অকূলের কাল। পর্ব ৫। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

0

(গত পর্বের পর)

বালিকাবাজ

কিছুদিন হলো শচি একটা বেয়াড়া অভ্যাসের পাল্লায় পড়েছে। ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে প্রেম করতে বেরিয়ে যায়। একটা বাচ্চা মেয়ে, সিক্স কি সেভেনে পড়ে, ওইসময়ে ইউনিফর্ম পরে স্কুলে যায়। শচি নীচে নেমে হস্টেলের সদর গেটে দাঁড়িয়ে থাকে। মেয়েটা গ্রে স্ট্রিটের একটা গলি থেকে বেরিয়ে হরি ঘোষ স্ট্রিটের মোড়ে পৌঁছলেই শচি তার সঙ্গ নেয়। আগডুম বাগডুম বকতে বকতে, মাঝে মাঝে দু-এক কলি গান গাইতে গাইতে তাকে ইস্কুলে পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসে। উপরে ওঠার সময় নীচের দোকান থেকে এক ঠোঙা গরম গরম জিলিপি আর শিঙাড়া কিনে নিয়ে আসে। কাকুদের তখনও গভীর রাত। সে ঘুমন্ত কাকুর কানের কাছে মুখ এনে কীর্তন শুরু করে দেয় -‘উঠো উঠো গোউরচাঁদ। নিশি পোহাইল…’ কাকু ঘুমচোখেই সপাটে হাত চালায়। শচি তৈরিই থাকে, নিমেষে ঘাড় সরিয়ে নেয়। তারপর এক হাতে ঠোঙা নিয়ে দিনুর নাকের কাছে ধরে, অন্য হাত দিয়ে তার কানে সুড়সুড়ি দেয়। দিনু উঠে পড়ে লাথি ছোড়ার আগেই তার মুখে একটা গরম জিলিপি গুঁজে দেয়। সামান্য ঝটাপটি, অবশেষে গরম জিলিপি শিঙাড়ার কাছে হার মানা। দিনুর পরে প্রদীপ আর কাকুও বিছানা ছাড়ে, বারান্দায় বেরিয়ে মুখেচোখে জল দিয়ে এসে টেবিলে রাখা ঠোঙা ঘিরে জিলিপি শিঙাড়ার সদ্গতি করে। শচির কীর্তন ততক্ষণে ‘নিশি পোহাইল’ থেকে ‘হরি দিন তো গেল’-তে পৌঁছে গেছে।

হস্টেলের টিফিন আসতে এখনও দেরি আছে, সবে সাড়ে ছ’টা। সাতটার আগে তো নয়ই, সাড়ে সাতও বাজে কোনো কোনো দিন। মাধুদা ঘরে ঘরে টিফিন দিয়ে যায়। হস্টেলের নিয়মিত কর্মী তিন জন। ব্যোমকেশ হেড রাঁধুনি, তার সহকারী মাধু আর দারোয়ান রামভকত সিং। এই তিনজন কলেজের মাস-মাইনের  স্টাফ। বাকি দুজনের একজন ঝাড়ুদার, অন্যজন রান্নাঘরের ফাইফরমাস খাটে সামান্য দৈনিক মজুরিতে। সেই মজুরি হস্টেলের ফান্ড থেকে দেওয়া হয়। ব্যোমকেশ পন্ডা মেদিনীপুরের কাঁথি অঞ্চলের লোক। বেশ ধারালো চোখমুখ। কাজেকর্মে, কথাবার্তায় চতুর ও চৌকশ। রান্নাঘরের ফাইফরমাশ খাটার ছেলেটাকে সে-ই নিয়ে এসেছে নিজের গ্রাম থেকে। সম্ভবত তাকে সুযোগ বুঝে কলেজের কর্মী হিসেবে ঢোকাবে কথা দিয়ে  নিয়ে এসেছে। হস্টেলের সুপার, অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার ইত্যাদি কর্তাব্যক্তিদের খুবই খোশামোদ করে চলে ব্যোমকেশ। হোস্টেল কমিটির ছেলেদেরকে, বিশেষ করে মেস ম্যনেজারকে খুবই খাতির করে। কাকুদের মতো ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেদেরকে সে তোয়াক্কাই করে না।

মাধো সিং বিহারের লোক। সব ছেলেরই সে ‘মাধোদা’। সবাই তাকে ভালবাসে। ফরসা, গাঁট্টাগোট্টা চেহারা, নীচের পাটির সামনের দিকের দুটো দাঁত নেই কিন্তু সদাই হাসিমুখ। মধ্য তিরিশের ব্যোমকেশের চাইতে সে কম করে দশ বছরের বড়ো। সমস্ত ভারী ভারী কাজ ব্যোমকেশ তাকে দিয়ে করায়। মেস ম্যানেজার বা তার ঠিক করে দেওয়া কোনো ছেলের পিছু পিছু আটহাতি ধুতি আর গেঞ্জি পরে মাথায় গামছার পুঁটলির উপর একটা বিশাল ঝুড়ি নিয়ে সে হাতিবাগানের বাজারে যায় রোজ সকালে। শাকসবজি, মাছমাংসের দোকানদাররা অবশ্য খুবই খাতিরদারি করে তাকে, যাওয়ামাত্র চারদিক থেকে ‘মাধোদা মাধোদা’ ডাকাডাকি। কার কাছে কী কিনতে হবে সেটা মাধোদাই জানে। শাকসবজি মাছ চেনার জ্ঞানগম্যি খুব কম ছেলেরই আছে। তার মূল কাজ জিনিসপত্রের ফর্দ করে খরচের হিসাব মেস ম্যানেজারের কাছে দাখিল করা। শিলনোড়ায় প্রতিদিন এত এত মশলা মাধোদাকে দিয়ে বাটায় ব্যোমকেশ। যখন তখন তার উপরে চোটপাটও চালায় সে। তার ধারণা, মাধো নাকি বেলার দিকে বাজারে গিয়ে মাছওলা সবজিওলাদের কাছ থেকে কমিশন আদায় করে।

জিলিপি-শিঙাড়া শেষ হতে শচি উত্তরের বারান্দায় বেরিয়ে কাঠের রেলিঙ –এ ঝুঁকে পড়ে হাঁক দিল – মাধোদা, চা –

মাধো ঠিক সাতটার সময় বাজারে যাবে। তার আগে ঘরে ঘরে চা-বিস্কুট দেবে। তখনও কেউ ঘুমিয়ে থাকলে তাকে রান্নাঘরে নেমে চা খেয়ে আসতে হবে। সেদিন যার বাজার করার ডিউটি, তাকে ডেকে নেওয়াও মাধোদার দায়িত্ব।

চা খাওয়া শেষ হতে একটা বিড়ি ধরিয়ে শচি বলল, – মজা মেরে রোজ রোজ যে জিলিপি খাচ্ছিস, টাকা দেবে কি গৌরী সেন?

দিনু বলল, – আমাদের গৌরী সেনের নাম অভীক গাঙ্গুলি।

কাকু বলল, – তার কাছে আগে দরখাস্ত পেশ কর। সময় বুঝে করতে পারলে মঞ্জুর হয়ে যাবে।

সময়ের ইঙ্গিতটা সবাই নিমেষেই বুঝে গেল। অভীকের একটা ব্যাপার চলছে, সবে অঙ্কুর দেখা দিয়েছে। আদৌ পাতা মেলবে কি-না সংশয়ে আছে সে। পরিচর্যা করতে এখন প্রায়ই কলেজ শেষে বালিগঞ্জে ছুটছে। সঙ্গে থাকে উদ্ভিদ-বিজ্ঞান সংক্রান্ত বেশ কিছু পেন্সিল-স্কেচ। অভীক নিজে আঁকতে পারে না। দোতলায় থাকে অমল পানিগ্রাহী, স্কটিশের বোটানি। ভালো আঁকার হাত। ফরসা গাবলুগুবলু চেহারা, নিরীহ গোবেচারা ধরনের। সে আবার অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার বিমল পানিগ্রাহীর কীরকম যেন তুতো ভাই। তা হলেও তাকে দিয়ে ইচ্ছেমত স্কেচ করিয়ে নিতে একটুও বেগ পেতে হচ্ছে না অভীককে।

গল্পের শুরু বছর দুয়েক আগে। আসানসোলে। অভীকের বাবার বন্ধু ও প্রতিবেশী ছিলেন এক ভদ্রলোক। দীর্ঘদিন পাশাপাশি থাকার ফলে দুই পরিবারের মধ্যে বেশ হৃদ্যতার সম্পর্ক। ভদ্রলোকের দুই মেয়ে। ছোটটির নাম সুবু। অভীক বরাবরের ভালো ছাত্র। সুবু যখন সিক্স সেভেনে তখন প্রায়ই সে তার অভিদার কাছে অঙ্ক নিয়ে আসত বুঝতে। অভীক প্রথম প্রথম তাকে অঙ্ক শেখানোর চেষ্টা করেছিল। কিছুদিন পরেই বুঝল অঙ্ক বোঝার পক্ষে সুবুর মাথা বড্ড নিরেট, ভেদ করা শক্ত। তখন থেকে সুবু অঙ্ক নিয়ে এলেই তার সঙ্গে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করে মাথায় হালকা গাট্টা মেরে বিদায় করে দিত। সুবুও ক্রমশ তাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করল, দেখা হলে কথা পর্যন্ত বলত না।

সুবু যখন ক্লাস টেন, তখনই একদিন অভীকের খেয়াল হয় মেয়েটার চেহারা, রূপ যেন ভোজবাজির মতো বদলে গেছে। সুবু তাকে চুম্বকের মতো টানছে। অভীক ঘনঘন তার বাড়ি যাওয়া শুরু করল, তার পড়াশোনা নিয়ে যে তার চিন্তার অবধি নেই – এমন একটা ভাব করে তার বই নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে শুরু করল। কিন্তু সুবু আর তাকে পাত্তা দেয় না। সে যেন অঙ্কের সঙ্গে অভীককেও বিসর্জন দিয়ে বসে আছে। এখন সে বোটানিকে পাখির চোখ করে হায়ার সেকেন্ডারির জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। বলে, তুমি বোটানির কিছু বোঝো না, খামোখা আমার সময় নষ্ট করো না তো!

এরপরই অভীক স্কুল শেষ করে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে ভর্তি হয়। সুবুর বাবাও বদলি হয়ে পরিবারসমেত বালিগঞ্জে থাকতে শুরু করেন। অভীক হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়, যে-ক’মাস নরেন্দ্রপুরে ছিল সপ্তাহে অন্তত একবার বালিগঞ্জে ঢুঁ মারত। এই হস্টেলে এসে সেই ঢুঁ-মারাটা বেড়ে গেছে। সুবুর একটা দুর্বলতাও সে আবিষ্কার করে ফেলেছে। তার স্কেচের হাত ভালো নয়, বোটানিতে গাছ পাতা ফুল ফল বীজের খুব সূক্ষ্ম ধরনের স্কেচ করতে হয়। সে সুবুকে বলেছে, এসব আঁকা তার কাছে জলভাত। এমন সব স্কেচ সে করে দেবে যে তার বোটানির নম্বর চড়চড় করে গাছের মগডালে উঠে যাবে। এর মধ্যেই সে নিজের গরজে অমলকে খুঁজে বের করেছে। তাকে দিয়ে নিত্যনতুন স্কেচ করিয়ে প্রায়ই ছুটছে বালিগঞ্জে। সুবু বোধহয় একটু একটু করে নরম হচ্ছে। সেখান থেকে হস্টেলে ফিরে এলে সেদিনের অগ্রগতির উপর নির্ভর করে থাকে তার মেজাজের পারা। জিলিপি-খরচের আবেদন পেশ করার ‘সময়’ বলতে কাকু এই সময়টার দিকেই ইঙ্গিত করেছিল।

দিন তিনেক পরেই এক রবিবার সন্ধে সাতটার সময় অভীক বালিগঞ্জ থেকে হস্টেলে ফিরল। ছুটির দিনে এই সময়টায় ছাদে তাসের আসর বসার কথা। কিন্তু সেদিন বসেনি, কারণ বিকেলেই অনুপম হস্টেল থেকে উধাও হয়ে যাওয়ায় খেলুড়ে কম পড়ে গেছে। অভীক ফিরেই খুশমেজাজে জিজ্ঞেস করল, – তাসুড়েদের আসর ফাঁকা কেন?

কাকু বলল, – সেতুস্তম্ভ কম পড়িয়াছে।

কিছুদিন আগেই তারা সদলবলে মিনার হলে গুগা বাবা দেখে এসেছে, এখন সেই ঘোর কাটেনি। কথাবার্তায় প্রায়ই এইসব শব্দ ঢুকে পড়ছে। অভীক বলল, – সতরঞ্চি পাত, আমি খেলব।

কাকু শচিকে চোখের ইশারায় জানিয়ে দিল, এটাই ‘সময়’। শচি তাস খেলে না। ছাদে শতরঞ্চি পেতে তাস বাটা হলো। কাকুর পার্টনার অভীক, দিনুর পার্টনার প্রদীপ। অভীক তার হাতের তাস সাজাচ্ছে। এই প্রক্রিয়া এখনও ধাতে আসেনি তার। চারটে তাস দাঁতে কামড়ে ধরে বাকিগুলো নিয়ে কসরত করছে। শচি তার পিছনে বসে কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে জিলিপি শিঙাড়ার আবেদন পেশ করল। অভীক বলল, – শালা বালিকাবাজ!

অমনি তার দাঁত থেকে খসে পড়ল চারখানি তাস। কাকুরা বুঝে গেল, আবেদন মঞ্জুর। শচিকে বালিকাবাজ বলা অভীকের প্রিয় অভিভাষণ।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply