অক্সিজেন। পর্ব ৯। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
ঋতুবদল
আকাশটা একদম কালো হয়ে এসেছে। যেকোন সময় বৃষ্টি নামবে। শুকনো জামাকাপড়গুলো ছাদে বুকের কাছে জড়ো করছিল মীরা। বৃষ্টি নামার আগেই তুলে না ফেললে আরো কাজ বাড়বে। আশ্বিন মাস পড়ল। এইসময়টায় বৃষ্টির কোনই ঠিকঠিকানা থাকেনা। হঠাৎ আসে, হঠাৎই থেমে যায়।
এখন শীত গ্রীষ্ম সব ঋতুতেই একটা অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ করছে সে। তীব্রতা বেড়ে গিয়েছে। হুড়মুড় করে যেমন বৃষ্টি হয়, তেমন আবার থেমে যেতেও সময় লাগেনা। বর্ষাকালে প্রথম বৃষ্টি এলে ব্যালকনিতে টুল পেতে বৃষ্টি দেখতে বসে যেত মীরা। বিয়ের পর প্রথম প্রথম রঞ্জিত অবাক হয়ে বলত,“কী দেখো তুমি? বৃষ্টি? বৃষ্টি আবার দেখার কী আছে?”
সেসব প্রশ্নের কখনওই উত্তর দিত না ও। মনেমনে বলত, “আছে। সে তুমি এমনিতে বুঝবে না। তোমাকেও বৃষ্টি দেখতে হবে।”
এখন অবিশ্যি জানতে চায়না। তবে ও টুল নিয়ে বাইরে বসলে রাধা চেঁচায়, “মা কোথায়? মা কোথায়?”
এখন মীরা এলে ওকেও সঙ্গে নিয়ে আসে। কাপড় শুকুতে দেবার তারে ওর খাঁচাটা ঝুলিয়ে দেয়। আশ্চর্য্য! চুপ করে বসে থাকে। একটু আওয়াজও করেনা। ও কি বৃষ্টি দেখতে ভালবাসে তার মতন? কে জানে?
রঞ্জিতের শরীর ঠিক নেই একদম। করোনা ওকে ভারি দুর্বল করে দিয়েছে। যখন তখন বিছানায় শুয়ে পড়ে। সুগারটাও বেড়েছে। মাঝেমাঝে বড় ভয় করে। কিছু হলে সামলাবে কী করে? বিভু বারবার বলছে কোভিডের কড়াকড়ি কিছুটা কমলে ওর কাছে গিয়ে কিছুদিন থেকে আসতে। ও টিকিট পাঠিয়ে দেবে। তার নিজের তেমন আপত্তি নেই। কিন্তু রঞ্জিত একদম যেতে চাইছেনা।
অদ্ভুত একটা কথা বলে ও। “জানো এই মাটি, এই বাতাস, এই আমার বাপ ঠাকুর্দার পুরনো ভিটে, বড় প্রিয় আমার। এখানেই মরতে চাই। বয়স বাড়ছে দিনদিন। আমায় আর কোথাও যেতে বলোনা।”
জবাবে ও অবশ্য শুনিয়েছিল দু’একটা কথা। যা ও বলার কথা আগে কখনও ভাবেনি। বলেছিল, “হঠাৎ এত ভাবুকের মত কথা বলছ? ইচ্ছে নেই সেটাই বল না। তাছাড়া মরণের কথা কে বলতে পারে? পথেঘাটেও তো মরে মানুষ। যাবেনা সেটাই বল।”
উত্তরে রঞ্জিত কিছুক্ষণ গুম হয়ে থেকে বলেছিল, “তুমি যাওনা। আমাকে টানাটানি করছ কেন?”
মীরার কথার আর কোন জবাব ও দেয়নি।
কয়েকদিন ধরে যেভাবে বৃষ্টি হচ্ছে, কোথাও বেরোন যাচ্ছেনা। এরকম হলে অবশ্য বৃষ্টির ওপর রাগ হয় তার। কুহুটার সঙ্গে তারপর থেকে দেখা হচ্ছিল না। কাল এসেছিল একবার। ওই এক অদ্ভুত মেয়ে। সারাক্ষণ তাদের জন্য কিছু না কিছু করবেই। অথচ ওকে কিছু দিতে গেলে ও নেবেনা। করোনা হবার পর অনেকদিন সেলাইমেসিনে বসা হয়নি। কদিন আগে দোকান থেকে কয়েকমিটার গোলাপী লিনেনের কাপড় কিনে এনেছিল। আর কিছুটা সাদা লেস। আন্দাজে মেয়েটার জন্য একটা কামিজ বানাচ্ছে ও। সেটা ওর গায়ে ফিট করবে কিনা তাই নিয়ে একটু সংশয় ছিল। তাই গতকাল মাপ নিতে ডেকেছিল ওকে।
কামিজটা বানাতে দেখে কুহু খুব খুশি হল। একমুখ হেসে মেয়েটা বলেছিল, “কতদিন কেউ কিছু বানিয়ে দেয়না। জানো কাকীমা, ঠাকুমা যতদিন ছিলেন, ছোটবেলায় আমাকে আর দিদিকে পুজোর সময় জামা বানিয়ে দিতেন। ঢোলা ঢোলা বড় বড় সেই জামা আর বড় সাইজের তুলো গোঁজা জুতো পরে পুজোতলায় ঘুরে বেড়াতাম আমরা। দুর্গতির শেষ ছিলনা। তবু কত আনন্দ!”
হাঁ করে মেয়েটাকে দেখছিল, আর কথা শুনছিল মীরা। মুখেচোখে মিষ্টি ভাব আছে একটা। তবে এমন কিছু আহামরি নয়। লম্বা একহারা চেহারা। চুলের সবটাই লম্বা বেণী করে পেছনে ঝোলানো। তবু সবমিলিয়ে একটা দীপ্ত ভাব আছে।সেটাই টানে। ওর মা নীপাদি, স্কুলে পড়ান। নীপাদির সঙ্গে আগে ওনার স্কুলে যাতায়াতের পথে দু’একটা কথা হত। এখন তো মুখ নামিয়ে হেঁটে যান। বাক্যালাপ করার ইচ্ছে আছে বলে মনে হয়না। বড়মেয়ে ওইভাবে চলে যাবার পর থেকেই নিজেকে একেবারে গুটিয়ে নিয়েছেন। পাড়াঘরের কোন অনুষ্ঠানেও আসেন না। ওনার স্বামী অসুস্থ হতে রঞ্জিত একবার গিয়েছিল। সেই শেষ।আর ওদের বাড়িতে যাবার কথা বলেনি। কিছু বুঝেছিল হয়ত।
স্বাভাবিক একটা পরিবার এভাবেই চারপাশে পাঁচিল তুলে নেয়, সমাজের ভয়ে। লোকের কথা শোনার ভয়ে। অথচ বিপদের সময় সেই সমাজের কারো টিকির দেখা পাওয়া যায়না। এইজন্যই আজকাল টিভি দেখতে পারে না মীরা।সিরিয়ালের প্রায় সব গল্পেই মেয়েদের ওপর অত্যাচার ,অবিচার। আর মেয়েদের ঘাড়ে মহান হবার দায় চাপানো হয় সুকৌশলে। যতসব বানানো গল্প।নানাধরণের ছোটবড় ষড়যন্ত্রও থাকে। ওসব দেখলে বড় রাগ হয় তার। মাঝেমাঝে ঐতিহাসিক কিছু জীবনী ভিত্তিক সিরিয়াল দেখলেও নিজেকে সিরিয়ালের ফাঁদে বুঁদ হতে দেয় না ও ।তা নিয়েও ঘরে বাইরে কম কথা শুনতে হয়না।
সেদিনই তো শুনলেন মেজজা কাকে যেন বলছে, “আমরা ভাই সাধারণ। উনি নয় বইমুখে বসে থাকেন…।”
বাকিটা শোনার রুচি হয়নি। রঞ্জিতের কানেও কখনও কখনও যায় এসব কথা। বলছিল, “তুমি পারও বটে! এরপরেও যাবে, রাঁধা তরকারি খাওয়াবে…। ওদের ছেলেমেয়েদের কম দেখাশুনা করেছ? তোমার কাছেই ছেড়ে দিয়ে নিজেদের কাজ সামলাত তো। এখনও তাদের নিয়ে আদিখ্যেতা করতে ছাড়ো না। অথচ তোমাকে নিয়েই যত কথা। তোমার লজ্জা নেই।”
বাকি কথাগুলোর মীরা উত্তর দেয়নি।শুধু বলেছিল, “ছোটদের এসবের মধ্যে টানছ কেন?”
আর মনেমনে ভেবেছিল, এরা আছে। আবার কুহুর মত মেয়েরাও আছে তো। যে যার মত থাক।
কে জানে? যে যার মত থাক কথাটায় সত্যি সত্যি কারো বিশ্বাস আছে কি?
(ক্রমশ)
ভালো লেখা, বাঁধুনি আছে। চমৎকার।