনাশ যে কোনও ঘটনার আঁচ সবার আগে অনুভব করতে পারত। তাদের দোকানের সামনে রাখা বসার জায়গাটি অনেকটা আড্ডা দেওয়ার স্থান — বয়োজ্যেষ্ঠ, কনিষ্ঠ সবাই জমা হত এখানে। দোকানে রাখা দৈনিকটি হাতে হাতে ঘুরত। দোকানে বসে অবিনাশ যখন গ্রামের বৃদ্ধ লোকেদের কথা শুনত, সদানন্দ বাবু  তাকে গালি দিতে গিয়ে বলত “তোর দুধ-দাঁতটা পড়ে গিয়েছে, যদি চাস তো আমি আবার লাগিয়ে দিতে পারি।”   শারীরিক ও মানসিক হিংসা কক্ষনও সে দেখেনি, তবে অবিনাশ একটা আঁচ অনুভব করছে। এ গ্রামে ভবিষ্যৎ বাণী করার এক্তিয়ার শুধু দশরথদের পরিবারের আছে — অবিনাশ সেটা জানে।

কালিপূজার রাতের ঠিক আগের রাত। মাঝরাতে সবাই যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, রাস্তায় অবিনাশ কিছু দ্রুত পদচারণার শব্দ শুনতে পায়। আগে সে কখনও এরকম শোনেনি। ঘুমের ঘোর কাটিয়ে যখন সে জানালা খুলে চাইল, দু-তিনটে অদ্ভুত দৃশ্য তাঁর চোখে পড়ল। দু’টি লোক হাতে মশাল নিয়ে এগিয়ে চলছে চণ্ডীপাটের দিকে। তার পেছনে আরেকটি লোক অদৃশ্য ছায়ার মত দৌড়ে চলছে।

অবিনাশ আগের দিন রাতে কী দেখেছে সেটা তার বাবাকেও বলল না। বাড়ির সামনে থেকে নিমের ডাল ভেঙ্গে দাঁতন বানিয়ে, অবিনাশ সকাল সকাল হাঁটতে বেরিয়ে পড়ল চণ্ডীপাটের দিকে। দ্রুত গতিতে পা বাড়িয়ে চলল। সকাল বেলায় তিন-চার জন গ্রামবাসীকে প্রাতঃক্রিয়া কালীন পরিস্থিতিতে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। তবে তার চোখ এড়ালো না চণ্ডীপাটের পাশে ছোটো ব্রিজের নীচে কিছু তাজা পায়ের নিশান। সমস্ত জিনিস অবিনাশের কাছে গোলকধাঁধার মত লাগছে। আর সময় অপচয় না করে সে বাড়িতে ফিরে এল। ততক্ষণে সদানন্দ ধূপ-ধুনো দিয়ে দোকান খুলে দিয়েছে। বাড়ির পেছনের রাস্তা দিয়ে প্রবেশ করাটাই অবিনাশ শ্রেয় মনে করল।

অবশেষে অবিনাশের প্রতীক্ষার রাত, নিয়ামতপুরের নিয়ম ভাঙ্গার রাত — সবই একসাথে কালিপূজার রাতে একত্রিত হল। গ্রামের সাঁওতালরা রাজনৈতিক ফরমান না মেনে সন্ধ্যাবেলায় জড়ো হয়েছিল চণ্ডীপাটের তীরে। রাত হতে না হতেই সবাই নিজের নিজের ঘরে ফিরে গেল। একটি সময়ের ধারণা কিছু মানুষ উৎপত্তি করে সময়কে ধ্বংসের জন্য। এই সময়ই যখন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মানুষকে জাঁতাকলে ফেলে দেয়, তখন মানুষ সময়ের নতুন সংজ্ঞার খোঁজে লেগে যায়। ঘুমোতে যাওয়ার ঠিক আগে, ঘড়ির বড় কাঁটাটি যখন হাঁফ ছেড়ে ছেড়ে এগিয়ে চলছে, সমস্ত নিয়ামতপুর যখন দু’প্রহরের ঘুম দিয়ে উঠে আবার উপপল্লবের তাড়নায় ঘুমিয়ে পড়ল, অবিনাশের কানে ভেসে এল এক মানুষের চিৎকার। এক অদ্ভুত গগনভেদী আওয়াজ! অবিনাশ ঘরে থাকতে পারছে না, তার মন উচাটন করছে। বেশ কিছুক্ষণ চোখ মেলে শুয়ে থাকার পর অবিনাশ ঘুমিয়ে পড়ল।

সকাল সকাল পুরো ব্লক জুড়ে খবর ছড়িয়ে পড়ল খুন হয়েছেন দশরথ চক্রবর্তী। অবিনাশ বিশ্বাস করতে পারছে না যে খুন হওয়ার আগের দিন সে গ্রামের ব্রাহ্মণ পাড়াতে গিয়ে এই ব্যাক্তিটির কাছে নিজের হাত দেখিয়ে এসেছে। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল গ্রামের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে খুঁটিনাটি বিবরণ জানা। প্রশ্নের উত্তরে দশরথ তোতার সামনে দু’টো কাগজ রেখে ছেড়ে দিলেন। তোতাটি শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। দশরথ তাকে বলেছিলেন যে, গ্রামে এক দুর্যোগ কড়া নাড়ছে। কিন্তু সেই দুর্যোগের সূত্রপাত যে তাঁর থেকেই হবে, ঘুণাক্ষরে কেউ টের পায়নি। দশরথের মৃত্যু হয়েছে চণ্ডীপাটের দক্ষিণ দিকে। রবি শস্যের সময়ে জলের আকাল থেকে বাঁচার জন্য অনেক কৃষক রাতের বেলা হ্রদ পাহারা দেয়। নিজের জমি পর্যবেক্ষণ এবং নৈশকালীন ভ্রমণের জন্য প্রায়ই দশরথ নিজের জমিতে আসতেন।

দেখা গেল তাঁর মৃতদেহ খড়ের উপর পড়ে রয়েছে। পেটের মধ্যে কেউ রামদা দিয়ে এ ফোঁড় ও ফোঁড় করে দিয়েছে। মুখে রক্ত ও পানের দাগ আলাদা করে চেনা যাচ্ছে। ফিনকে পড়া রক্ত-ভেজা ধুতি যেন এখন লাল পাড় সাদা শাড়ী। মৃতের পরিবারের লোকজনের হাতে একদিন পর দেহ তুলে দেওয়া হল। অঞ্চল ওসি প্রমোদ সমাদ্দার পুরো এলাকা গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, এর পেছনে মাশান দেবতার হাত রয়েছে। খুনি জড়ো করে রাখা খড়ের পালের পেছনে ওঁত পেতেই বসে ছিল — শুধু শিকারের অপেক্ষা করছিল। এই মৃত্যুর পর, অবশ্যম্ভাবী দায়টি বর্তায় সাঁওতাল সমাজের উপর। তাদের বার্ষিক উৎসবের দুধে চোনা ফেলেছিলেন এই দশরথই। প্রমোদ সমাদ্দারকে কিছুদিন নিয়ামতপুরে জীপ নিয়ে ঘুরতে দেখা গেল। অবশেষে জনরোষ থেকে বাঁচতে, সমাদ্দারবাবুকে অভিযুক্ত রামধিন বেসরাকে ছেড়ে দিতে হল। পুরো গ্রামের ভেতরে চলছে একটা চাপা সন্ত্রাস। সবাই একে অপরকে সন্দেহভাজন দৃষ্টিতে দেখছে। কে-ই বা হতে পারে এই হত্যার মূল ষড়যন্ত্রকারী?

মৃত্যুর রাতে দশরথ ভাত, ডাল আর ডিমের তরকারি দিয়ে খেয়ে স্ত্রী ঊর্মিলাকে বলেন যে তিনি একটু পাটের দিকে যাচ্ছেন জমিগুলো দেখে আসবেন। ঊর্মিলা স্বামীর মৃত্যুর ব্যাপারে ঘুণাক্ষরে আন্দাজ লাগাতে পারেননি। স্বামীর সঙ্গে ঊর্মিলার সম্পর্ক সেরকম পোক্ত ছিল না। গ্রামের লোকেরা সেটা অনুভব করত। দশরথ ব্রাহ্মণ সমাজ-এর প্রতিনিধি হলেও তাঁর চলাফেরা ছিল সমাজের অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে। সেটা চাক্ষুষ করেছিল অবিনাশ নিজে। আগের বছর কালিপূজার মেলাতে অবিনাশ দেখেছিল রামধিন বেসরার স্ত্রী ফুলমণি বেসরার সাথে হাঁড়িয়া খেয়ে দশরথ আরতি করছে। পুরো নিয়ামতপুর ছি ছি করেছিল। একজন ব্রাহ্মণ কীভাবে সাঁওতালদের ঘরের মেয়েদের সাথে নাচতে পারে!

মৃত্যুর একদিন পর ঊর্মিলা মৃতদেহ স্থানীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে নিয়ে যায়। ততক্ষণে দশরথের শরীরে মৃত্যুপরবর্তী আড়ষ্টতা এসে গিয়েছে। চণ্ডীপাটের পাশেই দশরথকে দাহ করা হল। একমাত্র পুত্র দিব্যেন্দু সমস্ত শাস্ত্র মেনে পিতার অন্ত্যেষ্টি সারল। সারা গ্রাম এক শোকের চাদরে ঢেকে গেল। এক সপ্তাহের মধ্যে সবাই আবার তাদের নিজ নিজ কাজে ফিরে গেলেন। কৃষকরা রবিশস্যের চাষে ব্যস্ত হয়ে গেল। অবিনাশের স্কুল আবার খুলে গেল। সদ্য পিতৃশোক থেকে বেরিয়ে আসা দিব্যেন্দুর সাথে অবিনাশের বন্ধুত্ব স্থাপন হল। প্রায়ই তাদের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু এসে ভবিষ্যৎবাণী ও সদ্য ইংরেজি অভিধানে শেখা শব্দ প্লানচেট-এ শেষ হত।

প্রায় দু’মাস পর পুরো চণ্ডীপাটের এলাকা জুড়ে যখন নতুন গমের শিষ এবং আলু চাষের ব্যস্ততা দেখা গেল, হঠাৎ একদিন কেশব দাসের খড়ের ছোট্ট পাহাড়ে একটি শুকিয়ে যাওয়া রক্তমাখা রাম-দা পাওয়া গেল।

 

(ক্রমশঃ)

পরবর্তী পর্ব…

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *