সৌভাগ্যশলাকা। ধারাবাহিক উপন্যাস। পর্ব ৪। লিখছেন অলোক সান্যাল

0

(গত পর্বের পর)

দুঃস্বপ্নের রাত

……………………

পালাতে চাইছে গায়াস। প্রাণপণে ছুটে চলেছে। পেছনে, খুব কাছে চলে এসেছে ভয়ংকর প্রাণীটা! অতিকায় চেহারা। হাওয়ায় উড়ছে সোনালি কেশর। বিরাট মুখগহ্বর থেকে মুহুর্মুহু হুংকার বেরিয়ে আসছে। প্রতিবার সেই গর্জনে কেঁপে উঠছে গায়াসের পায়ের নিচের মাটি। তার উত্তপ্ত নিঃশ্বাস নিজের শরীরে অনুভব করতে পারছে গায়াস। আর সামান্য পথ। ওই তো, সামনেই বয়ে চলেছে টাইবার নদী। একবার, কোনোক্রমে একবার যদি নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, তাহলেই বেঁচে যাবে সে।

‘দ্রুত… আরও দ্রুত।’

গায়াস নিজেকে চিৎকার করে বলল। ক্লান্ত পা দুটো তার কথা শুনতে আপত্তি জানাচ্ছে। মনের শাসন মানছে না। কামড়ে ধরছে পায়ের পেশি। পাঁজর ভেঙে ফুসফুস বুঝি বেরিয়ে আসতে চাইছে।

‘আর মাত্র একশো পা।’

বললেও প্রতিরাতের মতো আজও এই একশো পা দূরত্ব অতিক্রম করতে পারল না গায়াস। প্রবল জিঘাংসায় উন্মত্তের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল পশুরাজ। তার শরীরের ভার নিয়ে ঘাসে লুটিয়ে পড়ল রোমান সেঞ্চুরিয়ান গায়াস কাসিয়াস। হাতের খাটো বর্শা দূরে ছিটকে পড়ল। সুতীক্ষ্ণ বঁড়শি যেভাবে লোভী মাছকে গিঁথে ফেলে, হিংস্র পশুটির নখপ্রান্ত ঠিক সেভাবে রোমান সেঞ্চুরিয়ানের ধাতব বর্ম ভেদ করে শরীরে চেপে বসল। তীব্র যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল সে। শক্তিশালী চোয়াল একটানে ছিঁড়ে ফেলল গায়াসের ডান হাত। তারপর বাঁ হাতও। ছিন্ন শরীর থেকে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসছে রক্ত। সেই রঙে ক্রমশ লাল হয়ে উঠছে টাইবার নদী। আর্তনাদের শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছে গায়াস। ছিটেফোঁটা যেটুকু আতঙ্ক তার মনে অবশিষ্ট ছিল, ধর থেকে মাথা আলাদা হতে, সেটুকুও মিলিয়ে গেল।

বীভৎস দুঃস্বপ্ন থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল গায়াস। বিস্ফোরিত চোখ দিয়ে নিজের অস্তিত্ব যাচাই করে নিল একবার। সুতির পোশাক ভিজে এমন অবস্থা, দেখে মনে হবে সে বুঝি এইমাত্র স্নান সেরে থার্মি(thermae) থেকে বেরিয়ে এসেছে। একটু আগে পাওয়া যন্ত্রণার প্রতিটি মুহুর্তের রেশ শরীরে এখনো রয়ে গেছে। দু হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে রাখা বিছানার চাদর, কাঁপতে থাকা পা বলে দিচ্ছে স্বপ্নের আতঙ্ক মুছে গেলেও, দিনের শুরু থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত তা গায়াসকে তাড়া করে ফিরবে।

‘ওহ্ ঈশ্বর, এ তুমি আমাকে কেমন শাস্তি দিচ্ছ? প্রতি নিয়ত মৃত্যু যন্ত্রণা! আর কত সহস্র মৃত্যুর পর আমি পাপমুক্ত হব?’

শূন্য ঘরের চারদেয়ালে গায়াসের কাতরতা মাথা কুটতে কুটতে একসময় নিঃশেষ হলো। ধীরে, রণক্লান্ত যোদ্ধার মতো বিছানা থেকে নেমে এল গায়াস কাসিয়াস। না, সে এখন আর রোমান সেঞ্চুরিয়ান নয়। সাধারণ রোমান নাগরিক।

সামর্থবান হওয়া থেকে শুরু করে যতদিন তা অটুট থাকবে, দেশের জন্য যুদ্ধ করাই একজন রোমানের কর্তব্য। রাজ কোষাগার থেকে তার জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হবে। পরিবারকে নিয়ম করে দেওয়া হবে রেশন। বিনিময়ে একজন রোমান, যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেকে বিলিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করবে না। দীর্ঘ সামরিক জীবনে গায়াস নিজের কর্তব্যে অবিচল ছিল। তার সঙ্গে যে সমস্ত সৌভাগ্যবান রোমান সৈন্যদল থেকে অবসর নিয়েছে, তাদের মধ্যে অনেকে এতদিনের সঙ্গী ব্রোঞ্জের বর্ম, কিংবা যে গ্ল্যাডিয়াস শত্রুর বিরুদ্ধে ঝলসে উঠেছিল, যে শিরোস্ত্রাণ তাকে শত্রুর আঘাত থেকে রক্ষা করেছিল, সবই অস্ত্রাগারে বিক্রি করে দিয়েছে। কেউ আবার গচ্ছিত রেখেছে নিজের কাছে, পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য। গায়াসের কোনো পুত্র সন্তান নেই। কন্যা জন্মেছিল। তখন সে সদ্য আরিয়ানা(আফগানিস্তান) থেকে ফিরেছে। স্ত্রীর গর্ভে বেড়ে ওঠা সন্তান যে তার ঔরসজাত নয়, একথা গায়াসের প্রতিবেশীরাও নিশ্চিত করে বলতে পারবে। তবুও সন্তানের জন্মের অপেক্ষা করেছিল সে। আর তারপর, এক শীতার্ত রাত্রিতে পরিচারিকা এসে কন্যা সন্তান ভূমিষ্ঠের খবর শোনাল। না, গায়াস তাকে স্বীকার করেনি। শিশুটির কী পরিণতি হয়েছে তা সে জানে না। পিতা তার অসুস্থ দুর্বল পুত্র কিংবা সদ্যোজাত কন্যাকে স্বীকৃতি না দিলে সচারাচর যা করা হয়ে থাকে, বাড়ির বাইরে আস্তাকুঁড়ে তার ঠাঁই হয়েছিল নিশ্চয়ই। গায়াস খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। কিছুদিন পরে তাইমুরের যুদ্ধে যোগ দেওয়ার আগে, স্ত্রী এবং সে যুগ্মভাবে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বিবাহের মতো বিচ্ছদেও নারী-পুরুষের একত্রিত দাবিটুকুই তাদের সমাজে মেনে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট। গায়াস এরপর আর নতুন করে সংসার পাতেনি। তাই তার বর্ম কিংবা অস্ত্র নিজের কাছে গচ্ছিত রাখার প্রয়োজন ছিল না। তবুও একদিন যে বর্শা রোমের পরিত্রাতা সিজার স্বয়ং তার পূর্বপুরুষের হাতে তুলে দিয়েছিল, তাকে কয়েকটা দিনেরিয়াসের( denarius) জন্য অস্ত্রাগারে বিকিয়ে দিতে মন সায় দেয়নি। প্রতিরাতে দুঃস্বপ্নের শেষে গায়াস সেই অভিশপ্ত বর্শাকে নিজের চিবুকের নিচে স্থাপন করে। কল্পনা করার চেষ্টা করে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেওয়া শিশু কন্যার মুখ। চোখের সামনে ভেসে ওঠে নাজরাতীয় জিশুকে বিদ্ধ করার মুহুর্ত। মনে করে সমাধিক্ষেত্রে জিশুর শরীর সঠিকভাবে রক্ষিত আছে প্রচার করার জন্য উৎকোচ গ্রহণের কথা। গায়াস নিজের করা প্রতিটি পাপের কথা স্মরণ করে ফুঁড়ে দিতে চায় নিজেরই করোটি। প্রতি দিনের শুরুতে এভাবে নিজেকে নিঃশেষ করে দিতে চায় সে, কিন্তু পারে না।

আজও পারল না। পাথুরে দেয়ালের কোণে তার সাম্ভাব্য নিয়তিকে দাঁড় করিয়ে রেখে এট্রিয়ামে (Atrium), ছোট্ট জলাধারের কাছে এসে দাঁড়াল। মাথার ওপরে খোলা ছাদের অংশ দিয়ে সূর্যকে দেখা যাচ্ছে। নরম আলোয় ভরে উঠেছে এই ঘরের শূন্যতা। দ্বিতীয় চন্দ্র মাস থেকে অ্যানাক্সাম (Anaxum, ancient Roman city, central Italy) শহরের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। সঙ্গে বইতে থাকে শুষ্ক বাতাস। প্রধান প্রবেশপথের ঠিক পেছনের এই জলাধার, এট্রিয়ামের উষ্ণতাকে স্বাচ্ছন্দ্যের আশেপাশে ধরে রাখতে সাহায্য করে। গায়াস খোলা ঘরের একপাশে, পাথর খোদাই করে তৈরি ট্রাইক্লিনিয়াকে (Triclinia- Dinning tables) ঘিরে থাকা সেলাগুলোর( sella– chair) একটা দখল করল। ইতিমধ্যেই গতদিনের বাসি ফল পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছে। তার পরিচারিকারা কাজের ব্যাপারে বেশ পটু। প্রভুর পছন্দ অপছন্দ সম্পর্কে সচেতন। এট্রিয়ামের মোটা থামের আড়ালে এক দাসী দাঁড়িয়ে। এই যুবতীটিই গত রাত্রে তার শরীরের খিদে মিটিয়েছিল কিনা মনে পড়ছে না। হাতের ইশারায় তাকে কাছে ডেকে নিল গায়াস। দাসী আদেশ অনুসারে পানপাত্র ভরে দিলে, এক চুমুকে মধু মেশানো জলটুকু নিঃশেষ করল। পরপর বেশ কয়েকবার পাত্র খালি করার পরে তার মনে হল গলার শুষ্কতা কমেছে।

‘আমার পোশাক নিয়ে এসো মেয়ে।’

মেরুন রঙের লিনেনের টিউনিক। তার ওপরে হাঁটু ঝুল সাদা স্টোলা। মেরুন রঙেরই লম্বা টোগা শরীরে প্যাঁচ খেয়ে কাঁধ হয়ে হাতে এসে ঝুলছে। লঘু পায়ে বাজারের পথে হেঁটে চলেছে গায়াস। ব্যস্ততা চোখে পড়ছে সর্বত্র। পাশাপাশি নানান পসরা সাজিয়ে বসে আছে বিক্রেতারা। ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার জন্য কোনো দোকানের সামনে খাঁচায় ঝুলছে রং-বেরঙের পাখি। এক দোকানের মালিক অতিরিক্ত উৎসাহে গলায় সরু শেকলে ছোট্ট বানরকে বেঁধে রেখেছে। বেচারা এখনো অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। বিস্তর লাফালাফি করছে। বাজারের ঠিক মাঝামাঝি জাজমেন্ট স্কোয়্যর। এখানে দোকানপাট বসানোর অনুমতি নেই। প্রায় প্রতিদিন বিচার চলে। শহরে অপরাধের শেষ নেই, বিচারেরও। সাধারণ চুরি জোচ্চুরি তো আছেই, গুরুতর অপরাধের সংখ্যাও কম নয়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই শহরের সম্ভ্রান্ত এবং প্রাজ্ঞ নাগরিকদের জুরি হিসেবে পালা করে এইসব বিচারের ভার সামলাতে হয়। আজও বিচার বসেছে। তিনজন জুরির সামনে হাঁটু মুড়ে বসে রয়েছে এক যুবক। চেহারা এবং পোশাকের মলিনতা তার দারিদ্রতার সাক্ষ্য দিচ্ছে। পেছনে, জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক যুবতি। সম্ভবত তার স্ত্রী। বুকের কাছে ময়লা কাপড়ে জড়িয়ে ধরে রেখেছে তাদের প্রিয় সন্তানকে। গায়াস ভিড়কে পাশ কাটিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়াল। যুবকটির বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ এনেছে এক দোকানী। জুরিদের ইনিয়েবিনিয়ে নিজের ক্ষতির পরিমাণ বোঝাতে চাইছে। পাল্লা দিচ্ছে যুবকটিও। তার চোখের জলে মাটি ভিজে যাওয়ার জোগাড়! বুক চাপড়ে নিজের অসহয়তা জাহির করছে। কখনো ছুটে যাচ্ছে নিজের স্ত্রীর কাছে। স্ত্রী এবং শিশু সন্তানকে দেখিয়ে জুরিদের সহানুভূতি জোটাতে চাইছে প্রাণপণে। এই বিচার এভাবেই চলবে। এবং এর পরের বিচারও। বাদি-বিবাদি উভয়পক্ষই নিজের অসহায়তাকে ঢাল করে লড়াই চালিয়ে যাবে। রোমে সকলের জন্য এক আইন। অবশ্য একথা শুনতে যতটা চমৎকারই লাগুক, আদতে তার প্রয়োগ সীমাবদ্ধ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে খুন কিংবা নারীর সম্মানহানির মতো গুরুতর অভিযোগে দরিদ্র নাগরিকের তুলনায় ধনী এবং প্রভাবশালীদের শাস্তি অনেক হালকা হয়ে থাকে।

গায়াস ভিড় ছেড়ে বেরিয়ে সামনের রাস্তা নিল। কিছুটা হেঁটে দ্রুত খাবার পরিবেশন করা হয় এমন একটা থার্মোপোলিয়ার (Thermopolia- fast food places) সামনে এসে দাঁড়াল। একটা ব্রোঞ্জের মুদ্রার বিনিময়ে পানীয় নিল। সঙ্গে পোরিজ। দোকানের পাশেই বসার জায়গা। একটু ফাঁকায় জায়গা খুঁজে নিল গায়াস। অফুরন্ত সময় তার হাতে। জমানো যা কিছু আছে, তা দিয়ে এভাবে বসে খেলেও স্বচ্ছন্দে চলে যাবে। অবসরকালে তাকে এক টুকরো জমি দেওয়া হয়েছে। জীবনের সেরা সময় দেশের প্রতি অনুগত থাকার দরুন অবসরপ্রাপ্ত রোমান সেঞ্চুরিয়ান কিংবা লিজিয়নারিরা এমন জমি লাভ করে। গায়াস সেই জমি ভাড়ায় দিয়েছে। সেখান থেকেও আয় মন্দ হয় না। সুতরাং তার বাকি জীবনটা ফূর্তিতেই কাটা উচিত ছিল। অথচ দেখ, যুদ্ধক্ষেত্রে অকুতোভয় হয়েও এখন তাকে আতঙ্কে দিনগুজরান করতে হচ্ছে! গায়াসের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।

‘এসতাকিফ ব-খক্‌… এখানে বসতে পারি?’

অ্যারামিক ভাষা শুনে গায়াস চমকে বক্তার দিকে চাইল। ইহুদি! এখানে! জুডেয়াতে অনেকগুলো বছর কাটিয়ে সে জন্মস্থানে ফিরে এসেছে। কতগুলো চন্দ্রমাস হিসেব রাখেনি, কিন্তু মনে হয় এই তো সেদিনের ঘটনা। গলগাথার রাস্তায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে নিজের মৃত্যু পরোয়ানা বহন করে নিয়ে চলেছেন নাজরাতীয় জিশু। পেছনের ভিড় থেকে হাহাকারের সঙ্গে ভেসে আসছে, ‘এলোহিম’, ‘ম্যাকিলা'(হা ঈশ্বর, ক্ষমা করো) এমন সব শব্দ। দৃশ্যটা মনে করে চোখ বন্ধ করে ফেলল গায়াস।

‘আরিমাথিয়ার জোসেফ আমাকে পাঠিয়েছেন। বলেছেন এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের কথা।’

‘দুঃস্বপ্ন!’

ঘোর বিস্ময়ে চোখ মেলল গায়াস। বৃদ্ধ জোসেফ এবং তার সঙ্গীর মুখ মনে পড়ল। স্বজাতির রোষানলে পুড়ে মরতে হবে জানার পরেও লোকটা জিশুর শরীরকে সমাধিস্থ করার মতো সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আবার সে-ই মৃতদেহকে সমাধি থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল! আরিমাথিয়ার বৃদ্ধ জোসেফ এতদিন পরে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছেন! কেন? তবে কি সেই একই ভয়াবহ প্রাণী জোসেফকেও তাড়া করে ফেরে। প্রতি রাত্রে মৃত্যু উপহার দেয় কেবলমাত্র দিনের নিশ্চিন্ত নিদ্রা কেড়ে নিতে? হতে পারে। উৎকোচ গ্রহণের মতো দানকেও পাপ বলেছেন নাজরাতীয় জিশু। অথচ তাঁর অনুসরণকারী হয়ে জোসেফ একই দোষে দুষ্ট। সমাধিক্ষেত্র থেকে নাজরাতীয় জিশুর শরীরকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বৃদ্ধ তার হাতে একশো দানেরিয়াস তুলে দিয়েছিল। চামড়ার থলিতে মুদ্রার শব্দ তুলে বলেছিল, ‘দয়া করে প্রভু জিশুর কৃপা মনে করুন। আপনার প্রিয় সেবক তাঁর দয়াতেই সুস্থতা পেয়েছিলেন। প্রভু জিশুকে যে অন্যায্য বিচারে ক্রুশে তোলা হয়েছিল, সেকথা সম্ভবত আপনিও মানেন।’

‘আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি মাত্র জোসেফ।’

‘আমি জানি হে বীর যোদ্ধা। কিন্তু এখন তো সেই দায়িত্ব ফুরিয়েছে৷ প্রভু জিশু চিরতরে আমাদের ছেড়ে গিয়েছেন। চারিদিকে তাকিয়ে দেখুন, অরাজকতা, ক্ষুধা এবং হাজারো অবিচার এখনো রয়ে গেছে৷ প্রভু জিশু এসব থেকে আমাদের মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন। তিনি সকলের মাঝে দাঁড়িয়ে পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন। আমি তাঁর সেই ইচ্ছা পূরণ করতে চাই মাত্র।’

গায়াসের মনে হয়েছিল বৃদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে।

‘কিন্তু আপনাদের ঈশ্বরের সন্তান যে এখন মৃতদের মাঝে। সমাধিতে চিরঘুমে শুয়ে। কীভাবে তাকে সকলের মাঝে আবার দাঁড় করাবেন?’

বৃদ্ধ জোসেফের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখা দিয়েই মিলিয়ে গিয়েছিল।

‘প্রভু আবার উঠে দাঁড়াবেন। ঈশ্বরের সন্তান আবার ফিরে আসবেন। শুধু আপনার সাহায্য প্রয়োজন। নাজরাতীয় জিশুর মৃত শরীর গভর্নর পিলেতের কোনো উদ্দেশ্যই সফল করবে না। এমনকি মহাযাজক কাইয়াফাস এবং তাঁর সহচরেরাও এখন নিশ্চিন্ত। আপনি কেবল প্রভুর শরীর আমাকে নিয়ে যেতে দিন।’

‘তা হয় না জোসেফ। এই সমাধি পাহারা দেওয়ার ভার আমার। আমি তা অলঙ্ঘন করতে পারি না।’

‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন হে যোদ্ধা। এ কথা তৃতীয় কেউ কোনোদিন জানতে পারবে না। প্রভু জিশুর নামে শপথ করে বলছি।’

এরপর আর ‘না’ বলার সঙ্গত কারণ খুঁজে পায়নি গায়াস। একটা মৃতদেহ বই তো আর কিছু নয়। এমনিতেও আর বড়োজোর দুটো দিন পাহারায় থাকতে হবে। তারপর শেয়াল-কুকুরে ছিঁড়ে খাবে গলা, পচে যাওয়া শরীর। তার চেয়ে বৃদ্ধ জোসেফ যদি স্বেচ্ছায় মৃতদেহের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়, ক্ষতি কী? এটা বরং তার কাছে লাভজনক সওদা।

জুডেয়া থেকে জন্মভূমিতে ফিরে আসার পথে ঈশ্বরের সন্তানের জেগে ওঠার আশ্চর্য কথা শুনতে পেয়েছিল গায়াস। সমাধিগুহায় মশলা এবং সুগন্ধী নিয়ে গিয়েছিল যে মহিলারা, তারা নাজরাতীয় জিশুর শরীরকে খুঁজে পায়নি। স্বাভাবিক। কিন্তু এরপর জন্ম নিয়েছিল আশ্চর্য সব গল্প। গলগাথার সমাধিতে গিয়েছিল যারা, সেই মহিলাদের সামনে স্বর্গ থেকে দেবদূত উপস্থিত হয়ে প্রভু জিশুর অমরত্বের কথা ঘোষণা করে গেছেন! জেরুজালেম থেকে সাত মাইল দূরে ইম্মায়ু গ্রামের দুই বাসিন্দা নাকি পথে নাজরাতীয়দের মাসিহার সাক্ষাৎ পেয়েছেন! অসংখ্য অনুগামীর সামনে তিনি বারবার উপস্থিত হয়ে বলেছেন, ‘আমি জীবিত। মৃতদের মাঝে আমাকে খুঁজো না।’

বৃদ্ধ জোসেফ কী পরিকল্পনা করেছিল গায়াস জানে না। তার খোঁজও করেনি। কেবল কেউ তাকে দোষারোপ করেনি জেনে আস্বস্ত হয়েছিল। নিশ্চিন্ত মনেই জুডেয়া থেকে ফিরে এসেছিল সে। আর তারপর থেকে শুধু দুঃসহ স্বপ্নের রাত, এবং আতঙ্কে ঘিরে থাকা দিন।

‘কী চান আরিমাথিয়ার বৃদ্ধ?’

গায়াসের কণ্ঠে ব্যগ্রতা ফুটে উঠল।

‘আপনার সাক্ষাৎ। তাঁর ধারণা আপনিই তাঁর মুক্তির একমাত্র পথ।’

সিদ্ধান্ত নিতে মুহুর্ত সময় নিল না গায়াস। পান পাত্র ভরাই পড়ে রইল। পোরিজও তার উষ্ণতা হারিয়েছে। যেন ধ্যান ভেঙে উঠে দাঁড়াল গায়াস। মাটিতে লুটিয়ে থাকা টোগার প্রান্তদেশ হাতে পেঁচিয়ে নিয়ে অদ্ভুত শান্ত স্বরে সে বলল, ‘আমরা আগামীকালই বেরিয়ে পড়ব। আপনি প্রস্তুতি নিন।’

 

 

এক বিপ্লবীর মৃত্যু

…………………………….

‘বায়োলজিক্যাল সোয়াব দিয়ে বর্শার ধাতব অংশকে ভালোভাবে পরীক্ষা করা হয়। নাহ্, রক্ত কিংবা অন্য কোনো জৈবিক উপাদানের চিহ্ন পাওয়া যায়নি যা মারিয়মের সন্তানের কাছে আমাদের টেনে নিয়ে যেতে পারে। এক্স-রে ডিফ্র‍্যাকশন এবং ফ্লুরোসেন্স টেস্টও করা হয়েছিল। কিন্তু সেখানেও এমন কোনো সূত্র পাওয়া যায়নি যার দ্বারা আমরা জিনিসটাকে ঈশ্বরের মৃত্যুর জন্য দায়ী করতে পারি। যে ধাতব তার দিয়ে বর্শা ফলককে জুড়ে রাখা হয়েছিল, পরীক্ষায় জানা যায় তা ৬০০ খ্রীস্টাব্দের। রুপোর অংশটুকু এগারো শতকে জোড়া দেওয়া হয়। সোনার দারুণ কাজ করা স্ক্যাবার্ড তো আরও তিন শতক পরের।’

‘তার মানে হফবার্গ প্যালেসের কোষাগারে যে বস্তুটি যত্ন করে সাজিয়ে রাখা, সেটি জিশুর মৃত্যুর কারণ নয়!’

‘না। অন্তত পরীক্ষার ফলাফল তেমনই বলে। এর পরেও হ্যাবসবার্গ শাসকরা জিনিসটা এবং তার সঙ্গে জড়িত যাবতীয় কাহিনীকে সত্যি বলেই মেনে এসেছে। অবশ্য সৌভাগ্যের কথা বললে তার প্রমাণ বহু পূর্বেই পাওয়া গিয়েছিল। পবিত্র বর্শা হ্যাবসবার্গ রাজবংশের প্রাসাদেই ছিল। তবুও তার দৈবিক ক্ষমতা নেপোলিয়নকে থামতে পারেনি। তবে তাতে ফ্যুয়েরা-এর বিশ্বাসে টাল খায়নি। তাঁর দৃঢ় ধারণা ছিল যে পবিত্র বর্শাটি তাঁকে এবং জার্মান জাতিকে এক সুমহান উচ্চতা দান করবে। তাই বর্শাটা হফবার্গ থেকে ন্যুরমবার্গ-এ বিশেষ ব্যবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়।’

‘বার্লিনের যুদ্ধে পরাজয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, কাপুরুষের মতো আত্মহত্যা করার আগের মুহুর্তে, মানুষটা নির্ঘাত নিজের মুর্খামির কথা ভেবে হেসেছিল।’

‘ঠিক। পবিত্র বর্শা হিটলারকেও জয় এনে দিতে পারেনি। অবশ্য জিনিসটা আসল হলে কী হতো তা আমরা জানি না। এখন প্রশ্ন হলো, দ্য লেন্স অব লংগিনাস কি আদৌ হফবার্গ প্যালেসে আছে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জিনিসটা অস্ট্রিয়ার হাতছাড়া হয়ে যায় এ কথা সকলেই জানে। যুদ্ধের পরে হস্তান্তরের সময় বদলে দেওয়া হয়নি তো?’

‘মানে! কে বদলাবে, আর কেনই বা বদলাতে যাবে?’

‘সৌভাগ্যের প্রতি লোভ কার নেই এমা? অনেকে তো এখনো নানা কথা বলাবলি করে। যুদ্ধ শেষের পর আমেরিকান সৈন্যদল ভূ-গর্ভস্থ কোনো বাঙ্কারে সৌভাগ্য শলাকাটি খুঁজে পায়। দলের ভারপ্রাপ্ত অফিসার জেনারেল জর্জ স্মিথ পবিত্র বর্শা এবং তাকে ঘিরে তৈরি হওয়া গল্পকথার সঙ্গে সম্যকভাবে অবহিত ছিলেন। তিনি নিজ দায়িত্বে পবিত্র বর্শাকে আমেরিকা নিয়ে যান। পরে অবশ্য আন্তর্জাতিক চাপাচাপিতে অস্ট্রিয়াকে জিনিসটা ফিরিয়ে দিতে হয়। নেওয়া এবং ফিরিয়ে দেওয়ার মাঝে বদলা-বদলি করা খুব কঠিন কাজ নয়। তাই না? যদিও লুডল্ফ, এবং আমারও ধারণা আমেরিকা তার বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে এত বড়ো বিশ্বাসঘাতকতা করবে না। জিনিসটা আদতে লংগিনাসের বর্শা ছিলই না।’

‘বাপরে!’

কফির কাপ নামিয়ে রাখার ফাঁকে এমা বিস্ময় প্রকাশ করল।

‘হ্যাবসবার্গ কোষাগারে দ্য হোলি লেন্স নামাঙ্কিত বস্তুটি তবে তবে ইতিহাসের লম্বা রাস্তা পার করে এসেছে! যিশুর নামের সঙ্গে নাই-বা জোড়া গেল, তাতে জিনিসটার ঐতিহাসিক গুরুত্ব কমে না।’

‘খাঁটি কথা। অতএব নিশ্চিত হওয়া গেল জিনিসটা লংগিনাসের নয়, এবং কোনো সৌভাগ্যও বহন করছে না।’

‘এগজ্যাক্টলি। হিসেব মোতাবেক এরপর লুডল্ফের দ্য হোলি লেন্স নিয়ে আগ্রহ ফুরিয়ে যাওয়ার কথা।’

এমার দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর তাড়া দেখে বৃদ্ধ প্রফেসর মুচকি হাসলেন।

‘কিন্তু বাস্তবে তা আর হল কৈ?”

‘কেন, লুডল্ফ পরীক্ষার ফলে সন্তুষ্ট হতে পারেননি বুঝি?’

‘না, সে চলার পথ বদলে নিয়েছিল, তবে লক্ষ্য থেকে সরেনি। হয়তো সেই কারণেই অনেক বড়ো মূল্য দিতে হয়েছে তাকে।’

প্রফেসরের গলার স্বর ভারী হয়ে এল।

‘আপনার বন্ধু কি…?’

উত্তর অনুমান করেই এমা তার প্রশ্নকে অর্ধসমাপ্ত রাখল। ওপর-নিচে মাথা নেড়ে এমার অনুমানকে মান্যতা দিলেন প্রফেসর।

‘কাজের চাপ ছিল দু’জনেরই। দেখা কথা হতো কম। তবে সেরকম কোনো উল্লেখযোগ্য ধাপে পৌঁছালে, আমাকে জানাত। নিজের নিজের রিসার্চ নিয়ে আমাদের মধ্যে নিয়মিত না হলেও, কথা হতো। তারপর একদিন আচমকা খবরটা পেলাম। যে মানুষটা হিমোফোবিয়ায় ভুগত, আঙুলের ডগায় সূঁচ পর্যন্ত ফোটাতে দিত না, রক্ত দেখে কতবার অজ্ঞান হয়ে গেছে গুনে বলা মুশকিল, সে কিনা নিজের হাতের শিরা কাটবে! অবিশ্বাস্য নয়?’

এমন প্রশ্নের ঠিক কী জবাব দেওয়া যায় এমা বুঝতে পারল না। প্রফেসর বলে চললেন, ‘আমি মানতে পারিনি। লুডল্ফের অসুখ যদি না মানার একটা কারণ হয়, আরও একটা বড়োসড়ো প্রশ্ন আছে যার উত্তর খোঁজার প্রয়োজন মনে করেনি কেউ। মোটিভ। সে কেন এমন কাণ্ড ঘটাবে? বিশেষত ঘটনার এক সপ্তাহ আগেই যখন ফোনের ওপ্রান্তে তার দারুণ প্রত্যয়ী কণ্ঠস্বর শুনেছি। তাই খবর পাওয়া মাত্র কাপুথ(Caputh) উড়ে যাই।’

‘কাপুথ! আইনস্টাইনের জন্মভিটে ছিল না?’

‘হ্যাঁ। তুমি জানো দেখছি! লুডল্ফ আমারই মতো পারিবারিক বসতিকে স্থায়ী ঠিকানা বানিয়ে নিয়েছিল। নিভৃতে কাজ করার জন্য সেরা পছন্দ।  বসবাসকারীদের সংখ্যা আহামরি নয় বটে, তবে প্রায় সকলেই বিত্তশালী। লুডল্ফের বাড়িতে গিয়ে আরও একটা তথ্য জানতে পারি। ডায়ানা, ওর বান্ধবী, যে লুডল্ফের সহকর্মীও ছিল, ঠিক দু’দিন আগে একইভাবে আত্মহত্যা করেছে।’

‘পরপর দুটো অস্বাভাবিক মৃত্যু! ঘটনাটা কবেকার বলেছিলেন যেন?’

‘মাস ছয়েক আগের। বয়সের বিচার করতে যেও না। লুডল্ফ আমার বয়সী হলেও অনেক প্রাণবন্ত এবং রসিক ছিল। হুটহাট প্রেমে পড়া এক ধরনের বাতিক ছিল ওর। ডায়ানার ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রম ঘটে। নাকি ষাটের গণ্ডি পেরিয়ে আমার বন্ধুবরটি একটা পাকাপোক্ত জেটিতে তার নৌকা বাঁধতে চেয়েছিল জানিনা। তবে এ কথা সত্যি, ডায়ানার সঙ্গে ওর সম্পর্কটা টিকে গিয়েছিল।’

‘এক্ষেত্রে দুজনের একই বিষয় নিয়ে একসঙ্গে কাজ করাও একটা এক্স ফ্যাক্টর হতে পারে। আর হ্যাঁ প্রফেসর, আমার প্রশ্নের উদ্দেশ্য বেশি বয়সে লুডল্ফের প্রেমে পড়া নয়৷ প্রেমে পড়ার ক্ষেত্রে বয়সকে আদতে কোনো বাধা বলে আমি মনে করি না। আমার কৌতূহলের কারণ, আপনি কাপুথে কী এমন খুঁজে পেলেন, যে জন্য নিজের রিসার্চ থেকে সরে আসতে হল?’

উত্তর দিতে কিছুটা সময় নিলেন প্রফেসর বরিস। ছাইদানিতে নিভে যাওয়া পাইপটা বার কয়েক ঠুকে পোড়া তামাক বের করে আবার নতুন করে ভরে নিলেন। তারপর আগুন না ধরিয়ে মুখের একপাশে রেখে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, ‘কিছু একটা তো পেয়েছি বটেই। অনুমানও বলতে পারো। আর তা মিলে গেলে অনেক চড়াই-উতরাই পার হতে হবে। এই বুড়ো বয়সে অতটা ঝক্কি আমি একা সামলাতে পারব না। তাছাড়া সেন্ট লংগিনাসের পিছু ধাওয়া করে লুডল্ফ অনেকটাই এগিয়েছিল। সুতরাং শেষের কয়েকটি ধাপ পার হতে পারলেই তুমি লক্ষ্যের সামনে দাঁড়াতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।’

‘এবং সেই লক্ষ্যের কারণেই লুডল্ফকে হত্যা করা হয়। সরিয়ে দেওয়া হয় তাঁর বান্ধবীকেও। এমনটাই আপনার ধারণা। তাই তো?’

পাইপের তামাকে অগ্নিসংযোগ করে একদলা সুগন্ধি ধোঁয়া উগড়ে দিলেন প্রফেসর বরিস। তারপর দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, ‘একেবারেই তাই এমা। যদিও ফেডারেল ডিপার্টমেন্ট একটা সহজ যুক্তি খাড়া করেছে। ডায়ানার শোকে লুডল্ফও একইভাবে নিজেকে শেষ করেছে।’

‘হিমোফোবিয়া আছে এমন মানুষের পক্ষে কাজটা নিশ্চিতভাবেই কঠিন। মনোবিশারদরা ভালো বলতে পারবেন। অবশ্য আপনার বন্ধু কিংবা তাঁর বান্ধবীর মৃত্যু রহস্যভেদ করা আমার কাজ নয়।’

‘আমি তা চাই-ও না এমা। আমি চাই লুডল্ফের দেখা স্বপ্নকে যাচাই করতে।’

‘আর আপনার নিজের স্বপ্ন? ট্রু ক্রশ?’

‘কিছুটা ব্যহত হবে। পুরোপুরি নয়। রাফায়েল বেশ করিৎকর্মা ছেলে। গাইড করলে কাজ চালিয়ে যেতে পারবে বলেই মনে হয়। তাছাড়া দ্য হোলি লেন্স অনুসন্ধানের কাণ্ডারি তো তুমি। আমি তোমার নৌকার এক সওয়ারী মাত্র।’

 

দিনের আয়ু প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। পাহাড়ের মাথায় কমলা রঙের সূর্যপ্রদীপ নিভে যাওয়ার আগে তার লালিমা ছড়িয়ে দিচ্ছে আকাশ জুড়ে। ছাদে উঠে না এলে এই অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য থেকে বঞ্চিত হওয়ার আফসোস সারা জীবনেও এমার শেষ হতো না। প্রফেসর বরিসের বাড়ির ছাদ থেকেই দানিয়ুবের বড়ো বাঁকটা দেখতে পাওয়া যায়। আকাশ থেকে আগুন রং চুঁইয়ে পড়েছে নদীর জলে। পশ্চিম আকাশের সেই আগুনে সাঁতার কেটে চলেছে এক ঝাঁক পাখি। বাড়ি ফিরছে হয়তো। এই পুরোনো স্থাপত্যের পেছনে কতগুলো এপ্রিকট গাছ গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে। শরীরে গোলাপি সাদা ফুলের শাড়ি জড়িয়ে তারা বুঝি বসন্তের উদযাপনে মত্ত। একটা ব্ল্যাক হুডেড ওরিয়ল গাছের ডালে বসে মাঝেমধ্যে সুর করে ডেকে উঠছে। এমার শুনে মনে হল যেন বলছে- হিয়ার উই গো, হিয়ার উই গো।

 

‘আচ্ছা প্রফেসর, একটা বর্শার কি আদতেও কোনো অলৌকিক ক্ষমতা থাকতে পারে?’

‘ওয়েল… যদি সেই বর্শায় ঈশ্বরের সন্তানকে বিদ্ধ করা হয়, তবে এমন কিছু ঘটতেই পারে। এমা, তুমি পরের প্রশ্নটা আগে করে ফেলছ।’

‘অর্থাৎ জিশু ঈশ্বরের সন্তান কিনা? বেশ, এ সম্পর্কে আপনার মতামত শুনি। ট্রু ক্রশ যখন আপনার রিসার্চের বিষয়, নিশ্চয়ই সন্তোষজনক একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে।’

প্রফেসর সশব্দে হেসে উঠলেন। তাঁর হাসির তোড়ে বেচারি হলুদ বেনেবউ ঘাবড়ে গিয়ে উড়ে দূর গাছে আশ্রয় খুঁজে নিল।

‘ধারণা তো আছেই, কিন্তু তা তোমাকে কতটা সন্তুষ্টি দেবে আমি জানি না। জিশুর সমসাময়িক রোমান সম্রাটের নাম জানা আছে?’

‘অগাসটাস।’

‘সিজার অগাসটাস। তিনি সুদীর্ঘ গৃহযুদ্ধকে নিয়ন্ত্রণ করে রোমে বহুপ্রত্যাশিত শান্তি ফিরিয়ে এনেছিলেন। হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বের ত্রানকর্তা। পৃথিবীর কাছে একটা দারুণ সুসংবাদ। এবং সম্রাটের অনুরাগীরা এই কৌশলী প্রচারের মাধ্যমে একটা তত্ত্বকে সফলভাবে খাড়া করেছিল। মহান সম্রাট আগাসটাস হলেন ঈশ্বরের সন্তান। হঠাৎ কোত্থেকে এক ইহুদি যুবক ধুমকেতুর মতো উদয় হয়ে তাঁর সম্মান নিয়ে টানাটানি শুরু করল!’

‘মানে?’

‘মানে লিউকের গসপেল অনুযায়ী দেবদূত গ্যাব্রিয়েল সন্তানসম্ভবা মেরির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ঘোষণা করেন- তাঁর আসন্ন সন্তান আসলে ঈশ্বরের সন্তান। এখানেই তো সিজার অগাসটাসের সঙ্গে জিশুর তুলনা টানা শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। তাই নয় কি?’

‘আচ্ছা! তার মানে কেবলমাত্র ইহুদী যাজকদের ক্ষোভ জিশুকে ক্রুশে তোলেনি, পেছনে এটাও একটা কারণ ছিল?’ পুরোনো প্রশ্নটা দ্বিতীয়বার করল এমা।

‘অন্তত সে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যায় কি? যতই হোক জুডেয়ার গভর্নর পয়েন্টাস পিলেত ছিলেন অগাসটাসের প্রিয় পাত্রদের একজন। সুতরাং সম্রাটের ভাবমূর্তিকে রক্ষা করার দায় তিনি এড়ান কীভাবে? যদিও প্রচলিত এই যুক্তিটা আমার অন্তত পোক্ত বলে মনে হয় না।’

‘না হওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই পোক্ত যুক্তি আছে?’

প্রৌঢ় ইতিহাসবিদ মৃদু হেসে বললেন, ‘তা আছে বটে। দ্য ফোর গসপেল, নিউ টেস্টামেন্ট যার ওপরে গড়ে উঠেছে।’

‘ম্যাথিউ, মার্ক, লিউক আর জনের গসপেল। জানি। কিন্তু এগুলো আপনার সিদ্ধান্তের কারণ কেন?’’

‘কারণ এই চারটি গসপেল ছাড়া আরও অনেক গসপেল ছিল, কিছু এখনো আছে। এবং সেইসব গসপেল মূল চারটি থেকে একেবারে স্বতন্ত্র। টমাসের গসপেলের কথাই ধরা যেতে পারে, যেটা জুডাস এবং টমাস দু’জনে মিলে লিখেছেন। সেখানে শুরুই হচ্ছে- এই কথাগুলো জিশুর জীবিতকালীন সময়ে তাঁর মুখের কথা। ফিলিপের গসপেলে মেরি ম্যাগদালিনের কথা বলা আছে যিনি আবার ছিলেন জিশুর ঘনিষ্ঠ। এগুলো ছাড়াও পিটারের গসপেল, দ্য সিক্রেট বুক অফ জন, এবং আরও অনেক গসপেলে নাজরাতীয় জিশুকে নিতান্ত একজন সাধারণ মানুষ হিসেবেই তাঁর কাজকর্মের ব্যাখ্যা করা হয়েছে। প্রচলিত বিশ্বাস এবং জিশুর অলৌকিক শক্তির প্রতি ছিটেফোঁটা সমর্থনও এগুলোর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না।’

‘অর্থাৎ জিশু ঈশ্বরের সন্তান বলে দাবি সর্বৈব মিথ্যে, এবং সেই কারণে সিজার অগাসটাসের রোষ আদতে প্রতিষ্ঠিত মিথ। তাই তো?’

‘প্রতিষ্ঠিত মিথ! চমৎকার বলেছ। শুরুটা হয়েছিল ১৮০ শতকের দিকে। ইউরেনিয়াস তখন লিঁও-এর বিশপ। মুখ্যত তাঁর কৃতিত্বে চার্চ একটা সংগঠিত রূপ পেতে শুরু করে। তার আগে বিভিন্ন গোত্র আলাদা আলাদা বিশ্বাস নিয়ে চলত। ফলে ভেদাভেদ এবং মতান্তরে সংঘর্ষ। বিশপ ইউরেনিয়াস কড়া হাতে বিষয়টা নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি প্রথমেই ঘোষণা করেন সমস্ত নিয়ম-নীতি চার্চ অনুসারী হবে। লিঁও-এর বিশপই প্রথম চারটি চারটি গসপেলকে অনুমোদন দেন। বাকিগুলোকে সরাসরি ফেলে দেন বাতিলের খাতায়৷ এর প্রায় হাজার বছর পর ইজিপ্টের নাগ হাম্মাদিতে বাহান্নটা লেখ আবিষ্কার হয়। যার মধ্যে কবিতা, পৌরাণিক কাহিনির সঙ্গে অনেকগুলো গসপেলও ছিল। সেখানে প্রতিটি গসপেলেই জিশুকে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। একজন উদার এবং মুক্তমনা মানুষ যিনি সমাজকে শিক্ষিত করতে চেয়েছিলেন। ফল কী হয়েছিল অনুমান করতে পারো?’

‘ভ্যাটিকান নির্ঘাৎ সাততাড়াতাড়ি সেগুলোকে অবৈধ ঘোষণা করে?’

‘সঠিক। করবে নাই-বা কেন? ম্যাথুউ, মার্ক, লিউক, এবং জন তাঁদের গসপেলে জিশুর অলৌকিক কাণ্ডকারখানার বিবরণ দিয়েছেন। জিশুর কুমারী মায়ের গর্ভে জন্ম, তাঁর পুনরুত্থান ইত্যাদির মাধ্যমে জিশুর স্বর্গীয় ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছেন। চার্চের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তো এমন কিছুরই প্রয়োজন ছিল। মোদ্দা কথা হলো জিশুর দেবত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারলে চার্চ দেবগৃহ। জিশুর প্রতি ভক্তি জাগাতে পারলে তা চার্চকেও ভক্তি এনে দেবে৷ সহজ হিসেব।’

একটানা কথাগুলো বলে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন প্রফেসর বরিস। কথার ঝোঁকে তাঁর পাইপও নিভে গিয়েছিল। এমা তাড়াহুড়ো দেখাল না। ভদ্রলোক পুরোনো সময়কে দারুণভাবে তুলে ধরছেন! প্রফেসরকে তাঁর নিজস্ব গতিতে চলতে না দিলে হয়তো এই আকর্ষণীয়তা থাকবে না। প্রৌঢ় ইতিহাসবিদ নতুন করে পাইপে তামাক ভরে তাতে অগ্নিসংযোগ করলেন। তারপর মুখের সামনে ধোঁয়ার জাল তৈরি করে আবার ক্লাস শুরু করলেন।

‘সিজার অগাসটাসের ব্যক্তিগত সম্মানের প্রসঙ্গ বাদ দিলে যা পড়ে থাকে তা হলো বিশ্বাস। রোমানরা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করত। তাদের যাবতীয় উপাচারের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল- ঈশ্বর এবং সাধের রোমের মধ্যে সম্পর্ককে দারুণভাবে টিকিয়ে রাখা। তিনি যেন রোমের সাফল্য এবং সমৃদ্ধিকে উত্তরোত্তর উন্নতির শিখরে পৌঁছে দেন। দৈনন্দিন জীবনকে সহজতর করে তোলেন। ব্যধি, খরা থেকে রোমানদের রক্ষা করেন। এবং এজন্য তারা ঈশ্বরকে পশু, উৎকর্ষ পানীয় ইত্যাদি উৎসর্গ করত। রোমানদের যাবতীয় উপাচারের মধ্যেই ঈশ্বরকে উপঢৌকন দেওয়ার রীতি ছিল। এক কথায় বলা যেতে পারে, তাদের ধর্ম ছিল বিনিময়ের। ঈশ্বরকে দাও, তিনিও দেবেন। ভক্তির জায়গা কমই ছিল।’

‘অথচ জিশু সরাসরি রোমানদের প্রচলিত উপাচারের বিরোধিতা না করলেও, ঈশ্বরে ভক্তির ওপরেই গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সুতরাং ইহুদিদের মতো রোমানদের কাছেও তিনি ধর্মের কারণে শত্রু।’

এমার কথায় মাথা নাড়লেন প্রফেসর বরিস।

‘অর্থাৎ জিশুর ক্রুশবিদ্ধকরণের পেছনে ইহুদি ধর্মসভা, যাজক, রোমের ঈশ্বর বিশ্বাস ইত্যাদি একত্রিতভাবে দায়ী ছিল। এখন প্রশ্ন হলো, একটা লোককে সরানোর জন্য এতগুলো জোটবদ্ধ শক্তির প্রয়োজন পড়ল কেন? নাজরাতীয় জিশু কি তবে সত্যিই ঈশ্বরের সন্তান ছিলেন?’

 

দূর উপত্যকায় অন্ধকার জমতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণ হলো সূর্য পাহাড়ের আড়ালে নিয়েছে। ছায়া ঘন হচ্ছে ক্রমশ। প্রফেসর সামান্য থেমে যোগ করলেন,

‘রোমান নাগরিকদের জন্য আনুমানিক দুই থেকে চার হাজার লক্ষ টন শস্য যোগানের ব্যবস্থা করেছিলেন দ্য গ্রেট সেভিয়ার সিজার অগাসটাস। এবং তা যোগান দিত রোম অধিকৃত অঞ্চলগুলো। এছাড়াও ছিল প্রোডাকশন ট্যাক্স, কাস্টম ট্যাক্স, ট্রানজিট ট্যাক্স এবং আরও অনেক। তিন শতাংশ অভিজাত শ্রেণীর যাবতীয় স্বাচ্ছন্দ্য পূরণের জন্য দিবা রাত্র ঘাম ঝরাতে হতো বাকি সাতানব্বই শতাংশ দরিদ্রকে।’

‘দু হাজার বছর পেরিয়ে এসে, আজও কী আশ্চর্যজনক ভাবে পরিস্থিতি একই রয়ে গেছে প্রফেসর!’

‘কিছু কি আদতেও বদলায় এমা? বাহ্যিক একটা পরিবর্তন আসে বটে, কিন্তু ভেতরের সিস্টেমটা যে সেই একই জ্বালানিতে চলছে। খেটে খাওয়া মানুষের ঘাম রক্তই এই সমাজের জ্বালানি। সেখানে যারা বদল আনতে চাইবে, সমাজ তাদেরকে ক্রুশ ছাড়া আর কী উপহার দেবে বলো?’

এমা চমকে উঠল। পরনে সাদা কাসাক, গলায় ক্রুশবিদ্ধ জিশু। মাথায়, গালে কাঁচা পাকা দাড়ি নিয়ে এক শান্ত সৌম্য মুখ। ফাদার সাইমন। মঙইয়াম চার্চের বাগানে বসে তিনি বলেছিলেন,

‘আমাদের সমস্ত প্রথা, রীতি কিংবা দুর্নীতি সবই তখন ছিল। তার আগে এবং তারও আগে ছিল। সময়ের সঙ্গে আমরা বদলেছি মাত্র। তা বলে আমাদের সহজাত প্রবৃত্তিগুলোকে পেছনে ফেলে আসিনি। বহন করছি। এখানেও বদল ঘটেছে শুধুমাত্র কৌশলে।’ (প্রসঙ্গ : নষ্ট চাঁদের আলো)

বহুদিন আগে ফাদার সাইমনের বলা কথাগুলোই যেন অনুরণিত হলো প্রফেসর বরিসের কণ্ঠে! অন্ধকার এবার জড়িয়ে ধরেছে দুজনকেই। প্রফেসর তাই এমার ভাব পরিবর্তন খেয়াল করতে পারলেন না। তিনি আগের কথার রেশ ধরে বলে চললেন,

‘দুর্ভিক্ষ, মহামারীতে সমাজের ভোগান্তি চরমে। জীবন-জীবিকার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এমন এক ভীষণ অস্থির সময়ে একজন মানুষ এমন আশ্চর্য জীবনদর্শন আমদানি করলেন যেখানে শ্রেণীহীন সমাজ তৈরির কথা বলা হচ্ছে! বলা হচ্ছে সহানুভূতিশীল, বন্ধুত্বপূর্ণ, রোগ-জরা মুক্ত এক সুখী নিশ্চিন্ত জীবনের কথা! এসব তো সে-সময় খোলা চোখে স্বপ্ন দেখার সমতূল্য। আর তাই ডুবন্ত মানুষ যেভাবে খড়কুটো পেলেও আঁকড়ে বাঁচতে চায়, সকলে জিশুর হাত ধরে তাঁর দেখানো স্বপ্নের পথে হাঁটতে চেয়েছিল। আমি অন্তত তাঁকে একজন সমাজ বিপ্লবীর চোখেই দেখি। প্রবল ধর্মান্ধতার মধ্যে দাঁড়িয়ে মন্দিরকে অস্বীকার করা! মানুষকে ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে ঈশ্বরের খোঁজ করার কথা বলতে পারে যে মানুষ, তাঁকে বিপ্লবী ছাড়া আর কি বলা যায়? দীর্ঘ দশক ধরে শাসকদের বিভিন্ন স্তরের হাজারো চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের পৈতৃক জমিজামা হারানো, কিংবা দেনায় বিকিয়ে যাওয়া যখন সমাজের রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে, ঠিক সেই সময়ে জিশু বারবার দারিদ্র্যতা, ক্ষুধা এবং দেনার বিরুদ্ধে স্বর ওপরে তুলেছেন। এমনকি নিউ টেস্টামেন্টের চার গসপেল থেকেও তাই-ই জানা যায়। এরপরেও তাঁকে বিপ্লবী বলা যাবে না? রোম বিশ্বকে তার মহান ঐতিহ্যের সামনে নতজানু দেখতে চেয়েছিল। তার হাতের মুঠো যখন বাকিদের গলায় চেপে বসছে, তখন এক যুবক অসীম স্পর্ধায় মানবতার কথা শোনাচ্ছেন! প্রচলিত সামাজিক রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণার মূলে নৈতিকতার কুঠারাঘাত করছেন নিজের জীবনকে বাজি রেখে। মারিয়মের পুত্র যদি বিপ্লবী না হন এমা, তবে বিপ্লবের সংজ্ঞা বদলে ফেলা উচিত। অথচ ভাগ্যের পরিহাস দেখ, যে সিস্টেমের বিরুদ্ধে মানুষটা লড়াই করল, সমাজ তাকেই ঈশ্বর বানিয়ে চার্চের চৌহদ্দিতে বেঁধে ফেলেছে!’

‘তার মানে দ্য হোলি লেন্স ঈশ্বরের সন্তানের ঘাতক নয়। সেটার কোনো ঐশ্বরিক ক্ষমতা নেই।’

‘ঐশ্বরিক না হোক, ঐতিহাসিক গুরুত্ব তো আছে। বহুযুগ ধরে লংগিনাসের বর্শাকে ঘিরে যে গল্পকথা, তার একটা যবনিকাপতন ঘটবে। আমাদের কাছে সেটাই আকর্ষনের সবচেয়ে বড়ো কারণ। তাই না?’

 

অন্ধকার গাঢ় হওয়ার সঙ্গে ঠাণ্ডার তীব্রতা বাড়তে শুরু করেছিল। এমা হাতের তালু দিয়ে ঊর্ধ্ববাহুকে ঘষে নিল। স্পষ্ট দেখতে না পেলেও অনুমান করলেন প্রফেসর।

‘চলো, এবার নিচে গিয়ে একটু আগুনের আঁচ নেওয়া যাক। আমরা ঠিক আটটায় ডিনার করব। তার আগে তুমি ফ্রেশ হয়ে পোশাক বদলে নাও। বেলাকে বলা আছে। এতক্ষণে সে নিশ্চয়ই কোনো ব্যবস্থা করে রেখেছে। তার পর না হয় আবার ইতিহাসের চর্চা করা যাবে।’

 

 

শেষ ইচ্ছা

…………………

তার সামনে শুয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে চিনতে পারছিল না গায়াস। জুডেয়া ছাড়ার পর থেকে সেখানকার যাবতীয় খবর সম্পর্কে সে আগ্রহ হারিয়েছিল। শুধু কিছু স্মৃতি চেয়েও পেছনে ফেলতে পারেনি। বৃদ্ধ জোসেফ, নিকোডেমাস, সেক্রেটারি ম্যালিনাস, গভর্নর পিলেত, এবং অবশ্যই সেই আশ্চর্য মাসিহা। তাঁরা আজও ঘুরে ফিরে গায়াসের জেগে থাকা সময়ে কাছে আসেন। চোখের সামনে ভেসে ওঠে গলগাথার পথ, উদ্বেলিত জনতার একাংশের উচ্ছ্বাস। বাকিদের হাহাকার। ক্রুশবিদ্ধ একটা শরীর। গায়াস পালাতে চাইলেও দৃশ্যগুলো থেকে দূরত্ব কমাতে পারে না। যেমন পারে না প্রতি রাতে সেই ভয়ংকর পশুরাজের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে। এসবই বুঝি তার অবচেতন মনে বয়ে চলা পাপের ভার। কিন্তু আরিমাথিয়ার বৃদ্ধ জোসেফ তো প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন! করার সাহস দেখিয়েছিলেন স্বজাতিদের ঘৃণার আগুনে পুড়ে মরতে হবে জেনেও। ফল ভোগ করতে হয়েছে বেচারা জোসেফকে। প্রথমে সানহাদ্রিন থেকে বহিষ্কার, তারপর যাজক সভার বিচারে কারাবাস। বৃদ্ধ হলেও স্বজাতিরা রেহাই দেয়নি। নেহাৎ সম্রাট দয়াপরবশ হয়ে মুক্তি দিয়েছিলেন, নইলে লোহার গারদের ভেতরেই বৃদ্ধ জোসেফকে পচে মরতে হতো।

কয়েকটা বছরে এ কী অবস্থা হয়েছে জোসেফের! বিছানায় প্রায় মিশে যাওয়া একটা শরীর। দেখে মনে হয় কঙ্কালের ওপরে একটা পাতলা চামড়ার আবরণ রয়েছে কেবল। পাঁজরের দ্রুত ওঠা নামা দেখে ভয় হয়, এই থেমে গেল বুঝি। দুটো চোখ কোটরের গভীরে ঢুকে গেছে৷ কণ্ঠনালী কুৎসিতভাবে ঠেলে বেরিয়ে। হাঁ করে রাখা মুখ থেকে ঘরঘরে শব্দে অসংলগ্ন কথাগুলো কোনোক্রমে উচ্চারণ করলেন আরিমাথিয়ার বৃদ্ধ। তার কিছুটা গায়াস বুঝতে পারল, বাকিটা অনুমান করল।

‘মাসিহা না থাকলে আমাদের মুক্তি নেই। ঈশ্বরের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে সেঞ্চুরিয়ান গায়াস। এই পচে যাওয়া সমাজ থেকে তিনিই আমাদের উদ্ধার করবেন। সমাধিতে উৎসর্গ করো তোমার যা কিছু। সঁপে দাও নিজেকে। দায়িত্ব পালন করো সেঞ্চুরিয়ান গায়াস। অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্ত করো নিজেকে। সমাধিতে… বিশেষ… দায়িত্ব… প্রভু…’

শেষের ছাড়া ছাড়া কথাগুলো শেষ করতে পারলেন না আরিমাথিয়ার জোসেফ। তাঁর বুকের নিথর খাঁচার দিকে তাকিয়ে গায়াস বুঝতে পারল, সময় ফুরিয়েছে। বৃদ্ধের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে মধ্যবয়সী ইহুদি সেবকটি। একটু আগেই তারা একসঙ্গে প্রায় চোদ্দো দিনের পথ পেরিয়ে আরিমাথিয়ায় পৌঁছেছে। এখানে এসে কালবিলম্ব করেনি। সোজা হাজির হয়েছিল বৃদ্ধ জোসেফের শয়নকক্ষে। সেবকের মনের ভাব বোঝা যাচ্ছে না। নির্লিপ্ত ভঙ্গি। কেবল একভাবে প্রভুর দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

‘সৎকারের ব্যবস্থা করা দরকার।’

গায়াসের কথায় মুখ তুলল সেবক। থেমে থেমে জমে আসা কণ্ঠস্বরে জানাল, ‘সমাধি প্রস্তুত আছে। তবে এখনই নয়। সূর্যাস্তের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। প্রভুর নির্দেশ।’

‘এতক্ষণ অপেক্ষা করবে! কেন? আত্মীয় স্বজনরা কাছাকাছি থাকে না?’

‘না। প্রভুর চলে যাওয়ার খবর এখনই কাউকে দেওয়া হবে না। সমাধিতেও কারোর যাওয়ার নির্দেশ নেই। কেবলমাত্র আপনি এবং…’

চেয়েও প্রিয়জন হারানোর বেদনাকে চাপা দিতে পারল না সেবক। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘মাফ করবেন। আপনার জন্য খাদ্য ও পানীয়র ব্যবস্থা করি?’

সত্যিই খিদে পেয়েছে গায়াসের। সবজি দিয়ে মশলাদার ঝোল এবং রুটি। সঙ্গে উৎকৃষ্ট পানীয়। খাওয়ার পর শরীরে ঘাপটি মেরে থাকা ক্লান্তিবোধ যেন পেড়ে ফেলতে চাইল গায়াসকে। টানা ঘোড়া ছোটাতে হয়েছে। গ্রিসের মধ্যে দিয়ে দীর্ঘ পথ, তার ওপর জাহাজের ক্লান্তিকর যাত্রা। ধকল কম ছিল না। কিন্তু গায়াস চাইলেও বিশ্রামের সেভাবে সুযোগ পেল না। জোসেফের সেবক হাজির হতে শয্যা ছাড়তেই হলো তাকে।

‘আমাদের এখনই বেরিয়ে পড়তে হবে।’

‘এখনই!’

‘হ্যাঁ মাননীয়। রায়ডা(A large, covered, four-wheeled vehicle pulled by two or four horses) প্রস্তুত আছে। গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য বাকিদের আগেই বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং এখন প্রভু যোসেফের শেষ ইচ্ছে পূরণের ভার আমাদের। আরও একজন আছেন অবশ্য। মাননীয় অ্যাডোনিস। তিনি সমাধিক্ষেত্র অপেক্ষা করছেন।’

‘তিনি আবার কে?’

বিরক্তির সঙ্গে বলল গায়াস। নেহাত আবেগতাড়িত হয়ে এতদূর আসাটাই তার মূর্খামি হয়েছে। জোসেফের নাম শুনে দুঃসহ স্মৃতিগুলো ফিরে এসেছিল। ভয়ার্ত রাত্রির দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তির পথ খুঁজে দিতে পারে আরিমাথিয়ার বৃদ্ধ মানুষটি। সেবক তাকে সেই লোভ দেখিয়েই এখানে টেনে এনেছে। কিন্তু কোথায় মুক্তির পথ? মৃত্যুর দুয়ারে পা বাড়িয়ে রাখা বৃদ্ধ জোসেফ শব্দটা একবার মাত্র উচ্চারণ করতে পেরেছিল। কোনো সুনির্দিষ্ট পথের সন্ধান দেওয়ার সুযোগ পাননি বেচারা। ভাঙা ভাঙা শব্দে আর যা কিছু বলেছিলেন, বুঝতে পারলেও তার অর্থ উপলব্ধি করতে পারেনি গায়াস। ঈশ্বরের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে! নশ্বর মানুষের সেই সাধ্য আছে? সমাধিতে সে কী উৎসর্গ করবে? হাতের পুরোনো বর্শা আর কয়েকটা মুদ্রা ছাড়া এখানে তার আছেটাই বা কী? কোন বিশেষ দায়িত্বের কথা বলতে চেয়েছিলেন বৃদ্ধ? সবচেয়ে বড়ো প্রশ্ন, জোসেফকে সমাধিস্থ করা নিয়ে এতো গোপনীয়তা কেন? গায়াসের মস্তিষ্কে জেগে ওঠা কৌতূহল মিলিয়ে যাওয়ার আগেই তার প্রশ্নের রেশ ধরে বলে উঠল সেবক,

‘দক্ষ গ্রিক শিল্পী জেনেরিয়াসের সুযোগ্য পুত্র অ্যাডোনিস। যেমন ছবি আঁকার হাত, তেমনই স্থপতির। গত কয়েকবছর ধরে বিশ্বস্ত সঙ্গীদের নিয়ে সমাধিক্ষেত্র নির্মানের কাজ করেছেন।’

‘আমার সবকিছু ভীষণ জটিল এবং অস্বচ্ছ মনে হচ্ছে।’

কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল গায়াস। ইহুদি সেবক মাথা নিচু করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর আবেগমথিত গলায় বলল,

‘আমরা ভালো নেই মাননীয়। মন্দির থেকে ধর্মের নামে নিদারুণ যন্ত্রণা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ঘন অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে চারপাশ। বাঁচার জন্য আমাদের আলো প্রয়োজন মাননীয়। ঈশ্বরের সন্তান সেই আলো। প্রাণ দিয়ে সেই জ্যোতিকে রক্ষা করব। তাঁর শিক্ষা ছড়িয়ে দেব দিগন্ত পর্যন্ত। এই দেনাগ্রস্থ জীবন থেকে আমাদের মুক্তির পথ দেখাবেন মাসিহা। মৃত্যু যাঁকে ফিরিয়ে দেয়, একমাত্র তিনিই তো মাসিহা। ঈশ্বরের অংশ। সকলে তাঁর উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। আমি নগন্য সেবক মাত্র। নিজের অনুভবটুকু প্রকাশ করলাম৷ ভুল বললে মার্জনা করবেন। বাকিটা আপনি সমাধিক্ষেত্রে পৌঁছালে নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন।’

 

বিশ্বাস! যুগ যুগ ধরে এই বিশ্বাসকেই অস্ত্র বানিয়ে শাসনযন্ত্র নিষ্পেষিত করেছে বুভুক্ষু মানুষকে। আজ সেই বিশ্বাসে ভর করেই অপশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে চাইছে এরা! বৃদ্ধ জোসেফ কি এই কারণেই ঈশ্বরের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখার কথা বলেছিলেন? না ঈশ্বর নয়, আসলে বিশ্বাসকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে? নাজরাতীয় জিশুর অলৌকিক স্পর্শে প্রাণ পাবে মুমূর্ষু মানুষগুলো। গায়াসও পেতে পারে। এতদিন যত অনাচার করেছে, পাপ সঞ্চয় করছে, সবকিছু প্রভু জিশুর পায়ে উৎসর্গ করবে। হয়তো এটাই একমাত্র প্রতি রাতের মৃত্যুযন্ত্রনা থেকে তার মুক্তির পথ। শয্যার পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা খাটো বর্শার দিকে কিছুক্ষণ পলকহীনভাবে চেয়ে রইল রোমান সেঞ্চুরিয়ান। তারপর ধীর অকম্পিত কণ্ঠে বলল, ‘বেশ, তবে চলো।’

 

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *