অক্সিজেন। পর্ব ৬। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
বিকশিত আখ্যান
বিলুর টেবিলে বইখাতা সব ছড়ানো ছিল। এবছরেই যেকোন একটা চাকরির পরীক্ষায় ওকে ক্লিক করতে হবে। নাহলে বাবা ওকে ধরে বাবার অফিসের চেয়ারে বসিয়ে দেবে। এম কম পড়া অবধি কোনরকমে ও ঠেকিয়ে রেখেছিল ব্যাপারটা। আর কোনও যুক্তি দেখাতে পারছে না।
গতকাল এই নিয়ে খুব ঝামেলা হয়ে গিয়েছে। কেন ও ওদের নিজেদের অফিসে জয়েন করবেনা তার কারণটা বাবা লিখিত আকারে চেয়েছিল। ও লিখতে গিয়ে বারবার ফেল করছে। আসলে কারণটা ও নিজেও নিজের কাছে ব্যাখ্যা করতে পারছে না।আসলে সব কেনর তো উত্তর হয়না।
তবে এটা ঠিক ও একদম নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। কোনভাবেই বাবার ঠাকুরদার বাবার থেকে চলে আসা হার্ডওয়ারের বিজনেসের গদিতে বসে, নিজের জীবনের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করতে চায়না। ওর এব্যাপারে যে বাবার সঙ্গে একেবারে কথা হয়নি তা নয়। বাবাকে ও বলেছিল কথাটা ।
বাবা বলল, “তাতে কী? তুই আমাদের বিজনেসটাই একটু পালটে নিজের নামে একটা আলাদা বিজনেস করতে পারিস। সে ক্যাপিটালটা আমিই দেব। পরে তুই শোধ করে দিস। আমি যেমন বাবার বিজনেস থেকেই এই নিউ হার্ডওয়ার তৈরি করলাম।”
মানে আরো বেশি করে জড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা। কেননা বাবার অবর্তমানেও বাবার বিজনেস ওরই হবে। সেদিনই ও বুঝেছিল পারবে না। বাবাকে বোঝানো ওর কর্ম নয়। তাই চাকরির জন্য উঠেপড়ে লেগেছে ও। ওর জন্মের পাঁচবছর পরে একটা ভাই হয়েছিল। সে হওয়ার পাঁচমাস পরেই মারা যায়। সেই থেকে মা সংসারের বাইরের মানুষ। নিরামিষ আহার ছাড়াও, উপোস লেগেই আছে। দিনের বেশি সময়টাই ঠাকুরঘরে কাটায়। মার সঙ্গে দিনে দুবার ওর দেখা হয় খাবার টেবিলে। তখন সবাই থাকে বলে এসব কথা বলাই যায়না। ও জানে ওর কথাটা একমাত্র মা বুঝলেও বুঝতে পারে। কাউকে কিছু না বললেও একটা পজিটিভ পরামর্শ দিতেই পারে মা। কেননা ওর জীবনের শুরুতেই একটা বিরাট গোলমালের হাত থেকে ওকে বাঁচায় মা। ওদের পরিবারে ‘ব’ দিয়ে নাম রাখার সিস্টেম আছে। দাদু ওর নাম রেখেছিলেন বিশ্বলোচন। মা সেটা পালটে বিকশিত করে দেয়। ভাগ্যিস! নাহলে ওরকম একটা ভয়ঙ্কর নাম সারাজীবন ওকে বইতে হত।
তখন ভাই জন্মায়নি। ওর মনে আছে মা সেসময় বেশ ভাল গান গাইত। বই পড়ার নেশা ছিল। বই কিনত, লাইব্রেরিতে গিয়ে বই এনে পড়ত। বাইরের ঘরের চারটে বই-এর আলমারিতে মায়ের কেনা অনেক বই আছে। এখনও মা বই পড়ে। নিয়মিত কিছু ম্যাগাজিন কেনে। তবে সেসব বই ধর্মসংক্রান্ত।
খাবার টেবিলে মা আসে পরিবেশন করতে। নিজের হাতে ভাত বেড়ে, তরকারির বাটি সাজিয়ে ওকে আর বাবাকে খেতে দেয়। এমনকি বাড়ির কাজের লোকেদেরও মা পরিবেশন করে ভালমন্দ খাওয়ায়। কিন্তু নিজে নিরামিষ খায়। পোশাকে-আশাকে, খাওয়া-দাওয়ায় মায়ের এই পরিবর্তন দাদু বেঁচে থাকতেই ঘটে।
দাদু একবার জানতে চেয়েছিলেন, “এরকম উদ্ভট আচরণের মানে কী?”
মা বলেছিল, “উদ্ভট হোক, অন্য কারোর জন্য ক্ষতিকর কি?”
তারপরে আর দাদুর আপত্তি খাটেনি। এসব কথা ওর জানার নয়। বাবা বলেছে। মাঝেমাঝে ওর জেদ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে মায়ের প্রসঙ্গ টেনে আনে বাবা। তখনই এসব কথা বেরিয়ে পড়ে। এত কিছু করলেও এখনও দীক্ষা নেয়নি মা। বাইরের কেউ জানতে চাইলে বলে,“এখনও সময় হয়নি হয়ত।”
তবে ওকে একদিন মনের কথাটা বলেছিল। সেদিন ছিল পনেরোই আগস্ট। পাড়ার ক্লাবে সেবার পতাকা তোলার অনুষ্ঠানের দায়িত্ব ছিল ওদের মত অল্পবয়সীদের হাতে। সকাল ছটায় তৈরি হয়ে তাড়াতাড়ি যাবার সময় বাগানে মাকে দেখে ও। ফুল তুলছিল।
ওকে দেখে এগিয়ে আসে মা, একগাল হেসে বলে “ক্লাবে যাচ্ছিস? পতাকা তুলতে?”
কি খেয়াল হতে ও বলেছিল, “তুমিও চলনা। উদ্বোধন সঙ্গীত গাইবে।”
মা মাথা নেড়েছিল। মুখে বলেছিল, “তুই তো জানিস, আমি এসব…।”
ও সেদিন একটু অসহিষ্ণু হয়েই বলেছিল, “কার কথায় তুমি এসব কর? তোমার তো কোন গুরুই নেই।”
মা ওর দিকে কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে বলেছিল, “তিনি আছেন। আমার মনে। আমি মনের কথা শুনে চলি। যা ভেতর বাড়ি থেকে একটা প্যাকেট নিয়ে আয়। কিছু ফুল ভরে দিই। শহীদ বেদিতে লাগবে তো।”
সেদিন মায়ের দেওয়া ফুল খুব কাজে লেগেছিল। কেউ মারা যাওয়ায় বাজার বন্ধ ছিল। অনেক ঘুরেও ফুল কিনতে পারেনি ওরা।এরকম টুক্টাক্ কিছু কিছু ঘটেই চলে। আর ওর মনে হয় কেউ না বুঝুক মা বুঝবে। মাকে কথাগুলো একবার বলতে হবে।
(ক্রমশ)
কি সুন্দর!