অক্সিজেন। পর্ব ৩৫। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
হ্যাটস্ অফ্
রাত দশটার পর কলিংবেল বাজলে সরাসরি দরজা খোলা হয়না। এবাড়ির এটা একটা অলিখিত নিয়ম। কিন্তু ঠিক সাড়ে দশটাতেই বেজে উঠল বেলটা। একবার নয়। দুবার। পরপর।
বেলটা শুনে রঞ্জিত উঠে এলো বিছানা থেকে। “থাক্ আমি দেখছি।”
এই সময়টা মীরার নিজস্ব। ও একটু বই পড়ে।অথবা ফোন ঘাঁটে।নানান রকম করে সময় কাটিয়ে এগারোটা নাগাদ বিছানায় আসে ।ব্যালকনির দরজা খুলে বেরিয়ে দেখল রঞ্জিত।তারপর তাড়াহুড়ো করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলল, “নীপা বউদি। এত রাতে, …!কী ব্যাপার দেখছি।”
মীরাও দ্রুত নেমে এলো নীচে।নীপা ঢুকেই ধপ্ করে বসে পড়লেন সোফায়।
“সাড়ে দশটা বাজে।কুহু এখনও ফেরেনি।বাড়িতে তালা দিয়ে আমি এলাম। তোমরা তো জানো আমার বাড়িতে কী অবস্থা।”
মীরা জানতে চাইল, “কুহু কোথায় গিয়েছে?কটায় ফিরবে বলেছিল?”
নীপা জল চাইলেন একগ্লাস।একটু চুমুক দিয়েই রেখে দিলেন।“ও বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমায় গিয়েছে।সাড়ে আটটা ম্যাক্সিমাম হতে পারে,বলেছিল আমাকে।আর এখন সাড়ে দশটা বাজে।না ফোন,না কিছু।বড় ভয় করছে আমার।তাই ছুটে এলাম।”
রঞ্জিত বলে, “একদম ঠিক করেছেন।আপনি বাড়ি যান। কেকা, দাদা সবাই অসুস্থ। আমি দেখছি।”
নীপা বউদি চলে গেলেন।মীরা বলল একবার, “আমি যাব?”
উনি বললেন “না। আমি একা থাকতে পারব।”
ফোনে অনেকবার থানায় চেষ্টা করল রঞ্জিত । ফোন লাগছে না। শেষে অধৈর্য হয়ে স্কুটারের চাবি হাতে বেরিয়ে পড়ল ও। মীরা একবার বলেছিল, “থানায় এখনই যেতে হবে?”
“হ্যাঁ হবে।থানায় যেতে দেরি করা উচিত নয়। জানানো আগে দরকার। করোনায় এগারোটার পর রাস্তায় বেরোনোয় বারণ আছে ।এখনই রাস্তা শুনশান।আমি থানাতেই যাব।”
“গিয়েই ফোন করো কিন্তু।”
“করব।”
মীরা ব্যালকনিতে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল। ফোনে শেষ অবধি খবর দিল রঞ্জিত।কুহুকে নিয়েই ও ফিরবে। বউদিকে বলে দিতে বলল যে,কুহু সেফ আছে।
মীরা খবরটা দিয়ে ওখানেই বসেছিল।ও বাড়ি ঢুকতে ঢুকতেই ওরা ফিরল। কুহুর মুখে কোন কথা নেই। সাইকেলটা টানতে টানতে বাড়িতে ঢুকে গেল ও।
রঞ্জিত বলছিল, “কুহুকে হ্যাটস্ অফ্। ওই মেয়ের পাহাড়ে ওঠা কেউ আটকাতে পারবে না। ও কী করেছে শুনলে তুমি অবাক হয়ে যাবে। একটা ছেলের বাইকে ধাক্কা লাগে।সে রাস্তায় পড়েছিল অজ্ঞান হয়ে। কুহু সিনেমা দেখে ফেরার সময় দেখতে পায়। ও নিজের তিন বন্ধুকে ফোনে খবর দেয় যে ওখানেই সাইকেল রেখে ও ছেলেটাকে যেভাবে হোক হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। ওরা যেন থানায়,হাসপাতালে, চলে যায়। জিটিরোডের ওপর পুরনো তেলকলের ওই জায়গাটা খুব অন্ধকার। সেখানেই ওই ঘটনা ঘটেছে।ওর আর একটা বন্ধু সাইকেল টানতে টানতে থানায় নিয়ে গেছিল।চাবি ছিল নাতো। কুহু নিজে একটা চলন্ত ফোর হুইলার দাঁড় করিয়ে ছেলেটাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়েছে। বাড়ির লোক এসে গিয়েছে শুনলাম।”
“কী বলছ গো? অত রাতে অচেনা গাড়িতে উঠল,কুহুর বিপদ হতে পারত তো?”
“হতেই পারত।ও সাহসী মেয়ে। নিজের কথা ভাবেনি।”
“হাসপাতালে বাড়ির লোক এসে গিয়েছে? মোবাইল ফোনে হদিশ পেল বুঝি?”
“না। কুহু চেনে। ও যাকে পড়ায়, সেই পিন্টুর মাসতুতো দাদা।”
“ছেলেটা এখন কেমন আছে?”
“চব্বিশ ঘন্টা না কাটলে ডাক্তাররা কিছুই বলবেন না।”
সেদিন রাতে অনেকক্ষণ ঘুম এলোনা মীরার।কুহুর কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখ লেগে গিয়েছে, ও বুঝতে পারেনি।ঘুম ভাঙল রঞ্জিতের ডাকে।
“আটটা বাজে, উঠবে না?”
ধড়মড়িয়ে উঠে পড়ল মীরা।কাল রাতের কথা মনে পড়ছিল ওর।ছেলেটা বেঁচে আছে তো?
চায়ের পর্ব রঞ্জিত নিজেই সামলেছে।উল্টে ওর জন্য টিপটে চা রেখে বাজারে গিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ।ভেজানো ছোলা নিয়ে রাধার কাছে দাঁড়াতেই,ও কলকল করে বলতে শুরু করল, “কুহু,কুহু।”
চমকে পেছন ফিরল মীরা।ব্যালকনির ওই খাঁচা থেকে কুহুদের বাড়ির দরজা, রাস্তাটা পরিষ্কার দেখা যায় তো। রাধা ঘাড় ঘুরিয়ে কুহুকেই দেখেছে নির্ঘাৎ। ঠিক তাই,কুহু সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। ওর কাল রাতের সালোয়ার কামিজ, বাসি চুলের এলোমেলো বিনুনি, মুখের ত্রস্ত ভাব, চোখ এড়ালনা মীরার। মেয়েটাকে এজন্যই বড় ভালো লাগে তার।কাল রাতে অত করেও শান্তি নেই। সাতসকালে হয়ত চা বিস্কুট কিছু না খেয়েই চলল খবর নিতে।
ব্যালকনি থেকে মুখটা ঝুঁকিয়ে মীরা জানতে চায়, “কোথায় চললি রে মা?”
“হাসপাতালেই যাব।”
“খবর পেলি কিছু?”মীরা আবার বলে।
“তেমন নয়।এসে বলব।”প্যাডেলে চাপ দিয়ে উঠে পড়ে কুহু।মীরা ব্যালকনির দরজা বন্ধ করে।
(ক্রমশ)
প্রেম যে একটা সুস্থ বোধ, যা মানুষকে মহৎ করে সুন্দর করে তা স্পষ্ট হয়।