সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ১২। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ
মিন্টো বলছেন, অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের জন্য কি করা যায়, তা নিয়ে গ্রাহাম যারপরনাই ভাবিত ছিলেন। অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের বিষয়ে তিনি আগ্রহী হয়ে উঠলেন কী করে?
ডুয়ার্স, তরাই ও দার্জিলিং-এর চা বাগিচা এলাকায় নিয়মিত যাতায়াতের সুবাদে, গ্রাহাম বিপুল পরিমাণ অ্যাংলো ইন্ডিয়ান শিশুদের সংস্পর্শে আসেন। সে সময়ে…(চা) কোম্পানিরা ব্রিটেনের তরুণদের বাগিচা ম্যানেজার করে পাঠাতো। বাগিচা শিল্পের প্রথম দিকে তাদের বসবাসের সুব্যবস্থা ছিলো না, আশেপাশে পড়োশি বলতে কেউ নেই, যাতায়াতের রাস্তাও নেই। বর্ষাকালে নিজেদের এস্টেটে বন্দী হয়ে থাকতে হতো, কাছাকাছি নদী বা রেল স্টেশন অবধি চা নিয়ে যেতে হতো হাতিতে করে। এই নিঃসঙ্গতা দূর করতে তরুণ ম্যানেজারকূল…নাগপুর, সন্তালিস্থান, পরের দিকে নেপাল থেকে আসা মহিলা শ্রমিকদের সঙ্গে থাকা শুরু করে…কখনো কখনো এমন হতো, যে এই মহিলারা রাতে স্রেফ শয্যাসঙ্গী দিনে দাসী, প্ল্যান্টার অন্য জেলায় বদলি হলে বা দেশে ফিরে গেলে, পরিত্যক্ত বিস্মৃত অবস্থায় তাদের পিছনে পড়ে থাকতে হতো…
বাচ্চাকাচ্চা হলে কিছু একটা ‘উপায়’ করা হতো…কোথাও কোথাও বিয়েও হতো, কোথাও বা সহবাস চলতো, যতদিন অবধি প্ল্যান্টার দেশে না ফিরছে, এই ব্যবস্থা বাহাল থাকতো। কিন্তু…ভারতীয় কোন মেয়েকে–সুন্দরী অথচ প্রায়শই নিরক্ষর– বাচ্চাকাচ্চা সহ ব্রিটেনে নিয়ে যাওয়া নৈব নৈব চ। তার চাইতে মেয়েটাকে কিছু টাকা পয়সা বা জমিজায়গা দিয়ে কোথাও বসিয়ে দিলে সমস্ত ‘ঘিনঘিনে’ ব্যাপারটাকে ভুলে যাওয়া যায়, বিবেকও ঠান্ডা হয়।
….প্ল্যান্টারদের বাংলোয় যাতায়াতের সময়ে গ্রাহাম অবাক হয়ে দেখতেন, হাল্কা রঙের বাচ্চাদের পাদ্রী সায়েবের যাত্রাপথ থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিছু কিছু প্ল্যান্টার রীতিমতো অস্বস্তিতে পড়ছেন। মেয়েটিকে রান্নাঘরে নির্বাসন দেওয়া হচ্ছে, গ্রাহাম যতক্ষণ থাকেন সে আর বেরোয় না। বাকি অনেকেরই অবশ্য এত লাজলজ্জা ছিলো না, তারা ‘ব্যবস্থা’কে(সেকালের নিয়ম ছিলো, অন্তত বারো বছর বাগিচায় না কাটালে, দেশ থেকে ব্রিটিশ বৌ নিয়ে আসা যেতো না) দায়ী করতো। কিছু প্ল্যান্টার আবার নিজের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে চাইতো, অথচ ওদিকে ভালো কোন ইস্কুলে টাকাপয়সা দিয়ে পড়াতে চাইলে বেনামে, গোপনে সবটা করতে হয়…ফলে বাচ্চারা বাগিচার মধ্যেই ছাড়া বাছুরের মতো ঘুরে বেড়াতো….
মিন্টো বলছেন, এই শিশুদের দুরবস্থা গ্রাহামের মনকে স্পর্শ করেছিলো, তিনি এদের জন্য কিছু করতে চাইছিলেন। অবশ্য আর একটা কারণও ছিলো। গ্রাহাম মনে করতেন, বাগিচায় হোক বা কলকাতা কি অন্য শহরের রেল কলোনিতে এবং বস্তিতে যে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা চরম দারিদ্র্য ও দুর্দশায় দিনাতিপাত করছে, তারা গোটা ব্রিটেনের ও খ্রীষ্টধর্মের লজ্জা, এদের যদি উপযুক্ত শিক্ষা না দেওয়া যায়, ব্রিটিশদের মতো আদবকায়দা ব্যবহার কিছুই এরা শিখে উঠবে না। মিন্টো বলছেন, গ্রাহাম বাগিচামালিক বা প্ল্যান্টারদের দোষ দেখতেন না, প্রথমবারের মতো কালিম্পং থেকে স্কটল্যান্ড ফিরে তিনি প্ল্যান্টারদের জন্য আলাদা ধর্মযাজক মোতায়েন করার কথা বলছেন, সাম্রাজ্যের প্রান্তে ‘হিদেনদুনিয়ার’ যে ‘অপবাষ্প’ তাদের দিনরাত ঘিরে রাখে, সে বিষয়ে বিস্তারিত বলছেন। অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের সবাই যে গ্রাহামের প্ল্যান্টারপ্রেম ভালো ভাবে নেয়নি, সে বিষয়ে মিন্টো দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। ছুটিতে যাবার আগে একবার নাকি গ্রাহাম তাঁর ভারপ্রাপ্ত ডেপুটিকে বলেছিলেন, দ্যাখো হে, প্ল্যান্টারদের চটিও না। অনেক অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের মত ছিলো, গ্রাহাম প্ল্যান্টারদের নিন্দেমন্দ করতেন না তার কারণ, এক তো প্রায় সবাই তাঁর দেশোয়ালি ভাই, দ্বিতীয়ত, তাদের ও বড় বড় চা এজেন্সির নিয়মিত অর্থসাহায্য ছাড়া হোম লাটে উঠতো নির্ঘাত।
গ্রাহাম সাহেবের ইস্কুলে অবশ্য শুধু বাগিচামালিকরা অর্থসাহায্য করেছেন, এমন নয়। সায়েবসরকার থেকে সাহায্য এসেছে প্রচুর, এসেছে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও। মিন্টোর বইটাতে এ বিষয়েও বিশদে বলা আছে বটে, তবে আরো বিস্তারিত তথ্য পাওয়া গেলো অন্য এক সূত্র থেকে। হাইডেলবর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে বৌদ্ধবিদ্যা পড়ান গবেষক ও তিব্বত বিশেষজ্ঞ মার্কুস ভিব্যেক(কিম্বা ফিব্যেক, জর্মন নাম বাংলায় লেখা খুব মুশকিল), তিনি এবং তাঁর সহকর্মীরা ‘হাইডেলবর্গ কালিম্পং প্রকল্প’ নামে একটা কাজ হাতে নিয়েছেন কিছু বছর হলো। এই উদ্যোগের পক্ষ থেকে ভিব্যেকের সম্পাদনায় একটি সংকলনগ্রন্থ বেরিয়েছে, যার নাম ‘ ‘ট্রান্সকালচারাল এনকাউন্টার্স ইন দি হিমালয়ান বর্ডারল্যান্ডস, কালিম্পং অ্যাজ আ কনট্যাক্ট জোন’, অর্থাৎ কিনা ‘হিমালয়ের সীমান্তপ্রদেশে আর্ন্তসাংস্কৃতিক যোগাযোগ, সংযোগ ক্ষেত্র হিসেবে কালিম্পং’। এই বিষয়ে বছর কয়েক আগে একটা আর্ন্তজাতিক আলোচনাসভা হয়, কালিম্পং-এই। যে বইটার কথা বলছি, তা ওই সভায় পঠিত বিভিন্ন গবেষণাপত্রের সংকলন। আমাদের আখ্যানে এই বই -এর উল্লেখ ঘুরেফিরে আসবে। যেমন, গ্রন্থিত গবেষণাপত্রমধ্যে অন্যতম, মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক অ্যান্ড্রু জে মে-র লেখা গ্রাহামস হোমের আদিপর্বের বিবরণ। স্কটদেশের জাতীয় মহাফেজখানায় রক্ষিত বিভিন্ন দলিল ও হোমের পুরোনো পত্রিকা ইত্যাদি ঘেঁটে প্রচুর নতুন তথ্য হাজির করেছেন অ্যান্ড্রু।
দেখা যাচ্ছে, ১৯০০ সাল নাগাদ হোম যখন প্রথম চালু হচ্ছে, হোম পরিচালনার জন্য প্রথম যে সভাপতিমণ্ডলী বা বোর্ড গঠিত হয়, তাতে সরকারি রাজপুরুষ, মিশনকর্তা এবং নানান নামী ব্যবসায়ীরা ছিলেন:
সর জন উডবর্ন, বাংলার ছোটলাট, স্বয়ং হনররি প্রেসিডেন্ট, বাংলা সরকারের মুখ্য সচিব জে এ বর্দিলো স্থায়ী সভাপতি। সহ-সভাপতি, সর চার্লস এ এলিয়ট(বাংলার পূর্বতন ছোটোলাট), এডিনবরার প্রধান ধর্মযাজক অধ্যাপক চর্টেরিস(যার নামে চর্টেরিস হাসপাতাল), সর উইলিয়ম মুর(উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পূর্বতন ছোটোলাট), সর অ্যালান আর্থার(কলকাতার ব্যবসায়ী, বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্স-এর প্রাক্তন সভাপতি), জেমস বাকিংহাম(আমগুড়ি চা বাগিচার ম্যানেজার, ভারতীয় আইনসভার একদা সদস্য) এবং কলকাতা হাইকোর্টের উকিল এল পি পাগ। অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন ডুয়ার্স ও দার্জিলিং-এর বিভিন্ন প্ল্যান্টার, কালিম্পং-এর ব্যবসায়ীরা, তৎসহ দার্জিলিং, ডুয়ার্স ও কার্সিয়াং-এর একঝাঁক ধর্মযাজক।
(ক্রমশ)