অক্সিজেন। পর্ব ১। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
পাহাড় চূড়ায় পা
অবশেষে ধবলগিরি পর্বতের শীর্ষে এসে দাঁড়িয়েছে কুহু।এই শৃঙ্গের উচ্চতা আট হাজার একশো সাতষট্টি মিটার। এখানে হাত বাড়ালেই, আকাশ ছোঁওয়া যাবে বলে মনে হয়। ওর জীবনে এই অসাধারণ মুহূর্তটি বহু সাধনায় ধরা দিয়েছে! অথচ মোটে পনেরো কুড়ি মিনিট এর স্থায়িত্ব। আবহাওয়া এখনও ঠিক আছে, তাই আকাশে ঝকঝকে আলো। চারপাশে মেঘের দল আনমনে খেলা করে। চূড়ায় দাঁড়িয়ে সেই মেঘের ছোঁওয়া টের পায় ও। এ চূড়ার নীচে মেঘ, ওপরে মেঘ। শরীরের ওপর দিয়েও মেঘ ভেসে যায়।
এই পর্বতশীর্ষে দাঁড়িয়ে কুহু ছুঁয়ে দিতে পেরেছে নিজের অধরা স্বপ্ন। তবে এ স্বপ্ন নয়। মধুর বাস্তব! সত্যি সত্যি কুহু পৌঁছতে পেরেছে ওর অভীষ্টে। সাদা ধবধবে এক পাহাড় চূড়ায় ও দাঁড়িয়ে আছে শেরপা স্যারের সঙ্গে। একটু আগেই ওরা দুজনেই এসে পৌঁছেছে এই ধবলগিরি চূড়ায়। বিগত তিন বছরে যে চূড়ায় কোন মানুষের পদধূলি পড়েনি, সেখানে ওরা দাঁড়িয়েছে এসে। তাই এই জয় ওদের একার নয়। এ জয় ওরা ভাগ করে নেবে সেইসব ব্যর্থ, বিফল মানুষের সঙ্গে যারা চেষ্টা করেও সফল হয়নি।
এখন ওর মনে আনন্দের বা দুঃখের কোন অনুভূতিই কাজ করছে না। কোন তরঙ্গ উঠছে না। নিজের বিশ্বাসে স্থির আছে ও। ওর বিশ্বাস এই পাহাড় চূড়ায় ও এসেছে পাহাড়ের শক্তিতে। ওর নিজের ইচ্ছাশক্তি ছিল, কিন্তু সেই সব নয়। যেকোন সময় হিমেল হাওয়ায়, কঠিন বরফের ধাক্কায় ওর স্বপ্ন ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যেতে পারত। ও ছিটকে যেতে পারত একদম নীচে। বরফ এসে যেকোন মুহূর্তে ঢেকে দিতে পারত ওর তুচ্ছ শরীর। কিন্তু এ পাহাড় তা হতে দেয়নি। অনেক যত্নে, স্নেহে মমতায় ওকে মাথায় তুলেছে। অদৃশ্য কোন হাত ওকে ধরে রেখেছে, আশ্রয় দিয়েছে বরাবরের মত। তাই ছোট থেকেই যে স্বপ্ন ওর ছিল, তার অর্ধেক আজ পূর্ণ হল। আবার যাবে ও। দাঁড়াবে ওই এভারেস্টের চূড়ায়। পূর্ণ করবে ওর স্বপ্নের বাকি অর্ধেক।
পাহাড়ের চূড়ার এবড়ো খেবড়ো জমিতে পতাকা পুঁতেছে ওরা। দেবতার ছবি রেখে পুজো করেছে। ছবি তুলেছে। হাঁটাহাঁটি করেছে পরমানন্দে। হাতে বেশি সময় নেই আর। দশ মিনিট অতিক্রান্ত। আরো মিনিট পাঁচ এর অপেক্ষা। তারপর নীচে নামতে হবে। ফিরে যাবে সমতলের মানুষ সমতলে। ছবি তোলা হয়েছে। এবার প্রণতি। হাঁটু মুড়ে মাথা নীচু করল ও, ধবলগিরির উচ্চতার কাছে। যে কাছে টেনেছে, তার কাছে ও কৃতজ্ঞ। পথের বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে ওর স্বপ্নের চূড়ায় অবশেষে পৌঁছতে দিয়েছে যে অসীম শক্তি, তার কাছে ও আজ নতজানু।
একথা ওর সবসময় মনে হয় যে, পাহাড়ের কাছে, ও বাঁধা পড়ে আছে। পাহাড়ের শক্তিতেই অবশেষে পৌঁছে যায় উচ্চতায়। ক্রমশঃ এও বুঝেছে পাহাড় ওকে না ডাকলে ও পারত না তার গা বেয়ে বেয়ে এতটা পথ পেরিয়ে আসতে।প্রকৃতির সেই শক্তিকে চেতনে অবচেতনে বহুদিন ধরে নিবিড় ভাবে অনুভব করেছে যে ।
আরোহণ শেষ হল অবশেষে। এবার দেবতার ছবি, পতাকা সবকিছু গুটিয়ে নিয়ে নীচের দিকে যাত্রা। ফিরে যাওয়া নিজের ঠিকানায়। নামার ঠিক আগে আরেকবার পেছন ফিরে তাকাল কুহু। তারপর শুরু হল অবরোহণ।
এক যে ছিল কন্যে
ফিরে যাই কাহিনির শুরুতে। শহরতলির একটি অতি সাধারণ মেয়ে কুহু। হঠাৎ করেই ক্লাস ফাইভের বাংলা বইয়ে তেনজিং নোরগে আর এডমন্ড হিলারির এভারেস্ট অভিযানের কাহিনি পড়ে পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার কথা ভাবে। ছোট্ট সেই মেয়েটার মনে পাহাড়জয়ের স্বপ্নের বীজ সেই দিনই পোঁতা হয়ে যায়। ধীরে ধীরে সেই বীজ অঙ্কুরিত হয়। ডালপালা মেলে। ওর বড় হওয়া আর সেই আকাশকুসুমের ডানা মেলা একই সঙ্গে ঘটে। আমরা ফিরে যাব সেইসব দিনে, কুহু যখন কোন পাহাড়চূড়ায় ওঠেনি। পাহাড়ের হাতছানিতে এক পা দু’পা করে সেই পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে শুধু। সেই দিন গুলোর কথা নাহয় বলি আমরা, কুহুর স্বপ্নে জাগরণে যখন শুধু পাহাড়জয়ের ছবি আঁকা ছিল।
(ক্রমশ)
খুব ভাল লাগছে পড়তে।
সুন্দর সূচনাপর্ব