অক্সিজেন। পর্ব ১৬। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
রোদ আর ছায়া
দুদিন ধরে খাড়া করা চিঠিটা উলটে পালটে দেখছিল বিলু।এই নিয়ে তিনবার ও চিঠি লিখল নিজের বাবাকে।বিষয় একটাই।কেন ও পারিবারিক ব্যবসায়ে মাথা গলাতে চায়না।তিন নম্বর চিঠিতে একটা নতুন কথা যোগ করেছে ও।সেটা হল ওকে ব্যবসায়ে ঢুকতে জোর করা হলে ও বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে।
নতুন কথাটা লেখার পরই ও মনেমনে থাকার জায়গার সন্ধান করছিল।কিরকম একটা উদ্বাস্তু উদ্বাস্তু লাগছিল নিজেকে।আর একটা কথাও মনে হল।বাবা ,মা ,এই বাড়ি, আত্মীয়স্বজন এর মধ্যেই ওর অস্তিত্বের সবটুকু।নিজের বলতে ও কিছুই তৈরি করে উঠতে পারেনি।চেনাজানা বাড়ি, যেখানে ও থাকতে পারে, সেটা হল ছোটের বাড়ি। তাই বাড়ি ছাড়লে ওই একটা জায়গাই আছে, যেখানে ও নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে।তাছাড়া ও যাবে কোথায়?
ছোটেও মাসি।মায়ের বোন।ঘুরেফিরে সেই একই বৃত্ত। ছোটবেলা থেকে এমন অভ্যেস হয়েছে আশেপাশে নিজের মানুষগুলো না থাকলে কেমন যেন অসহায় লাগে।তাই বারবার চিঠি লিখলেও বাবার হাতে দিতে পারেনি এখনও।বাবা কোন ভাবেই ওকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলবে না যে, এটা ও জানে।কিন্তু নিজের কথার একটা দাম নিজের কাছেই রাখতে হবে তো।এসব ভাবতে ভাবতে নতুন চিঠিটা বাবাকে না দেওয়াই স্থির করল বিলু।
টুপুর করোনা হয়েছিল।এখন একটু ভালো আছে।ওদের বাড়ির কারোর কিছু এখনও হয়নি ।তাই বাঁচোয়া।টুপু বলছিল, “আমাদের বাড়িতে একটাই বটবৃক্ষ।আমরা সব তার ছায়ায় বেঁচে বর্তে আছি।ওই পিতি না থাকলে আজ আমি যেটুকু হয়েছি, সেটুকুও হতে পারতাম না।পিতি সুস্থ না থাকলেই চলবে না।অথচ পিতি বারবার আমার কাছে চলে আসছে।ঘরে যদিও ঢুকতে দিইনা।তবু ভয় পাচ্ছি।বাড়িতে গুচ্ছের বয়স্ক লোক।আর আমি এরকম একটা রোগ বাড়িতে নিয়ে এলাম।”
কথা হচ্ছিল ফোনে।সবসময়েই টুপুর কথা শুনে একটা ব্যাপার বোঝা যায় যে ওরা বাড়ির ছত্রছায়ায় থাকলেও সেখানে ওর মত চাপ ছিল না।ছোটবেলা থেকে কেউ ‘ডাইনে মুড়, বাঁয়ে মুড়’ বলে ওদের চালায়নি।
সেদিন যেমন বাবা ওকে বলল , “বাড়িতে দু’দুটো গাড়ি, তোকে ড্রাইভিংও শেখানো হয়েছে, কোনসময় তো চালাতে দেখিনা।সারাক্ষণ ওই ঝরঝরে মোটর সাইকেলে পাক খাস কেন বুঝিনা।একটা ভালো মোটর সাইকেল কিনে নে তাহলে। বীরেন রায়ের নাতির এত গরিবীয়ানা মানায়না।”
ওই ‘বীরেন রায়ের নাতি’ কথাটা ওর সঙ্গে কথা বলতে গেলেই বাবা একবার আওড়ে নেয়।শুনলেই ওর হাসি পায়।মনে হয় বাবারও কি ঠিকমত বিশ্বাস নেই ওর বীরেন রায়ের উত্তরাধিকারে? বাবাকেও দোষ দেওয়া যায়না।বাবা বা দাদুর মানসিকতার সঙ্গে ওর হাজার মাইলের পার্থক্য তো।।
কিন্তু এসব কথা এখানে থাকলেই ওকে শুনতে হবে।এসব একমাত্র ছোটের কাছেই বলে ও।ছোটে খুব মজা করে বলেছিল, “দুটো কানে দুটো ফুটো কেন জানিস?এক কান শোনার,আর এক কান বার করে দেওয়ার।”
ও খুব হতাশ হয়ে বলেছিল, “ছোটে তুমি আর কী বুঝবে, সামনের বৈশাখে বাবার গদিতে না ঢুকলেই বাবা মারাত্মক ঝামেলা শুরু করবে।কাজকর্ম তো পেলাম না।পি এইচ ডি তে চান্স পেলেও কিছু বলা যেত।কিন্তু এখনও তো কোন খবর নেই।কিছু না হলে বাড়ি থেকে কাটতে হবে।কিন্তু যাব কোথায়?”
বিছানায় বসে পিন্টু ছবি আঁকছিল।হঠাৎ বলে উঠল, “দিদির মত দার্জিলিংএ ট্রেনিংএ যেতে পারো। বেশ হিমালয়ে চড়বে।”
ওর কথা শুনে হতবম্ব হয়ে ওকেই জিজ্ঞেস করেছিল বিলু, “দিদি,মানে তোর বাড়ির দিদিমনি?ওই মেয়েটি?ও পাহাড়ে চড়বে কী?ও তো খুব রোগা।”
ছোটে অমনি বলে উঠল, “দেখতে রোগা। আসলে দারোগা।আমাদের পিন্টু এবারের টার্মিনালে ভূগোল ,ইতিহাস,দুটোতেই হায়েস্ট পেয়েছে।আর কী আত্মসম্মান!বললাম সামনের মাসের টাকাটা আগাম নিতে,রাজি হলনা।”
ছোটের কথাটা কানে ঢুকছিল না ওর।একটা ছবি আবছা হয়ে চোখের সামনে দুলছিল। তাই সেদিন ক্লাবঘরে শক্তিদার সঙ্গে বসে কিসব আলোচনা করছিল মেয়েটা।মেয়েটার নামটা বেশ।কুহু।কুহুর সঙ্গে বৃষ্টির দিন টুপুর বাড়ি থেকে ফেরার পথে দেখা হয়েছিল তো।বেশ স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলেছিল।ও পাহাড়ে যাচ্ছে?
বিলুর একটু একটু মনখারাপ লাগছিল।সবাই বেশ নিজের ইচ্ছেমত যা খুশি তাই করছে।ওকেই কেবল বাড়ির ইচ্ছেয় চলতে হয়।কেন?ও কি একটা আলাদা মানুষ নয়?বাবার ইচ্ছেমত ওকে ওই বিচ্ছিরি হার্ডওয়ারের ব্যবসা চালিয়ে সারাটা জীবন পয়সা পয়সা করে বরবাদ করতে হবে কেন?
ছোটে একটা বুদ্ধি দিল।সেটাই ও কাজে লাগাবে ভেবেছে।বুদ্ধিটা লাগসই।ও বাইরের ইউনিভার্সিটিতে পি এইচ ডি করার জন্য জি আর ই পরীক্ষায় বসবে।তার প্রিপারেশান শুরু করেছে।এরকম সময়ে ব্যবসার গদিতে যোগ দেওয়া সম্ভব নয়।
টুপু বাংলার।ও কেমেস্ট্রির।ওর সঙ্গে কুনাল পড়ত।এখন যোগাযোগ কম হলেও একসময় বেশ বন্ধুত্ব ছিল।কুনাল বলেছিল, জি আর ই তে বসার জন্য কোচিং লাগে।ও ভর্তি হবে।পুরনো মোবাইল ঘেঁটে কুনালের ফোন নং ট্রাই করে কিছুই লাভ হলনা।তবে লাভ হল অন্য জায়গায়।
বাবা এককথায় রাজি হয়ে গেল। খুব উৎসাহ! “বিদেশে পড়তে যাওয়ার কথা ভাবছ ,আগে বলবে তো।স্কলারশিপ না পেলেও বলো।আমি টাকা দোব।আমাদের বংশের একজন বিদেশের ইউনিভার্সিটিতে পড়বে,এ তো বড় গর্বের কথা।”
যে কথাই হোক,বাবা বংশে পৌঁছে যায় ।এটাই মুস্কিল।তবে যে রোগের যা ওষুধ।বাবাকে আর ঘাঁটাবে না বিলু।মনে মনে ছোটেকে অনেক ধন্যবাদ দিচ্ছিল ও।
এখন রোজই নিয়ম করে পড়তে বসছে দুবেলা।জি আর ই র ব্যাপারটা ওর নিজের মাথাতেও ঢুকেছে।একবার ক্লিয়ার করতে পারলে,নতুন একটা দেশ।তার মানুষজন। গবেষণার সুযোগের সঙ্গে সঙ্গে অখন্ড স্বাধীনতা।নিজের তাগিদেই রীতিমত পড়াশুনা শুরু করেছে ও।বাবাও এসে মাঝেমাঝে একপাক ওর পড়ার ঘরে ঘুরে যায়।
মা সেদিন প্রসাদ দিতে ঘরে ঢুকে বলল, “নিজের ইচ্ছেতেই এসব করছিস তো?”
ও ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিল।মা কেমন অবাক হয়ে দেখছিল ওকে।তখনই দোলাচল শুরু হল।সত্যি সত্যি ও নিজের ইচ্ছেতেই এগোচ্ছে তো?
পড়ার টেবিলে অনেকক্ষণ ধরে বইপত্র খুলে বসে থাকতে থাকতে পিন্টুর দিদির কথা ভাবছিল ও।ওই রোগা প্যাংলা মেয়েটার এত সাহস!একা একা পাহাড়ে উঠবে ভাবছে।ওর কেন এত সাহস কম?
ঘরের মধ্যে রোদ্দুর ঢুকে আলমারির আড়ালে একটুকরো ছায়া তৈরি করেছে।সেদিকে তাকিয়ে চুপ করে বসেছিল বিলু।ভাবছিল অনেক কিছু।ভারী অদ্ভুত সে ভাবনা। ও নিজে কী? রোদ না ছায়া?ভাবতে ভাবতেই ও দেখল সকালের রোদের আলো আস্তে আস্তে কেমন ম্লান হয়ে আসছে।
(ক্রমশ)
কি সুন্দর চলন!