সৌভাগ্যশলাকা। ধারাবাহিক উপন্যাস। পর্ব ৩। লিখছেন অলোক সান্যাল

ফিরবার পথে
……………………
দ্রুত পায়ে চড়াই ভাঙছিল জোসেফ। আজ বিশ্রামবার। নগরীর অধিকাংশ কাজ থেকে ছুটি নিয়েছে। এক বৃদ্ধ জোসেফের বসে থাকার ফুরসত নেই। এই ব্যস্ততা তার অনেকদিনের। নাজরাতীয় জিশুকে অনুসরণ করে গালীল থেকে সবূলূন হয়ে নপ্তালি, তারপর আবার জেরুজালেম চষে বেড়িয়েছে সে। এক দুর্বার আকর্ষণ তার শরীরের ক্লান্তি শুষে নিয়েছিল! নাকি সবই ঈশ্বরের সন্তানের ইচ্ছা? প্রভুর ক্রুশবিদ্ধ দৃশ্য কল্পনা করে তার মন বুক চাপড়াতে চাইল আবারও। সবকিছু তার চোখের সামনেই ঘটেছে। নাজরাতীয় জিশুর সহজ সরল ভঙ্গিতে শিক্ষাদান, সমাজে তাঁর তুমুল জনপ্রিয়তা, এবং সর্বোপরি পাপের থেকে মুক্তির পথ দেখানো। নাজরাতীয় জিশুর প্রতিটি মহান উদ্দেশ্য মহাযাজকসহ সমস্ত পণ্ডিত ও সম্ভ্রান্তদের মধ্যে অপরিমেয় হিংসার উদ্রেক ঘটিয়েছিল। মহাযাজক কাইয়াফাস এবং বাকিরা মিলিতভাবে যে এক ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের জাল বুনেছেন, তার আভাস পেয়েছিল জোসেফ। সানহদ্রিনের (ইহুদিদের বিচারসভা) ভেতরে থাকার সুবাদে কোনো কিছুই তার কাছে অজানা ছিল না। কেবলমাত্র একজন মানুষকে থামাতে নির্দ্বিধায় কত হীন কাজেই না লিপ্ত হয়েছিল সকলে! কাছ থেকে দাঁড়িয়ে দেখলেও জোসেফ তার নুন্যতম প্রতিবাদ করার সাহস জোটাতে পারেনি। কেবল গভর্নর পিলেতকে গোপনে খবরা-খবর পাঠিয়েই দায় সেরেছে। সংঘটিত চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালে, নিশ্চিতভাবে গোলগাথায় চতুর্থ ক্রুশ স্থাপন করা হতো। আর সেই ক্রুশে ঝুলতে হতো তাকে। তবুও একের পর এক অন্যায় দানা বাঁধছে দেখেও নীরব থেকে সে পাপ করেছে। পাপের ভয়ের থেকেও নিজের মৃত্যুভয়কে এগিয়ে রাখার অপরাধ করেছে। ক্ষমাহীন অপরাধ। আর এখন, জোসেফ চেয়েও তার প্রতিকার করতে পারবে না। কেবল প্রায়শ্চিত্তটুকুই করতে পারে সে। প্রভু জিশু তো তাই-ই বলেছেন। পাপের পঙ্কিল গহ্বর থেকে উত্তরণের পথ ঈশ্বরের নামে মন্দিরকে দান করার মধ্যে লুকিয়ে নেই। মুক্তির একমাত্র পথ অনুতাপ। নিখাদ অনুতপ্ত হৃদয়ে পিতার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে, তিনি তাঁর সন্তানকে ফিরিয়ে দেন না। জোসেফ একই ভুল দ্বিতীয়বার করবে না। যে উদ্যোগ সে নিতে চলেছে, তার দরুন হয়তো সমাজ তাকে আলাদা করে দেবে। অকুণ্ঠিত চিত্তে ঘৃণা দান করবে সবাই। করুক। জোসেফ প্রভুর দেখানো প্রায়শ্চিত্তের পথ ছাড়বে না।
পাঁজরের চাপে যেন ফুসফুস ফেটে পড়তে চাইছে। তবু থামলে হবে না। গভর্নর পিলেতের নির্দেশ নিয়ে রক্ষী গলগাথার দিকে চলেছে। তাকে চোখ ছাড়া করতে চায় না জোসেফ। অথচ না চাইতেও তার গতি শ্লথ হয়ে পড়ছে। মনের ভার জমা হচ্ছে শরীরের নিম্নাংশে।
‘নোও জোসেফ। আমাদের দ্রুত পৌঁছাতে হবে।’
সঙ্গীর কথায় মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়াল জোসেফ। আকাশের দিকে চাইল। সূর্য দেবতা যেন আগুন ঢেলে দিচ্ছেন! পৃথিবীর শেষ লগ্ন কি উপস্থিত? গতকালও ঠিক এমনই মনে হয়েছিল। সন্তানের মৃত্যুতে ক্রুদ্ধ ঈশ্বর গোটা করোটি পাহাড়কে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে চেয়েছিলেন! মনে হয়েছিল প্রভু জিশুর সঙ্গে পৃথিবীরও আয়ু বুঝি ফুরিয়ে এসেছে। উচ্ছ্বাস এবং কান্না একইসঙ্গে চাপা পড়েছিল দারুণ আতঙ্কে। যারা নাজরাতীয় জিশুর মৃত্যুযজ্ঞ উদযাপনে ভিড় করেছিল, শহরে ফেরার পথে প্রতি পদে পেছনে তাকিয়ে দেখছিল তারা। আবারও কোনো অলৌকিক শক্তির বহিঃপ্রকাশে মাটি কেঁপে উঠতে চলেছে ভেবে একে অপরের হাত খুঁজছিল। ‘ভুল’, এই একটা শব্দ তাদের মুখ থেকে মুখে ঘুরে ঘুরে যাচ্ছিল। যারা বিচারসভার বাইরে একসময় ভিড় জমিয়েছিল প্রভু জিশুর ক্রুশবিদ্ধকরণকে নিশ্চিত করতে, যারা গলগাথার পথে হাঁটতে হাঁটতে কেবল ঘৃণা এবং অপমান উগলে দিয়েছিল, তাদেরই চোখে একসঙ্গে আতঙ্ক এবং অনুশোচনার সহবাস দেখেছে জোসেফ।
‘একটু দ্রুত ভাই আমার।’
সঙ্গী নিকোডেমাস পুনরাবৃত্তি করল। নিজেকে তাগাদা দিল জোসেফ। সামনে অনেক কাজ। যদিও সব ব্যবস্থা সে আগে থেকেই করে রেখেছে৷ গলগাথার কাছেই নিজের ফলবাগান। দু’জন শ্রমিক এতক্ষণে সম্ভবত প্রভু জিশুকে সমাধিস্থ করার প্রস্তুতি সেরে রেখেছে।
জোসেফের অনুমান ভুল ছিল না। গভর্নর পিলেতকে একবার মাত্র অনুরোধ করেছিল সে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তিনি নাজরাতীয় জিশুকে সমাধিস্থ করার সম্মতি দিয়েছেন। ন্যায়বিরুদ্ধ বিচারের শেষ নির্দেশ তাঁর কণ্ঠ থেকেই উচ্চারিত হয়েছিল। যাজকসভা কাইয়াফাসের নেতৃত্বে যে চুড়ান্ত শাস্তিবিধান করেছিল, রোমান শাসকের প্রতিনিধির সম্মতি ছাড়া তা কার্যকর করা আইনত সম্ভব ছিল না। ধূর্ত মহাযাজক কাইয়াফাস তার পরিকল্পনায় এতটুকু ফাঁক রাখেননি! এমনকি যে পবিত্র মন্দিরকে নাজরাতীয় জিশুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে হবে বলে সর্বসমক্ষে দাবি জানিয়েছিলেন, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সেই মন্দিরের কোষাগার লুঠ করেছেন! করেছেন কিছু মানুষকে অর্থের বিনিময়ে দলে টানার জন্য।
‘ঈশ্বর তুমি এদের ক্ষমা করো। এরা কী করেছে নিজেরাই জানে না।’
নিজের কানে কানে প্রভু জিশুর বলা কথাগুলো পুনরাবৃত্তি করল জোসেফ।
করোটি পাহাড়ে উঠে আসার মুখে, একটা পাথরে নিজের ভর সঁপে বসেছিল গায়াস। তার সেনা পোশাকে লেগে থাকা রক্ত দাগ শুকিয়ে গাঢ় হয়েছে। গতকালের ভিড় অদৃশ্য হয়েছিল সন্ধের আগেই। তারপর থেকে ক্রুশবিদ্ধ শরীরগুলো পালা করে পাহারা দিয়ে গেছে অধীনস্থ সামারিটান সৈন্যরা। ক্লান্ত ছিল তারাও। আটদিন ধরে চলা নিস্তারপর্বে শহরে বহু পুণ্যার্থীদের আসা যাওয়া লেগে থাকে। সেই সময় শৃঙ্খলা রক্ষা করতে কম শক্তিক্ষয় হয় না। নিস্তারপর্ব মিটতে না মিটতেই আবার বিচারসভা বসেছিল। সেও এক অশান্তির পরিবেশ। আর তারপর গতকালের অস্থিরতা। সবকিছু সামলানোর পরে একটু বিশ্রাম তাদেরও প্রাপ্য। এক রোমান সেঞ্চুরিয়ানকে করোটি পাহাড়ের মুখে উঠে আসতে দেখে নিজের ভাবনা থেকে সরে এল গায়াস। একটু দূরেই গভর্নর পিলেতের ব্যক্তিগত সচিব ম্যালিনাস উদাস মুখে দাঁড়িয়ে। দৃষ্টি বাঁধা পড়ে রয়েছে ক্রুশবিদ্ধ নাজরাতীয় জিশুর নিষ্প্রাণ শরীরে। ম্যালিনাসকে আগে কখনো এতটা বিচলিত হতে দেখেনি গায়াস। বিচার শেষে এমন পরিণতি নতুন নয়। গলগাথার রাস্তায় এমন সারিবদ্ধ ক্রুশের অবস্থিতি বিষন্নতা এবং ভয় মিশ্রিত একধরনের অতীন্দ্রিয় অনুভূতির জন্ম দেয় বটে, তবে তা সাধারনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সেক্রেটারি ম্যালিনাস, সেঞ্চুরিয়ান গায়াস, কিংবা সামারিটান সৈন্যদল, যারা বিশ্রামে গিয়েছে, তাদের কাছে এ এক অতিপরিচিত স্বাভাবিক দৃশ্য। অথচ গভর্নরের ব্যক্তিগত সচিবটি গতকাল থেকে একই কথা আউড়ে চলেছেন,
‘আমরা পাপ করেছি গায়াস। নাজরাতীয় জিশু প্রকৃতপক্ষেই স্বর্গ প্রেরিত দেবদূত। সে ঈশ্বরের সন্তান। আমরা তার প্রতি অবিচার করেছি।’
গায়াস এতদিন ক্রুশে ঝুলন্ত শরীরটাকে মানুষ বলেই মনে করত। জ্ঞানী, বুদ্ধিমান, এবং অবশ্যই দয়ালু একজন মানুষ। দুখী মানুষের ব্যধি জাদু প্রয়োগ করে দূর করতে দেখছে। গায়াসের নিজের ভৃত্যকেই সুস্থ করেছিল নাজরাতীয় জিশু। সেসবে বাকি ভক্তের দল ঐশ্বরিক ক্ষমতা খুঁজে পেলেও, গায়াস পেয়েছিল কৌশল। বিভিন্ন জমায়েতে তার বলা প্রতিটি কথা মন দিয়ে শুনেছে। টিলার ওপরে দাঁড়িয়ে শ্যামলকান্তি মানুষটি উজ্জ্বল দৃষ্টি মেলে বলছেন,
‘আত্মায় নম্র যারা, তারা ধন্য। স্বর্গরাজ্য তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। যারা ন্যায়পরায়ণতার জন্য ক্ষুদার্ত ও তৃষ্ণার্ত, ধন্য তারা।কিংবা, শত্রু যদি তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে চায়, বিচারসভা পৌঁছানোর আগেই তার সঙ্গে মিটমাট করে নাও। নইলে সে তোমাকে বিচারকের হাতে তুলে দেবে, বিচারক রক্ষীর হাতে, এবং রক্ষী তোমাকে কারাগারে নিক্ষেপ করবে। মনে রেখ, নরহত্যা করলে ঈশ্বরের বিচারালয়ে জবাবদিহি করতে হবে।’
সত্যকে কত সহজভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল মানুষটা! অথচ দেখ, সকলে মিলে তাঁকেই কীভাবে অবলীলায় হত্যা করল! হ্যাঁ, নাজরাতীয় জিশুকে যে হত্যাই করা হয়েছে এ নিয়ে গায়াসের মনে অন্তত কোনো সংশয় নেই। হয়তো সচিব ম্যালিনাসও তাই-ই মনে করেন। বিচারের নামে হত্যা। আর সে, সচিব ম্যালিনাস, সামারিটান সৈন্যদের দল, এবং অবশ্যই গভর্নর পিলেত, সকলে সেই পাপের সমান অংশীদার। বাকিদের সঙ্গে নরকের আগুনে তাদেরও পুড়ে মরতে হবে। কিন্তু এতসবের পরেও নাজরাতীয় জিশুকে কেবলমাত্র একজন জ্ঞানী মানুষ বলেই মনে করত গায়াস। গতকাল থেকে সেই ধারণা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। সচিব ম্যালিনাসের মতো তার মনও দ্বিধাদীর্ণ। সীমাহীন শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করেও কোনো মানুষ এতটা শান্ত সমাহিত ভাব ধরে রাখে কীভাবে? আর তারপর, ক্রুশবিদ্ধকরণের সময় হঠাৎ নেমে আসা অকাল রাত্রি, পৃথিবীর কেঁপে ওঠা, এগুলো তো কোনো জাদু কৌশল ছিল না! তবে কি সত্যিই…? প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আশায় সচিব ম্যালিনাসের পাশে গিয়ে দাঁড়াল গায়াস। চোখাচোখি হতে সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানালো।
‘এই অহেতুক রক্তপাত এড়াতে গভর্নর সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। তাই না? তবুও দেখুন মাননীয় ম্যালিনাস, আমাদের হাতে লেগে থাকা রক্তের দাগ অমলিন!’
ম্যালিনাস কিছুক্ষণ বিষন্ন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন রোমান সেঞ্চুরিয়ানের দিকে। দায়িত্ব পালনে কোনো ত্রুটি রাখেনি এই সৈনিক। তবে নাজরাতীয় রাজার প্রতি কিঞ্চিৎ বেশি সহানুভূতি দেখিয়েছিল। কিছুই চোখ এড়ায়নি ম্যালিনাসের। মৃত্যুদণ্ড প্রাপক তার নিজের ক্রুশ বধ্যভূমি পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাবে। এটাই নিয়ম। প্রয়োজনে রোমের আইন যে কতটা বর্বর হতে পারে, রোমের শাসন যে কতটা শক্তিশালী, তা সকলের সামনে তুলে ধরার আরও এক পদ্ধতি। নাজরাতীয় জিশুর ক্ষেত্রেও এই নিয়মের অন্যথা হয়নি। সঙ্গে অবিশ্রান্ত ঘৃণা এবং কুকথা ঝরে পড়ছিল সকলের গলায়। রোমান আইনের ভার সহ্য করতে পারেনি নাজরাতীয়দের মাসিহা। ক্রুশ সমেত লুটিয়ে পড়েছিল মাটিতে। বিনিময়ে তার কয়েকটা চাবুকের আঘাত পাওয়ার কথা, অথচ শোভাযাত্রার দায়িত্বে থাকা সেঞ্চুরিয়ানটি অন্য পন্থা নিয়েছিল! আশ্চর্যভাবে সে সহকারী সাইমন দ্য সাইরিনকে জিশুর ক্রুশ বয়ে নিয়ে যাওয়ার আদেশ দিয়েছিল! উদ্বেল জনতার স্রোতকে চলমান রাখাই তার উদ্দেশ্য ছিল, নাকি মহানুভবতা, ম্যালিনাস এখনো বুঝে উঠতে পারেনি। আর তারপর, ক্রুশবিদ্ধ জিশুকে দ্রুত যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেওয়া! তাও কি কেবল সাব্যাথের আগেই কাজ শেষ করার তাগিদে? নির্দেশ পালনের জন্য? অকারণ ভাবনায় ডুবে গিয়েছিলেন গভর্নরের ব্যক্তিগত সচিব। তাঁকে নীরব দেখে আবারও বলে উঠল গায়াস, ‘আমার তো মনে হয় মাননীয় হেরোদ চাইলে এসবের একটা সুষ্ঠ সমাধান করতে পারতেন। তাই না? গভর্নরের সিদ্ধান্তে তো কোনো ভুল ছিল না! যে সমস্ত অভিযোগ আনা হয়েছে, সবই গালীলে সংগঠিত হয়েছিল। সুতরাং সেখানেই বিচার হওয়া উচিৎ। তেমনটা হলে হয়তো…’
‘কিছুই বদলাত না।’
দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে বললেন ম্যালিনাস। গভর্নর পিলেতের বিশেষ অনুরোধসহ নাজরাতীয় জিশুকে তিনিই হেরোদের(দ্বিতীয়) কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। সত্যি বলতে কিছুটা সংশয় তখনো তাঁর মনে ছিল। গালীলের বেশ কয়েকজন অধিবাসীকে গভর্নর পিলেত মন্দিরে চুরির অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। সেই থেকে হেরোদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অবনতি হয়েছে যথেষ্ট। তাছাড়া মানুষ হিসেবেও হেরোদ তাঁর পিতার ধারেকাছে পৌঁছাতে পারেননি। অত্যন্ত দুর্বিনীত এবং অনৈতিক চরিত্রের। সঙ্গে কড়া নেশায় আসক্ত। এমন মানুষের কাছ থেকে কোনোরকম সাহায্য প্রত্যাশা করা আদতে মুর্খতা। অবশেষে ম্যালিনাসের আশঙ্কাই সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। সম্ভবত নাজরাতীয় জিশুর আশ্চর্য কীর্তিকলাপের কথা হেরোদের কানেও পৌঁছেছিল। বিচারের প্রসঙ্গ ভুলে ভরা সভায় মত্ত হেরোদ বন্দীকে জাদু প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছিলেন! নাজরাতীয় জিশুর সেই নির্দেশ অগ্রাহ্য করা অবশ্য ম্যালিনাসকে ততটা হতবাক করেনি। মানুষটাকে সে কাছ থেকে দেখেছে। নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভীষণ নির্বিকার! হাজার অভিযোগের সামনেও নিজের সিদ্ধান্তে অচঞ্চল। আমোদের জন্য ভুল লোককে বেছে নিয়েছিলেন হেরোদ। হয়তোবা জিশুকে তাঁর কাছে উপস্থিত করা জুডেয়ার গভর্নরের নতুন অপমান ধরে নিয়েছিলেন। তাই তো কেবল যাজকদের অভিযোগকে মান্যতা দিয়েই ক্ষান্ত হননি, গভর্নর পিলেতের দ্বারাই ক্রুশবিদ্ধকরণ নিশ্চিত করেছেন। বন্দী নাজরাতীয় জিশুকে মূল্যবান সাদা ঝোলা পোশাকে রাজা সাজিয়ে জুডেয়াতে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। এরপর গভর্নর পিলেতের কাছে শেষ সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া বিশেষ কোনো উপায় ছিল না।
‘তুমি ভুল বলোনি গায়াস। এ রক্তের দাগ আমাদের জীবনভর কাছ ছাড়া করবে না। আমাদের গভর্ণর এবং তাঁর স্ত্রী তো ইতিমধ্যেই যথেষ্ট আতঙ্কিত।’
হয়তো আরও কিছু বলতেন সচিব ম্যালিনাস, হন্তদন্ত হয়ে প্রায় ছুটে আসা রক্ষী সামনে এসে স্থির হতে তাঁকে থামতে হলো।
‘গভর্নর নতুন নির্দেশ পাঠিয়েছেন। নাজরাতীয় জিশুর শরীরকে নামিয়ে আনতে হবে। আরিমাথিয়ার জোসেফ তাঁকে নিজ দায়িত্বে সমাধি দেবেন।’
মৃতদেহ নয়, যেন নিজের পাপের কিছুটা ভার নামানোর সুযোগ পেয়েছেন ম্যালিনাস। স্বস্তি ভরা দৃষ্টিতে তিনি রোমান সেঞ্চুরিয়ানের দিকে তাকালেন।
‘শুনেছ? মৃতদেহ নামানোর ব্যবস্থা করো গায়াস।’
‘অবশেষে!’
রোমান সেঞ্চুরিয়ান গায়াস কাসিয়াসের বুক থেকে হাহাকারের মতো শব্দটা বেরিয়ে এল।
কথোপকথনের ফাঁকে দুই প্রবীণ করোটি পাহাড়ে উঠে এসেছে। পেছনের জন শরীরে অপেক্ষাকৃত বেশি বয়সের ছাপ বহন করছে। দু’জনকেই আগে দেখেছে গায়াস। নাজরাতীয় জিশুর নানান জমায়েতের কাছাকাছি। ভিড় ছেড়ে আলাদা দাঁড়িয়ে থাকত। কিছু সম্ভ্রান্ত ইহুদিকে এমনটা করতে দেখেছে গায়াস। মনের কোনো কোণে নাজরাতীয় জিশুর জন্য ভালোবাসা জমিয়ে রাখলেও প্রকাশ্যে তা জাহির করতে পারেনি। সম্ভবত সমাজ থেকে বিচ্যুত হওয়ার ভয়ে। সম্ভ্রান্ত এবং প্রতিষ্ঠিত ইহুদিদের কাছে স্বজাতের মানুষটি শত্রুর থেকেও বেশিকিছু ছিল।
‘এরাই কি?’
আগত প্রবীণদের লক্ষ্য করে প্রশ্ন করল গায়াস।
‘হ্যাঁ। আমার দায়িত্ব শেষ। তবে তোমার আপাতত ছুটি মিলছে না গায়াস। নাজরাতীয় জিশুর সমাধিকে পাহারা দিতে হবে। অন্তত সামনের কিছু দিন। গভর্নর পিলেত চান না, এরপর শহরে আবার নতুন করে বিরোধ ছড়াক।’
গোলকধাঁধায়
……………………….
হপবানহফ থেকে ক্রেমস-এর ট্রেন ধরেছিল এমা। স্টেশনে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। মোটামুটি ঘণ্টা খানেক অন্তর ট্রেন পাওয়া যায়। পৌনে দু-ঘণ্টার ট্রেন সফরে ক্রেমস। সে অবশ্য মেল্ক-এর ট্রেনও নিতে পারত। এমার গন্তব্য এই দুই শহরের মাঝামাঝি। ওয়াকাউ ভ্যালি। উইলেনডর্ফ সেই উপত্যকার মাঝে ছোট্ট একটা গ্রাম। লোকসংখ্যাও সীমিত। গ্রাম ছুঁয়ে যাচ্ছে দানিয়ুব। গ্রামের কাছেই নদী একটা বড়োসড়ো বাঁক নিয়েছে।
ক্রেমস-এ আসার প্রস্তাব নিয়ে গোটা একটা দিন এমা ভেবেছে। এমনকি ইম্পেরিয়াল চ্যাপেল, যাকে অনেকে হফ চ্যাপেল বলে, কিংবা হফবার্গ প্যালেসের আশ্চর্য কোষাগার স্ক্যাৎজকামার ঘোরার সময়েও তার মনের একটা অংশ প্রফেসর বরিসের প্রস্তাব নিয়ে নাড়াচাড়া করে চলেছিল। পরিচয় হওয়ার পরপরই ভদ্রলোকের সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেওয়া শুরু করে দিয়েছিল এমা। এমনিতে প্রফেসর ড. বরিস গ্রইসম্যান প্রত্নতাত্ত্বিক জগতে একটা পরিচিত নাম। এমাও শুনেছে। ভদ্রলোক বেশ কিছু বইপত্রও লিখেছেন। কিন্তু সামাজিক সুপরিচিতি কিংবা প্রতিপত্তি সম্পন্ন ব্যক্তি মাত্রই যে বিশ্বাসযোগ্য হবে, তার কোনো স্থির নিশ্চয়তা নেই। জীবন এমাকে তেমন শিক্ষাই দিয়েছে। জোনাথন ডারওয়ার্ড জুনিয়রও একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। পয়সা এবং পাণ্ডিত্যের সহবস্থান যাকে বলে! একই সঙ্গে তাঁর মতো ক্রুর এবং লোভী মানুষ এমা দ্বিতীয় কাউকে দেখেনি। সেদিক থেকে বিচার করে প্রফেসর বরিসকেও সে এক কথায় ক্লিন চিট দিতে পারেনি। ফেলো অফ ইউনিভার্সিটি অফ ভিয়েনা, ইউনিভার্সিটি অফ বার্লিনের গেস্ট লেকচারার। প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে অগাধ জ্ঞান। ইতিহাসের যে-কোনো বিষয় নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের হাজারো অদ্ভুত প্রশ্নের জবাব দিতে নাকি তিলমাত্র সময় নেন না! এবং সেই জবাব দেওয়ার ভঙ্গিটিও আশ্চর্যরকম আকর্ষণীয়। ভিয়েনা এবং বার্লিনের ইউনিভার্সিটি, দু জায়গাতেই লতায়-পাতায় পরিচিতি জোগাড় করা এমার কাছে আহামরি সমস্যার ছিল না। তাদের কাছে খোঁজ নিয়েছে। ভদ্রলোক একটু পাগলাটে। ভুলো মনের মানুষ। তাছাড়া সন্দেহ করার মতো কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। একটা দিনেরই তো ব্যাপার। সংক্ষিপ্ত সূচি থেকে সময় বের করে এমা তাই ক্রেমস-এ আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল। আজ সকালেই ইউরোপিয়ান হিস্টরিক হাউসেস-এর জনৈক প্রতিনিধিকে জানিয়ে দিয়েছে তার ফেরা অনিশ্চিত। আমন্ত্রণ এবং গত চারদিনের আতিথেয়তার জন্য ধন্যবাদ জানাতেও ভোলেনি। যেহেতু সে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ভিয়েনায় আরও কিছুদিন কাটাতে চায়, সুতরাং সংস্থাকে তার থাকা কিংবা ফেরা নিয়ে ভাবতে হবে না। সে নিজেই কিছু একটা ব্যবস্থা করে নিতে পারবে। নিজের পকেট হালকা করে পাঁচতারা হোটেলের সুখী বিলাসী জীবন এমার পোষাত না। তাই সাত-সকালে হোটেল ব্রিস্টল থেকে চেক আউট করেছে। বেরিয়ে আসার সময় কালো মার্সিডিজ বেঞ্জ খানা নজরে পড়লেও, গত কয়েকদিনের সারথিকে প্রথামাফিক বিদায় জানানোর সুযোগ পায়নি। কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই এতক্ষণে তাকে জানিয়ে দিয়েছেন। হাপবানহফ সেন্ট্রাল ভিয়েনার ব্যস্ততম এবং প্রধান স্টেশন। স্টেশনের লকাররুমে নিজের লাগেজ জমা রেখে সে ক্রেমস-এর ট্রেনে উঠে পড়েছিল।
‘সিটিজেট’ লেখা লাল সাদায় ট্রেন ক্রেমস-এ যখন থামল, স্টেশনের উঁচু ঘড়ি মিনারে ঘণ্টার কাঁটা তখন সদ্য এগারোর ঘর পার করেছে। এক/বি প্ল্যাটফর্ম প্রায় ফাঁকা। যে দু-একজন যাত্রী নেমেছিল, তাদের অনুসরণ করে এমা স্টেশনের বাইরে চলে এল। প্রফেসর বরিসকে ক্রেমসে আসার কথা সে রাতেই জানিয়ে দিয়েছে। তা সত্ত্বেও চারপাশে চোখ বুলিয়েও তাকে কেউ নিতে এসেছে বলে মনে হলো না।
‘নির্ঘাৎ ভুলে গেছেন।’
বিরক্তির সঙ্গে উচ্চারণ করল এমা। পরমুহূর্তে ইভেন্টের দিন প্রফেসরের চশমা খোঁজার দৃশ্য মনে করে হেসেও ফেলল। ঠিক তখনই দেখতে পেল বাদামী পুলওভার এবং কালো স্কাল ক্যাপ পরনে একজন তার দিকেই এগিয়ে আসছে।
‘যাক, বুড়োর মনে আছে।’ মনে মনে বলে সে সামনে পা বাড়াল।
‘প্রফেসর বরিস গ্রইসম্যান পাঠিয়েছেন কি? আমি এমা মিলার।’
একপ্রকার নিশ্চিত হয়েই নিজের পরিচয় সামনে রাখল এমা।
‘সুপ্রভাত। আপনার লাগেজ?’
‘তেমন কিছু নেই। এই পিঠ ব্যাগটা আমি নিজেই বইতে পারব। চলুন।’
‘ক্রেমস-এ স্বাগত। আসুন।’
এমা লোকটাকে অনুসরণ করে স্টেশনের বাইরে এসে দাঁড়াল। রাস্তার ওপাশে একটা কালো ভ্যান অপেক্ষা করছিল। তাদের দেখে মুখ ঘুরিয়ে সামনে এসে দাঁড়াতে লোকটা আহ্বান জানাল, ‘আসুন মিস মিলার।’
খুলে দেওয়া দরজা দিয়ে নিজেকে ভেতরে গলিয়ে দিল এমা। গাড়ির ভেতরে হিটার চালু রাখাই আছে। নরম সিটের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা উষ্ণতাটুকু মন্দ লাগছে না। থার্মোমিটারের পারদরেখা যাই বলুক, ক্রেমসে নেমেই এমা ঠাণ্ডার দাপট টের পেয়েছে। উপত্যকার দিক থেকে বয়ে আসছে কনকনে বাতাস।
গাড়িটা যেন দানিয়ুবের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে! নদীকে কখনো কাছে কখনো দূরে রেখে রাস্তাটা চলেছে। কিন্তু কোথায়? তাদের তো উইলেনডর্ফে যাওয়ার কথা, অথচ এমার মনে হলো গাড়ি পূর্বের দিকে ছুটছে। অর্থাৎ যেখান থেকে সে এসেছিল, চালক আবার সেখানেই ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার অভিপ্রায়ে রয়েছেন! রাস্তা থেকে নজর সরিয়ে সামনে থিতু হতেই অদ্ভুত উল্কিটা এমার মনযোগ কেড়ে নিল। একটু আগে লোকটার পেছনে হাঁটার সময় খেয়াল করেনি। ঘাড়ের কাছে একটা গোলাপের আধফোটা কুঁড়ি। লম্বা বৃন্তটা নেমে পুলওভারের আড়াল নিয়েছে। ইতিমধ্যেই এমার হর্স সেন্স গণ্ডগোলের আভাস দিতে শুরু করেছে। সন্তর্পণে প্রশ্ন করল সে,
‘আমরা কি উইলেনডর্ফে যাচ্ছি?’
উত্তর দেওয়া নিয়ে লোকটার আগ্রহ নেই! নাকি কানে খাটো? নির্ঘাৎ নয়। খানিক আগে স্টেশনের বাইরে তার সঙ্গে দিব্যি কথা বলেছে। এমা এবার গলায় খানিক জোর ঢেলে বলল, ‘এই যে মিস্টার, আপনি বোধহয় ভুল পথ নিয়েছেন। আমার উইলেনডর্ফে যাওয়ার কথা। প্রফেসর বরিস গ্রইসম্যান…’
‘পথ বাছাইয়ে আপনার ভুল হয়েছে মিস মিলার। আমরা শুধুমাত্র শুধরে নিতে সাহায্য করছি।’
কাটা কাটা স্বরে বলা কথাগুলো সামনের সিট থেকে ছিটকে এল। লোকটা রাস্তা থেকে চোখ না সরিয়েই বলল, ‘ওই উন্মাদ প্রফেসরের কথায় নাচানাচি করলে বিপদ বাড়তে পারে মিস মিলার। আপনার এবং প্রফেসরেরও।’
এমন কিছু যে ঘটতে পারে এমা ঘুনাক্ষরেও অনুমান করেনি। তবে কি লেন্স অব লংগিনাস ঘিরে রহস্যের মেঘ জড়ো হয়েছে? কিন্তু সেটা তো নিখাদ একটা গল্প! নিকোডেমাসের অ্যাপোক্রিফাল গসপেলে লংগিনাসের কথা উল্লেখ থাকলেও, আদতে সেই নামের অস্তিত্ব ছিল কিনা তা প্রতিষ্ঠিত নয়। হ্যাঁ, জনের গসপেলেও জিশুর ক্রুশবিদ্ধকরণের সময় এক রোমান সৈনিকের বর্শা দিয়ে আঘাত করার বর্ণনা আছে বটে, কিন্তু সেই ব্যক্তিই সেন্ট লংগিনাস কিনা তা নিয়ে বিস্তর ধন্দ রয়েছে। যে সত্য এখনো প্রমাণিত হয়নি, তাকে ঘিরে রহস্য ঘনাবে কেন? নাকি লোকটা অন্য কোনো ব্যাপারে তাকে সাবধান করতে চাইছে? ঘাবড়ে যাওয়া এমার স্বভাব বিরুদ্ধ। সে নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল, ‘আপনার কথা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না মিস্টার। প্রফেসরের সঙ্গে আপনাদের ব্যক্তিগত বিবাদের মাঝে আমাকে টেনে আনছেন কেন? গাড়ি থামান। আমি নেমে যাব।’
তার কথায় লোকটা তৎক্ষনাৎ কোনো প্রত্যুত্তর দিল না। স্টিয়ারিং ধরে থাকা সঙ্গীকে ইশারা করল। গাড়িটা গতি কমিয়ে রাস্তার ডান পাশে ফাঁকা জায়গা দেখে থামতেই, দরজা খুলে নেমে এল এমা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সামনের আরোহীও। তার একেবারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ল চোখে চোখ রেখে। পলকহীনভাবে চেয়েই রইল কয়েক মুহুর্ত। বরফ শীতল চাহনিতেও সামনের মহিলাটির ভাবান্তর ঘটছে না দেখে বেশ শান্ত ভাবেই বলল, ‘মিস মিলার, হুমকি নয়, অনুরোধ করছি। প্রফেসরের পরিকল্পনায় সঙ্গী না হলেই ভালো করবেন। নিজের দেশে ফিরে যান। নইলে এরপর আমাদের সাক্ষাৎ এতটা মোলায়েম নাও হতে পারে।’
কথা শেষ করে আর অপেক্ষা করল না ঘাড়ে উল্কি আঁকা লোকটা। গাড়িতে উঠে জানালার কাচ তুলে দিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রাস্তায় উঠে ভিয়েনার দিকে দ্রুত ছুটতে শুরু করল বাহন খানা। ভ্যানটা দূরে কালো বিন্দুর মতো হয়ে মিলিয়ে যেতে এমা দুপাশে নজর বুলিয়ে নিল। চওড়া ফোর লেনের রাস্তা। রাস্তা ধরে মাঝেমধ্যে ছুটে যাচ্ছে দু-একটা ছোটো বড়ো গাড়ি। রাস্তার ওপাশে যুথবদ্ধ ইউরোপিয়ান বিচের সারি। তাদের ফাঁকফোকর দিয়ে দানিয়ুবের হালকা সবুজ জলের রেখা চোখে আসছে। ধারে কাছে কোনো দোকানপাট কিংবা বসতি নেই। চলমান গাড়িগুলো ছাড়া নেই সাহায্যের অন্য কোনো রাস্তাও।
‘আশপাশ দেখে থামতে বলা উচিত ছিল।’
নিজেকে ধমক দিল এমা। ঠোঁট কামড়ে ভেবে নিল তার এখন কী করা উচিৎ। ভিয়েনা ফিরে যাবে? বুড়ো প্রফেসর হয়তো তার কথা ভুলে গিয়েছেন। সম্ভবত নিজের বিষয় ছাড়া বাকি কিছু ঠিকঠাক মনে রাখা তাঁর জাগতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। তাছাড়া সেদিন ইভেন্ট শেষে কাজ নিয়ে বিশেষ কথাও হয়নি। শুধুমাত্র আভাস পেয়েছে প্রফেসর বরিস লেন্স অব লংগিনাস নিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে নামতে চলেছেন। এবং তাঁর ধারণা অভিযান সফল হলে পৃথিবী চমকে উঠবে। জিনিসটার অস্তিত্ব সম্পর্কে তিনি কীভাবে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন এমা জানে না। তার সঙ্গে প্রথম এবং শেষ সাক্ষাতে প্রফেসর কেবল জিশুর চারপাশে গোল গোল ঘুরে গেছেন। জিজ্ঞেস করলে বলেছেন, ‘কোনো বিষয়ের খোঁজে নামতে গেলে, তার সম্পুর্ণ ইতিহাস জানা জরুরি।’
কথাটা এমাও অস্বীকার করে না। তাছাড়া খোঁজে নামুক অথবা না নামুক, ইতিহাস তার পছন্দের বিষয়। ধর্মে মতি না থাকায় ঈশ্বরের সন্তান এবং তাঁর সংশ্লিষ্ট ইতিহাস প্রায় কিছুই সে জানে না। প্রফেসর বরিসের সৌজন্যে একটা নতুন জগতে বিচরণ করার সুযোগ মিলেছে। পেয়েছে যখন, তখন সেই পুরোনো দিনে ইতিউতি খানিক ঘুরে এলে ক্ষতি কী? পৃথিবীতে কোনো জ্ঞানই একেবারে বৃথা যায় না। সুতরাং লংগিনাসের বর্শা কেবল মিথ হোক বা না হোক, এমা সেই মিথের পেছনে ছুটুক না ছুটুক, ভেবেছিল সেই ফেলে আসা সময়কে জানার চেষ্টা করবে। তাছাড়া প্রফেসর সেদিন রেঁস্তোরার বাইরে এবং তার পরে ফোনেও বারংবার অনুরোধ করেছিলেন। এরপর ড. বরিস গ্রইসম্যানের মতো বিদগ্ধ মানুষকে ‘না’ বলাটা অসৌজন্যের পর্যায়ে পড়ে। সবদিক বিবেচনা করে তাই উইলেনডর্ফে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল। ভাগ্যিস নিয়েছিল!
এখন, এই মুহুর্তে শুধু ঐতিহাসিক অনুসন্ধান নয়, তার সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা বিপদের গন্ধও সে টের পাচ্ছে। সরাসরি হুমকি! খোঁজাখুঁজি করতে যেওনা, গেলে ফল ভালো হবে না। এমার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি খেলা করেই মিলিয়ে গেল। গোলাপ কুঁড়ির উল্কি আঁকা লোকটা এমা মিলার সম্পর্কে ঠিকঠাক তত্ত্বতালাশ করেনি। করলে জানত, বিপদের ভয়ে পিছিয়ে যাওয়ার মেয়ে সে নয়। লোকগুলো তার উইলেনডর্ফে আসার উদ্দেশ্য বদলে দিয়েছে। না, এখন আর কেবল নিখাদ ঐতিহাসিক চর্চার মধ্যে নিজেকে আটকে রাখবে না। প্রফেসর বরিসের দাবির মধ্যে যদি যুক্তি খুঁজে পায়, তাহলে সে খুব তাড়াতাড়ি নতুন কাজে নামতে চলেছে। এমা লেন বদলে নিয়েছিল। ক্রেমসগামী প্রাইভেট গাড়ি দেখলেই ডান হাত তুলে লিফট চাওয়ার ইশারা করছিল। ইতিমধ্যেই অন্তত গোটা কুড়ি গাড়ি তার অনুরোধকে স্রেফ বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ছুটে গেছে নিজ গন্তব্যে।
‘একটু এগিয়ে গিয়ে দেখা যাক। সামনের বাঁকের পর হয়তো কোনো কফি-শপ পাওয়া যেতে পারে।’
পাকাপাকি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই ঝকঝকে কালো মার্সিডিজ বেঞ্জে এমার দৃষ্টি আটকে গেল। গাড়িটা কাছাকাছি আসতে চেনা বিপদের গন্ধটা আবার ফিরে পেল। ডেভিড! সে কীভাবে জানল এমা ক্রেমস-এ এসেছে? হোটেল ছাড়ার সময় ছেলেটাকে দেখতে পায়নি। এমা না বলে এলেও, সংস্থার তরফে তো তাকে দায়িত্ব শেষের কথা জানিয়ে দেওয়া উচিৎ। ভিয়েনায় ব্যক্তিগত প্রয়োজনে কাটানো সময়ের জন্য তৃতীয় কোনো পক্ষের নির্ভরশীল হতে চায় না এমা। মেইলে পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়ার পরেও ডেভিড আলাবা তাকে ধাওয়া করে ক্রেমস-এ! কেন? নাকি নিছক সারথি হিসেবে নয়, তার ওপরে নজরদারির কাজও চালাচ্ছিল ছোকরা? এখন মনে হচ্ছে নির্ঘাৎ তাই-ই।
কালো মার্সিডিজ খানা গতি কমিয়ে এমার ঠিক পাশে এসে দাঁড়াল। জানালার কাচ নেমে যেতেই ডেভিডের উদ্বিগ্ন মুখ নজরে এল এমার।
‘না জানিয়ে এদিকে চলে এসে আপনি ঠিক করেননি ড. মিলার। এভাবে আমার কাজের সমস্যা বাড়িয়ে তুলছেন।’
‘আমি যতদূর জানি ডেভিড, আপনাকে কেবলমাত্র আমার যাতায়াতের সুবিধার জন্য নিয়োগ করা হয়েছিল। এবং তা মিটেও গেছে। সুতরাং আমার পিছু ধাওয়া করে আপনি এখানে! কেন? আপনাকে নিশ্চয়ই আমার ওপরে গোয়েন্দাগিরি করার জন্য কাজে লাগানো হয়নি। তাই না?’
ডেভিড চট করে কোনো উত্তর দিল না। বদলে কন্ট্রোল প্যানেলের স্যুইচ টিপে পেছনের দরজা খুলে দিল। অর্থাৎ কোনো কথা খরচ না করেই বলল, ‘উঠে পড়ুন।’
এমা সেই আহ্বান উপেক্ষা করে আবার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, ‘আমি যে ক্রেমস-এ এসেছি জানলেন কীভাবে?’
শান্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিল কৃষ্ণকায় যুবক, ‘আপনার সব প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই ড. মিলার। মাফ করবেন। আপাতত শুধু এটুকু বলতে পারি, অস্ট্রিয়ায় থাকাকালীন আপনাকে যে-কোনো ধরনের সমস্যা থেকে আগলে রাখা আমার দায়িত্ব। এবং সকালে আপনার করা মেইলের পরেও সেই কর্তব্য থেকে অব্যহতি মেলেনি। সুতরাং প্লিজ, আমাকে আমার কাজ করতে দিন। উঠে আসুন।’
যুবক ড্রাইভার যতক্ষণ কথা বলছিল, এমা ক্ষুধার্ত চোখে তার প্রতিটি অভিব্যক্তি মেপে নিতে চাইছিল। একটা বিষয় ক্রমশ তার কাছে পরিষ্কার হচ্ছে। ভিয়েনায় তার আশ্চর্য আমন্ত্রণ নিছক ঘটনা নয়, বরং কোনো বড়ো পরিকল্পনার অংশ। সম্ভবত প্রফেসর বরিস গ্রইসম্যানের সাক্ষাৎও তার বাইরে নয়। অর্থাৎ কেউ, বা কারা তাকে একটা নির্দিষ্ট দিকে চালিত করতে চাইছে। তাহলে গোলাপকুঁড়ি উল্কি আঁকা লোকটা তাকে বিপদের ভয় দেখিয়ে ভিয়েনা ছাড়া করতে চাইছে কেন? এমা যেন এক অদ্ভুত গোলকধাঁধায় ঢুকে পড়েছে। যেদিকেই যাচ্ছে, সার সার জিজ্ঞাসা চিহ্ন ঝুলছে কেবল! উত্তরের খোঁজ মুলতবি রেখে এমা গাড়িতে উঠে পড়ল।
সারিবদ্ধ পাহাড় যেন হাতে হাত মিলিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। গভীর বন্ধুতা তাদের মধ্যে। সিঁড়ির মতো ধাপে ধাপে নেমে এসেছে আঙুর ক্ষেত। সেই মধ্যযুগীয় সময় থেকেই ওয়াকাউ ভ্যালি অ্যাপ্রিকট এবং আঙুর চাষের জন্যে বিখ্যাত। আর বিখ্যাত ওয়াইন উৎপাদনে। উইলেনডর্ফ এমনই একটা গ্রাম। ছোট্ট বসতির একেবারে শেষ মাথায় প্রফেসর বরিসের আস্তানা। পারিবারিক সূত্রে পাওয়া মনোমুগ্ধকর ঠাঁই। উইলেনডর্ফে নেমে এমা বুঝতে পেরেছিল কেন প্রফেসর বরিস ভিয়েনার বিলাসিতা ছেড়ে এই গ্রাম্য জীবন বেছে নিয়েছেন। নিম্ন উপত্যকা হওয়ার কারণেই হবে হয়তো, ঠাণ্ডার কামড় এখানে সেভাবে টের পাওয়া যাচ্ছে না। পুরোনো গোথিক স্থাপথ্যের ধাঁচে তৈরি প্রফেসর বরিসের পৈতৃক আবাসকে ছোটোখাটো অট্টালিকা বললে অত্যুক্তি হবে না। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দশা কিছুটা জীর্ণ। চলটা ওঠা পলেস্তারার খাঁজে খাঁজে বৃষ্টির জল জমায় শ্যাওলার দল ছাপ ফেলেছে দেয়ালের গায়ে। পেছনের পাহাড় শ্রেণী প্রফেসর বরিসের অট্টালিকার সেই দৈন্যতাকে ঢেকে দিয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলা কোনো প্রাচীন রোমান প্রাসাদ।
‘স্বর্গ এখানেই’, মনে মনে বলে উঠল এমা। তাকে ঠিক কোথায় পৌঁছে দিতে হবে, সারথিকে তা আলাদা করে বলে দিতে হয়নি। ডেভিড কীভাবে তার গন্তব্য জেনেছে সে বিষয়ে এমা আর কৌতূহল প্রকাশ করেনি। ভিয়েনাতে পা রাখা ইস্তক তার ওপরে নজরদারি চালানো হচ্ছে। হয়তো একের অধিক পক্ষ এমাকে নিয়ে দড়ি টানাটানি খেলছে। যথাসময়ে সবই প্রকাশিত হবে। অকারণ আগে থেকে দুঃশ্চিন্তার ওজন বাড়াতে চায় না এমা।
‘এই যে ড. মিলার, ঠিকঠাক চিনে পৌঁছে গেছেন দেখছি।’
সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে সোল্লাসে বলে উঠলেন প্রফেসর বরিস গ্রইসম্যান, ‘পথে আশাকরি কোনো অসুবিধা হয়নি? গতকাল আপনার ফোন পাওয়ার পর, রাফায়েলকে রাতেই ক্রেমস স্টেশনে লোক পাঠানোর কথা বলে রেখেছিলাম।’
বেলা গড়িয়ে চলেছে, ভদ্রলোক এখনো রাত পোশাক ছেড়ে ওঠার সুযোগ পাননি! স্নান করেছেন বলেও এমার মনে হলো না। মাথার সিল্ক সাদা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে প্রফেসরকে এক উদ্ভট এলিয়েন সুলভ রূপ দিয়েছে।
‘অসুবিধা?’
এমা প্রফেসরের পেছনে, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা মধ্য তিরিশের যুবকটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘নাহ্, তেমন কিছু সমস্যায় পড়তে হয়নি প্রফেসর। শুধু আপনার দেখা পেতে এতটা সময় লাগতে পারে জানা থাকলে, ব্রেকফাস্টে আরও একটু সময় দিতাম। এখানে লাঞ্চের সময় পেরিয়ে গেছে নিশ্চয়ই?’
‘লাঞ্চ!’
প্রফেসরের ভাব দেখে মনে হলো এমা বুঝি বেশ ঘোরালো একটা প্রশ্ন করে ফেলেছে! তাঁকে সেই জটিল ফাঁস থেকে উদ্ধার করতে পেছন থেকে যুবকটি দ্রুত পায়ে নেমে এল।
‘আপনি প্লিজ ভেতরে আসুন ড. মিলার। সময় পেরিয়ে গেছে বটে, তবে স্যার নিজেও এখনো লাঞ্চ করেননি।’
‘সেকি!’
হাতঘড়ি দেখে অবাক সুরে বলে উঠল এমা, ‘আমার জন্য মিছিমিছি দেরি করার কোনো প্রয়োজন ছিল না প্রফেসর।’
‘না না, আপনার জন্য নয়। আসলে নতুন কিছু ইন্টারেস্টিং বিষয় নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, তাই খাওয়ার কথা মাথায় ছিল না।’
এমা হেসে ফেলল। সবাই ঠিকই বলে, ভুলো মানুষটা অকারণ ভদ্রতার ধার ধারেন না। সোজাসাপটা।
‘কিন্তু আমি যে আবার পেটে খিদে নিয়ে কথা চালিয়ে যেতে পারি না।’
‘তা কেন… তা কেন! রাফায়েল, তুমি আমাদের দু’জনের জন্য…’
‘তিন জন। আমার বেচারা সারথিটিও সম্ভবত পেটে কিছু দেওয়ার সময় পায়নি।’
রাফায়েল, প্রফেসর বরিসের পার্সোনাল অ্যাসিসটেন্ট, গাড়িতে হেলান দিয়ে থাকা দীর্ঘদেহীর দিকে এক নজর বুলিয়ে অনুগত স্বরে বলল, ‘নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই। আপনারা ভেতরে আসুন প্লিজ।’
খাওয়ার ব্যাপারে এমার তেমন আদিখ্যেতা নেই। তার মতে খাওয়া হলো শরীরকে টিকিয়ে রাখার কৌশল মাত্র। কাজে ডুবে থাকলে প্রফেসর বরিসের মতো তারও নাওয়া-খাওয়ার হুঁশ থাকে না। কিন্তু উইলেনডর্ফের মতো বহু প্রাচীন এই বসতিতে, মধ্যযুগীয় এই বাড়ির আতিথ্য গ্রহন না করলে, খাদ্য সংস্কৃতির এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে তাকে বঞ্চিত থাকতে হতো।
অ্যাশ কাঠের তৈরি বিরাট ডিম্বাকৃতির টেবিলে জনা দশেকের স্বচ্ছন্দে বসার ব্যবস্থা রয়েছে। যদিও খাওয়ার টেবিলে তারা মাত্র তিনজন। রাফায়েল, প্রফেসরের সহকারীটি ঘড়ির কাঁটা মেপে লাঞ্চ সেরে ফেলেছেন। খাঁটি অস্ট্রিয়ান পদ টেবিলে সাজানো। উইনার শেনিৎজেল, এদেশীয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাবারের নাম। মাংসের এই কাটলেট অবশ্য হোটেলের মেনুতেও ছিল। কিন্তু বিফের সঙ্গে নানান সবজি সহযোগে তৈরি টাফেলস্পিৎজ, কিংবা সবশেষে ডেসার্টে ভিয়েনিজ অ্যাপল স্ট্রুডাল খাবার সম্পর্কে এমার লালিত ধারণাকে ভেঙে দিল। ওয়াকাউ ভ্যালি কেন ইন্টারন্যাশনাল কালচারাল হেরিটেজের তকমা পেয়েছে, তার ক্ষুদ্র অনুমান লাঞ্চের টেবিলে বসেই পেয়ে গেল সে।
তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে প্রফেসরের স্টাডিতে বসেছিল এমারা। ডেভিড নিরস আলোচনা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়। এমা আপত্তি করেনি। রাফায়েলকে তাঁর প্রভুই নিরস্ত করেছেন। যদিও সে আলোচনায় অংশগ্রহণে উৎসুক ছিল বলেই এমার ধারণা। স্টাডির অবস্থা প্রফেসরের মতোই। চুড়ান্ত অগোছালো। বড়ো ঘরে আলমারির সংখ্যা কম নয়। তবুও সেগুলোর তাকে যতগুলো বই রয়েছে, সম্ভবত তার চেয়ে বেশি, কিংবা কাছাকাছি সংখ্যায় বই ঠাঁই পেয়েছে মেঝেতে। জায়গায় জায়গায় সদ্য কাটা ফসলের মতো স্তূপীকৃত করা রাখা সেগুলো। এমার নজর স্টাডির চারপাশে ঘুরে প্রফেসরের মুখে থিতু হতে, তিনি হেসে বললেন, ‘সবকিছু বড্ড বেগোছ হয়ে আছে, না? আসলে এদিকটা রাফায়েল দেখাশোনা করে। অবশ্য তাকে দোষ দেওয়া অনুচিত হবে। বেচারা দিন তিনেকের ছুটি নিয়েছিল। গতকালই এসেছে। নিজের পড়াশোনা সামলে এক দিনে সব পুরোপুরি গুছিয়ে উঠতে পারেনি।’
‘তিন দিনেই এই অবস্থা!’
হেসে ফেলল এমা।
‘এই গাদা থেকে দরকারে কিছু খুঁজে বের করাও তো রীতিমতো কঠিন কাজ!’
‘আমার অসুবিধা হয় না। কিন্তু এখন এসব খুচরো কথা থাক। আমরা বরং আলোচনায় ঢুকে পড়ি।’
‘সেই ভালো। যদিও ডেভিড সঙ্গে আছে, কিন্তু বেশি রাত করে ফিরতে চাই না।’
‘না না, ফিরলে হবে কী করে? কাজে নামার আগে আপনাকে সবকিছু বুঝে নিতে হবে যে।’
এমা আবার হাসল। নরম গলায় বলল, ‘আচ্ছা, এখন শুরু তো করুন। আপনার আগ্রহের কেন্দ্রে যে দ্য হোলি লেন্স অব লংগিনাস, সে-কথা জানি। জিনিসটার অস্তিত্ব নিয়ে সম্ভবত আপনার কোনো সন্দেহ নেই। অনুমান করছি এ সম্পর্কে আপনার কাছে কিছু প্রমাণও আছে।’
‘সঠিক অনুমান।’
শিশু সুলভ উচ্ছ্বাস নিয়ে যোগ করলেন প্রফেসর বরিস।
‘শুনলে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, বছর খানেক আগেও লেন্স অব লংগিনাস আমার রিসার্চের বিষয়বস্তু ছিল না। আমার চর্চার বিষয় ছিল ট্রু ক্রশ।’
‘মানে গলগাথায় যে যূপকাষ্ঠে জিশুকে বলি দেওয়া হয়েছিল?’
‘ঠিক। ৩২৬ খ্রীস্টাব্দে সেন্ট হেলেনা জেরুজালেমে তীর্থযাত্রা করতে গিয়ে আবিষ্কার করেন। এবং তারপর থেকে খ্রিষ্ট ধর্ম যতবার এবং যেখানে যেখানে প্রসারিত হয়েছে, ট্রু ক্রশের একটা টুকরো সেখানকার অ্যাবিগুলোতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মজার কথা কী জানেন ড. মিলার? ট্রু ক্রশের এই টুকরোগুলো জুড়তে পারলে আস্ত একটা জাহাজ তৈরি করা যাবে।’
‘আসলে ভক্তির কাছে যুক্তি আগাগোড়া বড়োই দুর্বল। তাছাড়া প্রফেসর, সেন্ট হেলেনার আবিষ্কার করা ক্রুশেই যে জিশুকে বিদ্ধ করা হয়েছিল, তারই কি কোনো নিশ্চয়তা আছে?’
প্রফেসর বরিস তাঁর সাদা সিল্ক দাড়িতে আঙুল চালিয়ে বললেন, ‘তা তো বটেই। প্যারিসের নট্রেডাম ক্যাথিড্রাল হোক, কিংবা গ্রিসের মনেস্ট্রি অব মাউন্ট এথোস, ধর্মীয় স্থান থেকে ট্রু ক্রশের টুকরো নিয়ে বয়স পরীক্ষা করার সাধ্য কারোর নেই। তবুও আমি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম আশপাশ থেকে তথ্য-প্রমাণাদি সংগ্রহের।’
‘আর তারপর, আপনি নিজের বিষয় থেকে সরে এলেন। লেন্স অব লংগিনাস। কেন প্রফেসর?’
ক্ষণিকের জন্য প্রফেসরের দৃষ্টিকে উদাস হয়ে যেতে দেখল এমা। স্টাডির বড়ো জানালা দিয়ে দূরের পাহাড়শ্রেণী হাতছানি দিচ্ছে। কথা বলতে বলতে এমারও মন বারবার জানালা গলে সেই সবুজ পাহাড়ে হারিয়ে যাচ্ছিল। সামান্য সময় নিয়ে প্রফেসর ফিরে এলেন।
‘পাইপ ধরালে আপনার কি অসুবিধা হবে?’
এমা ঘাড় নেড়ে জবাব দিল। প্রফেসর প্রথমে তাঁর পকেট হাতড়ালেন, তারপর স্টাডি টেবিলের ড্রয়ারগুলো টানাটানি করলেন। সম্ভবত চটজলদি পাইপ খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বুঝে নিজের চেয়ারে এসে বসলেন। ভুরু কুঁচকে এমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘আপনি কিছু জিজ্ঞেস করছিলেন?’
‘ট্রু ক্রশ থেকে আপনার লক্ষ্য লেন্স অব লংগিনাসের দিকে ঘুরে গেল কেন?’
‘দুর্ঘটনা।’
‘দুর্ঘটনা! আপনার?’
‘না। দেখতেই পাচ্ছেন আমি এখনো অক্ষত আছি। দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল আমার একসময়ের সহপাঠী এবং প্রিয় বন্ধু। ড. ক্রিস্টোফ লুডল্ফ।’
‘জার্মান?’
প্রফেসর মাথা নেড়ে সহমত প্রকাশ করলেন।
‘লুডল্ফ দারুণ চনমনে ছেলে। ক্ষুরধার মগজ। অতুলনীয় পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ ক্ষমতা ছিল তার! একদম শুরুতে, প্রায় বছর পঁচিশ আগের কথা বলছি, লুডল্ফ কাজ করছিল কোনো এক বৃটিশ মেটালজিস্টের সঙ্গে। নামটা ঠিক মনে নেই।’
‘স্বাভাবিক।’ মনে মনে বললেও মুখে অন্য প্রশ্ন করল এমা।
‘আপনার বন্ধু এবং জনৈক ব্রিটিশ মেটালজিস্ট বুঝি হোলি লেন্সের সন্ধান করছিলেন?’
‘সন্ধান বলাটা ঠিক হবে না, বরং যাচাই বলা যেতে পারে। আপনি নিশ্চয়ই হফবার্গ প্যালেসের কোষাগার দেখেছেন?’
মাথা নাড়ল এমা।
‘স্ক্যাৎজকামার। দেখেছি, এবং আপনার বর্তমান উৎসাহের কারণ আইটেম নম্বর ১৫৫-কেও চাক্ষুষ করেছি।’
‘হ্যাঁ, লুডল্ফের টিম সেই হোলি লেন্সকে বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষা করে দেখেছিল। তার জন্য অবশ্য বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। মিউজিয়াম অথরিটি মাত্র ছয় ঘণ্টা সময় দিয়েছিল তাদের।’
এমা এবার নড়েচড়ে বসল।
‘কিছু কি পাওয়া গিয়েছিল? মানে ওটাই কি সেন্ট লংগিনাসের বর্শা?’
প্রফেসর আবার উঠে স্টাডির এদিক ওদিক কিছু খোঁজাখুঁজি করলেন। সম্ভবত পাইপ। রক্ত একবার নিকোটিনের স্বাদ পেয়ে গেলে তার টান উপেক্ষা করা কঠিন হয়ে ওঠে। এমার অনুমান অভ্রান্ত প্রমাণ করে সজোরে সহকারীর উদ্দেশ্যে হাঁক পারলেন প্রফেসর বরিস,
‘রাফায়েল… রাফায়েল… আমার পাইপটা কোথায় রেখেছি বলতে পারো?’
মিনিট দুয়েকের মধ্যেই প্রফেসরের হারিয়ে যাওয়া পাইপ এবং সহকারী রাফায়েল একসঙ্গে ঘরে ঢুকল।
‘এই যে স্যার। বারান্দায় ছিল।’
প্রফেসর যেন হাতে চাঁদ পেলেন, ‘ওহ্ রাফায়েল, তোমাকে না পেলে আমার যে কী হাল হতো, ঈশ্বরই জানেন। ধন্যবাদ। আমাদের জন্য একটু কফির ব্যবস্থা করা যাবে?’
‘নিশ্চয়ই স্যার। আমি মিসেস বেলাকে বলে দিচ্ছি।’
রাফায়েল ঘর ছেড়ে বেরোতে গিয়েও ফিরে এল।
‘একটা কথা ছিল স্যার, মিস মিলার কি আজ রাতে থাকছেন?’
‘অবশ্যই… অবশ্যই। ভালো কথা মনে করিয়ে দিয়েছ আমায়। ড. মিলারের জন্য…’
প্রফেসরের কথার মাঝেই উঠে দাঁড়াল এমা।
‘আমার জন্য ভাবতে হবে না প্রফেসর। আপনার আমন্ত্রণের জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমি ভাবছি ভিয়েনায় ফিরে যাব। যদিও লেন্স অব লংগিনাস সম্পর্কে অনেক কথাই এখনো জানা বাকি, তবুও…’
‘না না ড. মিলার। আপনাকে পুরো ঘটনা খুলে বলা ভীষণ দরকার। এবং সেটা যত শীঘ্র সম্ভব। তাছাড়া আমি যদি ভুল না করি, ভিয়েনায় তো আপনার আর সেরকম কোনো জরুরি কাজ নেই। তাই না? এখানে আপনার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ বাড়িতেই থাকুন প্লিজ। অবশ্য আমার মতো একঘেয়ে বুড়োর সঙ্গ নিয়ে যদি আপত্তি না থাকে।’
নিজের হাসি সামলাতে এমা বেশ কিছুটা সময় নিল। ভদ্রলোক ধরেই নিয়েছেন এমা তাঁর অনুসন্ধানে যোগ দিচ্ছে। অথচ এখনো সে ব্যাপারে উৎসাহিত হওয়ার মতো কিছু খুঁজে পায়নি, কেবল গোলাপ কুঁড়ির উল্কি আঁকা লোকটার হুমকি ছাড়া। আসলে প্রফেসর এত অলিগলিতে ঢুকে পড়ছেন যে মূল প্রসঙ্গে পৌঁছে উঠতে পারেননি। আবার একথাও ঠিক, এই অলিগলিগুলোকেও ভালোভাবে চেনা দরকার। সম্পূর্ণ ব্যাপারটার একটা আন্দাজ পাওয়ার জন্য একটা রাত নিশ্চয়ই যথেষ্ট? এমা ইতস্তত করে বলল,
‘আপনার মতো গুণীজনের সান্নিধ্যে আপত্তি করার মতো মুর্খ আমি নই। বেশ, আজকের রাতটা না হয় একসঙ্গে ইতিহাসের পেছনে ছুটে কাটিয়ে দেওয়া যাবে। সমস্যা হলো, আমি রাত যাপনের প্রস্তুতি নিয়ে আসিনি।’
‘এটা কোনো সমস্যাই নয় এমা।’
প্রফেসর বিষয়টাকে প্রায় তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেন। এমা লক্ষ্য করল তিনি সম্বোধনকে সৌজন্যতার বাঁধন থেকে মুক্তি দিয়েছেন। ড. মিলার নয়, শুধু এমা। যে কোনো কারণেই হোক, মানুষটাকে এমারও ভালো লাগতে শুরু করেছে। হারিয়ে যাওয়া বিশেষ একজনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন তিনি। ফাদার সাইমন। স্মৃতি কোষে সঞ্চিত প্রিয় মানুষের মুখ এমার চোখের তারায় ভেসে উঠল। আবার পরমুহূর্তে প্রফেসরের ভারী গলার নিচে চাপাও পড়ে গেল, ‘রাফায়েল, তুমি এমার থাকার ব্যাপারটা বেলাকে জানিয়ে দিও প্লিজ। আর এখন কফি।’
‘আমার সারথিটির মতামতও জেনে নেবেন দয়া করে।’
এমার কথায় ঘাড় নেড়ে রাফায়েল বলল, ‘নিশ্চয়ই মিস মিলার। আমি জেনে নেব।’
রাফায়েল বেরিয়ে যেতেই প্রফেসরের হাতে ধরা পাইপের কথা মনে পড়ল। নিকোটিনের পাউচ এবং লাইটার স্টাডি টেবিলের আধখোলা বইয়ের নিচ থেকে খুঁজে পাওয়া গেল। পাইপের তামাক আগুনের ছোঁয়া পেতেই সুন্দর একটা গন্ধ এসে ধাক্কা মারল এমার নাকে। ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছেড়ে প্রফেসর বললেন, ‘আমরা যেন কোথায় ছিলাম এমা?’
(ক্রমশ)