কাশীর অলি-গলি : ইতিহাস-সমাজ-সংস্কৃতি। পর্ব ৬। শোভন সরকার

0
গত পর্বে: দণ্ডপাণির গল্প জানতে পারলাম। দণ্ডপাণির মন্দিরেই রয়েছে কালকূপ, যেখানে নিজের ছায়া না দেখলে হয় অঘটন। সেই পথ পেরিয়ে অবশেষে এসে পৌঁছলাম কালভৈরব মন্দিরের ফটকে। 

মূল প্রবেশদ্বারের দুই পাশে পাহারায় আছে দুই দ্বারপাল। দ্বারের উপরের দিকে তাকাতেই দেখলাম পাহারারত অবস্থায় রয়েছে কালভৈরবের বাহন কুকুরের মূর্তি। মজার ব্যাপার এই যে, অন্যান্য মন্দিরে কুকুরের প্রবেশ বর্জিত হলেও এখানে কুকুরের অবাধ বিচরণ। ভোরবেলায় যখন মন্দিরের দ্বার খোলা হয়, তখন সবার প্রথমে প্রবেশাধিকার কালভৈরবের বাহনেরই। কালভৈরবের কুকুর নিয়ে এক গল্প এখানে লোকমুখে বেশ প্রচলিত, ঐতিহাসিক সত্যতা যাচাই করার মত যথাযথ তথ্যসূত্র অবশ্য আমি পাইনি। আওরঙ্গজেব-এর সেনার দল তখন কাশী তছনছ করছে। এগোতে এগোতে যখন সৈন্যরা কালভৈরবের মন্দির আক্রমণ করতে উদ্যত হল, তাদের পরাক্রমের সামনে কেউ এসে বাধা দেবে সেটা তারা ক্ষণমাত্রেও ভাবেনি। হঠাৎ কোথা থেকে একদল কুকুর এসে ছত্রভঙ্গ করে দিল সৈন্যদের। কেউ কেউ বলে যে দণ্ডপাণির মন্দিরের সেই কালকূপ থেকেই নাকি এই কুকুরের দল আবির্ভূত হয়েছিল কালভৈরবকে রক্ষা করতে। যাই হোক, কুকুরের আক্রমণে বেশ কিছু সৈন্য আহত ও নিহত হলে পরে বাকিরা মন্দির ছেড়ে পিছু হটল, রক্ষা পেল মন্দির। 

ফটক পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলে সামনে দেখা যাবে মূল মন্দির, ওখানেই আছে গর্ভগৃহ। মন্দির চত্ত্বরে চতুর্দিকের বারান্দায় সারি সারি বসে আছে পূজারীর দল। তাদের হাতে ময়ূরের পালকের তৈরি দণ্ড, আশেপাশে সাজানো বহু রঙের ও ধরণের ডোর — মূলতঃ কালো ও হলুদ, কালভৈরবের মুখোশ ইত্যাদি। দর্শনার্থীদের অনেককে দেখা গেল এই সমস্ত পূজারীদের সামনে মাথা ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রয়েছে, পূজারীর কেউ কেউ ভয়ংকরভাবে মাথা দোলাতে দোলাতে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় মন্ত্র আওড়াচ্ছে, তারপর তার হাতের ময়ূরপুচ্ছ দণ্ড দিয়ে সেই আনতমস্তক ভক্তের পিঠে মৃদু আঘাত করছে। তারপর হাতে বেঁধে দিচ্ছে কালভৈরবের মন্ত্রপূতঃ ডোর। একে ওকে জিজ্ঞেস করে জানলাম এভাবেই ভক্তেরা কালভৈরবের আশির্বাদপ্রাপ্ত হন। এতে নাকি সমস্ত কালোজাদুজনিত সমস্ত বিপত্তি দূর হয়ে যায়, অপশক্তির নজর থেকে মুক্ত হয়ে যায়। ঐ ময়ূরপুচ্ছ দণ্ড কালভৈরবের দণ্ডের প্রতীক। কালভৈরব নিজেও পাপীর শাস্তির জন্য এরূপ দণ্ড ধারণ করেন। এ ছাড়াও কালভৈরবের ‘বিভূতি’ (ছাই) অনেকে নিজেদের কপালে ঠেকিয়ে নেন, কেউ কেউ জিভে — অনেকের বিশ্বাস এতেও কালভৈরবের কৃপা পাওয়া যায়। 

একটা জিনিস লক্ষ্য করছিলাম যে এখানে কালো রঙের বেশ প্রাধান্য। যদিও মূল মন্দিরের রঙ উজ্জ্বল সিঁদুরে, তবে কালো রঙের অদ্ভুত সহাবস্থান সমস্ত মন্দির প্রাঙ্গণে — লোকজন পরে আছে কালো কাপড়, কালো সুতো, কালো ছাই ইত্যাদি। আশেপাশের দেওয়ালও কি কালো নয়? আবার কালভৈরবের নামেও ‘কাল’ (অবশ্য কাশীখণ্ডের মতে এই ‘কাল’ হল ‘সময়’ বা ‘মৃত্যু’। কালভৈরব ‘কাল’-কে দমন করেন বলেই তিনি কালভৈরব)। পরে জেনেছি, কালভৈরবের উপাসকেরা বিশ্বাস করেন যে কালো রঙ ভৈরবের বিশেষ পছন্দ। তাছাড়াও, কালো রঙ অন্য সমস্ত রঙের প্রভাব দূর করে, সমস্ত রঙকে শুষে নিয়ে সমাহিত করে নিজের মধ্যে। কালভৈরবও তেমনি। তিনি সমস্ত রিপুর প্রভাব থেকে উপাসকদের মুক্ত করেন, সমস্ত অশুভকে নিজের মধ্যে লীন করে নেন। কালো রঙ তাই স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর প্রিয়। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বিভিন্ন লোকায়ত আদি দেবদেবী বা উপদেবতার উপাসনার মধ্যে কালো বা সমতুল্য রঙ অপরিহার্য এক অঙ্গ। কালভৈরব তার ব্যতিক্রম নন। তিনি এমন একজন যাঁর উপাসনায় একসময় যা সমস্ত অশুভ, যা সমস্ত অপ্রচলিত, কিংবা তথাকথিত স্বাভাবিক সমাজের কাছে বহিষ্কৃত সে সব কিছু ব্যবহৃত হত। তার আংশিক প্রভাব আমরা এখনও দেখি এই রঙ বা পুজোর উপচারে।  

মূল মন্দিরের চারপাশ দিয়ে চলাচলের জায়গা আছে — মন্দির প্রদক্ষিণ করেন অনেকেই। এরই পাশে জায়গায় জায়গায় দেখা যাবে বিভিন্ন দেবদেবীর পূজার বেদী। রয়েছে কালভৈরবের অধীনস্থ নবগ্রহের সারিবদ্ধ প্রতিকৃতিও। অনেকেই বিশ্বাস করে যে মানুষের জাগতিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, দুঃখ-পীড়া এ সমস্ত কিছুর নিয়ন্ত্রণ আছে এই নবগ্রহের হাতে। কাজেই কালভৈরবের উপাসনায় সেই গ্রহদোষও দূরীভূত হয়। ডায়না ইক তাঁর বইতে এই প্রসঙ্গে একটি সুন্দর মন্তব্য করেন — ভৈরব এপারের দেবতা, পরপারের নয়। জাগতিক সুরক্ষা, সুখ-স্বাস্থ্য-সমৃদ্ধির জন্যই তিনি পূজিত, মৃত্যুর পর মুক্তিলাভের জন্য নয়। 

কাশীর এই কালভৈরব মন্দির বহু শতাব্দি ধরে শৈবধর্মের চরমমার্গ অনুসরণকারীদের সিদ্ধপীঠ ছিল — বিশেষ করে কাপালিক ও তাদের পরবর্তীকালে নাথ ও কানফাটা সম্প্রদায়ের যোগীদের। তন্ত্রাচার, শক্তির আরাধনায় ভৈরব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সতীর এক একটি শক্তিপীঠে মহাদেবের প্রতিরূপ হিসেবে এক একটি করে ভৈরব উপস্থিত। কাশীতে রয়েছে দেবীর একান্ন শক্তিপীঠের অন্যতম বিশালাক্ষী মন্দির, অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন বিশালাক্ষী দেবী। আর এই দেবীরই ভৈরব হলেন স্বয়ং কালভৈরব। বর্তমানে কাশী বিশ্বনাথের মূল মন্দিরের খুব কাছেই এই বিশালাক্ষী মন্দির দেখতে পাওয়া যায়। দক্ষিণী শৈলীতে তৈরি এই নতুন মন্দিরটি তামিল ব্যবসায়ী শ্রেণির মানুষ রক্ষণাবেক্ষণ করেন। প্রসঙ্গতঃ বলি, সতীর কর্ণের মণি এখানে পড়েছিল, তাই এই দেবীকে অনেকে মণিকর্ণী দেবীও বলেন। তাঁদের মতে এই দেবীর নাম থেকেই মণিকর্ণিকা ঘাটের নামকরণ হয়েছে।  

সূত্র: আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইণ্ডিয়া

আবার কালভৈরব মন্দিরে ফিরে আসি। অবশেষে মূল মন্দিরে প্রবেশ করলাম, গর্ভগৃহে ঢুকতে অনুমতি পেলামনা। নিরাপত্তার কারণেই বিশেষ পুজো ছাড়া সাধারণ মানুষ গর্ভগৃহে প্রবেশ করতে পারে না। গর্ভগৃহের খোলা দরজা দিয়ে কালভৈরবের দর্শন করা যায়। সামনে স্বয়ং কালভৈরব — সমস্ত শরীর ফুল ও অঙ্গসজ্জায় আবৃত, কেবল রূপোর তৈরি মুখখানি দেখা যায় গলায় ঝুলছে ধাতুর তৈরি মুণ্ডমালা, মুখের পাশে ছিলিম। সেই সজ্জার আড়ালে ডান হাতে ত্রিশূল নিয়ে স্ফীতোদর কালভৈরব নিজের বাহনের উপর আসীন। কেবলমাত্র ভৈরবাষ্টমীর দিনে দুপুরে নাকি এই বিগ্রহ সকলের সামনে আনা হয়। বিগ্রহটি খুব সম্ভবতঃ ত্রয়োদশ শতকের মাঝামাঝি সময় বা তারও পূর্বের নির্মাণ। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইণ্ডিয়ার সংরক্ষণে সারনাথ জাদুঘরের পঞ্চম গ্যালারিতে রাখা রয়েছে একটি ভৈরব মূর্তি — ষষ্ঠ শতকে পাথরের তৈরি এই মূর্তিতে দেখি ভৈরব ডানহাতে ধরে আছেন এক পাত্র, বাঁ হাতে ত্রিশূল, গলায় হার, কানে কুণ্ডল, করাল বদন তাঁর।

গর্ভগৃহের দরজার সামনেই প্রদীপ জ্বলছে। দেখলাম সবাই তাতে বাইরে থেকে কিনে আনা সরষে বা তিসির তেল ঢালছে। চোখে পড়ল কোন কোন দর্শনার্থী কালভৈরবকে পুজোর জন্য মদ (তন্ত্রের পরিভাষায় ‘কারণবারি’) উৎসর্গ করছে। আরও একটু সময় পেয়ে ভাল করে লক্ষ্য করলেই দেখতাম কালভৈরবের সামনে রাখা রয়েছে ‘খপ্পরসেবা’ — মড়ার মাথার খুলির প্রতিরূপ হিসেবে রূপোর পাত্র আর তাতে রাখা মদ। সেটি প্রসাদ হিসেবে বিতরণ করা হয়। তবে যে কেউ কি যে কোন পরিমাণে সেই ‘কারণ’ প্রসাদ হিসেবে গ্রহণ করতে পারে? সংক্ষেপে এর উত্তর হল, না। তন্ত্রসাধনায় এই ‘কারণ’ গ্রহণেও নিয়ম নির্দিষ্ট করা আছে। কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে ভর্তি হবার পর যখন বেনারসে চলে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছি, ঠিক তার আগে আমার মা আমাকে বারবার সাবধান করে দিয়েছিল, বাইরে গিয়ে নানা রকম মানুষ আমাকে ‘রঙিন জল’ খাওয়ার জন্য প্রভাবিত করার চেষ্টা করবে, আমি যেন তার থেকে সর্বদাই দূরে থাকি। মাতৃ আদেশ, অগত্যা সেই আদেশ অমান্য করে কালভৈরবের মন্দিরে সেই প্রসাদ গ্রহণের সাহস হয়নি সেদিন।

(ক্রমশ)

পরবর্তী পর্ব

Disclaimer
The views and opinions expressed in this series are solely those of the author and do not represent the views, policies, or positions of any organisation, institution or society of any kind or the government. The content of this series is written in the author’s personal capacity and does not reflect any official information or stance.

Author

Leave a Reply