রান্নাঘরের গল্প। পর্ব ৩। লিখছেন মহুয়া বৈদ্য

0

(গত পর্বের পর)

কাজীসাহেবদের বাড়িতে একটাই মাত্র ঘর ছিল আমাদের, কোনো রান্নাঘর ছিল না। আমাদের তক্তোপোষের পাশে একফালি জায়গায় মা রান্না করতেন। কিভাবে যে পারতেন এখন ভাবলে শিউরে উঠি। এই জ্বলন্ত উনুন, তার এপাশে খাটের উপর আমরা দুইবোন…বোন তখন কত ছোট দুই বছর বয়স, ছটফটে, আর ওপাশে আলনায় জামাকাপড়। আলনার পাশে আড়াআড়ি মায়ের সেই রান্নাঘরের আলমারি। এদিকে খাটের নীচে আমাদের চারখানা ট্রাঙ্ক। জতুগৃহের মধ্যে সংসার। এসব কিছুর মাঝেও মা যখন স্নান করে এসে পিঠে ভিজে চুল ছড়িয়ে রান্নায় বসতেন, তাঁকে অন্নপূর্ণার মতো লাগতো। কী পরম মমতায় ও দক্ষতায় তিনি ওইটুকু জায়গায় অমৃত রাঁধতেন! সে এক দেখার মতো বিষয় ছিল।

এইসব সময়ও একসময় পেরিয়ে গেল। বারুইপুরে আমাদের একটুকরো নিজেদের বাসা হল। নিজেদের বাড়িতে যখন আসি, তখনো আমাদের একটি ঘর আর একটুকরো বারান্দা সম্বল, তবে একটা বড়সড় দর্মার দেওয়াল আর টালির চালের রান্নাঘর হল আমাদের। তার মধ্যে মায়ের রান্নাঘরের আলমারি রাখার পর ও দেদার জায়গা। তোলা উনুন কাঠের উনুন জনতা স্টোভ, সবই ছিল সেখানে। তানজিলা রোজ যত্ন করে গোবর-লেপা দিয়ে দিয়ে মাটির মেঝে নিটোল ঝকঝকে হয়ে ফেলেছিল। তানজিলা এই নতুন বাড়িতে মায়ের সহায়িকা হিসেবে এসেছিল। আমার চেয়ে বয়সে অনেকটা বড় হলেও তার সাথে আমার ছিল প্রখর বন্ধুত্ব। যাইহোক, কালে কালে এই রান্নাঘরেই মায়ের গ্যাস এল। এই রান্নাঘরের সময়ই আমার দিদা এ বাড়িতে এসে আনন্দ করে থেকে গেছেন অনেকবার। দিদা এলে কাঠের জ্বালে রান্না হত। তখন মেটে হাঁড়িতে ভাত বসত, গরুর দুধের সর জমিয়ে তৈরি হত ঘি, শাকভাজা রান্না হত পোস্ত ছড়িয়ে… আর দিদার হাতে রাঁধা নিম-বেগুন ভাজাও আমাদের মিষ্টি লাগতো। বাড়ির সবার খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে তিনি কাঁসার থালে ভাতটুকু বেড়ে নিয়ে আসন পেতে খেতে বসতেন। এইসময় কোথা থেকে কী জানি খবর পেয়ে যেত সেই কালো টিপ ওয়ালা চামর লেজের সাদা বেড়াল। সে এসে চুপ করে বসত দিদার কাছে। দেখতাম দিদা মাছের বাটি থেকে আদ্দেকের বেশি মাছ ভেঙে তাকে দিয়ে তবে ভাতের চূড়োটি ভেঙে তাতে ডাল ঢাললেন। বিস্ময়ে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, “ তুমি খাবে না!” বলেছিলেন, “ এ পৃথিবীতে অনেক তো খাওয়া হল… কিছু কম পড়ে নি আমার…”

তারপর আমাদের এই দর্মার রান্নাঘর ভেঙে পাকা রান্নাঘর হল। মায়ের রান্নাঘরে গ্যাসের টেবিল হল, মা এখন আর বসে রান্না করেন না। মনের সুখে নিজের সুবিধামতো বিভিন্ন তাক বানিয়েছেন, মশলাপাতির কৌটো আর এখন হারিয়ে যায় না, সব চোখের সামনে। রান্নাঘরটি নিজের মনের মতো করে বানিয়ে মা খুব পরিপূর্ণ বোধ করতেন। যে সময়ের কথা বলছি তখন গ্যাস বাঙালীর হেঁসেলে এলেও তারা বসে রান্না করে। সেইসময় আমার মা গ্যাসের টেবিল এবং রান্নাঘরের চারিদিকে সুবিধা মতো তাক এবং রান্নাঘরের লাগোয়া কলঘর করে সবাইকে বেশ তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন।

 

সবকিছু মনের মত হলেও আমাদের এই অঞ্চলে জলে খুব বেশী আয়রণ। দুইপাইপের একটি নলকূপের জলে ধোওয়া-মাজা স্নান ইত্যাদি চললেও সেই জল, খাওয়ার অযোগ্য ছিল।  নিম্ন মধ্যবিত্ত পাড়ায় আশেপাশের সবারই এক অবস্থা। আমরা তখন বালতি কলসী নিয়ে জল আনতে যেতাম হাজার ফুটের কলে। এর দায়িত্বে থাকতাম আমি আর তানজিলা মূলত। বোনও যেত একটা ছোট ঢাকনা দেওয়া জ্যারিকেন নিয়ে।  আমরা তিনজন মিলে জল আনতে যেতাম, সকাল বেলা। তানজিলা কলসী কাঁখে নিতে পারত, আমার হাতে বড় একটা ঢাকনা দেওয়া অ্যালুমিনিয়ামের জলের বালতি, আর ছোটির হাতে জ্যারিকেন। ছোটি আমার বোনের ডাকনাম। সকাল হলেই মুখটুখ ধুয়ে আমি ছোটি আর তানজিলা চললাম, হাজার ফুটের জল আনতে। আমাদের বাড়ির সামনে  ধানের বাদা পেরিয়ে শাসন রোড স্টেশনের কোয়ার্টারের গা ঘেঁষা একটা কল থেকে আমরা জল নিতাম। বাদা দিয়ে হেঁটে  যাওয়াটাই একটা অসামান্য উপভোগের ব্যাপার ছিল। বাদায় যখন ধান থাকত, তখন আল ধরে ধরে ব্যালেন্স করে জলের বালতি নিয়ে চলা  খেলার মতোই ছিল। ধানের মঞ্জরী ফোটার দিন কয়েক বাদে তাতে জমত ধানের দুধ। সেই দুধেল মঞ্জরী ছিঁড়তে গিয়ে ধানের ধারালো পাতায় হাত চিরে গেছে কতবার! এসব তখন গ্রাহ্যের মধ্যেই পড়ত না। মিষ্টি ধানের দুধ সেসব ব্যথায় ছিল চন্দনের প্রলেপ। আর ধানকাটা ন্যাড়া বাদাতে  ইচ্ছেমতো এলোমেলো চলাচল । তবে, ধানের নাড়ায় পায়ে ব্যথা পেতাম মাঝে মাঝে। ধান ওঠার পর ফেলে রাখা জমিতে কচি কচি শাক জন্মাতো। কলমী, শুশনি, হিঞ্চে, সাঞ্চা এইসব শাক কোঁচড় ভরে তুলে আনতাম । একবার শাক তুলতে গিয়ে বুনো মৌমাছি কামড়ালো হাতে, সাতদিন হাতের পাতা ফুলে ঢোল। পাপিয়াদিদি ধনুদিদি দেখে বলেছিল, বড়মানু মোটা হলে পদ্মের মতো হাতের পাতা হবে। তা অবশ্য হয় নি, যদিও আমি খুবই মোটাসোটা মানুষ।

 

জল নেওয়ার কলে বেশ লাইন পড়ত। স্টেশনের কল খারাপ হলে তো কথাই নেই, লম্বা লাইন। ইঁট দিয়ে লাইন রেখে ঘরের দুটো কাজ সেরে এল বাড়ির বউঝিরা, এমনও হয়েছে।  জল ভরার শব্দ আর গল্প গুলি এখনো কানে লেগে আছে। বেশিরভাগই  বউ মেয়েরা আসতো কলসী কাঁখে নিয়ে, যাকে অনেকে বলত ডাবর। কারো ডাবরের তলার অংশ প্রায় গোলাকার, কালো রঙের মিনে করা, কারো ডাবর নৈনিতাল আলুর মতো, কোনোটা বড়, কোনটা ছোট। কারোর সাথে থাকত এইসা বড় কলসী, ওরা তাকে বলত ঘড়া। কারো ঘড়া সোনার মতো ঝকঝকে, তাই দেখে ওপাশের লাল ঘোমটা দেওয়া নতুন বউ ঘড়া মেজে ঝকঝকে করার গোপন পদ্ধতিটি জেনে নিত। কানখাড়া করে আমিও শুনে নিতাম, শুকনো ছাই দিয়ে ঘষে ঘষে ঘড়া মাজলে অমন সোনার বরণ চেহারা নেবে। কারো ঘড়া অত ঝকঝকে নয়, তা নিয়েও বেশ করে ঠেস দেওয়া হত ঘড়ার মালকিনকে।  “গতরখাকি ” শব্দটি আমি এইসূত্রে শিখে গেলাম। ফাঁকা কলসী নিয়ে কেউ জল আনতে আসত না, সবার ঘড়ায় সামান্য হলেও জল থাকত। সেই জল ফেলে কষকষে করে ধুয়ে, কলসী বসত কলের মুখে। ঘড়া যাতে ঠিকঠাক বসে সেজন্য কয়েকটা পাথরের টুকরো, খোলামকুচি এইসব থাকত কলতলায়। হাজার ফুটের নলকূপ টিপে জল নেওয়া তখন অত সহজ ছিল না, যথেষ্ট বলপ্রয়োগ করতে হত, কলের মুখে জল আনার জন্য। বেশ ডাঁটো মহিলারা একদমে তিন চারটি কলসী ভরে দিতে পারতেন, তারপর হাত বদল হত। ফাঁকা কলসীতে যখন জল পড়ত, তার কী গম্ভীর গমগমে আওয়াজ। এই আওয়াজ আবার বড় বা ছোট কলসী ভেদে পালটে যেত। যত বড় কলসী, ফাঁকা অবস্থায় তার তত খাদের দিকে সুর। গম্ভীর গমগমে। কলসী ভরে এলে শব্দ খাদের স্বর থেকে মধ্যস্বরে চলে আসত। কলসীতে জল ভরার শব্দ শুনে চোখ বুজিয়েই বলে দেওয়া যেত, জল ভরে এসেছে। জল ভরা হলে কলসীর মুখে একখানি মাপসই ঢাকনা বসিয়ে সবাই কাঁখে তুলে নিত। এই কলতলায় একটি ছোট্ট ফর্সা মেয়ে একখানি ছোট্ট কলসী কাঁখে বাড়ির কাজের মেয়ের সাথে জল নিতে আসত। অমন সুন্দর দুগ্গা ঠাকুরের মতো মুখ আমি আর দেখি নি। আর তেমন সুন্দর ছিল তার ছোট্ট কলসখানি! আহা! ছবির মতো মনে রয়ে গেছে তাকে।

 

এই কলও মাঝে সাঝে খারাপ হত, তখন আমাদের কষ্টের অন্ত থাকত না। স্টেশনের কলে  বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তবে জল পেতাম। তবে যেদিন স্টেশনের কলে যেতাম, ট্রেনের লাইন ধরে ফেরা আমাদের দারুণ আনন্দের বিষয় ছিল। চকচকে সাদা লাইনগুলি রোদের আলোয় ঝলকাতো, আর আমরা ব্যালেন্স করে জলের কলসী বালতি সহ তার উপর দিয়ে হেঁটে ফিরতাম। একদিনও জল পড়ে যায় নি! কী করে পারতাম কে জানে তখন! আর একটা দারুণ ব্যাপার করতাম, অদ্ভুত আকারের পাথর দেখলেই নিয়ে চলে আসতাম। কোনটা ইঁদুরের মতো দেখাচ্ছে, কোনোটা কচ্ছপের মতো।একবার চ্যাপ্টা একটা পাথর পেলাম, প্রায় প্লেটের মতো। বাড়ি এসে সেটায় চন্দন বাটা যাচ্ছে দেখে কী আনন্দ হয়েছিল। এসব কাজকর্ম করে জল নিয়ে বাড়ি ফিরতে মাঝেমাঝেই দেরী হত, আর ফিরেই মায়ের বকুনি খেতে খেতে সুড়সুড় করে বই নিয়ে পড়তে বসে যেতাম।

এর বেশ কিছু বছর পরে, তখন আমি কলেজে ভর্তি হয়েছি, এমন সময়,  রানিং ওয়াটারের চল হল। আমাদের বাড়িতেও পাম্প বসল। পাম্পের প্রায় সাথে সাথেই  অ্যাকোয়াগার্ড বসে গেল। আর, আমাদের হাজারফুটের জল খাওয়ার ইতি ঘটল।

এখন মায়ের রান্নাঘরে হাতের কাছে রান্না এবং খাওয়ার জল। তবে এইটুকুই। মা এইখানেই রান্নাঘরের আধুনিকীকরণে ইতি টানলেন। পরবর্তীতে যখন বাহারি টালি এল বা চিমনি, মায়ের আর আগ্রহ দেখি নি সেসব ক্ষেত্রে। আসলে একটানা একই কাজ করতে করতে মানুষ ক্লান্ত হয়, সেই ক্লান্তি হয়ত তাকে নিস্পৃহ করে দিয়েছিল।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *