নায়িকার ভূমিকায়। সপ্তম পর্ব । লিখছেন স্পন্দন ভট্টাচার্য
মিনার্ভা থিয়েটার তখন জমজমাট মঞ্চতারকা মিস লাইট, চারুশীলা, রেণুবালাদের নাচে-গানে-অভিনয়ে। তারই মধ্যে দশ-বারো বছরের একটি মেয়ে দাপটের সঙ্গে নিজ গুণে জায়গা করে নিয়েছিল মিনার্ভায় – নাম উমা। মিনার্ভায় আত্মপ্রকাশ করে কেরিয়ারের পরের পর্যায়ে পূর্ণ থিয়েটারে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন উমা। তারও পরে মঞ্চ-দুনিয়া থেকে রোমাঞ্চকর নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে ক্রমে ক্রমে সিনেমার তারকা হয়ে ওঠেন উমাশশী। গত শতাব্দীর বিশ আর ত্রিশের দশকে মঞ্চের নায়িকা আর সিনেমার নায়িকাদের আলাদা নির্মাণ হিসেবে দেখাটা অসম্ভব হয়ে পড়ে থিয়েটার আর চলচ্চিত্রের নানা রকম বিনিময়ে। একদিকে যেমন থিয়েটার প্রযোজনার ছবি তুলে তার ‘চলচ্চিত্রায়ন’ হতে থাকে, অন্যদিকে থিয়েটার মালিকেরাও আগ্রহী হয়ে পড়েন চলচ্চিত্র প্রযোজনায়। আর থিয়েটার ও পর্দার নায়িকারা সমান্তরাল দুটো নির্মাণ হিসেবে না থেকে হয়ে পড়েন বৃহত্তর এক নির্মাণের অংশ। তাই মঞ্চের নায়িকা থেকে সিনেমার নায়িকা হয়ে ওঠার যাত্রা গুলোর নেপথ্যে থেকে যায় নানা রকম মাধ্যমগত, বাণিজ্যগত বিনিময়ের গল্প। এই সময়ের প্রখ্যাত নায়িকাদের বিবরণ থেকে এই মাধ্যমগত আদান-প্রদান ও নানা বিনিময়ের একটা ছবি পাওয়া যায়।
উমাশশী তাঁর আত্মকথায় লিখছেন, “তখন সাইলেন্ট ছবির যুগ। পূর্ণ থিয়েটারে নির্বাক ছবি দেখান হত। মাঝে ইন্টার্ভেলের সময় এক ঘন্টার একটা নাটক দেখান হত। তাতে নাচ গান এবং অভিনয় তিনটেই থাকত। এছাড়া মোট চারজন ছেলে চারজন মেয়ে নিয়েও একটা দল ছিল। আমরা তাতে অংশ নিতাম। তাদের প্রধান কাজ ছিল নাচা ও গাওয়া। সেখানে প্রথম যে অভিনয় করি তার নাম ছিল ‘কেরানীর স্বপ্ন’। কার লেখা মনে নেই, পরিচালক ছিলেন নন্দলাল ব্যানার্জী”। তাঁর অভিনয় কেরিয়ারের এই প্রথম পর্যায়ে বেশ দিন কাটছিল ওঁর। মঞ্চে অভিনয় করছেন, আবার পর্দার অভিনয়ও দেখছেন নিয়মিত। পেশা ও সখ, কর্মব্যস্ততা ও অবসর, মঞ্চের অভিনেত্রী কেরিয়ার ও সিনেমায় অভিনয়ের আকাঙ্খা- সবটা নিয়েই এই নায়িকার পূর্ণ থিয়েটারে উমা থেকে উমাশশী হয়ে ওঠা।
তাঁর লেখায় ফিরে ফিরে আসে এই নাটকের অভিনয়ের ব্যস্ততার সঙ্গে সিনেমার প্রতি প্রবল এক আকর্ষনের কথা। নিজেই লিখেছেন তখন উনি নাটকের আগে ও পরে দু’চোখ ভরে ছবি দেখছেন- “সবই তখন আমার কাছে অবাক বিস্ময়ের। মানুষ হাসছে কাঁদছে চলছে ফিরছে অভিমান করছে, মিলন ও হচ্ছে। আবার দৌড় ঝাপও করছে। ছবিতে কথা নেই, অথচ তাদের ভাবভঙ্গী, চলাফেরা দেখে দর্শকের সঙ্গে আমরাও হেসে কেঁদে মরি।” এসময়ই উমাশশী নির্বাক ‘দেবদাস’ দেখে অভিভূত হয়ে পড়েন। আগের পর্বে আলোচিত মিস লাইট এই ছবিতে ছিলেন নায়িকা পার্বতীর ভূমিকায় আর ফণী বর্মা দেবদাসের চরিত্রে। উমাশশী এইসব ছবি দেখছেন আর মনে মনে ভাবছেন আহা উনিও যদি অমন করে সিনেমায় অভিনয় করতে পারতেন। কিন্ত ভয়ও রয়েছে সমালোচনার। নাটকে অভিনয় নিয়েই কত রকম নিন্দে-মন্দ, সিনেমায় নামলে তো কথাই নেই! একদিকে সিনেমা করার এই প্রবল ইচ্ছে্র অন্যদিকে নিন্দে-সমালোচনার ভয় এই নিয়েই থিয়েটার করে আর ছবি দেখে দিন কাটতে থাকে।
নিউ থিয়েটার্সের ‘চণ্ডীদাস’ (১৯৩২) চলচ্চিত্রে সহ-অভিনেত্রীর সঙ্গে উমাশশী (
এরকমই একদিন নাটকের রিহার্সাল এর ফাকে যখন সহ অভিনেত্রীদের সঙ্গে গল্প-আড্ডা চলছে, ডাক পড়ল ওঁর। পূর্ণ থিয়েটারের মালিক মনোময় বাবু ডাক পাঠিয়েছেন। মনোময় বাবুর ঘরে যেতেই বললেন “ছাদে চল। তোমার ছবি তোলা হবে”। ছাদে যাওয়ার পর নির্দেশ এল – “একটু হেঁটে চলে বেড়াও, তোমার ছবি তুলি কিছু”। বিস্ময়ে–ভয়ে হতবাক উমাশশীর মাথায়ই আসেনা, হেঁটে চলে বেড়িয়ে এ কেমন ছবি তোলান! ছবি মানে তো উনি জানেন একদম চোখের পলক না ফেলে কাঠের পুতুলের মত স্থির থাকা। সে যাই হোক, ভয় কেটে যায় কিছু পরেই। অনেক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, অনেক রকম ভাব ও ভঙ্গিমায় ছবি তোলা শেষ হয় একসময়। এর কদিন পরে উমাশশীর কাকা ওঁদের বাড়ি এসে জানালেন মনোময় বাবু ছবি করছেন, ‘গ্র্যাফিক আর্টস কোম্পানী’র ব্যানারে। নির্বাক ছবি, নাম ‘বঙ্গবালা’। গল্প বিজয়রত্ন মজুমদারের। পরিচালক ও নায়ক ফণী বর্মা। আর নায়িকার ভূমিকায় উমাশশী!
(চলবে)
তথ্যসুত্রঃ
“এই আমি উমা থেকে উমাশশী” প্রথম প্রকাশ শারদীয়া আনন্দলোক, ১৯৭৮। পুনঃমুদ্রিত
“সোনালি রুপালি তারারা” সম্পাদনা ও অনুলিখন শান্তিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, প্রতিভাস, ২০০৭।
স্পন্দন ভট্টাচার্য
স্পন্দন ভট্টাচার্য চলচ্চিত্র বিদ্যার ছাত্র এবং গবেষক। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বাংলা ভাষায় চলচ্চিত্র চর্চার যাঁরা সূত্রধর এবং অগ্রণী স্পন্দন তাঁদের মধ্যে একজন। নির্মুখোশে স্পন্দন লিখছেন বাংলা ছবিতে প্রথম যুগের নায়িকাদের নিয়ে।