লাল রঙের দেশ মারয়ুল । পর্ব ৯। লিখছেন কৌশিক সর্বাধিকারী
দিল্লি থেকে বিমানপথে লেহ আসার আগে আপনি যদি পুরো অঞ্চলটা গুগল ম্যাপে ডাউনলোড করে রাখেন এবং যাত্রা শুরুর আগে ফোনটাকে এরোপ্লেন মোডে দিয়ে জিপিএস অন করে রাখেন, তবে এই একঘন্টার উড়ানে জিপিএস ফলো করে এবং জানলা দিয়ে বাইরে দেখে গোটা যাত্রাপথের একটা আন্দাজ আপনি পেতে পারেন। দু’দিকের জানলার দৃশ্যই অপূর্ব হলেও বড়া সিগরি হিমবাহ, চন্দ্রতাল বা ৎসো কার দেখতে গেলে বিমানের ডানদিকে জানলার ধারে বা ‘F’ নম্বর আসন নেওয়াটাই সমীচীন হবে। তবে তাই বলে দেখবেন বিমানের ডানার উপরের আসন যেন বুক করবেন না, কিছুই দেখতে পাবেন না তাহলে।
টেক অফ করার দশ মিনিট পর থেকেই আপনি পানিপথ এবং মুজফফরনগরের মধ্যবর্তী বিস্তীর্ণ শস্যখেত আর তার মাঝে জলসেচকারী অজস্র সরু সরু নদী-নালা দেখতে পাবেন। আঁকাবাঁকা এই নদী গুলি সবই উত্তরের তরাই অঞ্চল থেকে নেমে আসা এবং প্রায় সমান্তরাল। এর পর বাঁদিকে কুরুক্ষেত্র আর ডানদিকে সাহারানপুর আর পন্ঠাসাহিবকে রেখে যমুনানগরের উপর দিয়ে উত্তরদিকে উড়ে যাবেন আপনি। ডানদিকে দেখতে পাবেন তরাই অঞ্চল থেকে অনেকগুলো আঁকাবাঁকা নদী নেমে এসে যমুনা আর গঙ্গার মাঝে সাহারানপুর, ভগবানপুর আর রুরকির মাঝের কৃষিক্ষেতে মিলিয়ে যাচ্ছে।
আপনি যদি বামদিকের উইন্ডোসীট থেকে নীচে তাকান তবে এতক্ষণ উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত যমুনা নদী দেখতে পেয়েছেন আর এর কয়েক মিনিট পরেই ডানদিকের জানলা দিয়ে পন্ঠাসাহিবের কাছে যমুনার বিশাল বিস্তার আপনার চোখে পড়বে। চন্ডিগড়কে বাঁদিকে এবং দেরাদুনকে ডাইনে রেখে আপনার বিমান যাবে আরো উত্তরে, বিমান প্রায় দশ কিলোমিটার উঁচু দিয়ে চলছে বলে ডানদিকে দেড়শ কিলোমিটার দূরে দেখতে পাবেন এই অঞ্চলের সর্বোচ্চ শিখর, সাড়ে সাত কিলোমিটার উচ্চতার নন্দাদেবী। এরপর বাঁদিকে পড়বে সিমলা, নীচে পেরিয়ে যাবে নারকান্দা। আকাশ পরিষ্কার থাকলে এর পরেই পরিষ্কার দেখতে পাবেন উত্তরপূর্ব থেকে দক্ষিণপশ্চিমে বিস্তৃত শতদ্রু নদীর উপত্যকা।
এরপর থেকেই নীচের কালচে সবুজ এবং বাদামী রং বদলে যাবে বরফ ঢাকা পাহাড়ে। ডানদিকে পড়বে পিন ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক আর বাঁদিকে পেরিয়ে যাবেন কুলুর উত্তরপূর্বে পার্বতী নদীর উপত্যকা। বাঁদিকে দেখতে পেতে পারেন জরি, কাসোল, মালানা, মণিকরণ, তোষ… আর এর পরেই ডানদিকে আপনি এক নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে পাবেন – দেখবেন ডানদিক থেকে তিনটে পৃথক হিমবাহের ধারা একসঙ্গে এসে মিশে উত্তরপশ্চিমে চলে গেছে। মধ্যবর্তী হিমবাহটির উজানে তাকালে দেখতে পাবেন বিখ্যাত পার্বতী পর্বত যার দক্ষিণপশ্চিম দিক থেকে পার্বতী হিমবাহ নেমে এসে পার্বতী নদী সৃষ্টি হয়েছে। এই পার্বতী নদীই কুটলা গ্লেসিয়ার পয়েন্ট পেরিয়ে তোষ হয়ে মণিকরণে এসেছে, তার পর কুলুতে বিপাশা নদীতে গিয়ে মিশেছে।
আপনি যে তিনটে হিমবাহের সঙ্গম দেখেছিলেন সেটা বড়া সিগরি হিমবাহ – এই হিমবাহ থেকে বেরনো জলধারা লাহুল ভ্যালিতে চন্দ্রতাল থেকে তৈরি হওয়া চন্দ্রনদীতে এসে পড়েছে, এরপর কিছুটা পশ্চিমে গিয়ে টান্ডিতে দারচা থেকে আসা ভাগ নদীর সঙ্গে মিশে চন্দ্রভাগা নদী হয়ে বয়ে যাবে আরো পশ্চিমে কিস্তোয়ারের দিকে।
এদিকে আপনার বিমান বড়া সিগরি হিমবাহ পেরিয়ে উত্তর পশ্চিম দিকে চলেছে। নীচে পেরিয়ে যাবেন চন্দ্রনদীর উপত্যকা। যদি আকাশ পরিষ্কার থাকে, তবে ম্যাপ মিলিয়ে আকাশ থেকে চন্দ্রতালের একঝলক দেখতে পাবেন, আর চন্দ্রতাল দেখতে না পেলেও বিমানের ঠিক নীচে বিষ্ণু হ্রদ বেশি ভাল করে দেখতে পাওয়া উচিত। তবে বিমানের নির্দিষ্ট রুট থাকলেও আবহাওয়া এবং বায়ুপ্রবাহের গতি অনুযায়ী বিমানের পথ একটু এদিক ওদিক হয়, সেক্ষেত্রে নিচের দৃশ্যাবলীর বদল হতে পারে।
এর পরে আপনার বিমান কিছুক্ষণ সামান্য উত্তরপূর্বে চলবে, আপনি পেরিয়ে যাবেন গ্রেট হিমালয়ান রেঞ্জ। নীচে পড়ে থাকবে এই রেঞ্জের বড়ালাচালা আর জানস্কার রেঞ্জের লাচুলুংলা। এই দুই পর্বতশ্রেণীর মাঝে সারচু থেকে বামদিকে উত্তর পশ্চিমে সরাপ-ছু নদীকে বয়ে যেতে দেখবেন। ঘুরে ফিরে ফুকতাল গোম্পা হয়ে পুর্ণে-তে গিয়ে এই নদীরই নাম হয়েছে লুংনাক ছু আর তারপর পাদুম-এ স্তোদ নদীর সঙ্গে মিশে হয়েছে জানস্কার নদ। বিমান আর একটু এগোলে ডানদিকে দেখতে পাবেন নীল জলের লম্বা হ্রদ ৎসোমোরিরি আর তার উত্তরে ছোট্ট ফোঁটার মত ক্যাগার ৎসো। ৎসো মোরিরির পশ্চিমে দিকে দেখতে পাবেন ৎসো কার আর তার দক্ষিণে অপেক্ষাকৃত ছোট আর একটা লেক স্টারৎসাপুকৎসো। ৎসোকারের উত্তরে সাদা রঙের বিস্তীর্ণ বেলাভূমি। লাদাখী ভাষায় কার মানে সাদা, ৎসো মানে হ্রদ। সাদা বেলাভূমির হ্রদ বলেই এর এমন নাম। এই বেলাভূমি আসলে যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত পার্বত্য লবণের এক বিশাল ভাণ্ডার। স্মরণাতীত কাল ধরেই এই বেলাভূমির লবণ পশ্চিম তিব্বতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের লোকেদের খাদ্যলবণের চাহিদা মিটিয়েছে। এই লবণ বিবিধ খনিজসমৃদ্ধ এবং রক্তচাপ বাড়ায় না – বহুজাতিকগুলি এই লবণের গায়েই সর্বরোগহর ‘হিমালয়ান পিঙ্ক সল্ট’ নাম দিয়ে বাজারে বিক্রি করে।