সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ২০। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ
চার
চরিত্রহীন, জাতধম্মের ঠিক নেই, এমন সব লোকজন যদি খ্রিস্টান বলে বুক ফুলিয়ে প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করতে থাকে, এদেশি নেটিভরা সদধর্মে দীক্ষিত হতে চাইবে কেন?
অতএব, গ্রাহাম সায়েব কালিম্পং-এ যে ইস্কুল খুললেন, তা হয়ে দাঁড়ালো একাধারে আশ্রম(প্রকৃত ধর্মাচরণের স্থান), বাড়ি(নতুন মা, বাবা, সুস্থ পারিবারিক পরিবেশ), এবং সাম্রাজ্য ও খ্রীষ্টধর্মের মানমর্যাদা রক্ষা করবার শিক্ষালয়। ইস্কুলে সাধারণ পড়াশুনো খানিক হতো। কিন্তু তার চাইতে বেশি হতো নীতিশিক্ষা, চরিত্রগঠন ইত্যাদি। গ্রাহামের ধারণায়, ইউরেশিয় শিশুদের আদর্শ বাড়ি বলতে শৃঙ্খলানিগড়ে আবদ্ধ পরিসর, সেখানে আবাসিক বাচ্চারা ঘরগেরস্থালির যাবতীয় কাজ শিখবে, নিজের হাতে করবে। বিশেষ করে, মেয়েদের ঘরের কাজ শেখানো নিয়ে গেরস্ত বিদ্যা বা ডমেস্টিক সায়েন্স নামে আলাদা এক পাঠক্রমই তৈরি হয়ে গেলো(এই বিষয়টাই হোমসায়েন্স নামে আমাদের শৈশব কৈশোরকালে দিশি ইস্কুলেও মেয়েদের পড়ানো হতো, হয়তো এখনো হয়)।
ভারতবর্ষের তামাম সায়েববাড়িতে গন্ডায় গন্ডায় রাঁধুনিচাকর বাবুর্চিখানসামা ইত্যাদি মোতায়েন থাকতো(যেমন চা সায়েবদের বাংলোয়), তাতে কি? কালিম্পং-এর কটেজবাড়িতে দিশি চাকর ঢুকতে দেওয়া হতো না। দিশি চাকর মানেই সেই দিশি মা, অর্থে দিশি পরিবেশ ও সেই পুরোনো পুতিগন্ধ আবর্জনা, যা থেকে বাচ্চাদের আলাদা রাখবার জন্য এত কান্ড করা। এবং, ইউরেশিয় মানে তো আর পুরো য়ুরোপীয়(অর্থাৎ সাদা চামড়া) নয়, বড়জোর আধা-জাত বা ‘হাফ-কাস্ট’, তাদের তো খেটে খেতে হবে, নিজের কাজটা নিজেদেরই করে নিতে হবে, চাকর রাখবার পয়সা দেবে কে?
ফলে, চাকর নয়, নিজের কাজ নিজে করো। ঘরের কাজ তো বটেই, বাইরের কাজও। তাঁর ইস্কুল থেকে বেরিয়ে বাচ্চারা কি করবে কি খাবে তা নিয়ে গ্রাহাম যারপরনাই চিন্তিত ছিলেন। হোমের মধ্যেই কাঠবিদ্যা বা কারপেন্ট্রি, যন্ত্রবিদ্যা(যন্ত্র সারাই বা সাদা বাংলায় মেকানিক), চাষবাস, রান্নাবান্না শেখানো ও অনুশীলনের জন্য নানান রকম ওয়র্কশপ বা কারিগরশালা গড়ে উঠলো, যার কোন কোনটা এখনো অবধি আছে। নিছক বইয়ের পড়া নয়, এসবে জোর পড়তো বেশি।
কিছু পড়াশুনো এবং অনেকটা হাতের কাজ শেখা হলে, বাচ্চাদের সাম্রাজ্যের এদিক ওদিক পাঠানো শুরু হলো। গ্রাহামের আকাঙ্ক্ষা ছিলো, ‘পুরো-জাত’ শুদ্ধরক্ত শিক্ষিত য়ুরোপীয় সমাজে না হোক, য়ুরোপীয় গরীব অর্থাৎ শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে হোমের বাচ্চারা কালক্রমে জায়গা করে নিতে পারবে। হায়, রক্ত(কিম্বা চামড়া, অর্থে চামড়ার রং) বড় বালাই, বিলেতের সায়েবকর্তারা গ্রাহামের আধাজাত কালিম্পংগোত্র বাচ্চাদের জায়গা দিতে আদৌ রাজি হলো না।
গ্রাহাম চাইছিলেন একদল ভালো, খাটিয়ে শ্রমিক তৈরি করতে। সেই শ্রমিকরা পুরো-জাত শ্বেতাঙ্গদের দলে হুট বলতে ভিড়ে পড়বার চেষ্টা করবে না, নিজেদের ‘নিচু’ সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে সদা-সচেতন থাকবে, সাম্রাজ্য ও স্বধর্মের প্রতি অবিচল আনুগত্যের প্রমাণ দেবে। এইভাবে, রক্ত, জাত, বর্ণ ও শ্রেণীর ‘স্বাভাবিক’ বিন্যাসে হেরফের ঘটবে না, যে শাসক সে শাসিতের ওপরে থাকবে, যেমন বড়লোকরা গরীবের, সাদারা, কালো হলদে বাদামির ওপরে, বা সায়েবরা অ-সায়েব নেটিভ দের ওপরে থাকে। এবং, এতদ্বারা, ইউরেশিয় সমস্যার স্থায়ী সমাধানও ঘটবে।
হায়, গ্রাহামের ইচ্ছা পূরণ হয় নি। এক আধটি বালক ব্রিটিশ সেনাদলে ভর্তি হতে পেরেছে, কিছু বালক সাউদ্যাম্পটনের নাবিক প্রশিক্ষণ জাহাজে জায়গাও পায়। এর বাইরে বাকি অনেকেই অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড আদি সায়েব উপনিবেশে যায়, সেসময়ের অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের যা দস্তুর। নিউজিল্যান্ডে বেশি, অস্ট্রেলিয়ায় কম। ব্রিটেনের নৌবাহিনীর কর্তারা শেষমেশ আধা-জাত পুরোজাতের বিভাজনে আস্থা রেখে, হোমের বাচ্চাদের নৌবহরে কাজ দিতে রাজি হন নি। একইভাবে, অস্ট্রেলিয়ার শাসককুল ‘হোয়াইট অস্ট্রেলিয়া’ নামে পুরোপুরি বর্ণবাদি ব্যবস্থা চালিয়ে আসছিলো, যার অর্থ, গায়ে য়ুরোপীয় রক্ত কম থাকলে সে লোককে দেশে ঢুকে করেকম্মে খেতে দেওয়া যাবে না, বা ঢুকতে দেওয়াই যাবে না। অর্থাৎ কিনা, শুধু সাদা, ধপধপে নিষ্কলঙ্ক সাদা চামড়ার প্রবেশাধিকার, বাকিরা কেটে পড়ো। মূলত স্থানাভাবে এ গল্প আমাদের গল্পে ঢুকতে দেওয়া যাবে না সেইভাবে, তথাপি একটা কথা না বললে নয়। ভারত যথা আর দশটি উপনিবেশের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ড বা আমেরিকার তফাৎ আছে। লুটতরাজ গুন্ডামি বদমাইশি নিসর্গ বদল এগুলো ওখানেও ছিলো, যেমন বাকি উপনিবেশে। যেটা তফাৎ সেটা হচ্ছে, যে সাদা সায়েবরা অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ড আমেরিকা ও পরে আফ্রিকার কোথাও কোথাও থাকতে শুরু করে, তারা উপনিবেশগুলোকে নিজেদের দেশ হিসেবেই দেখেছে। অর্থাৎ, য়ুরোপের নিসর্গ উদ্ভিদ পশুপাখি সমেত তামাম সংস্কৃতি স্থাপত্য ভাষা ও জনবিন্যাস ওই উপনিবেশে চালান করা হয়েছে, এবং যেহেতু এই কাজে স্থানীয় নেটিভরা বাধা, ছলে বলে কৌশলে তাদের নিকেশ করা হয়েছে, কি কোনঠাসা করে রাখা হয়েছে। য়ুরোপ যেমন সাদাদের দেশ, সাদাদের থাকবার সমস্ত জায়গাও তাই, এই ভাবনা থেকে যা সাদা নয় তাকে তাড়ানো হয়েছে কিম্বা ঢুকতে দেওয়া হয়নি পারতপক্ষে, যতদিন সম্ভব। অস্ট্রেলিয় শাসকদের ‘সাদা অস্ট্রেলিয়া’ নীতি নিয়ে বিস্তর লেখাপত্র আছে, (যেমন, সিডনি য়্যুনিভার্সিটি প্রেস থেকে ২০০৯ সালে ছাপা, জেন ক্যারে ও ক্লেয়ার ম্যাকলিস্কি সম্পাদিত সংকলন গ্রন্থ, ক্রিয়েটিং হোয়াইট অস্ট্রেলিয়া, কামা ম্যাকলিন লিখিত ও নিউ সাউথ পাবলিশিং থেকে ২০২০ সালে প্রকাশিত ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, হোয়াইট অস্ট্রেলিয়া, বা কিছু আগের, টেইলর অ্যান্ড ফ্রান্সিস থেকে ১৯৬৭ সালে ছাপা মাইরা উইলার্ড-এর লেখা, হিস্ট্রি অব দি হোয়াইট অস্ট্রেলিয়ান পলিসি আগ্রহী পাঠক খুঁজে নেবেন।
(ক্রমশ)