নির্বাসিত গ্রহ, প্রত্যাখ্যাত মানুষ। গুলজারের ‘প্লুটো’ পড়ে লিখছেন সুমনা চৌধুরী
জীবনে বেশিরভাগ ভালো বই পড়া-ই ঘটেছে অপ্রত্যাশিতভাবে। এই যেমন গুলজারের ‘প্লুটো’। তিন-চার বছর আগে করিমগঞ্জ বইমেলায় এক বন্ধু বইটি উপহার দিয়ে বলে— ‘শুধু বলিউডি সিনেমার গানেই গুলজারের পরিচয় শেষ হয়ে যায় না। এক অনন্য গুলজারকে চিনতে হলে তাঁর কবিতার বইগুলো অবশ্যই পড়ে দেখিস!’
এভাবেই প্লুটোর আমার ঘর অব্দি আসা। পড়া তারও মাস আটেক পরে। কাজকর্মহীন খুবই অলস এবং মনখারাপ করা দিনে। সম্ভবত জুলাই-আগস্ট মাসে। সম্ভবত বললাম কারণ মাসটা খেয়াল নেই। দিনটি আছে। কালো মুখগম্ভীর প্যাচপ্যাচে বৃষ্টির দিন।
কৈশোরে আমরা ক্যাসেটে, টিভিতে গুলজারের গান শুনে বড়ো হয়েছি। তারও পরে বড়ো হয়ে শহরের রাস্তায়, শীতের ঘন রাতে, বৃষ্টির প্যাচপ্যাচে বিষণ্ণ দিনে হেডফোনে বেজেছেন গুলজার। মনখারাপি বিষণ্ণতায় গুনগুন সুর ভেসে এসেছে—
‘এক অকেলা ইস শহর মে
রাত মে ঔর দোপেহের মে
আবোদানা ঢুন্ডতা হ্যাঁ
আশিয়ানা ঢুন্ডতা হ্যাঁ….”
কিন্তু প্লুটো আমায় চিনিয়ে গেল এক অন্য গুলজারকে। যে গুলজারের কাজ, অন্ধকারতম বিষণ্ণ মুহূর্তগুলোও আলোয় ভরা।
বইটির নাম প্লুটো কেন, তার উত্তর বইটির মুখবন্ধে গুলজার দিয়েছেন এভাবে—
“গ্রহ হিসেবে প্লুটো সম্প্রতি তার মর্যাদা হারিয়েছে। বৈজ্ঞানিকরা বলেন, ‘দূরে থাকো তুমি, আমরা তোমায় নয়টি গ্রহের পরিবারে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি না।’
বহুকাল আগে আমার পরিবারে আমি জায়গা হারিয়েছিলাম। আমার পরিবারের তরফে বলা হয়েছিল, ‘ব্যবসায়ীদের পরিবারে মিরাসি-র প্রয়োজন কী?’ নিঃশব্দে উচ্চারিত হয়েছিল, তুমি আমাদের কেউ নও। প্রত্যাখ্যাত হয়ে প্লুটোর দুঃখে আমার মন ভারাক্রান্ত। কত দূরে…. কত ছোট…তাই আমার ক্ষুদ্র কবিতাগুলি তাকে উপহার দিলাম।….”
খুবই অবিন্যস্তভাবে কবিতার বই পড়ি আমি। মানে নিয়ম মেনে শুরু থেকে শেষ—এমনটা নয়। পৃষ্ঠা উল্টে পাল্টে হয়তো মাঝখানের একটা কবিতা পড়লাম। প্লুটোও এভাবে পড়া। প্রথমে পাতা উল্টে পাল্টে একটা কবিতায় চোখ আটকালো—
‘উস সে কেহনা…’
ইতনা কহা…অউর ফির গর্দন নীচি কর কে
দের তলক ওয়হ প্যায়ের কে অঁন্গুঠে সে মিটটি খোদ-খোদকে
বাত কা কোই বীজ থা, শায়দ, ঢুঁঢ় রহী থী
দের তলক খামোশ রহী
নাকসে সিসকী পোঁছ কে আখির
গর্দান কো কান্ধে পর ডাল কে বোলি,
“ব্যস…ইতনা কহ দেনা!”
পড়তে পড়তে আমার অবচেতনে এসে দাঁড়াচ্ছে সেই কবেকার কোন বিকেলে অর্জুন গাছের সামনে এসে দাঁড়ানো ফাতিমা। অর্জুন গাছের গায়ে সোনার লেখা ‘জ্যাঠামশাই আমরা হিন্দুস্থান চলিয়া গিয়াছি’ দেখে যে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলবে! ভারতবর্ষের একপ্রান্তের এক কবির লেখা আমায় মনে করিয়ে দিচ্ছে দেশের আরেকপ্রান্তের অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা। নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে উপন্যাসের কথা।
প্রবেশক কবিতা পেরিয়ে বইয়ে ঢুকলে ক্রমশ প্রানবন্ত রূপক-ছবিতে বন্দী মুহূর্ত এবং আবেগে সমৃদ্ধ মহাবিশ্বে পাঠককে দ্রবীভূত করেন গুলজার। চাঁদ, পাহাড়, পাখি, স্রোতস্বিনী, রাস্তাঘাট, প্রেম, আঘাত, সম্পর্ক—সবকিছুকে যেন একটি ব্যক্তিত্ব দিয়েছেন গুলজার। জীবনের ছোটো ছোটো, তুচ্ছ, ক্ষণস্থায়ী মুহূর্তগুলোও যেনবা আলাদা করে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে গোটা বইটিতে। শুধু মানবসম্পর্ক বা প্রেম, প্রকৃতির মাঝেই গুলজারের ভাবনা বিচরণ করেনি। বরং মৌলবাদ, হিংসা, বৈষম্যের বিপক্ষে তিনি অবস্থান নিয়েছেন তাঁর ব্যঞ্জনাময় বুদ্ধিদীপ্ত ভাষায়। অবিচল থেকেছেন তাঁর আশাবাদের লক্ষ্যে।
গুলজার লিখছেন প্লুটো গ্রন্থে—
‘আল্লামাকে গিয়ে বলুক কেউ,
যে ক্ষেত থেকে রুটি পায়নি কৃষক,
সেই ক্ষেত কেউ পোড়ায়নি
কেউ উঠে দাঁড়ায়নি, হয়নি কোনও বিপ্লব
প্রতিটি গ্রামে আজ কৃষকের শবযাত্রা বেরোয়
যারা ঋণের মাটি চিবিয়ে আত্মহত্যা করেছে।’
(আল্লামা ইকবাল যিনি লিখেছিলেন
‘যে ক্ষেত থেকে পায় না কৃষক রুটি
পুড়িয়ে দাও সেই ক্ষেতের প্রতিটি শস্যকণাকে।’)
এই বইয়েরই আরেকটি কবিতা—
‘ওঅ সুখা পত্তা উস লকড়ী কে পুল পর হী পড়া থা
উসে উস পুল পে আনে-জানেওয়ালে প্যায়রোঁ কা ডর থা
কুচল দেগা কোইভী, পীস দেগা পাও কে নীচে
কোই ঝোঁকা হাওয়া কা আয়ে অউর উসকো উঠা কে দরিয়া পে রখ দে
সুকুঁ সে লেটকর, ইয়ে আখরী হিস্সা সফর কা পার কর জায়ে!’
যে মানুষটির জীবন ভারত ও পাকিস্তান বিভক্তির ফলে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল; যে মানুষটি প্রথম জীবনে গাড়িতে রঙ করার কাজ করে তাঁর জীবিকা নির্বাহ করতে চেয়েছিলেন, যাতে তিনি লেখক এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা হওয়ার স্বপ্ন পূরণের জন্য সময় পেতে পারেন; পরিবারের প্রত্যাখ্যান মানতে হয়েছে— তাঁর লেখার জীবনবোধ, দর্শন, তাঁর মানবিক ভাবনার জগত, আবেগ, অনুভূতি, সম্পর্ক, প্রতিবেশকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গী তো এমন উন্মুক্ত আকাশের মতো বিশাল-ই হবে…। সমুদ্রের মতো গভীর! তাঁর প্লুটো অথবা পরবর্তীতে পড়া অন্যান্য কবিতাগ্রন্থও আমার মতো এক ক্ষুদ্র পাঠক না পড়লেও তাঁর কোনো ক্ষতি হতো না। কিন্তু পাঠক হিসাবে আমার সবিশেষ ক্ষতিটি হতো। এই অসম্ভব মায়াময় অথচ বিষন্ন, হতাশার মাঝেও আলোয় ভরা যে ভুবন, যে মহাবিশ্ব তার খোঁজ পাওয়াই হতো না।
যারাই গুলজারের কবিতা পড়েছেন, যারা তাঁর লেখা কালজয়ী গানগুলো শুনেছেন, তারা জানেন গুলজারের লেখা-গুলজারের কবিতা সকালের স্নিগ্ধতার সাথে সমুদ্রের নোনা বাতাসের গন্ধ বয়ে আনে। জীবনের ছোটো বড় তুচ্ছ মুহূর্ত-আবেগগুলিকে স্বর্গীয় রূপক দিয়ে এমনভাবে সাজান, এমন প্রানবন্ত করে তুলেন গুলজার—পাঠক সরাসরি, প্রথম শব্দ থেকেই নিজেকে সেই অনুভূতিগুলোর সাথে সম্পর্কিত করতে পারে।
গুলজারের কবিতা সমুদ্রের মতো—গভীর ও বিশাল। ঝড় শেষে শান্ত সমুদ্রের মৃদু ঢেউয়ে ভেসে যাওয়া ডিঙি নৌকাটির মতো। যা পাঠককে ভাসিয়ে নিয়ে যায় দূর থেকে দুরে। জানা থেকে অজানায়। হৃদয়ের গভীর থেকে গভীর অনুভূতিগুলোর মাঝে। তাঁর কবিতার আবেগ মেঘের স্তরের মতো। যা পাঠকের হৃদয়ে নীরবে বৃষ্টি ঝরিয়ে চলে।
আমার বন্ধুর কথাটি একশো ভাগ খাটি। শুধু বলিউডের অসাধারণ গানগুলোর মধ্যেই গুলজারকে আটকে রাখলে গুলজারের এই অসম্ভব সুন্দর মানবিক পৃথিবীটাকে কখনোই ছোঁয়া যাবে না।
বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন শেখ সদর নইম। অবশ্যই ভালো অনুবাদ। সুন্দর প্রচ্ছদ। লেখার মাঝে মাঝে ছবিগুলোও সুন্দর। এই বইটিই আমায় গুলজারের আরো আরো কবিতা খুঁজতে উৎসাহিত করে তোলে।
তবে যদি উর্দু বুঝতে/পড়তে পারেন, তবে মূল লেখাগুলোই পড়বেন। কেননা কোনো না কোনোভাবে যে কোনো অনুবাদ গ্রন্থ থেকে-ই মূল লেখার মাধুর্য আরেকটু সুন্দর এবং মায়াময় হয়। তবে উর্দু না পড়তে পারলেও অসুবিধা নেই। বাঙালি পাঠককে গুলজারের কবিতার কাছাকাছি নিয়ে আসতে এই বইটিই যথেষ্ঠ। অনুবাদক খুব যত্নে এবং সচেতনভাবে কবিতাগুলোর মূল নির্যাস ও সৌন্দর্য অক্ষত রাখার চেষ্টা করেছেন। এবং তাতে তিনি সফলও।
…………………………………….
বইয়ের নাম : প্লুটো
লেখক : গুলজার
অনুবাদক : শেখ সদর নইম
মুদ্রিত মূল্য : ১৯৯ টাকা
প্রকাশক : দেজ পাবলিশিং