সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ৩০। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

0

(গত পর্বের পর)

হোমের নথিপত্রে আবাসিকদের মায়েদের নাম সাধারণত থাকতো না। জেন এবং অন্যান্য গবেষকরা সেকারণে একরকম বাধ্য হয়েই বাবাদের কথা বলেছেন বেশি, বাচ্চাদের কথাও। একশো বছরের বেশি সময় ধরে যত্নে রেখে দেওয়া, আবাসিকদের নামে নামে হোমের নিজস্ব ফাইল ঘেঁটেও জেন ম্যাকেব একটি দুটির বেশি মাতৃনাম উদ্ধার করতে পারেননি। তার মধ্যে একটি ‘প্রসনি(তাঁতি জাত)’। স্পল্ডিং বাচ্চাদের মা ‘প্রসনি’(সম্ভবত তাঁর আসল নাম ছিলো ‘প্রসন্ন’?)-র পরিচয় হিসেবে দেওয়া হয়েছে ‘বাগানের কুলি’, ভর্তির সময়াবধি (১৯২২ সাল) তিনি জীবিত। এইটুকুই। প্রসন্ন বা প্রসনির বিষয়ে আর কিছু জানানো হয়নি। প্রসনির বাচ্চাদের বাবা ডব্লিউ সি স্পল্ডিং ছিলেন শ্রীহট্টের জনৈক প্ল্যান্টার, কলকাতায় তাঁর মৃত্যু ঘটছে ১৯২০তে। এর এক বছর পরে তাঁর বিষয়সম্পত্তির অছি জেমস ডিওয়ার গ্রাহামকে চিঠি লিখছেন। চিঠির সঙ্গে ভর্তির ফর্ম ও ৪০০০ টাকা পাঠানো হয়েছিলো। বারো ও দশ বছরের দুটি ছেলে কালিম্পং এসে পৌঁছোয় আরো এক বছর পর। ডিওয়ার জানাচ্ছেন, ‘দুটি ছেলেই চালাকচতুর, ভদ্র’, এবং ‘বর্তমান পরিস্থিতি-সাপেক্ষে, ভালোভাবে বেড়ে ওঠা’। স্পল্ডিংদের ফাইলে পরের দিকের চিঠিপত্রও রয়েছে। সেখানে ডিওয়ার সাহেব স্পষ্ট বলছেন, চার্লস এবং টম, দুজনকেই বাইরে, উপনিবেশে পাঠানো উচিত। এ বিষয়ে তাদের মায়ের মতামতের কথা আদৌ বিবেচনাধীন ছিলো না। ১৯২৫ সালে, নিউজিল্যান্ড যাত্রার আগে গ্রাহামের লেখা চিঠির(গ্রাহাম জানতে চাইছিলেন, যাবার আগে চার্লস তার মায়ের সঙ্গে একবার দেখা করবে কিনা)উত্তরে, ডিওয়ার লিখছেন, এক যদি চার্লি খুব জেদ না করে, যেতে না দেওয়াই উচিত। দেখা করে ‘কাজের কাজ’ কিছু হবে না, ডিওয়ার বলছেন, কেননা এমনিতেও, ‘মহিলা সচ্চরিত্রের নয়’।

ধরে নেওয়া যায়, দেশ ছাড়ার আগে, চার্লি তার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারেনি। তা সত্ত্বেও, ‘অসচ্চরিত্র’, ‘বাগানের কুলি’ প্রসনি নিজের ছেলেদের দেখবার চেষ্টা ছাড়েননি, নিজে নিরক্ষর হলেও অন্য কাউকে দিয়ে চিঠি লিখিয়ে, চার্লির কাছে পাঠিয়েছেন। দূর নিউজিল্যান্ডের উত্তরদিকের দ্বীপ তে আউয়ামুতু থেকে চার্লি হোমের সচিব জেমস পার্ডি-কে চিঠি দিয়ে বলছে:

‘মায়ের কাছ থেকে চিঠি পেয়েছি। মা বলছে, তোর কিছু টাকাপয়সা হলে একবার কি আসবি এখানে, তোকে একবার দেখবো, আমি উত্তর দিয়ে বলেছি, হ্যাঁ, আমি তোমার কাছে যাবার চেষ্টা করবো…মা বলছে, টম নিউ জিল্যান্ড আসার আগে ওকে একবার দেখবে।’

বলা বাহুল্য, চার্লির অনুরোধ রক্ষিত হয়নি, টম তার মা-কে দেখতে যেতে পারেনি। জেন জানাচ্ছেন, ফাইলে রাখা একটা চিঠিতে(ইংরিজিতে অনুবাদ করা)প্রসনি-র বুড়ো আঙুলের টিপছাপ ছিলো।

হোমে রাখা আবাসিকদের ব্যক্তিগত ফাইল থেকে আর একজন মা সম্পর্কে খানিক বেশি জানা যাচ্ছে। কা নগেলবু (পরে নেলি) ছিলেন জীন এবং রেন্ড মর্টিমোরের মা। ছেলেরা যখন হোমে, জাতিতে খাসি এই মহিলা ইংরিজি লিখতেপড়তে শেখেন। ছেলেদের নিউজিল্যান্ড  যাবার সব ঠিকঠাক,  যাত্রার ঠিক আগে, শিলং থেকে নেলি হোমকর্তাদের লিখছেন:

অতীব দুঃখের সহিত জানিতে পারিলাম, গত মাসের ২৫ তারিখ, আমার সন্তান, জীন এবং রেনরোজ কালিম্পং হইতে নিউজিল্যান্ড উপলক্ষে যাত্রা করিয়াছে। এই সংবাদ আমার পক্ষে হৃদয়বিদারক, নিতান্ত অসহনীয়। আপনাদিগকে কিছু না লিখিয়া থাকিতে পারিতেছি না।

কা নগেলবু ওরফে নেলি সম্পর্কে হোমের ফাইল থেকে আরো খবর  পাওয়া যাচ্ছে, জেন জানাচ্ছেন। নেলির ‘স্বামী’, এবং তাঁর বাচ্চাদের বাবা ছিলেন জনৈক ডব্লিউ মর্টিমোর, দক্ষিণ শ্রীহট্টের প্ল্যান্টার। সেসময়ের রেওয়াজ অনুযায়ী, মর্টিমোর সাহেব লম্বা ছুটি বা ফার্লো নিয়ে দেশে যান, যাবার আগে তাঁর বাচ্চাদের মায়ের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে যাবতীয় দায়িত্বকর্তব্য থেকে খালাস হন। যে টাকা দিয়েছিলেন, তাতে বাচ্চাদের দুতিন মাসের খরচা হতে পারে বড়জোর।

 

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *