উড়নচণ্ডীর পাঁচালি। পর্ব ৭। লিখছেন সমরেন্দ্র মণ্ডল
ছবি ঘরে দিনরাত্তি
উড়নচন্ডীর পা চলে মন চলে না। আবার মন চলে, পা বাঁধা থাকে আগের ঘাটে। আবার পা আর মন যখন একই সঙ্গে চলে, তখন নতুন কিছু সামনে এসে যায়। এই যে চলা – তা কখনও খিদের তাগিদে, মানে পেটের খিদে, কখনও আবার ব্যোম ভোলা হয়ে। তখন মনে হয় এ পৃথিবী আমার নয়, আমিও পৃথিবীর নই। আমি এক অনন্ত শূন্যে অবস্থান করছি। আমি শূন্য থেকে ছুঁড়ে দিতে পারি এক, ছুঁড়ে দিতে পারি দুই অথবা তিন। বর্হিজগত আর অর্ন্তজগতে যুগপৎ প্রলয় ঘটে যেতে পারে। যখন এমনই মানসিক স্থিতি, তখনই কলকাতার এক বড় কাগজের প্রতিষ্ঠানে কাজ জুটে গেল। এদের ছিল খান কয়েক পত্রিকা। সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, বার্ষিক। শুধু পত্রিকা প্রকাশ করেই বাংলা বাজারে যে বড় প্রতিষ্ঠান হওয়া যায়, তা তারাই দেখিয়েছিলেন।
তা সেই কাগজের অফিসেই পরিচয় হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। নিতাই ঘোষ। চিত্রশিল্পী। তখন তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের শিল্প নির্দেশক। কাগজের অলঙ্করণ নিয়ে ভাবনার অবকাশে ছবিও আঁকতেন। ভালোবাসতেন জল আর তেল রঙ। ওর ঘরে একটা তেলরঙে আঁকা বড় ক্যানভাস ছিল। একদিন ওঁর জন্য বরাদ্দ খাঁচায় বসে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল – চন্দ্রাহত। আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিতাইদা আবার ছবি আঁকায় মন দিলেন। জিজ্ঞাস্য ছিল, কী আঁকছেন।
উত্তর, শাড়ির ডিজাইন।
নিতাই ঘোষ সাতের দশক থেকেই পরিচিত নাম। বই বা পত্রিকার প্রচ্ছদ কিংবা গল্প-উপন্যাসের ছবি, যাকে বলে ইলানট্রেশন, সে সব আঁকায় বেশ নাম করেছিলেন। আমাদের প্রাক-যৌবনেই ‘অমৃত’ সাপ্তাহিক, আলোক সরণী, দু-একটা সিনেমার পত্রিকায় ওঁর ইলাসট্রেশন দেখে উনি আমার বেশ পরিচিত হয়ে গেছেন। তখন আমাদের বন্ধুদের মধ্যে একটা খেলা ছিল – ছবি দেখে বলতে হবে কার আঁকা। কারণ প্রত্যেক ইলাসট্রেটরের নিজস্ব প্যাটার্ন ছিল। দেশ, আনন্দবাজার, যুগান্তর, অমৃত এই সব পত্রিকায় পাওয়া যেতো বিখ্যাত ইলাসট্রেটরদের ছবি। এঁদের কারো কারো সঙ্গে পরে পরিচিত হয়েছি। ভালবাসা পেয়েছি। এই পর্বে তাঁদের কথা বলব, যতটুকু স্মরণে আছে। নিতাইদার কথাই যখন আগে এলো, তাঁর সম্পর্কেই দু-চার টুকরো বরং বলে নেওয়া যাক।
নিতাই ঘোষের একটা নিজস্ব প্যাটার্ন ছিল। রেখাচিত্রের মাঝে তিনি মাঝে মাঝে মোটা করে কালি লেপে দিতেন। তাঁর ছবির নারীর চোখ-মুখে থাকতো পুতুলঘরানা। কাগজের অফিসে দেখেছি অন্যান্য শিল্পী, বিশেষ করে তরুণদের দিয়ে ছবি আঁকানোর পর, দু-চারটে ছবি নিজে আঁকতেন। কিন্তু সাধারণত প্রচ্ছদ করতেন তিনি নিজে।
তখন শারদীয় সংখ্যার কাজ চলত অনেক রাত পর্যন্ত। আমরা, যারা শারদীয় সংখ্যার দায়িত্বে থাকতাম, অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করতাম। তখন পিটিএসের যুগ। আটপুলে লেখা ছেপে আসত। সেগুলো কেটে আঠা দিয়ে মোটা বোর্ডে সাঁটতে হত। সে এক মহাযজ্ঞ বটে। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না থাকলে বোঝানো সম্ভব নয়। নিতাইদা নিজের খাঁচায় বসে ছবি আঁকতেন। কখনো ইলাসট্রেশন, কখনো প্রচ্ছদ, আবার কখনো অন্য কোনও ছবি। সেই সময় তিনি লাল আরকে গলা ভেজাতেন আর উদাত্ত স্বরে রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেন। কখনো সখনো আমাদের দু-এক জনকে ডেকে নিতেন। গেলাশে গেলাশ মিলিয়ে চলত খোশ গল্প, কবিতা পাঠ আর গান। বলতেন নিজের ছবি আঁকার জীবনের টুকরো কথা, যার অধিকাংশই উড়ে গেছে কালের বাতাসে। দীর্ঘকায়, ফর্সা, সুদর্শন, উন্নতনাসা, ঘন চুলে চলচ্চিত্রের অভিনেতা হওয়ার সমস্ত রকম বৈশিষ্ট্য তাঁর ছিল। অভিনয় করেন নি এমন নয়। রবীন্দ্রনাথের ‘তাসের দেশ’ চলচ্চিত্রায়িত করেছিলেন এক নৃত্যশিল্পী। কী নাম ছিল তাঁর? অসিত মুখোপাধ্যায় কি? নিতাই ঘোষ সেই চলচ্চিত্রের দৃশ্যনির্মাণের সঙ্গে অভিনয়ও করেন।
নাটকের মঞ্চ করতেন। সেই মঞ্চ দৃশ্য তিনি এঁকে রাখতেন কাগজে। সব সময় নিজের জগতে থাকতেন তিনি। হঠাৎ স্থির করলেন একদা শক্তি চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘কবিতা সাপ্তাহিক’ আবার বের করবেন। পত্রিকাটি জনমানসে হারিয়ে গিয়েছিল। বেশ কয়েকটা সংখ্যা বের করেছিলেন। আমাদের কবিতা ছাপলেন। কবিতার প্রতি আনত ছিলেন তিনি। শক্তি চাটুজ্জে, অমিতাভ দাশগুপ্তদের সঙ্গে সখ্যতা তাঁকে কবিতার চারণভূমিতে সবুজ জাজিমে গড়াগড়ি দিতে প্ররোচিত করেছিল বোধ হয়। নিজে ছড়া লিখতেন। ছড়ার ছবি আঁকতেন প্রচলিত কার্টুনের কাঠামো ভেঙে। এঁকেছেন বিজ্ঞাপনের ছবি। সাতের দশকের শেষ দিকে ‘ড্রিঙ্কো’ নামে একটি নরম পানীয় বাজারে এসেছিল। সেই পানীয়ের বিজ্ঞাপন তিনি এঁকেছিলেন। একসময় বাটার বিজ্ঞাপনও এঁকেছেন। তখন বাটার শিল্প নির্দেশক পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়। মুম্বাইয়ের কাগজের অফিসের কাজ ছেড়ে যোগ দেন বাটা কোম্পানির বিজ্ঞাপন বিভাগে। তখন বাটার একটা নিজস্ব বিজ্ঞাপন বিভাগ ছিল। এখনও আছে কিনা জানি না। পৃথ্বীশদা বাটায় যোগ দেওয়ার পর বিজ্ঞাপনের ভোল পাল্টে দেন। তিনি কবিতার অংশ বিজ্ঞাপনের ব্যবহার করতেন। নিজে ছবি আঁকার সঙ্গে তরুণদের দিয়েও আঁকতেন। নিতাইদা একদিন বললেন, তখন ফ্রিল্যান্স কাজ করি। অমৃততে নিয়মিত ছবি করছি। এক সকালে পৃথ্বীশদা এলো আমার বাড়িতে। বলল, চল, বাটার কিছু কাজ করে দিবি।
পৃথ্বীশদার অনুরোধ নয়, বলা যেতে পারে আদেশেই নিতাইদা বাটার বিজ্ঞাপনে কিছু কাজ করেছিলেন। অন্য কোম্পানির বিজ্ঞাপনেও কাজ করেন। ইত্যাদি প্রকাশনীতে শিল্প নির্দেশনার কাজে যোগ দেওয়ার পর পরিবর্তন, খেলার আসর, নবম-দশম, শিলাদিত্য, দ্য সকার, কিশোর মন এইসব পত্রিকার কাজ করতে করতেই বয়সটাকে অনেকটা এগিয়ে দিলেন। এই কাগজের কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আবার তিনি ছবি আঁকায় ফিরে এলেন। সঙ্গে চলছিল কলেজ স্ট্রিটে প্রকাশনা সংস্থার কাজ। তরুণ শিল্পীদের নিয়ে গড়ে ছিলেন একটি দল। বছরে একবার করে প্রদর্শনী করতেন ছবির। প্রদর্শনীর কদিন আবার জমজমাট আড্ডা চলত। নিতাইদার ছবি দেখতে অন্যান্য শিল্পীদেরও আসতে দেখেছি। কিন্তু আসতে দেখিনি ধ্রুব রায় কিংবা সন্তোষ গুপ্তকে। তাঁরা তখন নেই হয়ে গেছেন।
গত শতাব্দীর পঞ্চাশ-ষাটের দশকে ছিল পত্র-পত্রিকার প্রবল প্রবাহ। কত রকমের পত্রিকা। কত বিষয়। লেখকদের আত্মবিকাশের কত জায়গা। এখনকার মতো মাঠটা ছোট হয়ে যায়নি। অনেক পত্রিকাই লেখকদের সম্মান মূল্য দিত। সেকালের পত্রিকায় কাজ করে বা লিখে অনেকেই উপার্জন করতেন। সেসব ছিল অহংকারের বিষয়। তবে দুটো বাড়ি দখলে রেখেছিল সাহিত্যের বাজার। আনন্দবাজার আর যুগান্তর। ছিল সমান্তরাল লড়াই। দুই বাড়ির দুটো সাহিত্য পত্রিকা দেশ আর অমৃত। লেখকদের মধ্যে অদৃশ্য আড়াআড়ি ভাগ ছিল। দুই পত্রিকাতেই ছাপা হয়েছে কত কালজয়ী রচনা। দুই বাড়িই আগলে রাখতো তাদের লেখকদের। অনেক পরে ‘আজকাল’ ও চেষ্টা করেছিল নিজস্ব লেখকগোষ্ঠী তৈরি করার। কিন্তু সফল হয়নি। লেখকদের মতো ছবি আঁকিয়েরাও ভাগ হয়ে গিয়েছিলেন। বিশেষ করে ইলাসট্রেটররা। দেশ পত্রিকার দখলে যেমন সুধীর মৈত্র, সমীর সরকার, মদন সরকার, অহিভূষণ মালিক প্রমুখ দিকপাল ছিলেন, তেমনই ‘অমৃত’ দলে ছিলেন শৈল চক্রবর্তী, সূর্য চ্যাটার্জি, নিতাই ঘোষ, সুবোধ দাশগুপ্ত, ধ্রুব রায়, সন্তোষ গুপ্ত এমন অনেকেই।
আট নয়ের দশক পর্যন্ত এই সব শিল্পীদের কাজ পাঠকদের মুগ্ধ করেছে। আটের দশকেই ‘অমৃত’ পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেল। অনেক শিল্পীর কাজ চলে গেল চোখের আড়ালে। ‘যুগান্তর’ পত্রিকা পড়ল সংকটে। ঠিকানা বদল করেও থিতু হতে পারল না। ‘যুগান্তর’ শারদীয়াতেও আর এই সব খ্যাতনামা শিল্পীদের অনেকেই অনুপস্থিত রয়ে গেলেন। এলেন এক ঝাঁক নবীন শিল্পী। ততদিনে বাজারে এসে গেছে ‘বর্তমান’ খবরের কাগজ। আরেকটা নতুন বাড়ি। পুরনো শিল্পীদের জায়গায় নতুন শিল্পীদের মাথা গোঁজার জায়গা হয়ে উঠল।
প্রবীণ-নবীন কাগজ-বাড়ির এই আত্মপ্রকাশ আর বিলুপ্তির খেলা যখন চলছে, সেই সময়কালে ইত্যাদি প্রকাশনী নামক এক কাগজ-বাড়ি শুধু মাত্র নানা বিষয়ক পত্রিকা প্রকাশ করে মাথা চাড়া দিয়েছে। সাতের দশকে যার শুরু, নয়ের দশকে তার শেষ। এই ক্ষণকালে পত্র-পত্রিকার জগতে ঝড় তুলে দিয়েছিল। পুরনো মানুষদের সেসব হয়তো স্মরণে আছে।
উড়নচণ্ডী এই ইত্যাদি প্রকাশনীতেই ঠাঁয় পেয়েছিল। নিতাই ঘোষের মতো শিল্পীর সান্নিধ্যে থাকতে থাকতেই এবং কাগজ-বাড়ির সৌজন্যে পরিচয় ধ্রুব রায়ের সঙ্গে। দীর্ঘকায়, পেটানো চেহারা। গাত্র বর্ণ কৃষ্ণ। গাম্ভীর্যের আড়ালে ছিল সরলতা। রেখাচিত্রে ছিলেন নিপুণ। তাঁর আঁকাতেও ছিল ভিন্ন শৈলী। ধ্রুবদা কলকাতা মাঠে প্রথম ডিভিশনে ক্রিকেট খেলেছেন। তাঁর হাঁটার ছন্দেও ছিল ক্রিকেটার স্মার্টনেস। মনে হতো ব্যাট হাতে ক্রিজে যাচ্ছেন। সাধারণত বিকেলের দিকে ‘ইত্যাদি’-তে আসতেন। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকুরে ছিলেন। নিতাইদার ঘরে বসতেন। এক কাপ চা নিয়ে গল্পের পাতায় চোখ বুলিয়ে নিয়ে ছবি এঁকে দিতেন।
এভাবেই পেয়েছিলাম সন্তোষ গুপ্তকে। তিনি ‘স্টেটসম্যান’ ইংরাজি দৈনিক শিল্প বিভাগে ছিলেন। সুধীর মৈত্র ছিলেন তাঁর উপরের পদে। সুধীর বাবু ছিলেন আনন্দবাজার দলে, আর সন্তোষ বাবু যুগান্তর দলে। একই সঙ্গে ছবি আঁকতেন ইত্যাদি বাড়িতেও। রোজ বিকেলে এসে একটা নির্দিষ্ট খাঁচায় বসতেন। তখন তিনি ‘খেলার আসর’ সাপ্তাহিক পত্রিকার ফুটবল সম্রাট পেলের জীবনী কমিক্স আঁকছেন। চায়ে চুমুক দিতে দিতে পত্রিকার দ্বিতীয় আর তৃতীয় মলাটের জন্য এঁকে দিতেন পেলে সিরিজ। এরই মাঝে ফাঁক-ফোকর খুঁজে, দু-একটা গল্পের ছবি। সাধারণত কোনও না কোনও শারদীয়ার জন্য। ফর্সা, সুদর্শন সন্তোষদা আটের দশকের শেষের দিকেই আকস্মিক প্রয়াত হলেন। বন্ধ হয়ে গেল পেলে সিরিজ।
এখানেই ফিরতি আলাপ হয়েছিল চণ্ডীদার সঙ্গে। চণ্ডী লাহিড়ি। চাকরি করতেন আনন্দবাজার পত্রিকায় সংবাদ বিভাগে। আঁকতেন ‘তির্যক’। বিখ্যাত সব ব্যাঙ্গচিত্র। সরকার, রাজনৈতিক দল অসামাজিক কাজের সমালোচনা, বিদ্রূপ থাকতো তাঁর কলমের আঁচড়ে। একটা হাত তাঁর ছিল না। ডান হাতকেই ব্যবহার করতেন সব্যসাচীর মতো।
চণ্ডীদার সঙ্গে প্রাথমিক আলাপ কৃষ্ণনগরে সিংহরায় বাড়িতে। নবদ্বীপ ছিল তাঁর পৈত্রিক নিবাস। নবদ্বীপে এলেই তিনি ঘুরে যেতেন সিংহরায় বাড়িতে। সমীর সিংহরায় ছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক। বলা ভাল সংবাদদাতা। তাঁর বাড়িতে বসত নবরত্ন সভা। সমীরবাবুকে আমরা বলতাম জ্যাঠামশাই। আমাদের বন্ধু সুবীরের বাবা। ওদের বাড়িতেই সুবীরের মাধ্যমে পরিচয় চণ্ডীদার সঙ্গে। সুবীরের বাবার বন্ধু কি করে সে আমার চণ্ডীদা হয়ে গেলেন কে জানে।
সমীর সিংহরায় একটি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র চালাতেন। নদীয়া মুকুর। চার পাতার ট্যাবলয়েড। তখনকার দিনে মফস্বল থেকে এরকম কাগজই বের হত। একথা আগেও বলেছি। নদীয়া মুকুর একটা শারদীয়া সংখ্যা বের করত। একটু স্থুলকায়। ওখানে কবিতাও লিখেছি সুবীরের সৌজন্যে। তা নদীয়া মুকুর একবার ‘গোপালভাঁড়’ সংখ্যা বের করল। সম্পাদনায় নেতৃত্ব দিলেন চন্ডী লাহিড়ি। প্রচ্ছদও করেছিলেন তিনি। তাঁর নিজস্ব স্টাইলে। সেই সংখ্যা এখন দুষ্প্রাপ্র্য। বেশ কিছু গবেষণামূলক লেখা ছিল সেই সংখ্যায়।
উড়নচণ্ডী যখন ইত্যাদি প্রকাশনীতে, তখন চণ্ডীদা দুপুরে বা বিকেলের দিকে আসতেন ছবি আঁকতে। প্রথম যখন পরিবর্তন বের হয়, তখন তিনি আধপাতা ব্যঙ্গ চিত্র আঁকতেন ‘লাহিড়ি’ নামে। এছাড়া টুকটাক ছবি। যখন ‘কিশোর মন’ পত্রিকা বের হল, তখন হাসির গল্পের ছবি এঁকে দিতেন চন্ডীদা। তিনি নিজেও বেশ কিছু কিশোর গল্প লিখেছিলেন ওই পত্রিকায়। ‘আজগুবি’ নামে ধারাবাহিক কমিক্সও এঁকেছিলেন বেশ কিছু দিন। যেহেতু এই উড়নচণ্ডী নদীয়ার মানুষ, বিশেষত কেষ্টনগরের, ফলে একটু বেশি স্নেহ দিতেন। তার আহ্বানে পাইকপাড়ায় আবাসনেও পা পড়েছে। তার মেয়ে তৃণাও ভাল আঁকত। সে তো অকালে চলে গেল। ইত্যাদি প্রকাশনী বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও নিয়মিত যোগাযোগ ছিল চণ্ডীদার সঙ্গে। আনন্দবাজার থেকে অবসরের পরেও যোগাযোগ হতো। দেখা হলেই বলতেন, বাড়ি এসো।
গিয়েছি। একবার একটি সংস্থা শারদীয়া সংখ্যা বের করার তাগিদ অনুভব করলেন। তৃতীয় পুরুষের যোগাযোগে এই উড়নচণ্ডীর উপর দায়িত্ব বর্তালো সম্পাদনার। ছদ্ম সম্পাদক। সম্পাদকের নাম থাকবে যার পেট গুড়গুড় করেছিল, তার। কিছু রেস্ত পকেটে ঢুকবে ভেবে ঝাঁপালাম। চণ্ডীদাকে দিয়ে পুজোর কার্টুন আঁকালাম। বিনে পয়সার ভোজ। শুধু স্নেহের বশে এঁকে দিলেন। শারদীয়া বের হল। উড়নচণ্ডী যে টিম নিয়ে কাজটা করেছিল, তাদের কারোরই পকেটে চুক্তি মাফিক পয়সা গলল না। অনেক ঝগড়ার পর কয়েকজন লেখক-শিল্পীকে সামান্য কিছু দিতে পারা গিয়েছিল। পরে সেই আহাম্মক আবার পত্রিকা বের করবে বলে চণ্ডীদার বাড়ি গিয়েছিল। চণ্ডীদা খেদানো চা খাইয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
সময়ের ব্যবধানে যোগাযোগও কমে আসছিল। ক্রমশ অপসৃয়মান। তারপর একদিন চলে গেলেন। তার প্রয়াণের পর ‘মাতৃশক্তি’ নামে একটি পত্রিকা সংখ্যা প্রকাশ করেছিল চণ্ডীদাকে নিয়ে। ছাপা হয়েছিল ‘আজগুবি’র কয়েকটি পূর্বমুদ্রিত পাতা। স্মৃতির উপর ভার চাপিয়ে দিয়ে এইসব শিল্পীদের প্রয়াণ বেদনার বাগানটাকে ছড়িয়ে দেয় ঠিকই, কিন্তু প্রাপ্তিগুলো পুরনো বাড়ির নীচ থেকে প্রাপ্ত মোহরের মতো উজ্জ্বল হয়ে থাকে। এঁদের ভুলি কী করে? ভোলা যায়!
(ক্রমশ)