কাগজের নৌকো। পর্ব ২৩। ধারাবাহিক উপন্যাস। লিখছেন সায়ন্তন ঠাকুর
বছর দশ আগের কথা, সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, একটি নির্জন পথে হাঁটছি আমি আর দুলাল। জয়রামবাটির মাতৃমন্দির আমোদরের শীর্ণা নদীখাত পার হয়ে প্রায় এক মাইল চলে এসেছি, দুপাশে কার্তিকের কুয়াশাফোটা জগত, মন্দ মন্দ বাতাসে নূতন ধানের তিরতির সুবাস ভাসছে, পশ্চিমাকাশে অস্ত আলোর অলঙ্কার-সেদিকে পানে চেয়ে দুলাল মলিন গলায় বলল, ‘আর ভাল্ লাগে না বুজলা!’
অনেকদিন আগে কলকাতার মেসে আলাপ হয়েছিল, নদীয়ার ছেলে, আমার থেকে বয়সে চার-পাঁচবছরের ছোট, ভারি নরম স্বভাব, ওই কাঁচা বয়সে বাড়ি ছেড়ে হইহই মেসেই আমরা ভেবেছিলাম জীবন কেটে যাবে-কিন্তু তা তো হওয়ার নয়, অল্প বয়সের মায়াঞ্জন বেলা বাড়লেই খর রক্তচক্ষু হয়ে ওঠে! অন্য সবার সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে এলেও কী জানি কেন দুলাল আর আমার সম্পর্কটি আলগা সুতোর মতো রয়ে গেল, এ বড়ো বিচিত্র নিয়ম, ভবহাটে কোন্ সম্পর্ক যে থাকবে আর কোনটি মুছে যাবে তা বোঝা ভারি মুশকিল।
পয়সাকড়ির দিক থেকে তেমন কিছু করে উঠতে পারেনি, খুবই সাধারণ একটি চাকরি-নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর সংসার, দুটি ছেলেমেয়েও হয়েছে, চোখের নিচে গাঢ় কাজলপারা কালি, গতকাল ফোন করে এসব সাত-পাঁচ অভাবের কথা বলছিল, আমিই বা কী করব, পয়সাকড়ির সাধ্য তেমন নাই, তা বললাম, ‘চল্ দুটো দিন আমার সঙ্গে ঘুরে আসবি!’
দুলাল এককথায় রাজি, কোথায় যাব অবধি জিজ্ঞাসা করল না, আসলে মানুষ সমস্যা থেকে দূরে বেড়াতে যেতে বড়ো ভালোবাসে!
দু-একটি তারা ফুটে উঠছে আকাশে, এখন শুক্লপক্ষ, অল্প সময়ের মধ্যেই পরমা প্রকৃতির করুণার মতো চন্দ্রদেব পুব আকাশে উদিত হবেন-তবে দুলালের এসব দিকে তেমন মন নাই, সেটিই স্বাভাবিক, আমি হালকা সুরে শুধোলাম, ‘ভালো লাগে না কেন? আবার ধার করেছিস বাজারে?’
—কী করব বলো, সংসারে শুধু দ্যাও দ্যাও, চাল আচে তো নুন নাই, নুন আচে তো ডাল নাই! কী করব!
—কেন তোর মাইনের টাকা?
দু-এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, ‘মাইনার ওইটুকুন টাকায় কী চলে! চারখান প্যাট! আর টাকা দশ হাজার! বাড়িওলা তিন হাজার, তাও দুমাসের বাকি পড়ছে, উটতে বসতে তাগদা!
—তোর বড়ো ছেলেটা ইস্কুলে ভর্তি হয়েছে না?
—হুঁ, সরকারি ইস্কুল বলি বাঁচা, তাও আজ খাতা পরশু ডেরেস, তারপরদিন অন্য কিচু, হাজার বায়না, বুজলা দাদা, হাজার বায়না! সংসার মানুষে করে!
আদিগন্ত প্রান্তরে সন্ধ্যাদেবী তাঁর রেশম বস্ত্রের মতো কুয়াশার আঁচল পেতে বসেছেন, দূরে টুপটুপ আলো-গৃহস্থ উঠানের প্রদীপ, কোথাও মৃদু সুরে শাঁখ বেজে উঠল, ঝোপের মাথায় সাদা ফুলের কী বাহার, বামদিকে বাঁশবনে একমুঠি জোনাক পোকা আপনমনে খেলা শুরু করেছে, একটি গোরুর গাড়ি আমাদের পার হয়ে কাঁচাপথে নেমে গেল-হেমন্তিকার এমন রূপ দেখলে চোখ জুড়িয়ে আসে, এই রূপও সত্য আবার দুলালের গঞ্জনার জীবনও সত্য, অথবা দুটিই অলীক মায়া, কী জানি!
কয়েক মুহূর্ত পর বললাম, ‘পীরিত করেই তো বিয়ে করেছিলি, তাহলে এখন এসব কথা বলে লাভ আছে! আচ্ছা, মাধবী কী একটা কাজ করতো না?’
কার্তিক দ্বিপ্রহরের ছায়াচ্ছন্ন রৌদ্রের মতো হাসল দুলাল, ‘সে কোনকালে, ছেলাপিলা হওয়ার পরে কবে ছেড়ে দিছে।’
মন্থর পায়ে দুজন হাঁটছি, আমার মন পড়ে রয়েছে জ্যোৎস্না পানে, দুধ আলোয় কুন্দকুসুমের মতো অস্ফুট জগত বড়ো প্রিয়, কেমন অতীত আখ্যান হয়ে সে জেগে ওঠে, কতদিন দেখি নাই। হঠাৎ দুলাল জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্চা, তেলাভোলার মাট ইদিকেই, নয়?’
প্রসঙ্গ বদলে যাওয়ায় সামান্য অবাক হয়েই শুধোলাম, ‘কেন বল্ তো?’
বালকের মতো হাসল দুলাল, ‘না সেই ডাকাত দেখা পাইচেল, আর আমি তো কোনও অন্যায় করিনি, কারোর পইসা মারিনি জীবনে, সতপতে রইচি, তুমি তো জানো! কত দু নম্বরি লোক ক্যামন সুকে আচে আর যত অভাব শুদু আমার বেলা? উটতে বসতে খোঁটা দেয় লোক, মাধবীর খরখরে কতা তো শোনোনি, মুকে অন্ন উটবে না।’
শেষদিকে চৈত্র বাতাসের মতো করুণ হাহাকারে ভরে উঠল দুলালের কণ্ঠস্বর, পরিবেশ লঘু করার চেষ্টায় কৌতুকের সুরে বললাম, ‘তাঁর দেখা পেলে এই নিয়ে অভিযোগ জানাবি বুঝি?’
—নাহ! ওসব করি কিচু হয়না গো! দ্যাকো মন্ত্র নিলাম, জপ করি, তাও কি অভাব যায়! গুরু মহারাজের কাচে একদিন সব বলতে যেচি, তা এত ভিড় যে ওসব বলব কী, পনাম করে ঘর চলে এলাম!
একটি শীর্ণ নালার উপর পথটি সামান্য উঁচু হয়ে চলে গেছে দূরে, এপলক দেখলে মনে হয় কোনও রমতা সাধু সাপি নিয়ে প্রায়ান্ধকার সন্ধ্যা ভুবনে হারিয়ে গেছেন, যাত্রাপথের দুপাশে মধুসুরের শব্দে জেগে উঠেছে মলিনবসনা হেমন্ত, সামনে একখানি বাধানো বটতলা দেখিয়ে দুলালকে বললাম, ‘আয় একটু বসি!’
একখান বিড়ি নিজে ধরিয়ে আমাকেও দিল, বেশ স্বাদ, কড়া তামাক। দু-এক মুহূর্ত পর বললাম, ‘একটা কথা দুলাল, তুই যখন মন্ত্র নিয়েছিলি তখন কি তোর গুরু মহারাজ বা মা কাগজে লেখাপড়া করে বলেছিলেন, যে তোর কোনও অভাব কখনও থাকবে না?’
মাথা নিচু করে বিড়ি টানছে, নতুন ধান আর কুয়াশা সুবাসে মিশে যাচ্ছে তামাকের ঘ্রান, আবার জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী রে বলেছিলেন?’
নিঃশব্দে মাথা নাড়ল দুলাল।
‘তাহলে? এখন এই কথার কোনও মানে হয়?’
আমার দিকে শুকনো চোখে শুধোল, ‘তাহলে সাদুর কাচে আসি কী হবে? কোথাও একটুও ছায়া পাব না?’
মৃদু হেসে বললাম, ‘সাধু তো তোর ছেলের ইস্কুল, ভালো চাকরি, বউয়ের খুশি, মান যশ কিছুই দিতে পারবে না দুলাল। সে কিছুই পারে না। শুধু কী পারে জানিস?’
—কী?
—নিঃসঙ্গতা দিতে পারেন আর এই ভবহাটের কিচিরমিচিরের মাঝে ঈশ্বর কথা কইতে পারেন! তিনি চন্দনগন্ধী মলয় বাতাসের মতো ঈশ্বরকথা বয়ে আনেন!
আধপোড়া বিড়ি ছুঁড়ে নালার জলে ফেলে তীক্ষ্ণ স্বরে জিজ্ঞাসা করল, ‘ও দিয়ে কী হবে? গায়ে মাখব না মাতায় দেব? ছেলের দুদ কেনার পইসা না তাকলে ওই মলয় বাতাস না কী বললে ও দিয়ে কী হয় দাদা?’
সহসা উত্তরপথগামী বাতাসে ভর করে চন্দ্রদেব উঠে এলেন পূর্বাকাশে, মুহূর্তে ফিনফিনে প্রজাপতির পাখার মতো আলোয় আদিগন্ত ধানক্ষেত মায়া তরণীর মতো দুলে উঠল, কুয়াশাবৃতা জগত এখন আর অস্পষ্ট নয়-আবার স্পষ্টও নয়, যেন আমাদের সহস্র জন্মের দ্বিধা।
মলিন গলায় বললাম, ‘ওসব কিছুই হয় না রে দুলাল, শুধু তুই এই অপমান লাঞ্ছনা অভাবের দুনিয়ার মাঝে দাঁড়িয়েও অবিচল থাকবি আর খুব পরিশ্রমের শেষে অর্থ উপার্জন করে দায়িত্বের চৌকাঠে রেখে দিয়ে আপনমনে ঝলমল করে উঠবি! আনন্দ, হ্যাঁ, এই জ্যোৎস্নার মতো আনন্দে দেখবি টলমল করবে মন!’
বেশ কিছু সময় চুপ করে থাকার পর দুলাল সংশয়ী কণ্ঠে জানতে চাইল, ‘ সত্যি আনন্দ পাব?’
হাসলাম আমি, ‘পাবি! সাধুসঙ্গ থেকে পাওয়া নিঃসঙ্গতাই তোর বর্ম হবে। বউ বল্ ছেলে মেয়ে বন্ধুবান্ধব বাপ মা-যার কথাই ধর্ ,কে তোকে ভালোবাসে দুলাল? কেউ না! এই জানাটুকু হয়ে গেলেই দেখবি কী আনন্দ! ন্যাংটার নাই বাটপাড়ের ভয়!’
—আর অভাব?
—ও তো আসবে যাবে! ভয় কী! আমরা দুহাতে সমস্ত অনাদর আর অপমান সরিয়ে এখানেই বাঁচব, কোথাও পালানোর দরকার নাই! এই তো আমাদের পুজোর ঘর! যম জিনিতে যাব আমরা, ভয় কী!
গহিন নিশীথে কৌমুদী-কুসুমাস্তীর্ণ ফেরার পথে দেখি এক চাষী বাড়ির উঠানে নতুন গুড় জ্বাল দেওয়া হচ্ছে, কী মধুর সুবাস, অদূরে মাতৃমন্দির, গুড়ের কড়াইয়ের দিকে দুলালকে ইশারা করে বললাম, ‘দ্যাখ, কেমন ফ্যানা তুলছে, ওই ফ্যানা কেটে গেলেই নিচে টলটলে গুড়!’
বালকের দুধ চোখে ভেসে ওঠা জলছবির মতো হাসল দুলাল।
এই দুলালই অনেকদিন আগে সেনাপতি ভট্চাযের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। তখন কার্তিক মাসের দিন, দুপুর গড়ালেই পাখির মতো ডানা মেলে উড়ে যায় বেলা। রোদ্দুরের তাপ মরে এসেছে, এসব দিকে এখন থেকেই শীতকালের বাদ্যি শোনা যায়। উত্তুরে হাওয়া বইছে, ধুলা-ওড়া শুখা বাতাস।
সেনাপতির সঙ্গে আলাপ পর্বটিও ভারী বিচিত্র। দমদম স্টেশনে পুরোনো বইয়ের দোকান ছিল, খাওয়া দাওয়া সেরে হাঁটতে হাঁটতে যাই ওদিকে, কাঠের বেঞ্চে এমনি অলস বসে থাকি, রেলগাড়ির চলাচল দেখি। দুপুরের দিকে ভিড় পাতলা হয়ে আসে, সেনাপতির দোকানে বইপত্র উল্টেপাল্টে দেখি। কোনওদিন দাম দর করে কিনি দু একখান। একদিন বই ঘাঁটছি, হঠাৎ সেনাপতি একটা পাতলা বই এগিয়ে দিয়ে বলল, এইকান দ্যাকো! পচন্দো হবে!
বাঁশপাতা কাগজ দিয়ে মলাট দেওয়া, জীর্ণ বাঁধাই,একটু অবাক হয়েই পাতা উল্টে দেখি ভেতরে কালো মোটা হরফে লেখা, গুপ্ত প্রেতবিদ্যা, রচয়িতা আচার্য মৃগাঙ্কস্বামী। নিচে লেখকের সই, প্রায় মুছে গেছে, স্নেহের সেনাপতি’কে মৃগাঙ্কস্বামী, ২রা চৈত্র, ১৩৫৮!
তারপর যা হয় গল্পের ফুঁপি খুলে গেল! রোজ যাতায়াত, মাখামাখি। তখনই সেনাপতির বয়স ষাট বাষট্টি হবে, তবে দেখে বোঝা যেত না, কষ্টি পাথরের মতো কালো দোহারা চেহারা। একমাথা সাদা ফুরফুরে চুল, এমনি আর পাঁচটা লোকের মতোই শুধু চোখদুটি ধকধক করে জ্বলছে যেন সবসময়।
আলপথ ধরে চলেছি। চারপাশে গায়ে হলুদের মতো আলো, পাকা ধান আর সর্ষে ফলেছে এবার খুব। এক দঙ্গল গাঙ শালিখ উড়ে উড়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি লাগিয়েছে! মাথার ওপর একবালতি নীল গোলা আকাশ। রেশম রেশম হাওয়ায় ধুলো উড়ছে পাক খেয়ে, দূরে গাছপালার সারি। এখনই ধোঁয়া ধোঁয়া, আরেকটু পরেই দুধ সরের মতো কুয়াশা নেমে আসবে ভুবনডাঙায়। রূপ দেখে কেমন মায়ায় পড়ে যাই! বিভ্রম জাগে মনে, এই জগতের অধিক সত্য আর কিছুই কি আছে ?
কতদিন দেখা হয় নাই সেনাপতির সঙ্গে। বইয়ের দোকান তুলে দিয়েছে সেই পুজোর আগে, তাও হল বছর দুয়েক। কিছু বই এমনি দিয়েছিল আমাকে, বিনিপয়সায়, আর একটা জিনিসও দিয়েছিল। একখান রুদ্রাক্ষ, বলেছিল লাল কার বেঁধে গলায় পরতে! ওই রুদ্রাক্ষটি ছিল মৃগাঙ্কস্বামীর বাক্সে। মারা যাওয়ার আগে সেনাপতিকে দিয়ে গেছিল।
বাঁকিদেবীপুর কিছুই চিনি না আমি। শুধু জানতাম শান্তিপুর স্টেশনে নেমে বাবলা পার হয়ে যেতে হয়। সে পথেই চলেছি। বড় রাস্তার এক চা দোকানে বলল, আল ধরে সোজা মিনিট কুড়ি হাঁটলেই নাকি বাঁকিদেবীপুরের দেখা মিলবে। আধঘন্টা হয়ে গেল হাঁটছি, কোথায় কী! লোকজনও তেমন চোখে পড়ে নাই, তখন বয়স অল্প, শরীরে ক্লান্তি কম, ভালোই লাগছে বেশ। অপরাহ্ন বেলায় রূপবতী কন্যার মতো জেগে উঠেছে হেমন্ত ঋতু।
গুপ্ত প্রেতবিদ্যা পড়েছিলাম, প্রেতচক্র অনুষ্ঠান কীভাবে করতে হয় তার নিঁখুত বর্ণনা ছিল। তার আগে আমি জানতাম, শুধুমাত্র মৃত মানুষকেই চক্রে আহ্বান করা যায়, ওই বই পড়ে জানলাম, ঘুমন্ত মানুষের আত্মাকেও নাকি ডাকা সম্ভব। মানুষটি মরার মতো পড়ে থাকবে আর তার বায়ুশরীর উঠে আসবে প্রেতচক্রে। তবে কঠিন সাধনা, একটু ভুলচুক হলে ওই সূক্ষ্মদেহ আর ফিরতে পারে না শরীরে। তালা পড়ে যায় দেহের দরজায়। সারাজীবন একটি শরীরের লোভে ঘুরে বেড়ায় তখন ওই বায়ুদেহ।
সেনাপতি আরও দু একটা বিদ্যার কথা মুখে বলেছিল আমাকে। কিন্তু বারবার নিষেধ করেছিল, অভ্যাস না করতে, গৃহস্থ মানুষের অকল্যাণ হয়। এমনকি এও বলেছিল, ওই প্রেতজগতের দরজা একবার খুলে গেলে তারা বারবার করে ডাকতে থাকে। সে ডাকে উন্মাদ হয়ে যায় মানুষ। কাঁচা বয়সে কথা না শুনতেই ভালো লাগে।নির্জন মেসবাড়ির ঘরে শুরু করেছিলাম, তবে শেষ করতে পারি নাই ,মিনিট দশেক পরেই উঠে পালিয়েছিলাম, বায়ুর বুদবুদের মতো কীসব ভেসে ভেসে আসছিল চোখের সামনে। নিথর হয়ে উঠেছিল চারপাশ।
আলো নাই আর আকাশে। ঝুপ করে কুয়াশার পর্দা ফেলে দিয়েছে কে যেন। দূরে বড় রাস্তায় মিটমিট করে চলে ফিরে বেড়াচ্ছে আলোর বিন্দু। কতক্ষণ আর হাঁটব, ফিরে যাব কিনা ভাবছি, হঠাৎ দেখি ধুলা উড়িয়ে চার পাঁচটি ছাগল নিয়ে এদিকেই আসছে এক বালক।
গ্রাম্য বালকদের মতো একবারেই নয়, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন শরীর, ভারী কোমল মুখখানি। পরনে একখানি ধপধপে গেরুয়া ধুতি, খালি গা, গলায় মোটা পৈতা। পায়ে জুতা নাই, কতই বা বয়স হবে, আট নয় বছর! মাথা পরিস্কার করে কামানো, হাতে একখানি দণ্ডী। দেখে মনে হয়, এই মুহূর্তে কোনও উপনয়নের হোমাগ্নি ছেড়ে উঠে এসেছে।
কাছে এলে আমি একটু অবাক হয়েই জিগ্যেস করলাম, ‘খোকা বাঁকিদেবীপুর কোনদিকে বলতে পারো?’
রিণরিণে গলায় বালক উত্তর দিল, ‘তুমি ভুল পথে এসেছ।’
—এদিকে নয় বাঁকিদেবীপুর?
দু দিকে মাথা নেড়ে নাড়ল বালকটি। আমি আবার শুধোলাম, ‘তুমি বলতে পারো কোনদিকে?’
—কার কাছে যাবে তুমি?
বালকের কণ্ঠস্বরটি ভারী অদ্ভুত,কী যেন একটা আছে স্বরে, অমান্য করা যায় না। কোনও বালককে এত সুন্দর গুছিয়ে কথা বলতেও আমি শুনিনি কখনও। ইতস্তত করে বললাম, ‘সেনাপতি, সেনাপতি ভট্টাচার্য। তার বাড়ি যাব।’
—ফিরে যাও। সেনাপতি বলে ওখানে কেউ থাকে না।
এবার একটু রাগ হল। খুব পাকা পাকা কথা শিখেছে তো। একটু রূঢ় গলায় বললাম, ‘তুমি জানলে কী করে?’
নির্বিকার উত্তর এল, ‘আমি জানি।’
শান্ত খেলনার মতো ছাগলগুলি সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। অস্পষ্ট কুয়াশায় একটু একটু করে মুছে যাচ্ছে আদিগন্ত প্রান্তর। কী একটা মিষ্টি ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে, কেমন মাথা ভারী করা ঝিমঝিমে সুবাস। সন্ধ্যাতারা ফুটে উঠেছে দূর আকাশের গায়ে।
হাতের দণ্ডীটি তুলে বালক নির্দেশ করল আমাকে, ‘এসো আমার সঙ্গে। তোমাকে পৌঁছে দিই।’
কী হয়েছিল কে জানে! নিশি পাওয়া মানুষের মতো বালকের পেছন পেছন চললাম। আলপথের দুপাশে ধানক্ষেত, শিরশিরে বাতাস বয়ে চলেছে অবিরল।
কতক্ষণ হাঁটছি খেয়াল নাই। ফুটফুটে জোছনা থইথই ভুবনডাঙা। বালকটি কেমন আবছা, কাপাস তুলোর আঁশের মতো ভেসে ভেসে যাচ্ছে। পা দুখানিও যেন মাটিতে নাই। ছাগলগুলি একবার জমির মধ্যে নামছে আবার উঠে আসছে, শান্ত নির্বিকার, যেন ওই বালকের খেলনা পুতুল।
নিদ্রিত সব জনপদ পার হয়ে আমরা চলেছি। নিথর জগৎ সংসার, অলীক কুয়াশা আর জোৎস্না পরস্পরকে আদর করছে। পরীদের ফিনফিনে পাখনার মতো থিরথির করে কাঁপছে আমার পায়ের তলার মাটি। কারা সব দুপাশে ফুটে উঠছে আবার মিলিয়েও যাচ্ছে বাতাসে। ছায়া ছায়া শরীর তাদের। খুব বেশি ছায়া শরীর জমে উঠলে বালক হাতের দণ্ডী তুলে নরম গলায় বলছে, ‘তিষ্ঠ! তিষ্ঠ!’
চেতনা ফিরল বড় রাস্তায় উঠে। অবাক হয়ে দেখলাম তখন দুপুর হয়েছে সবে। সেই যেমন সময়ে আমি আলপথ ধরেছিলাম অবিকল সেই মুহূর্ত! বাস লরি হু হু করে ছুটে চলেছে। চা দোকানে তেমনই দু চারজন মানুষের ভিড়। ওখানেই আমি জিগ্যেস করেছিলাম বাঁকিদেবীপুরের কথা।
বালকটি আমার দিকে ফিরে ম্লান হেসে বলল, ‘যাও! বাড়ি ফিরে যাও। বাঁকিদেবীপুর বলে কোথাও কিছু ছিল না কখনও!’
(ক্রমশ)