অক্সিজেন। পর্ব ২০। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
মানে না মানা
করোনার প্রকোপ কমতে না কমতেই বাজার দোকানে ভিড় উপচে পড়েছে। শিপ্রা বহুদিন বাদে বাজার করতে এসে একটু ঘাবড়ে যাচ্ছিল। দাম বেড়েছে খুবই। অনেকটা ইচ্ছে নিয়েই বাজারে এসেছে ও। অনেকদিন নিজে হাতে কিছু রান্না করেনি। আজ বড়ি দিয়ে মাছের ঝোল করবে।তাই বাজার থেকে টাটকা রুই মাছ নিয়ে যাবার বাসনা হয়েছে তার।
কিন্তু বাজারে তার মেজাজ বিগড়োল। নজরে এলো তাকে দেখে উৎফুল্ল হয়ে এগিয়ে আসছেন ,সজলবাবু। এসেই গড়গড়িয়ে বলতে আরম্ভ করলেন, “মাছ নেবেন তো। চলুন আমার মাছওলার কাছে নিয়ে যাব। ঠকবেন না।ভাল মাছ, ঠিকমত দামে পাবেন।”
এসব গায়েপড়া ভাব একদম পছন্দ হয়না তার। কিন্তু কিছু করার নেই।সজলবাবুর পিছুপিছু শিপ্রা চলল সেই মাছওলার কাছে। তবে গিয়ে উপকারই হল।দাম বেশি নয়,মাছও টাটকা।নানারকম মিশিয়ে দেড়কেজির মত মাছ কেনা হয়ে গেল।ফেরার পথে নজরে এলো সজলবাবু সবজি কিনছেন।নুয়ে পড়া মানুষটাকে পেছন থেকে দেখে একটু খারাপ লাগছিল ওর।ভদ্রলোক সারাক্ষণ ওর উপকার করার চেষ্টা করেন।ও নিতে পারেনা কেন?
আসলে খেয়াল করে দেখেছে, পুরুষমানুষ দেখলেই ওর কেমন একটা আড়ষ্ট ভাব জাগে। এমনি তেই বাড়ির লোক আর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন ছাড়া শিপ্রা তেমন করে কারো সঙ্গেই মিশতে পারেনা। স্কুলে বেশিরভাগ মেয়েরাই গান শেখে। সজলবাবুর মত দু’একজন আছে,তবে যারা গান শেখে তাদের সঙ্গে গানের ক্লাসের বাইরে বেশি সম্পর্ক তৈরি করার মত আগ্রহ ও কোনকালেই পায়না।হঠাৎ সজলবাবুর এ হেন বাড়াবাড়ি ও একেবারেই নিতে পারছে না।কতভাবেই তো সেটা বোঝাচ্ছে, বুঝলে তো!
“শিপ্রাদি,শিপ্রাদি,…”
যেতেযেতেই কানে এলো ডাকটা।কে ওকে ডাকছে?তারপরেই চোখে পড়ল দূর থেকে সাইকেল নিয়ে হেঁটে আসছে কুহু।সাইকেল হাঁটিয়ে আনছে বলে ওর আসতে দেরি হচ্ছে।দূর থেকে ওর হাসিটা নজরে এলো শিপ্রার।
কুহুদের পাড়ার দু’একটি মেয়ে তার কাছে গান শিখতে আসে।তাদের কাছে কিছু কিছু খবর সে পায়। মেয়েটা যে কী পরিস্থিতিতে আছে,তার অনেকটাই অনুমান করতে পারে।তবু ওর মুখের ওই উজ্জ্বল হাসিটা দেখে বড় ভাল লাগল শিপ্রার ।থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।কাছাকাছি আসতেই নজরে এলো ব্যাগটা জিনিসের ভারে নুয়ে পড়েছে।বাজারের ভিড়ে তাই আর সাইকেল চালিয়ে আসার ঝুঁকি নেয়নি হয়ত। মাথাটা এলোমেলো,মুখে ভর্তি ঘাম,কুহুর দিকে তাকিয়ে খুব মায়া হল তার।ইচ্ছে হল কাপড়ের আঁচলে মুখটা মুছিয়ে দেবার। সেটা তো আর বাজারে দাঁড়িয়ে সম্ভব নয়।
তাই কাছাকাছি হতে নরম গলায় বলল, “কী হল?ডাকছিলি কেন?”
“এমনি”বলে হাসে কুহু।
“শুনলাম পাহাড়ে ওঠার ট্রেনিং নিতে গেসলি?”
কুহু একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায়।“গিয়েছিলাম তো।কিন্তু পাহাড়ে যেতে পারব কী? বাবার যা অবস্থা!”
“পারবি। নিশ্চয়ই পারবি। তোকে একটা মেয়ের ঠিকানা দেব।ও অনেকগুলো পিকে উঠেছে। নাম ভাস্বতী সেন। দেখা কর। দেখবি অনেককিছুই জানতে পারবি।”
কুহু কাছে এগিয়ে আসে। “কোথায় থাকে?ঠিকানা দেবেন? ফোন নাম্বারও লাগবে তো।”
“দোব।এখানে এই বাজারে দাঁড়িয়ে দেব কীকরে? আয়।বাড়িতে আয়।তবে এখন বাড়ি যা।”
“ঠিক আছে।আমি আজ বিকেলেই যাব। আপনি থাকবেন তো?”
শিপ্রা ঘাড় নাড়ে।তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে কুহু সাইকেল টেনে এগিয়ে যাচ্ছে।পিঠের ওপর বিনুনিটা এলিয়ে আছে।বাড়ি ফেরার পথে মনে হচ্ছিল একটা চেনা ছবি যেন চোখের সামনে ভাসছে।তারপর মনে পড়ল কুহুর দিদি কেকার মাথায় ঠিক এরকম একটা লম্বা বিনুনী ছিল।যদিও সেই বিনুনীর চেহারাটা ছিল অনেক মোটা।পিঠের ওপর আলতো ভঙ্গিতে শুয়ে থাকলেও ওটা কারও নজর এড়াত না। কেকার চেহারাটা কুহুর মতই । শুধু ওর গায়ের রঙ ধবধবে ফরসা, মুখেচোখে একটা শান্ত ভাব।তবু কে জানে কেন, ওই দস্যি কুহুকেই বরাবর বেশি পছন্দ হয়েছে তার।
বাজারের ব্যাগ নিয়ে দ্রুত চলার চেষ্টা করে শিপ্রা। রোদ্দুর বাড়ছে।বাড়ি গিয়েই যতীনকে ওর ফরমাস করা জিলিপি দিতে হবে।তারপরেই রান্নাঘরে ঢুকতে হবে তাকে। জিলিপি বোধহয় ঠান্ডা হয়ে গেল।টুপুটা ইদানিং বড় মনমরা হয়ে থাকে। দেখা যাক পিতির হাতের রান্নায় ওর মন ভাল হয় কিনা।
(ক্রমশ)
বাঃ