সৌভাগ্যশলাকা। ধারাবাহিক উপন্যাস। পর্ব ২। লিখছেন অলোক সান্যাল

0

(গত পর্বের পর)

উত্তরের খোঁজে

………………………..

মেহগনি কাঠের টেবিল। বয়স্ক এবং বেশ বড়ো। টেবিলে অনেকগুলো বই। গুছিয়ে রাখা। শুধু টেবিল নয়, গোটা ঘরটাই গোছানো। লুডল্ফ বন্ধু হলেও কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে একেবারে বিপ্রতীপে তাঁর অবস্থান। অবস্থান ছিল বললেই ব্যাকরণগত দিক থেকে সঠিক হবে, কারণ- নির্মেঘ আকাশে বজ্রপাতের মতো তিনি গতকাল রাতে খবরটা পেয়েছিলেন। প্রিয় বন্ধু নেই! ড. ক্রিস্টোফ লুডল্ফ আত্মহত্যা করেছেন! সকালে স্টাডিতে তাঁর রক্তশূণ্য দেহ উদ্ধার করা হয়। খবর পাওয়ার পর কোনোরকমে রাত পার করেছেন তিনি।

তিনি প্রফেসর বরিস গ্রইসম্যান। ইতিহাসের একনিষ্ঠ সেবক। শিক্ষক কিংবা এখনো ছাত্র বলার চেয়ে ‘সেবক’ শব্দে সবকূলই রক্ষা করা যায়। প্রাচীন সময়কে কাটাছেঁড়া করেন যাঁরা, প্রায় সকলের কাছেই বরিস গ্রইসম্যান একটা অতি পরিচিত নাম।

কাপুথে নেমে প্রফেসর বরিস সোজা বন্ধুর সমাধিতে গিয়েছিলেন। অত্যন্ত দ্রুত সব ব্যবস্থা করা হয়েছিল। অবশ্য অপেক্ষা করার মতো লুডল্ফের কেই-বা ছিল। ঝকঝকে কালো পাথরে সাদা অক্ষরে লেখা বন্ধুর নাম। নিচে জন্ম ও মৃত্যু তারিখ। মৃত্যু, জীবনের এক অনিবার্য পরিণতি। এবং আশ্চর্যেরও বটে। আশ্চর্যের কারণ, মৃত্যুর পরেও মানুষকে অনেক কিছু হারাতে হয়। শুধু নিজের শরীরের ওপর অধিকার নয়, দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে সযত্নে লালিত নীতি-আদর্শের দখলদারিও হারাতে হয় তাকে। নইলে লুডল্ফের মতো ঘোর নাস্তিকের শেষ শয্যা কখনো চার্চের চৌহদ্দিতে পাতা হয়? অবশ্য ঈশ্বর সম্পর্কে উদাসীন লুডল্ফের এ নিয়ে অতো মাথাব্যথা থাকত কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে। বিছানা যখন প্রিয়তমার পাশে, তখন জায়গাটা স্বর্গে নাকি নরকে, তা নিয়ে ভাবার মতো মুর্খামি সে করতে চাইত না নিশ্চয়ই। পাশাপাশি শুয়ে আছে লুডল্ফ-ডায়ানা। সহকর্মী এবং ভালোবাসার মানুষ। দু’জনে আর কিছুদিন সময় পেলে মিস্টার এবং মিসেস হতে পারত। তাড়া ছিল দু’জনেরই! নাকি তাদের হঠাৎ চলে যাওয়া নিছক চলে যাওয়া নয়। নেপথ্যে অন্য কারণ রয়েছে। রয়েছে কি?

খবরটা শোনার পর, এবং এখানে পৌঁছে সবকিছু জানার পর, প্রশ্নচিহ্নটা বড়োসড়ো আকার ধারণ করেছে৷ প্রথমত লুডল্ফের দিন চারেক আগে ডায়ানার মৃত্যু। ধরন এক। তাছাড়া ক্রিস্টোফ লুডল্ফ একজন হিমোফোবিয়ার পেশেন্ট। খুব কম জন একথা জানে। সেই হাতে গোনা সংখ্যার মধ্যে প্রিয় বন্ধু প্রফেসর বরিস গ্রইসম্যান একজন। রক্ত যার কাছে বিভীষিকার অন্য নাম, সে আত্মহত্যা করার অন্য কোনো উপায় ভেবে পেল না! নাকি জীবন সম্পর্কে চূড়ান্ত বিতৃষ্ণা জন্মালে ভয়-ভাবনা সব অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়? হয়তো প্রথম প্রশ্নের উত্তর হিসেবে দ্বিতীয় প্রশ্নটিকেই খাড়া করতেন প্রফেসর, বাধ সেধেছেন জনৈক মি. এডওয়ার্ড। ভদ্রলোক নিজেকে লুডল্ফের পরিচিত বলে দাবি করছেন। কাজের সূত্রে পরিচয়। এবং লুডল্ফ, এমনকি ডায়ানার আকস্মিক মৃত্যুর জন্য তিনি ইতিহাসের পেছনে ছোটাকে দায়ী করছেন।

‘অ্যাড্রিয়ান স্যাঞ্চেজ ১৮৫৭, অলিভিয়া ক্রেমলিন ১৮৯৩, অর্লান্ডো ফোরলানি ১৯০২, মাঝে অনেকটা বিরতির পর ভারতীয় ঐতিহাসিক রামকমল শর্মা এবং তাঁর তিব্বতি সহকারী জেনদুং। তালিকা খুব ছোটো নয় প্রফেসর। প্রত্যেকেই যথেষ্ট পণ্ডিত মানুষ। এটা যদি একটা মিল হয়, অন্য এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মিল হলো এঁদের গবেষণার বিষয়বস্তু এক। দ্য হোলি লেন্স। আপনার বন্ধুটিও লংগিনাসের বর্শাকে ইতিহাসের স্তূপ থেকে তুলে আনতে চেয়েছিলেন।’

‘হ্যাঁ, চেয়েছিল। কিন্তু এটা কি লুডল্ফের মৃত্যু নিয়ে সন্দিহান হয়ে ওঠার জন্য যথেষ্ট? আমি অন্তত আরও এক ডজন ইতিহাসবিদের নাম বলতে পারি মি. এডোয়ার্ড, যাঁরা একই বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন। এখনো করছেন।’

‘সঠিক। পার্থক্য হলো—তাঁরা কেউই সেই বিতর্কিত বর্শার ধারেকাছে পৌঁছাতে পারেননি। স্যাঞ্চেজ কিছুটা এগিয়েছিলেন। অলিভিয়া এবং রামকমল শর্মাও। ড. ক্রিস্টোফ লুডল্ফ কতদূর এগোতে পেরেছিলেন আমি হলপ করে বলতে পারব না, তবে একটা ধারণা করতে পারি। বেশ কাছাকাছি। বিশ্বস্ত এবং কাছের মানুষ হিসেবে আপনি নিশ্চয়ই আরও ভালো জানেন। লংগিনাসের বর্শা রহস্য সমাধানের কাছাকাছি যাঁরাই পৌঁছেছেন, আশ্চর্যজনকভাবে পুরো গিঁট খোলার আগে তাঁরা প্রত্যেকে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন! কেন? আর ডায়ানার সঙ্গে রামকমল শর্মার সহকারীর মৃত্যুর মিল রয়েছে। আমার অনুমান, যদিও তা ভুল প্রমাণিত হলেই খুশি হব, সাফল্যের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার মাশুল গুনতে হয়েছে তাঁদের।’

বয়সের দিক থেকে মি. এডোয়ার্ড এবং প্রফেসর বরিসের তেমন ফারাক নেই। তবে চেহারায় আছে। বলিষ্ঠতা ভদ্রলোকের পোশাকের আড়াল থেকে উঁকি মারছে। নিখুঁতভাবে ছাটা দাড়ি। জেল লাগানো চুল ব্যাকব্রাশ করা। মাথার ফেদোরা টুপি একবার হাতে নিয়েছিলেন। সমাধিতে দাঁড়িয়ে মৃতের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের রীতি। প্রফেসরের সঙ্গে চোখাচোখি হতে হাতের টুপি যথাস্থানে রেখে এগিয়ে এসে আলাপ করেছিলেন। ঠিক আলাপ নয়। নিজের পরিচয় দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে প্রসঙ্গে ঢুকে পড়েছিলেন। ভদ্রলোক সময়ের ব্যাপারে সম্ভবত দারুণ কৃপণ!

‘আপনার সঙ্গে কিছু জরুরি কথা আছে প্রফেসর গ্রুইসম্যান। একটু নিরিবিলিতে বলা যায় কি?’ বলে একটা ফাঁকা জায়গায় টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন। কতকটা জোর করেই। তারপর একের পর এক যুক্তিতে প্রফেসরের সন্দেহের নৌকাকে ক্রমাগত দোলা দিয়ে মাঝ পুকুরে নিয়ে গেছেন। ভদ্রলোক এলেবেলে কেউ নন, তা বাইরে থেকে দেখেই বোঝা যায়। পরনে কালো স্যুট। দর্জির হাতের তারিফ করতে হয়। মাপে কোনো ত্রুটি নেই। নির্ঘাত র‍্যাভেনসক্রফট কিংবা ওই জাতীয় কোনো পুরোনো এবং অভিজাত টেইলার শপে বানানো। পায়ে ইটালিয়ান ভ্যালেসা কোম্পানির ডকারস। শরীর থেকে বিষণ্ণ সুগন্ধ ভেসে আসছে। চশমার পেছনে বুদ্ধিদীপ্ত একজোড়া চোখ, এবং তাকে যোগ্য সঙ্গত করা রাশভারি কণ্ঠস্বর। কথা শুরুর পরপর প্রফেসর বুঝতে পেরেছিলেন, বাইরের মতো ভদ্রলোকের ভেতরটাও যথেষ্ট সুসজ্জিত। প্রথাগত ডিগ্রিধারী না হলেও মি. এডোয়ার্ডের ইতিহাসের ভিত যথেষ্ট মজবুত। বিশেষত জিশু এবং তাঁকে ঘিরে জন্ম নেওয়া অজস্র লোককথা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা বহন করেন। সম্ভবত লুডল্ফের সঙ্গে ভদ্রলোকের ঘনিষ্ঠতার এটাই কারণ। প্রফেসর বরিসের অনুমান করেছিলেন। তিনি চেয়েও ভদ্রলোকের যুক্তিগুলো হেলায় উড়িয়ে দিতে পারেননি।

‘ড. লুডল্ফের বাড়িতে আমাদের একবার যাওয়া দরকার প্রফেসর। সন্দেহ অমূলক হলে আপনার বন্ধুর গবেষণা সংক্রান্ত কাগজপত্র সেখানেই থাকা উচিত। তাই নয় কি?’

কথাটা প্রফেসর বরিসের মস্তিষ্কেও বারকয়েক আঁচড় কেটেছিল। কারণ ছিল ভিন্ন। নিরীহ কৌতূহল মাত্র। গত সপ্তাহেই লুডল্ফের সঙ্গে তাঁর ফোনালাপ হয়েছে। লক্ষ্য পূরণের উচ্ছ্বাস এবং আত্মবিশ্বাস যুগ্মভাবে খেলা করছিল বন্ধুর গলায়। তার পরেই এমন মর্মান্তিক কাণ্ড! খাপে খাপ মিলছে না। এখন, মি. এডোয়ার্ডের কথা শোনার পর নিরীহ কৌতূহল অজানা আশংকায় বদলে গেছে। এখন আর নিছক বন্ধুর কাজের খবর নিতে নয়, বরং তার মৃত্যুর সঠিক কারণ খোঁজার জন্য লুডল্ফের বাড়িতে যাওয়া প্রয়োজন। সমস্যা হলো, দ্বিতীয় কেউ না থাকায় ফেডারেল পুলিশ গোটা বাড়িকে সিল করে দিয়েছে। উপায়ের খোঁজে পুলিশ স্টেশনে গিয়েছিলেন দুই প্রৌঢ়। তরুণ তদন্তকারী অফিসার তাঁদের হতাশ করেননি।

‘টেবিলের ঠিক এখানে আপনার বন্ধুকে পাওয়া যায়। হাত নিচে ঝুলছিল। রক্ত দ্রুত ড্রেন হয়েছিল সে কারণে।’

তরুণ তদন্তকারী অফিসার বলল। প্রফেসর কাঠের চেয়ারের পাশটায় গিয়ে দাঁড়ালেন।

‘ছোঁয়াছুঁয়িতে আপত্তি আছে?’

হেসে জবাব দিল অফিসার, ‘আজ সকালে হলেও আপত্তি জানাতাম। আপনারা আসার ঠিক আগেই ফাইনাল রিপোর্টের কাজ শেষ হয়েছে। বড়ো কর্তা হয়তো আজ কালের মধ্যেই ফাইলটা ক্লোজ করে দেবেন। ততক্ষণ পর্যন্ত এ ঘরের সবকিছুই তদন্তের প্রয়োজনে সিল থাকা উচিত। সেই নিয়ম একটু আগেই আমরা ভেঙেছি। দেখতে পারেন, তবে অহেতুক ছোঁয়া এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।’

পকেট থেকে একজোড়া ল্যাটেক্স গ্লাভস বের করে এগিয়ে ধরলেন তরুণ তদন্তকারী।

‘ধন্যবাদ অফিসার।’

বলে প্রফেসরের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন মি. এডোয়ার্ড।

‘আপনার চোখে বিসদৃশ কিছু ঠেকছে নাকি?’

প্রফেসর ঘাড় নাচিয়ে বললেন, ‘তেমন কিছু থাকলেও আমার পক্ষে ধরা মুশকিল। আমাদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম ছিল ফোন। বছরে বার চার-পাঁচেক দেখাও হতো। কোনো বক্তৃতা কিংবা আলোচনা সভায় ডাক পড়লে। তখন সামনা-সামনি গল্প। কাজের এবং ব্যক্তিগত দু’রকমের গল্পই হতো। তবে এ বাড়িতে খুব বেশি আসা হয়নি। শেষ এসেছিলাম… তাও বছর সাতেক আগে।’

‘তবুও ড. লুডল্ফকে আপনার চেয়ে ভালো কেউ চেনে না প্রফেসর। তাঁর স্বভাব, অভ্যাসের সঙ্গে খাপ খায় না এমন কোনো দৃশ্য চোখে আটকাতেই পারে।’

‘কেন বলুন তো?’

কিছুটা বিরক্তি এবং অনেকটা সন্দেহ নিয়ে বলে উঠল তরুণ তদন্তকারী অফিসার।

‘আমরা তদন্তে কোনো ফাঁক রাখিনি। ঘরে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির উপস্থিত ছিল না। ভদ্রলোক সঙ্গিনীর মৃত্যুতে যথেষ্ট ভেঙে পড়েছিলেন। প্রতিবেশীরা এছাড়া অন্য কোনো অস্বাভাবিকতা দেখেননি। ময়না তদন্তেও অন্য কিছুর ইঙ্গিত নেই। আমাদের কাছে ওপেন অ্যান্ড শাট কেস।’

উত্তরে প্রফেসর কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, মি. এডোয়ার্ড তড়িঘড়ি মাঝে ঢুকে পড়ায় তাঁকে থামতে হলো।

‘আমরা তেমন কিছু সন্দেহ করছি না অফিসার। আসলে প্রফেসর এবং ড. লুডল্ফ একই বিষয় নিয়ে গবেষণা করছিলেন। একসঙ্গেই বলা যায়। সেই সম্পর্কিত কোনো প্রয়োজনীয় নথি যদি পাওয়া যায়…।’

বলে স্টাডির চারিদিকে একবার নজর বুলিয়ে যোগ করলেন, ‘প্রাচীনত্বের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা বড়ো বিরক্তিকর। তার চেয়ে চলুন, ঘরে ভালো পানীয় আছে কিনা খোঁজা যাক। প্রফেসর সম্ভবত সময় নেবেন। আমরা ততক্ষণ গলা ভেজাই। ছোঁয়াছুঁয়িতে আপত্তি নেই যখন, কয়েক পাত্র খরচ করলে অসুবিধা হবে না নিশ্চয়ই?’

ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বরে অদ্ভুত দাপট আছে! চেয়েও এড়ানো যায় না।

‘না… মানে… কিন্তু… বেশ…’

তরুণ তদন্তকারীর সুর ক্রমান্বয়ে আপত্তি থেকে সম্মতিতে বদলে গেল। দু’জনে স্টাডি থেকে বেরিয়ে যেতে নিজের অনুসন্ধানী দৃষ্টি টেবিলে রাখলেন প্রফেসর বরিস গ্রইসম্যান।

স্বভাব। সত্যিই বন্ধুর সঙ্গে তাঁর স্বভাবে বিস্তর অমিল ছিল। নিজের ব্যক্তিগত জীবন ছাড়া লুডল্ফ সবকিছু যত্নে, গুছিয়ে রাখায় অভ্যস্ত। টেবিলের মতো। মাপ অনুযায়ী পরপর সাজিয়ে রাখা বই। প্রায় নির্ভুলভাবে টেবিলের মাঝামাঝি অবস্থানে ডেক্সটপ। তার ডান পাশে রাখা রোল করা কিছু চার্ট এবং পেন হোল্ডার রূপে গ্রিক পুরাণের জনপ্রিয় চরিত্র টাইটান এটলাস। এটিও বেশ পুরোনো। মার্বেল পাথরে তৈরি প্রাচীন গ্রিক দেবতা হাঁটু ভাঁজ করে বসে। পিঠে বহন করছেন পৃথিবীর ভার। কয়েকটা কলম সেই পৃথিবীতে রাখা। যে জিনিসটিতে গিয়ে প্রফেসরের নজর থমকে দাঁড়াল সেটি টেবিলের এক কোণায় রাখা। খ্রিষ্টের ছোট্ট প্রতীক চিহ্ন। কাঠের। টেবিলের কোণায় একটার ওপর একটা যত্ন করে সাজিয়ে রাখা ফাইলগুলোর মাঝে বেখাপ্পাভাবে মুখ গুঁজে পড়ে। জিনিসটা বের করে চোখের সামনে তুলে ধরলেন প্রফেসর বরিস। ক্রশের মাঝামাঝি অদ্ভুত চিহ্ন। রুপোর তৈরি একটা আধফোটা গোলাপ। লম্বা বৃন্ত মাঝখান থেকে একেবারে নিচে নেমে শেষ হয়েছে।

‘বিসদৃশ!’ শব্দটা মনে মনে আউড়ে নিলেন প্রফেসর বরিস। লুডল্ফের পড়ার টেবিলে তার গবেষণা সংক্রান্ত বই পত্র, ফাইল বন্দী অজস্র আর্টিকেল, চার্ট এবং ম্যাপ থাকবে। স্বাভাবিক। যদিও ফাইলগুলো ঘেঁটে বন্ধুর উদ্দেশ্য কতটা পরিণতি পেয়েছিল, তা বোঝার উপায় নেই। বস্তুত তাঁর নিজের লেখা দরকারি একটা কাগজও টেবিলে নেই। না ওপরে, না ড্রয়ারের মধ্যে। অথচ লুডল্ফ এখানে বসেই কাজ করলে তেমনটা হওয়ার কথা নয়। ঘরে আরও জায়গা আছে। কয়েকটা আলমারি। কোণের দিকে একটা টেবিল। সেটাও বড়োসড়ো এবং বইপত্রে বোঝাই। একটা মেটাল চেস্ট। তবুও কাজের সময় দরকারি নথি হাতের নাগালে রাখা উচিত। লুডল্ফের গোছানো স্বভাবের কথা মাথায় রাখলেও, ভীষণ চিন্তার মুহুর্তে হঠাৎ কিছুর দরকারে বারবার জায়গা বদল করা… নাহ্‌, এমনটা হওয়ার কথা নয়। তার থেকেও বড়ো কথা ক্রশ খানা সাজিয়ে রাখা ফাইলগুলোর মাঝে গোঁজা কেন? লুডল্ফ এবং ধর্ম, দুই আলাদা গোলার্ধ। বরাবর।

‘বিসদৃশ।’ এবার শব্দটা জোরালো স্বরে উচ্চারণ করলেন প্রফেসর বরিস। তারপর সেটা আগের স্থানে রেখে ঘরের কোণে চলে গেলেন। সেখানে অবশ্য ‘বিসদৃশ’ কিছু চোখে বাঁধল না। আরও একটা কম্পিউটার। তাকে জাগিয়ে লাভ হবে না। পাসওয়ার্ড জানা নেই। অবশ্য যারা এ বিষয়ে দক্ষ, তাদের কাছে পাসওয়ার্ড ব্রেক করা ততটা সমস্যার নয়। লুডল্ফ কি তবে যন্ত্রের স্মৃতিকোষে সব তথ্য ভরে রেখেছিল? প্রশ্নটা বুদবুদের মতো মগজে ভেসে উঠেই মিলিয়ে গেল। নাহ্‌, বন্ধু তাঁর মতোই কাগজ কলমে বেশি আস্থাশীল। পড়া, বোঝা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী নোট নেওয়ার মাঝে মাঝে নতুন নতুন চিন্তা হাজির হয়। আগের ভাবনাকে এক লাইনে বাতিল করে তখন আবার নতুন পথে হাঁটা। তা বলে আগের চিন্তাগুলো একেবারে বাতিলের খাতায় চলে যায়, এমনটা নয়। কখনো-সখনো আবার বাতিল চিন্তাসূত্রগুলো কাজে লাগে বইকি। এসব ক্ষেত্রে প্রফেসর বরিস নিজেও খাতায় কলমে কাজ করায় বেশি স্বচ্ছন্দ। কাজ শেষ হলে তখন যন্ত্রের মগজ পূরণ। যদি বাস্তবিকই লুডল্ফের কাজ শেষ হয়ে গিয়ে থাকে, তবে ঘরের দুটো কম্পিউটারের মধ্যে কোনো একটায় অন্তত সেই ইঙ্গিত পাওয়া উচিত। এক্ষেত্রেও তরুণ তদন্তকারী অফিসার ভরসা। প্রফেসর বরিস টেবিল ছেড়ে প্রথম আলমারির কাছে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর নজর সবার আগে আলমারির তৃতীয় শেলফে আটকে গেল। বর্ণানুক্রমিকভাবে সাজিয়ে রাখা বইগুলোর শেষ মাথায় তিনটে খাতা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তাড়াহুড়ো করে বইয়ের ভিড়ে গুঁজে রাখা। প্রফেসর মাঝের খাতাটা বের করলেন। কয়েকটা পাতা উলটে নিয়ে চটপট বাকি দুটোও। বন্ধুর হাতের লেখা চিনতে তাঁর ভুল হয়নি। লুডল্ফ ছাড়া আরও একজন খাতাগুলো ব্যবহার করেছে। সম্ভবত ডায়ানা। দরকারি নোটস। অজস্র চিন্তার কাটাকুটি। নতুন ভাবনা। লক্ষ্যে পৌঁছানোর সিঁড়ি নির্মান। কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই প্রফেসর খাতাগুলো কাঁধের ঝোলা ব্যাগে ভরে নিলেন।

স্টাডির বাকি অংশ পুরোপুরি খতিয়ে দেখার আগেই দরজার মুখ থেকে তরুণ তদন্তকারীর গলা শোনা গেল, ‘কাজের কিছু খুঁজে পেলেন প্রফেসর?’

‘নাহ্‌।’

দ্বিধাহীনভাবে জবাব দিলেন প্রফেসর বরিস গ্রইসম্যান। তাঁর অভিব্যক্তি দেখে প্রখ্যাত আইরিশ মঞ্চাভিনেতা রে ম্যাকআনলিও হয়তো শিক্ষা নিতেন!

‘লেখাজোখা কিছুই পাওয়া গেল না। এমন হওয়ার কথা নয়। আমার ধারণা কম্পিউটারে সব রাখা আছে।’

‘নেই। তদন্তের স্বার্থে কম্পিউটার দুটো আমাদের প্রযুক্তি বিভাগের কর্মীরা খুঁটিয়ে দেখেছে। একেবারে পরিস্কার। সম্ভবত ঘটনার আগের দিনই ফরম্যাট করা হয়েছিল। হার্ড ড্রাইভ প্রায় ফাঁকা।’

‘আশ্চর্য! এত দিনের কাজ। নিশ্চয়ই লুডল্ফ সব ডাস্টবিনে ফেলে দেয়নি। এটা দেখার পরেও আপনাদের সন্দেহ হয়নি!’

‘দেখুন প্রফেসর…’ কিঞ্চিত বিরক্তির সঙ্গে বলে উঠল তদন্তকারী অফিসারটি, ‘আপনাদের রিসার্চের কাগজপত্র কি ছিল বা নেই, তা বোঝার মতো মেধা থেকে আমরা বঞ্চিত। তবে অপরাধ স্থলে সন্দেহজনক সূত্রগুলো সহজে আমাদের চোখে ধুলো দিতে পারে না। স্টাডি থেকে যে ফিঙ্গার প্রিন্ট স্যাম্পল পাওয়া গিয়েছিল, সেগুলোও ক্রস চেক করা হয়েছে। অস্বাভাবিক কিছু পাওয়া যায়নি। প্রতিবেশীদের সঙ্গেও কথা বলা হয়েছে। ব্যাপারটা আমাদের কাছে জলের মতো পরিস্কার। মিস ডায়ানার সঙ্গে আপনার বন্ধুর ঘনিষ্ঠতা ছিল। বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্কই বলতে পারেন। দু’জনে নাকি বিয়ের ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ঘনিষ্ঠ জনকে হারানোর শোক এবং সে কারণে মানসিক অবসাদ। এছাড়া অন্য কোনো কারণ নেই। সুতরাং আপনাদের গবেষণার কাগজপত্র উধাও কেন, তা নিয়ে ভাবার অবকাশ আমাদের নেই। দুঃখিত। এবার সময় হয়েছে।’

শেষের কথা থেকে স্পষ্ট, অনেক জ্বালিয়েছ বাপু, এবার মানে মানে কেটে পড়। একটা ওপেন অ্যান্ড শাট কেসে খামোখা নতুন কোনো জটিলতা যোগ করতে চায় কোন আহাম্মক? মি. এডোয়ার্ড ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। ধারালো দৃষ্টিতে মেপে নিচ্ছিলেন প্রফেসরকে। তাঁর কাঁধের ঝোলা ব্যাগ সামান্য ফোলা। ব্যাগের মুখটা খোলা। কিছু অনুমান করে তিনি তড়িঘড়ি বলে উঠলেন,

‘ফেডারেল পুলিশের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার মতো দুঃসাহস আমাদের নেই অফিসার। লুডল্ফ হয়তো তাঁর গবেষণার ফাইল এ বাড়িতেই অন্য কোথাও রেখে দিয়েছেন। খুঁজলে পাওয়া যাবে। না না, তা বলে আপনার মূল্যবান সময় আর নষ্ট করব না। আপনি ইতিমধ্যেই আশাতীত সাহায্য করেছেন। অসংখ্য ধন্যবাদ। আসুন প্রফেসর। আপনাকে এয়ারপোর্টে ড্রপ করে আমিও রওনা দেব।’

তদন্তকারী অফিসারকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত বেরিয়ে এলেন প্রফেসর বরিস। তাঁর মাথার মধ্যে কেবল একটা কথা টিকটিক করছে। ভিয়েনা ফিরতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব। খাতায় লেখা প্রতিটি শব্দকে খুঁটিয়ে দেখা দরকার।

‘প্রফেসর… আপনার ব্যাগ।’

সদর দরজার ঠিক মুখে যখন, পেছন থেকে তরুণ তদন্তকারী অফিসারের ভারী কণ্ঠস্বর ভেসে এল। মি. এডোয়ার্ডের হাতের মুঠো অজান্তেই শক্ত হয়ে উঠল। তিনি আড় চোখে পাশের জনকে দেখলেন। প্রফেসর বরিস ছেলেবেলার ফেয়ারি ফুটস্টেপ খেলায় মত্ত স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে। নিথর এবং নিস্পন্দ। আর তরুণ তদন্তকারী হলো কিউরেটর। অফিসার গম্ভীর পা ফেলে এগিয়ে এল। তার চোখের তারা প্রফেসরের ব্যাগে আটকে। এই মুহুর্তে ধরা পড়লে ফেডারেল পুলিশ ঠিক কোন কোন অভিযোগ তাঁদের বিরুদ্ধে আনতে পারে, মনে মনে তার একটা তালিকা তৈরি করে নিচ্ছিলেন মি. এডোয়ার্ড। দুর্ঘটনা স্থলে ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে অনুপ্রবেশ। তদন্তকারী অফিসারকে ইচ্ছাকৃতভাবে ফাঁকি দেওয়া। এবং সবচেয়ে গুরুতর অপরাধ, ঘটনাস্থল থেকে প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা। তিনি নিজেকে নিয়ে অতোটা ভাবিত নন। চিন্তা প্রফেসরকে নিয়ে। বেচারা এখনো পুতুলের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন। নিশ্বাস নিতেও ভুলে গেছেন যেন!

‘আপনার ব্যাগ প্রফেসর। মুখটা খোলা আছে। কিছু হারিয়ে ফেললে অভিযোগ জানাতে আবার স্টেশনে হাজিরা দিতে হবে।’

পাশ থেকে ‘ফোঁওস’ শব্দ শুনতে পেলেন মি. এডোয়ার্ড। প্রফেসর দম বন্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তারপর গোড়ালির ভরে ঈষৎ থলথলে শরীরটা নিয়ে চোঁ করে ঘুরে তিনি তরুণ তদন্তকারী অফিসারের মুখোমুখি হলেন। দারুণ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এবং বিগলিত হাসিতে বললেন, ‘দেখেছেন কাণ্ড। জলের বোতলটা বের করেছিলাম। বন্ধ করতে ভুলে গেছি!’

‘বইয়ের ছাপা অক্ষরগুলো ছাড়া এসব ছোটোখাটো বিষয় আপনাদের পক্ষে মনে রাখা কঠিন প্রফেসর। এ কথা সকলেই জানে।’

হালকা স্বরে বলে আচমকা জোরে হেসে উঠল অফিসার। হেসে উঠলেন মি. এডোয়ার্ডও।

প্রফেসর বরিস গ্রইসম্যান সম্পর্কে তরুণ তদন্তকারীর মন্তব্যে এতটুকু ভুল নেই। এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে বসে দৃশ্যটা মনে করে মি. এডোয়ার্ডের ঠোঁটের কোণে হাসি জড়ো হচ্ছিল। মানুষটা সত্যিই ভুলো মনের। নিজের কাজের ব্যাপারে ঠিক ততটাই নিখুঁত। তবে ড. লুডল্ফের গবেষণাকে লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়া একা প্রফেসর বরিস গ্রইসম্যানের পক্ষে সম্ভব নয়। অনেক ধকল নিতে হবে। মস্তিষ্কের সঙ্গে শারীরিক সক্ষমতাও ভীষণ জরুরি। এক্ষেত্রে একজনই আছে যার ওপরে অন্ধ আস্থা রাখা যায়। মি. এডোয়ার্ড তার কথা প্রফেসরকে জানিয়েছেন।

 

 

আশ্চর্য আমন্ত্রণ

………………………………

নটেনডর্ফে অ্যালি তির্যক ভাবে এসে যেখানে এডবার্গ স্ট্রিটে এসে হাত মিলিয়েছে, ঠিক সেই স্থানে জন্মদিনে কাটা এক টুকরো কেকের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে হোটেল ব্রিস্টল। শেষ বিকেলের অবসন্ন আলো তার গায়ে নেতিয়ে পড়ে রয়েছে। ঘন নীল রঙের দেয়ালে জানালাগুলো মুক্তো সাদা। আশেপাশে বড়ো বড়ো স্থাপত্য থাকলেও চোখে বাধে। এমারও নজর থমকে গিয়েছিল। তখনো তার জানা ছিল না আগামী কয়েকদিনের জন্য এই পাঁচতারা হোটেলেরই অস্থায়ী আবাসিক হতে চলেছে সে।

এমার এই সময় ভিয়েনাতে আসার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। সুযোগটা অযাচিতভাবে জুটে গেছে। কীভাবে? সে নিজেও জানে না। গত বছর শেষ হয়েছিল দারুণ রোমাঞ্চকর ভাবে। প্রজেক্ট রিভেঞ্জ নিয়ে একরাশ উচ্ছ্বাসের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল ভীষণ উদ্বেগের মধ্যে দিয়ে। কৃষ্ণদ্বীপে চিরকালের মতো হারিয়ে যেতে বসেছিল সে। হঠাৎ সামুদ্রিক ঝোড়ো বাতাস হয়ে হাজির হয়েছিল ভাই এলিন এবং ফাদার সাইমন। জোনাথন ডারওয়ার্ডের যাবতীয় চক্রান্তকে দু’জনে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল। (নষ্ট চাঁদের আলো বইতে সেই ঘটনার বিবরণ আছে)

জোনাথন ডারওয়ার্ড জুনিয়র। নামটা মনে পড়লেই এমার শরীরে রক্তস্রোতের বেগ দ্বিগুণ হয়ে ওঠে। ছোটোবেলায় ছায়া দেখে ভয় পাওয়ার মতো এক অতি পরিচিত শীতল অনুভূতি মনে ভর করে। অবশ্য ক্ষণিকের জন্যই। দুঃস্বপ্নের সেই সমুদ্র সাঁতরে পারে ওঠে এমা। ভদ্রলোককে লোভের জন্য নিদারুণ প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছে। একটা রুক্ষ, নির্জল, নির্জন দ্বীপে কতদিনই-বা টিকে থাকতে পারে মানুষ? ভাই রাজি ছিল না। দিন চারেক পরে এমাই জোর করে রেসকিউ টিম পাঠিয়েছিল। কৃষ্ণদ্বীপে জোনাথন ডারওয়ার্ডকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

‘উন্মাদটা জলে ডুবে মরেছে।’ যুক্তি দিয়েছিল এলিন। পরের অনেক রাত কৃষ্ণদ্বীপের স্মৃতি জাগিয়ে রেখেছিল এমাকে। তারপর ধীরে ধীরে কাটিয়েও উঠেছে। বর্তমান শতাব্দী এক ঘটনায় বেশিদিন থিতু হয়ে থাকার সুযোগ দেয় না। এমাও ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। কাজের জন্য নতুন একটা জায়গা দরকার। রয়্যাল ইনভেন্টার্সের সঙ্গে বিচ্ছেদ, এবং তার পরেপরেই প্রজেক্ট রিভেঞ্জের ক্রেডিট হাতছাড়া হওয়া, দুটো ঘটনা তাকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বিভিন্ন সংস্থায় আগ্রহ দেখিয়েও কোনো সাড়া পায়নি। অভিযানের ব্যর্থতায় এমনটা যে হতে পারে এমার জানা ছিল। এমার ক্ষেত্রে কারণটা ভিন্ন। সাফল্য পেলেও সেই তালিকা থেকে তার নামকে দক্ষতার সঙ্গে মুছে দেওয়া হয়েছে। কিছুই করতে পারেনি সে। ব্ল্যাকবিয়ার্ডের ফ্ল্যাগশিপ নয়, সমুদ্র ছেঁকে পরিতাপের পাহাড় তুলেছিল এমা। সেসব এখন অতীত। আফশোসের পেছনে নাগাড়ে সময় খরচ করার মেয়ে এমা মিলার নয়। পেছনে ফিরে দেখা ছেড়ে দিয়েছে এমা। এখন তার সামনে একটাই লক্ষ্য, কাজের জন্য নতুন একটা ঠিকানা খুঁজে পাওয়া। লক্ষ্যটা কঠিন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। নতুন বছরের প্রথম দুটো মাস প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে নয়, বরং অনুসন্ধান করার ঠিকানা জোগাড় করতেই কেটে গেছে। বলা ভালো এখনো যাচ্ছে। তেমন আশাবাদী হয়ে ওঠার সুযোগ মেলেনি এখনো। নিরুদ্বেগ জীবনে অবসরের ছোটোখাটো মুহুর্তগুলোও ভীষণ একঘেয়ে মনে হতে শুরু করেছে। আর ঠিক তখনই, নিজের পায়ের তলায় মাটি হাতড়ে বেড়ানোর মাঝে আচমকা এমন আমন্ত্রণ!

হফবার্গ প্যালেস অস্ট্রিয়ার রাজনীতি এবং সংস্কৃতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য এক নাম। নামে প্যালেস হলেও হফবার্গ তার থেকে অনেক বেশি কিছু। শহরের মধ্যে একটা ছোটো শহর। দুশো চল্লিশ হাজার স্কোয়ার মিটার এলাকায় আঠারোটা আলাদা আলাদা উইং! হ্যাবসবার্গ রাজবংশের শীতকালীন আবাস। প্রধান আবাসও বলা যেতে পারে। তেরো শতকে নির্মিত এই প্রাসাদের নির্মান শৈলী নিও বারোক ঘরনার। পরের শতাব্দীগুলোতে বেশ কয়েকবার হফবার্গ প্যালেসকে সম্প্রসারিত করা হয়েছে। বর্তমানের অতিকায় রূপ তারই ফলশ্রুতি। প্রাসাদকে খুঁটিয়ে দেখতে একটা গোটা সপ্তাহ গলে যেতে পারে। এমার ভিয়েনায় আসার উদ্দেশ্য হফবার্গ প্যালেসের রূপ দর্শন কিংবা এখানকার বিখ্যাত কোষাগারের (স্ক্যাৎজকামার) আশ্চর্য সংগ্রহ দেখে মুগ্ধ হওয়া নয়। সে এসেছে ইউরোপিয়ান হিস্টরিক হাউসেস-এর আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে। প্রাচীন ইতিহাসের খোঁজ কেবল সমুদ্রের তলায় সীমাবদ্ধ নেই, বরং বিস্তীর্ন ভূ-খণ্ডেই তার পাল্লা ভারী। আর হফবার্গের মতো সুপ্রাচীন প্রাসাদে তো প্রতিবার নেওয়া শ্বাসে ফেলে আসা সময়ের মন বিবশ করা গন্ধ পাওয়া যায়। এমা মেরিন আর্কিওলজিস্ট। তার প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান জলের নিচে সীমাবদ্ধ। ডাঙার কোনো প্রাচীন স্থাপত্য কিংবা ইতিহাসের খোঁজে তার যুক্ত থাকার কথা নয়। তা সত্ত্বেও এক অজ্ঞাত কারণে প্রথমে ফোন, তারপর সম্মতিক্রমে আমন্ত্রণ পত্রটি এসে উপস্থিত হয়েছিল। রাজকীয়ই বটে! আকাশ রঙা সুদৃশ্য খামে সোনালি জলে লেখা। ওল্ড ইংলিশ ফন্টে জ্বলজ্বল করছে- ডঃ এমা মিলার; অনারেবল স্পেশাল গেস্ট। খামের মধ্যে এমার জন্য ভিয়েনার একটা বিজনেস ক্লাসের টিকিট। আলাদা ভাবে একটা নোট। তাতে পরিষ্কার হাতে লেখা-

আপনাকে বিশেষ অতিথিদের মাঝে পেলে আমরা কৃতজ্ঞ বোধ করব। ভিয়েনায় আপনার থাকার সম্পূর্ণ দায়ভার আমাদের। ইভেন্টের পরে ফেরার দিন স্থির করে দয়া করে আমাদের জানিয়ে দেবেন। আমরা ব্যবস্থা করে রাখব। এছাড়াও আপনার যে-কোনো প্রয়োজন নির্দ্বিধায় জানানোর অনুরোধ করছি।

অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গেই ডাক পাঠানো হয়েছে তাকে। সময়টাও এমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্নতত্ত্বের সঙ্গে যুক্ত অনেক বিজ্ঞ এবং প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে মুখোমুখি আলাপ হওয়ার একটা সুযোগ। হয়তো একটা কাজও জুটে যেতে পারে। এরপর আর এমার কাছে ভাবার জন্য বলিষ্ঠ কোনো অজুহাত ছিল না। তাই অদ্ভুত আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ছুটে এসেছে।

গতকাল বিকেলে একটা মার্সিডিজ বেঞ্জের এস ক্লাস এয়ারপোর্টে তার জন্য অপেক্ষা করছিল। ভিয়েনায় থাকাকালীন এই বিলাসী বাহনটিই তার যত্রতত্র গমনের জন্য বরাদ্দ। এবং বাহনের সারথিটিও। নাম ডেভিড আলাবা। সুঠামদেহী যুবক। ছেলেটার সবচেয়ে বড়ো গুণ হলো—কম কথা বলে। এমার মতো বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়া একজন প্রত্নতাত্ত্বিকের জন্য এমনতর ব্যবস্থাদি! অস্বস্তিজনক। ভিয়েনাতে তার থাকার জায়গাটিও বাছাই করা। পাঁচ তারা হলেও শহরের এক পাশে হওয়ায় ব্যস্ততা সেভাবে চোখে পড়ে না।

রোদ ঝলমল সকাল। এমা হোটেলের বাইরে পা রাখতেই ডেভিডকে দেখতে পেল। ঝকঝকে কালো মার্সিডিজের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই নড়ে উঠল। ডেভিড দরজা খুলে দাঁড়াতে এগিয়ে গেল এমা।

‘ডাঙ্কে। ধন্যবাদ ডেভিড। আমি ভাবছি বাস কিংবা সাবওয়ে ধরব। নতুন জায়গায় এসে গাড়ির ভেতরে কাটাতে চাই না। আপনি বরং আজকের দিনটা ছুটিতে কাটান।’

‘আমাকে আপনার সঙ্গে থাকার জন্যই অ্যাপয়েন্ট করা হয়েছে মিস মিলার।’

চোস্ত ইংরেজিতে তার প্রস্তাবকে উড়িয়ে দিল ডেভিড। এমার ভুরু জোড়া কাছাকাছি এসেই আবার দূরত্ব তৈরি করল। এবার স্পষ্ট এবং দৃঢ় শোনাল এমার কণ্ঠস্বর, ‘বেশ। তবে হোটেলেই অপেক্ষা করুন। আমি সাবওয়ে ধরব। আপাতত আপনার সঙ্গের প্রয়োজন নেই।’

কথা শেষ করে আর অপেক্ষা করল না এমা। ঘুরে রাস্তায় নেমে এল। গতকালই শহরের মানচিত্র খুঁটিয়ে দেখে নিয়েছিল। হোটেল থেকে কার্লসপ্লাৎজ মেট্রো স্টেশন মিনিট তিনেকের হাঁটা পথ। ইউ-১ সাবওয়ে লাইন ধরলে বার্গরিং পৌঁছাতে বেশি সময় লাগার কথা নয়। সেখান থেকে হেঁটে হফবার্গ।

দ্য বার্গটর। পাঁচটি বিশালাকার খিলানকে একত্রিত করে প্রাসাদ তোরণটি তৈরি। সম্রাট নেপোলিয়নের সৈন্যদল মূল তোরণটির দুরাবস্থা করে ছেড়েছিল। পরে আবার নতুন করে নির্মাণ করা হয়। রাস্তা পারাপারের চিহ্ন সবুজ হতেই এমা দ্রুত পায়ে তোরণের সামনে এসে দাঁড়াল। ঘড়িতে সময় যাচাই করে নিল। আটটা চার। এক ধাক্কায় ফুসফুস থেকে অনেকটা বাতাস বের করে ফিসফিসে স্বরে নিজেকে বলল, ‘চলো, ইতিহাসের গভীরে ডুব দেওয়া যাক।’

পর্যটকরা সাধারণত প্রাসাদের উত্তর-পূর্বে সেন্ট মাইকেলস গেট ব্যবহার করে। এদিকটায় তাই ভিড় নেই। অবশ্য এত সকালে প্রাসাদ দেখতে খুব কম মানুষই আসে। একজন উর্দিধারী প্রবেশপথের পাহারায়। এমার উদ্দেশ্য বুঝে বলে উঠল, ‘গুড মর্নিং মাডাম। সামনে এগিয়ে বাঁ দিকে কাউন্টার। পাস পেয়ে যাবেন।’

‘গুটেন মগন।’

রোজকার দরকার মেটানোর মতো জার্মান ভাষাজ্ঞান এমার আছে। সে স্থানীয় সরকারি ভাষায় প্রত্যুত্তর জানাল। তারপর ডবল ব্রেস্টড ট্রেঞ্চকোটের পকেট থেকে হফবার্গ বেট্রিবসগেসেলশ্যাষ্ট থেকে ইস্যু করা ইভেন্ট পাস বের করে সামনে বাড়িয়ে ধরল। দ্বাররক্ষককে সন্তুষ্ট করে প্রাসাদ চত্ত্বরে পা রাখল এমা।

এই প্রাসাদের কোনো এক ব্যালকনি থেকে ইতিহাসের কলঙ্কিত স্বৈরশাসক সেরিমোনিয়াল স্পিচ দিয়েছিলেন। আর এখন, এই প্রাসাদ প্রেসিডেন্ট অব অস্ট্রিয়ার সরকারি আবাস। ও এস এস ই-এর(অর্গানাইজেশন ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড কো-অপারেশন) দপ্তরও এখানে। এমা পূর্বদিকের চকচকে রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করল। তার কোনো তাড়া নেই। ইভেন্ট শুরু হওয়ার কথা বারোটা থেকে। অর্থাৎ হাতে সাড়ে তিন ঘণ্টা সময়। আজকের অবশিষ্ট সময়টুকু প্রাসাদের বাইরে ঘুরে একটা ধারণা নিয়ে নেবে। আরও দুটো দিন আছে এখানে। ভেতরটা ইতিহাসের খনি। ধীরে সুস্থে সময় নিয়ে দেখতে হবে। হেঁটে ওয়েল্ট মিউজিয়াম ওয়েনের সামনে এসে দাঁড়াল এমা। পাশেই একটা বোর্ডে বাঁদিকে তীর চিহ্ন এঁকে লেখা ‘ইম্পেরিয়াল শপ, ভিয়েনা’। কেনাকাটায় তার কোনোকালেই আগ্রহ নেই। ডানদিকের রাস্তা নিল সে।

প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে এমা প্রাসাদ চত্ত্বরের নানা অলিগলি ঘুরে সুইস উইং-এ এসে থিতু হয়েছে। খোলা জায়গাটা কোবলস্টোনে বাঁধাই। প্রাসাদের প্রাচীনতম অংশ। মূল দূর্গ প্রাসাদের একটা বর্গাকার রূপরেখা ছিল। চারখানা টারেট(বুর্জ) এবং প্রবেশদ্বারে একটা ড্র-ব্রিজ সহ পরিখা বেষ্টিত ছিল। দূর্গের এই প্রাচীনতম অংশগুলো সুইসকোর্ট গঠন করেছে। কেবল বাইরের অংশটুকু ঘুরে দেখতেই মনে হয় দেড় দিন লাগবে।

ইতিমধ্যেই বিভিন্ন বয়সের পর্যটকেরা ভিড় জমাতে শুরু করেছে৷ দুই যুবক-যুবতী, সম্ভবত সদ্য বিবাহিত, হফবার্গ প্যালেসকে মধুচন্দ্রিমার উপলক্ষ ঠাওরেছে কিনা এমা জানে না, হাতে প্রাসাদের একটা পথ নির্দেশিকা। সম্ভবত সেন্ট মাইকেলস গেট দিয়ে ঢোকার মুখে পাওয়া যায়।

‘কাজের জিনিস। বেরোনোর সময় একটা নিয়ে নিতে হবে।’ এমা মনে মনে স্থির করে নিল। সুইসকোর্টের ধারে কাছেই সম্মেলন কেন্দ্র। নজর ঘোরাতেই ‘বার্গাপ্টম্যানসচ্যাফট ওস্টারইচ’ লেখা দিক নির্দেশক চিহ্ন তার নজরে পড়ল। ঘড়ির সময়ে চোখ বুলিয়ে নিল এমা। আর পনেরো মিনিট। দেরি করা ঠিক হবে না। সে নির্দেশ অনুসারে দ্রুত পা চালাতে শুরু করল।

‘… তর্ক বিতর্ক আছে। থাকবেও। কিন্তু একটি বস্তুর কাল্পনিক অস্তিত্ব যুগের পর যুগ ধরে টিকে থাকে কীভাবে? লেন্স অব লংগিনাসকে দেখা যায় সেন্ট মরিসের প্রবল বীরগাথার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে৷ সেই একই লেন্স আবার ১০৯৮ সনে ক্রুসেডর কাউন্ট রেমন্ড বহন করেছেন। বৃটিশরা তাদের দেশের অস্তিত্বের জন্য যে ঐতিহাসিক যুদ্ধের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ, সেই ব্যাটল অব ব্রুনানবার, সেখানেও কিং এথেলস্টানের পাশে বিষ্ময়কর সৌভাগ্য প্রতীকের উপস্থিতি! না, দ্য লেন্স অব লংগিনাস নিয়ে গল্পকথা কেবল সেই প্রাচীন যুগে সীমাবদ্ধ ছিল না। গল্পকথা শব্দবন্ধটি আমি সজ্ঞানে প্রয়োগ করলাম। কারণ সেই আশ্চর্য সৌভাগ্য শলাকাটি হয় গল্প, নতুবা এমন এক কথা যার অস্তিত্ব আছে।’

একটানা বক্তব্য রাখছিলেন প্রফেসর ড. বরিস গ্রইসম্যান। ঈষৎ থলথলে খাটো চেহারা। এলোমেলো মাথার চুল। বক্তব্য রাখার ঝোঁকে নেমে আসা চুলগুলো বাঁ হাত দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছিলেন বারবার। একমুখ দাড়ি কুঁচকে যাওয়া গালের চামড়াকে আড়াল করে রেখেছে। প্রফেসর যে ভীষণ ভুলো মনের মানুষ, পরিচয় না থাকলেও এমা বলে দিতে পারে। ভদ্রলোক ইতিমধ্যেই বার দুয়েক নিজের চশমা হারিয়েছেন। একবার তো মাথার ওপরে রেখে পকেট হাতড়াতে দেখা গেছে। তবে বক্তব্য রাখার সময় একবারের জন্যও প্রফেসর বরিসকে থমকাতে দেখেনি এমা। পোডিয়ামে রাখা জলের বোতল থেকে গলা ভিজিয়ে নিলেন প্রফেসর। এমা বুঝতে পারছিল তাঁর বক্তব্য উপসংহারে এসে দাঁড়িয়েছে।

‘কনসটেন্টাইন দ্বিতীয় থেকে শুরু করে হিটলার, প্রাচীন থেকে আধুনিক যুগ, সর্বত্র লংগিনাসের বর্শার একইরকম আশ্চর্যজনক উপস্থিতি! যদি কেবলমাত্র মিথই হবে, তবে জিনিসটাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত টেনে আনার কি আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল? একগুচ্ছ প্রশ্ন আছে। আমরা চাইলে সহজেই একটা উত্তর খুঁজে নিতে পারি। সৌভাগ্য শলাকা আদতে কিছু মুর্খের তৈরি একটা শ্রুতিকথা। মিথ। বছরের পর বছর ধরে তাদেরই স্বজাতিরা সেই মিথকে লালন-পালন করে চলেছে। সুতরাং এমন একটা গল্পের উৎস সন্ধান করা, আরও বড়ো মুর্খামি।  অথবা গল্পের সূত্র ধরে আমরা তার উৎসের দিকে এগিয়ে যেতে পারি। সৌভাগ্য শলাকার অস্তিত্ব যাচাই করে দেখার চেষ্টা করতে পারি। দ্বিতীয় পথ অনেক জটিল। স্বচ্ছ দৃষ্টি ধরে রাখা মুশকিলের। কিন্তু জটিল বলেই ইতিহাসের প্রতি দায় থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা অন্যায় হবে।’

সামনের সারিতে বসেছে এমা। বিশেষ অতিথিদের জন্য আলাদাভাবে চিহ্নিত করা জায়গায়। ভি আই পি অতিথিদের একেবারে মাঝখানে। এমার ঠিক পাশেই বসে মেয়র রেইনহোল্ড সাহল। একটু পরেই ফেডারেল মন্ত্রী মার্টিন কোচার এবং মিসেস সেক্রেটারি ইভা ল্যান্ডরিচিংগার পৌঁছে যাওয়ার কথা। তাঁরা ইভেন্টের দ্বিতীয় পর্বে যোগ দেবেন। ‘দ্য হ্যাবসবার্গ ইন ইউরোপ’ শীর্ষক একটি ডকুমেন্টারির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করতে আসবেন। ঠায় বসে নিরস প্রত্নতাত্ত্বিক পাণ্ডিত্য প্রদর্শন দেখে ক্লান্ত বোধ করছিল এমা। একমাত্র শেষের বক্তা, প্রফেসর বরিসের কথাগুলো তার মনকে মঞ্চে বেঁধে রেখেছিল। ভদ্রলোক পোডিয়াম ছেড়ে যেতেই আবার উসখুসভাব ফিরে এসেছে। একই সঙ্গে হতাশাও। ভেবেছিল এখানে তার কাজের একটা হিল্লে হতে পারে, কিন্তু আশেপাশে যাঁরা আছেন, কেউই কোনো অনুসন্ধান সংস্থার মাথা নন। তেমন কাউকে পেলে এমা লাজলজ্জা জলাঞ্জলি দিয়ে নিজের প্রয়োজনীয়তার কথা বলত। অর্থের নয়, কাজের। সেই সম্ভাবনা নেই দেখে এমা দ্বিতীয় পর্বে আবার একগুচ্ছ নাটক দেখার পরিকল্পনা বাতিল করল।

দ্বৈত কক্ষ ছেড়ে হলে বেরিয়ে এল এমা। হলের উঁচু ডোমের মতো সিলিং-এর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। সিলিং-এর অনন্যসাধারণ ফ্রেস্কো কিছুক্ষণ তার পা দুটোকে নড়তে দিল না। হঠাৎ—

‘ড. মিলার?’

মোটা কণ্ঠস্বর এমার দৃষ্টিকে সিলিং থেকে নামিয়ে নিয়ে এল। প্রফেসর বরিস! ধূসর রঙের ব্লেজারখানা ডানহাতে ধরে রেখেছেন। মার্চের শেষ দিকে তাপমাত্রা বেড়ে চোদ্দো ডিগ্রি ছুঁয়েছে। যদিও তা পরনের ব্লেজার খুলে ফেলার কারণ বলে মনে হয় না। জামার হাতায় জলছাপ লেগে। নির্ঘাত ওয়াশরুমে গিয়ে ভিজিয়েছেন। বুকপকেট থেকে চশমার টেম্পলস বেরিয়ে। একটু পরেই প্রফেসর ‘চশমা কোথায়’ ভেবে ব্যস্ত হবেন কল্পনা করে এমার হাসি পেল।

‘ড. এমা মিলারই তো? ডিসকাভারার অব দ্য রিভেঞ্জ?’

এবার চমকে উঠতে হলো এমাকে। হ্যাঁ, প্রজেক্ট রিভেঞ্জ তারই ব্রেন চাইল্ড। শতাব্দী প্রাচীন সেই জাহাজের যেটুকু উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে, তার পেছনে এমার ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং বিচক্ষণতার ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে কাগজে-কলমে রিভেঞ্জ ডিসকাভারি-এর সঙ্গে এমা মিলারের এতটুকু সম্পর্ক নেই। সব কৃতিত্ব রয়্যাল ইনভেনটার্সের। বরং বাজারে তার ব্যর্থতার গুঞ্জন কান পাতলেই শোনা যায়। তার পরেও রিভেঞ্জের আবিষ্কর্তা হিসেবে প্রফেসর ড. বরিস গ্রইসম্যানের মতো বিখ্যাত নৃতত্ত্ববিদের কাছে তার নাম পৌঁছাল কীভাবে? প্রত্যুত্তরে ঠিক কী বলা উচিত এমা স্থির করতে পারল না। ঘাড় নাড়ল কেবল।

‘আপনি তো অসাধ্য সাধন করেছেন মশাই! আঠেরো শতকে ডুবে যাওয়া…’

‘আপনি বোধহয় ভুল করছেন।’ প্রফেসরকে এবার থামিয়ে দিল এমা।

‘ব্ল্যাকবিয়ার্ডের ফ্ল্যাগশিপ উদ্ধারে আমার কোনো ভূমিকা আছে বলে জানতাম তো!’

‘আমার আছে ড. মিলার। বিলক্ষণ জানা আছে। কে কী বলে কিংবা জানে, তা নিয়ে আমার এতটুকু মাথা ব্যথা নেই। ভুল ত্রুটি দূর করে নতুন ইতিহাস লেখাই একজন আর্কিওলজিস্টের লক্ষ্য হওয়া উচিত, ইতিহাসে নাম লেখানো নয়। হ্যাঁ, তার দরুন স্বীকৃতি জোটে বইকি। যেমন আমার খানিক জুটেছে। কখনো আবার ইতিহাসের দলিল বিশ্বের সামনে তুলে ধরার পরেও পরিশ্রমের কদর পাওয়া যায় না। কিংবা ব্যর্থতায় জোটে উপহাস। কিন্তু তার জন্য কোনো আক্ষেপ থাকার তো কথা নয় ড. মিলার! যেকোনো কাজে সততার সঙ্গে চেষ্টাটুকু যেন মিশে থাকে। তাছাড়া স্বপ্ন পূরণের আনন্দ থেকে কেউ কাউকে বঞ্চিত করতে পারে কি? সেটা একেবারেই ব্যক্তিগত অধিকারের মধ্যে পড়ে। তাই না?’

এমা চট করে কোনো জবাব খুঁজে পেল না। প্রফেসর বরিস সম্ভবত তার দোলাচলতা অনুমান করে ঘনিষ্ঠ সুরে বললেন, ‘আমার আপনাকে প্রয়োজন ড. মিলার। ভীষণ প্রয়োজন।’

‘আমাকে!’

‘সবকিছু শোনার পর, দ্বিতীয় কারোর ওপরে ভরসা করতে পারছি না যে। আপনি সাহায্য করলে ইতিহাসকে আমরা নতুন ব্যাখ্যা উপহার দিতে পারব ড. মিলার।’

প্রফেসর বরিস কী বলতে চাইছেন এমার বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না। নিশ্চয়ই কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে নামতে চলেছেন। এবং সে কারণেই তার সাহায্য চাইছেন।

‘দ্য লেন্স অব লংগিনাস?’

এমার কথায় ঈষৎ ঝুঁকে থাকা শরীর টানটান করলেন প্রফেসর বরিস। গলাকে যথাসম্ভব খাদে নামিয়ে বললেন, ‘সবকিছু এখানে দাঁড়িয়ে আলোচনা করা উচিত হবে না ড. মিলার। আপনি কি এখন কিছুটা সময় দিতে পারবেন?’

‘এখনই!’

ভদ্রলোকের তাড়াহুড়ো করা দেখে অবাক হল এমা। এটা ঠিকই একটা কাজের খোঁজে সে ভিয়েনাতে এসেছে। নতুন কোনো প্রজেক্ট, অজস্র হিসেব, হাজারটা পুরোনো বইয়ের গন্ধ, আর সবচেয়ে বড়ো কথা— নতুন একটা স্বপ্ন। যার পেছনে ছুটতে গিয়ে সময় মুঠোয় ভরা বালির মতো গলে যাবে। সেদিক থেকে ভাবলে প্রফেসর বরিস তার ত্রাণকর্তা। তা বলে দ্য হোলি লেন্স! নিখাদ একটা গল্প নিয়ে খোঁজ! তাছাড়া সে জলের মানুষ, ডাঙায় খোঁজ চালানো তার কাজ নয়। প্রফেসরকে শেষের কথাটা স্মরণ করিয়ে দিতে তিনি বললেন, ‘অনুসন্ধানের নেশা যার রক্তে, তার কাছে জল-স্থলে ফারাক থাকে না বলেই আমি মনে করি ড. মিলার। প্রশ্ন চিহ্নের পেছনে পেছনে ধাওয়া করে উত্তর খুঁজে আনাই আমাদের কাজ। হ্যাঁ, তার জন্য স্থান বিশেষে কৌশলগত পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়। ও নিয়ে আপনি ভাববেন না। সেজন্য আমি আছি। আহামরি কঠিন কাজ নয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি উপাদান হলো— দেখবার চোখ আর ভাববার মগজ। সে দুটো আপনার যথেষ্ট শক্তিশালী।’

প্রফেসর বরিস মুহুর্তের জন্য থামলেন। তাঁকে ব্লেজারের পকেট হাতড়াতে দেখে এমা হেসে ফেলল। যথারীতি চশমা হারিয়েছেন।

‘জামার পকেটে।’

এমার কথায় অবাক হয়ে তাকালেন প্রফেসর বরিস।

‘চশমা খুঁজছেন তো? আপনার শার্টের পকেটে।’

একটা সময়ের পর জীবনচক্র বুঝি শৈশব থেকে আবার চলতে শুরু করে। প্রফেসর বরিসের হাসি দেখে এই একটা কথাই এমার মনে উঁকি মারল।

গ্রিন ডোর বিসট্রো। রেঁস্তোরাটা হফবার্গ প্যালেসের কাছেই। বেশ পরিচ্ছন্ন। পরিপাটি করে সাজানো। দেয়ালের ঘন রং আলো শুষে নেওয়ায় বেশ রহস্যময় পরিবেশ তৈরি হয়েছে। প্রফেসর বরিস এবং এমা, মুখোমুখি বসে আছে দুজনে। জরুরি যে কথা বলার জন্য ভদ্রলোক তাকে প্রায় গ্রেপ্তার করে নিয়ে এলেন, রেঁস্তোরায় ঢুকে বেমালুম ভুলে বসে আছেন! দিব্যি খাবারে ডুবে। লেটুস, বিট, আপেল এবং রোস্টেড ওয়ালনাটের সহযোগে গ্রিলড গোট চিজ। খাওয়ার ধরণ দেখে এমার মনে হলো প্রফেসর সম্ভবত বেলা ফুরনোর আগেই ডিনারের পর্ব চুকিয়ে ফেলতে চান। ইভেন্টের মাঝেই লাঞ্চের ব্যবস্থা ছিল। দুপুরের দিকে হালকা খাওয়া এমার অভ্যাস। বরং ব্রেকফাস্ট সামান্য ভারী হলেও তার অসুবিধা হয় না। সারাদিন ছোটার রসদ জমা থাকে। আজও দুপুরে সেভাবেই সামান্য কিছু মুখে দিয়েছিল। খাওয়ার ইচ্ছেটা তাই আর অসময়ে তাগাদা দেয়নি। প্রফেসরের অনুরোধ সত্ত্বেও এমা বিশেষ কিছু নেয়নি। ফিলড পাফড পেস্ট্রির একটা কোণা ভেঙে মুখে দিয়েছিল। তার পর থেকে কেবল চামচ নেড়ে যাচ্ছে।

‘আপনি কিছুই নিলেন না। ওয়াইন?’ খাওয়ার পাট চুকবার পর অবশেষে এমার কথা মনে পড়ল প্রফেসর বরিসের।

‘নাহ্। এখন থাক। আগে আপনার জরুরি কথাটা শোনা যাক।’

‘ওহ্, দেখেছেন! এখনো আসল কথাতেই আসিনি!’

বলে চশমাটা খুলে টেবিলে রাখলেন।

‘জাজমেন্ট ডে। বিচারের সেই দিন সম্পর্কে কিছুটা ধারণা আছে নিশ্চয়ই?’

‘আছে। গভর্ণর পয়েন্টাস পিলেত এবং ইহুদি যাজকদের সম্মিলিত পরিকল্পনায় ক্রুশিফিকশনের নির্দেশ কার্যকর করা হয়েছিল। গলগাথার ঘটনাও পড়েছি। আপনার ওই লংগিনাসের বর্শা দিয়ে জিশুকে হত্যা করা ইত্যাদি।’

এমার কথা বলার ঢঙে স্পষ্টত বিরক্তি ঝরে পড়ল। প্রথমত, এইসব আষাঢ়ে গল্প নিয়ে সে এতটুকু আগ্রহী নয়। দ্বিতীয়ত, প্রফেসর বরিস ইতিমধ্যেই তার যথেষ্ট সময় নষ্ট করেছেন। সামনে বসা ভুলো মনের মানুষটি অবশ্য অবধারিতভাবে তার অধৈর্যভাব নজর করলেন না।

‘তেমনটাই আমাদের জানানো হয় বটে। সেই সময় ড. মিলার, জুডেয়ার প্রশাসনিক ব্যাপারে রোম বেশ সতর্কতামূলক নমনীয় নীতি অবলম্বন করত। সিরিয়া এবং ইজিপ্ট, রোমের এই দুই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধিকৃত অঞ্চলের একেবারে মাঝামাঝি অবস্থান ছিল জুডেয়া, মানে এখনকার প্যালেস্তাইনের। বাকি দুটি অঞ্চলে রোমান লিজিয়ন মোতায়েন করা থাকলেও প্যালেস্তাইনে কিন্তু ছিল না।’

‘সম্ভবত শক্তি খাটিয়ে নয়, চেয়েছিল স্বেচ্ছায় তারা রোমের প্রতি বিশ্বস্ত থাক।’

নিস্পৃহভাবে বলল এমা। এ ইতিহাস তার একেবারে অজানা নয়। তার যুক্তিতে দ্বিগুণ উৎসাহে প্রফেসর বরিস বলে উঠলেন,

‘একদম খাঁটি কথা ড. মিলার। এবং জুডেয়ার শাসক হিসেবে হেরোদ কাজটা দারুণভাবে সামলেছিলেন।’

‘তাই! কিন্তু রাজা হেরোদ তো সাধারণ মানুষের জীবন করের বোঝা চাপিয়ে দুর্বিষহ করে তুলেছিলেন বলেই জানি। বিক্রয় কর, মন্দিরের কর, পেশাভিত্তিক কর, এমনকি উপাচার পালনের ওপরেও কর চাপানো ছিল।’

‘এছাড়াও ছিল। দ্য গ্রেট জুলিয়াস সিজারের রোমকে নিয়ে বিরাট উচ্চাশা ছিল। টাইবার নদীর গতিপথ বদলে দেওয়া, ফোরামকে নতুনভাবে তৈরি, নতুন ব্যাসালিকা নির্মাণ, সেনেট হাউসকে আরও উত্তরে সরিয়ে নতুন করে গড়ে তোলা, তালিকা করলে বেশ লম্বাই হবে। সিজারের পর অবশিষ্ট বিষয়টাই অগাসটাস তুলে নিয়েছিলেন। মন্দির নির্মাণ। শহরের যত্রতত্র সর্বত্র। এমনকি নিজের আবাসস্থলেও অ্যাপেলোকে ঢুকিয়ে ছেড়েছিলেন। আর তার জন্য টাকার পাকাপোক্ত যোগান দরকার ছিল যে।’

‘বুঝলাম। কিন্তু এসবের সঙ্গে লেন্স অব লংগিনাসের কী কোনো সম্পর্ক আছে প্রফেসর?’

‘সরাসরি নেই। তবে আমি বরাবর মনে করি ড. মিলার, যে বিষয়ে কাজ করব, তার আশপাশের খুঁটিনাটি জেনে রাখা উচিৎ। কাজটা কেন করছি সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার।’

‘ঠিক।’

সংক্ষিপ্ত সমর্থন জানালো এমা। প্রফেসরের শেষ যুক্তিটা সে নিজেও যথাসাধ্য মেনে চলার চেষ্টা করে। যদিও এই প্রাচীন গল্পের পেছনে দৌড়ানোতে তার সায় নেই, তবে আপাতত ইতিহাসের চর্চাটুকু মন্দ লাগছে না। প্রফেসরের বলার ধরনটিও চমৎকার।

‘গৃহযুদ্ধ এবং দাঙ্গায় ধ্বস্ত গালীল, জুডেয়াতে হেরোদ নিপুনভাবে রোমের কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিলেন। সুতরাং তিনি যে অগাসটাসের প্রিয় পাত্র হবেন, এ আর নতুন কি? রোমের নির্ধারিত করের ওপরে হেরোদ আবার আলাদাভাবে কর চাপিয়েছিলেন। জুডেয়াবাসীদের নাভিশ্বাস উঠে যাওয়ার মতো অবস্থা। তাঁর মৃত্যুর পরে রোমের দ্বারা মনোনীত গভর্ণরদের প্রতি জুডেয়াবাসীর মনোভাব আলাদা আলাদা হয়ে যায়।’

‘সম্প্রদায় বিশেষে রোমের প্রতি মান্যতা আলাদা ছিল বলতে চাইছেন?’

‘ঠিক তাই। ফরীশীরা যেমন, রোমের শাসনকে মেনে নিলেও দরকারে চ্যালেঞ্জ করার জন্য তলায় তলায় প্রস্তুত থাকত। আবার সদ্দূকী সম্প্রদায় সমঝোতার রাস্তা বেছে নিয়েছিল। নিজেদের জীবনে রোমের শাসনকে মেনে নিয়ে, শাসকের ইচ্ছাপূরণে তাদের অনীহা ছিল না।’

‘হোয়াটএভার প্লেজারস দ্য এম্পেরর, ইজ দ্য ল।’

‘অ্যাবসলিউটলি কারেক্ট।’

এমার কথায় উচ্ছ্বসিত হয়ে জোরে টেবিলে চাপড় মেরে বসলেন প্রফেসর বরিস। পোর্সিলিনের প্লেট, স্টিলের কাঁটা চামচ ঝনঝনিয়ে মৃদু প্রতিবাদ জানালো। ওয়াইনের গ্লাস খানা উলটে যাচ্ছিল, কোনোমতে সামাল দিলেন তিনি। এমা ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশে চট করে একবার নজর বুলিয়ে নিল। দু-একজন অবাক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে। প্রফেসর ভুলে বসে আছেন এটা রেঁস্তোরা, তাঁর স্টাডি নয়। এমা কোনোক্রমে নিজের অবাধ্য হাসিকে লাগাম পড়াল। সামনের মানুষটির অবশ্য নিজের কৃতকর্মে তিলমাত্র অনুশোচনা নেই! তিনি যথারীতি ক্লাস শুরু করে দিয়েছেন।

‘তৃতীয় এক ধরনের মনোভাব ছিল ড. মিলার। নন ভায়োলেন্ট রিজেকশন অব রোমান ল। অনেক ঐতিহাসিক জিশুকে এই শ্রেণীতে ফেলেন।’

‘সুতরাং জিশুর ক্রুশবিদ্ধকরণের পেছনে কেবল ইহুদিরা নয়, রোমান শাসকদেরও স্বার্থ লুকিয়ে ছিল বলছেন?’

‘তাই তো থাকার কথা ড. মিলার। যদিও পয়েন্টাস পিলেতের জবানবন্দি অন্যরকম, তবু যুক্তিগুলোকে একেবারে অগ্রাহ্য করা যায় না। তাছাড়া…’

ফটফটে সাদা পোশাকের বেয়ারা এসে টেবিলের পাশে এসে দাঁড়াতে প্রফেসরকে মাঝপথে থামতে হলো।

‘আর কিছু নেবেন স্যার?’

‘আর কিছু!’

প্রশ্নটা বুঝতে সামান্য সময় নিলেন প্রফেসর। তারপর এমাকে জিজ্ঞেস করার ভদ্রতা ভুলে জবাব দিলেন,

‘নাহ্। বিল?’

বেয়ারা প্রস্তুত হয়েই এসেছে। বেয়াড়া খদ্দের দুটো প্রায় দু ঘণ্টা টেবিল আঁকড়ে বসে। সে তড়িঘড়ি হাতে ধরে রাখা চামড়ার ফ্ল্যাপ টেবিলে নামিয়ে রাখল। প্রফেসর বিল দেখে একটা কুড়ি ইউরোর নোট ফ্ল্যাপে গুঁজে বললেন, ‘কিপ দ্য চেঞ্জ প্লিজ।’

রেস্তোরা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে দু’জনে। একটু দূরেই এমার বাহন এবং চালক, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। বেচারা ডেভিড ঠায় অপেক্ষা করছে তার জন্য। এবার আর নিজের ব্যস্ততা লুকোনোর চেষ্টা করল না এমা, ‘মাফ করবেন প্রফেসর। আমার একটু তাড়া আছে। আমাকে ঠিক কী কারণে আপনার প্রয়োজন তা আজ আর শোনার উপায় নেই।’

‘দেরি করে ফেললাম, না?’

বিষন্ন হাসি মেলে ধরলেন প্রফেসর বরিস। পরমুহূর্তেই তা মুছে শিশুসুলভ ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, ‘আপনি আগামীকাল দয়া করে আমাদের গ্রামে আসুন। ওয়াকাউ ভ্যালি। ক্রেমস থেকে খুব কাছেই। ভূমিকাটুকু শুনলেন, বাকিটা না হয় আগামীকাল আলোচনা করা যাবে। আপাতত আপনাকে এটুকু বলে আশ্বস্ত করতে পারি, কাজটা ভীষণ ভীষণ চ্যালেঞ্জিং। সবটা দেখলে এবং জানলে, লংগিনাসকে আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না। তাঁর বর্শাকেও নয়।’

‘আমি চেষ্টা করব প্রফেসর।’

সংক্ষেপে জবাব দিল এমা। আগামীকাল সে হফবার্গ প্যালেসের ভেতরে ঢুঁ মারার পরিকল্পনা করে রেখেছে। জ্বলজ্যান্ত ইতিহাস ছেড়ে নিখাদ এক গল্পের পেছন পেছন ক্রেমস ছুটে যাওয়ায় মন সায় দিচ্ছে না। আবার মগজ বলছে প্রফেসর বরিস গ্রইসম্যানের মতো প্রাজ্ঞ মানুষের কথা নিতান্ত অবহেলায় ছুঁড়ে ফেলা মুর্খামি। হয়তো যে কাজের সন্ধানে ভিয়েনায় ছুটে এসেছে, ক্রেমসেই তার খোঁজ পাওয়া যাবে। দোটানায় পড়ে এমা অবশেষে মাঝামাঝি একটা অবস্থান নিল।

‘আমাকে ভাবার একটু সময় দিন প্রফেসর। প্লিজ।’

 

 

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *