কাগজের নৌকো। পর্ব ১৫। ধারাবাহিক উপন্যাস। লিখছেন সায়ন্তন ঠাকুর
একটি গ্রাম্য হাটের পাশ দিয়ে চলেছে গাড়ি, কামাল সাহেব ভালোই বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন, চালক ছেলেটির বয়স খুব বেশি হলে বছর ত্রিশেক হবে, পরেশ দাস, জন্মসূত্রে বাঙালি হলেও দীর্ঘদিন এই যশিপুরের বাসিন্দা, সিমলিপাল অভয়ারণ্যের পথঘাট সব কিছুই তার নখদর্পণে। গাড়িটি অবশ্য তেমন ভালো কিছু নয়, পুরনো দিনের ফোর হুইল লেফট-হ্যান্ড ড্রাইভ জিপ, ডানদিকে পরেশের পাশে বসেছে অবিনাশ, পেছনে প্রায় কুড়ি লিটার জলের ড্রাম, চাল-ডাল-তেল-মশলা-লবণ, আলু, পেঁয়াজ, আদা-রসুন, কাঁচালঙ্কা, বনদপ্তরের আপিসের বাগান থেকে পাড়া একটা বড়ো পেঁপে সবকিছুই গুছিয়ে রাখা, চহালার চিতল ভিলায় চৌকিদার থাকলেও রান্নার কাঁচা সরঞ্জাম না নিয়ে গেলে দুবেলা খাওয়া জোটে না, তাছাড়া বাংলোর হাতায় পাতকুয়োর জলও নাকি অত্যন্ত খারাপ, কামাল বলছিলেন, টানা দু-তিন খেলে পেট খারাপ কেউ ঠেকাতে পারবে না, তাই সঙ্গে করে এইসব লটবহর নিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনও উপায় নাই! অবিনাশ জিপগাড়ির খোলা জানলা দিয়ে হাটের দিকে ইশারা করে পরেশকে বলল, ‘বেশ বড়ো হাট বসেছে তো!’
রাস্তা বড়োই খারাপ, উঁচু নিচু, ধুলামলিন পাথুরে পথে শক্ত হাতে জিপের স্টিয়ারিঙ ধরে সামনে থেকে চোখ না-সরিয়ে পরেশ উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ, এরপর আর দোকান বাজার কিছুই নেই। এখান থেকেই কিছু সামান নিতে হবে।’
বিস্মিত কণ্ঠে অবিনাশ শুধোল, ‘আবার কী কিনবেন?’
মৃদু হাসল পরেশ, ‘মোরগা আর মউল!’
দুপাশে ঝিলিমিলি অরণ্যের ইশারা স্পষ্ট, সকাল এখনও ফুরোয়নি, বেলা প্রায় দশটা কিন্তু এর মধ্যেই চৈত্র চরাচর ডাইনির রুক্ষ কেশরাজির মতো হয়ে উঠেছে, দূরে কৃষ্ণবর্ণ শৈলরাজি বিবর্ণ আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে নির্বিকার দাঁড়িয়ে রয়েছে–ঠিক আমাদের দেশ-গাঁয়ের ধুলিবসন রমতা সাধু; সারি সারি মহুয়া গাছের মাঝে একখানি প্রশস্ত জমির উপর হাট বসেছে, বামদিকে জোড়া কুসুম গাছ যেন এই নিরাভরণ হাটের একমাত্র অলঙ্কার, তাদের একপলক দেখে অবিনাশের মনে হল, একমুঠি লোহিতকণিকা কেউ রক্তস্রোত থেকে তুলে বৃক্ষের সর্বাঙ্গে বিছিয়ে দিয়েছে, ওদিকে মহুয়াবনও নূতন কুসুমভারে অপরূপ, যেন রঙ-থইথই বনভূমি অলীক শ্যামাঙ্গীর সঙ্গে গোপন হোরিখেলায় মেতে উঠেছে।
পথ থেমে নেমে হাটের একপাশে জিপগাড়ি থামিয়ে অবিনাশের মুদ্ধ দৃষ্টির পানে চেয়ে পরেশ জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কি হাট দেখতে যাবেন?’
–হ্যাঁ! এ কী! এই হাট না দেখলে তো সারাজীবন আপশোষ রয়ে যাবে!
হাসল পরেশ, গাড়ির পেছনের সিট থেকে একটি পাঁচ লিটারের শূন্য জ্যারিকেন বের করে দরজা লক করে বলল, ‘তাহলে আমার সঙ্গে আসুন! খুব বেশিক্ষণ থাকা যাবে না, চহ্বলা পৌঁছাতে নাহলে সন্ধে হয়ে যাবে।’
হাট দেখে প্রথমে বিস্মিত হল অবিনাশ, কত দোকান, চাল-ডাল-সবজি-মশলা কী আছে আর নাই তা বলা মুশকিল, এ যেন এক সব পেয়েছির আসর, একদিকে মেয়েদের অলঙ্কারের দোকানে উথলে উঠেছে ভিড়, মহুয়ার তেলে টান করে চুল বেঁধে, পরিষ্কার সাদা শাড়ি পরে যুবতির সে কী কলকল কথা–একদল মৌটুসী পাখি যেন নিজেদের মধ্যে কিচিরমিচির করে চলেছে, অদূরে শাড়ির দোকানেও জোর কদমে দরদাম শুরু হয়েছে তবে পরেশের সঙ্গে পায়ে পায়ে হাটের শেষপ্রান্তে পৌঁছে অবিনাশের বাক্যিহারা দশা হল; এদিকে যৌবনবতী কুসুম গাছের তলায় মেয়েরা এনামেলের হাঁড়িতে মহুয়া আর হাঁড়িয়া নিয়ে বসেছে, পাশে বিড়িবড়া, পাঁপড় ভাজা চলছে, কেউ আবার কাঁচা শালপাতায় পিঁপড়ের ডিমের চাটনি খরিদ্দারের হাতে তুলে দিচ্ছে, আশ্চর্যের বিষয় হল, চৈত্রের খর রৌদ্রতলে গাছ-গাছালির ছায়ায় এই অবারিত পানশালার অধিকাংশ দোকানিই যুবতি অথচ কোথাও কোনও খারাপ ব্যবহার নাই, হট্টগোল নাই, লোকে হাট-বাজার সাঙ্গ করে এসে শান্ত বালকের মতো শালপাতার দোনায় তাজা মহুয়া কি হাঁড়িয়া খেয়ে আপনমনে উঠে যাচ্ছে! দূরে পটচিত্রের মতো শৈলরাজি, এলোঝেলো উন্মনা মধুবাতাসে ঝিমঝিম ছায়া বিছিয়ে দিয়েছে প্রাচীন কুসুম গাছ, প্রসাধনহীন ধুলিচরাচর প্রেমে পড়া কিশোরীর মতোই আপন ভুবনে বিভোর, আনন্দ হাটে থিরথির করে কাঁপছে এই জগত–অবিনাশ প্রথমবার অরণ্য সুবাসে নিজেকে সামলাতে না পেরে নিচু গলায় পরেশকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আমি বসব একটু?’
পরেশ দু-এক মুহূর্ত অবিনাশের পানে চেয়ে মৃদু হেসে বলল, ‘বসুন! তবে বেশি দেরী করবেন না। আমি জোড়া মুরগা কিনে এখানেই ফিরে আসছি।’
টাকায় বড়ো এক দোনা মহুয়া, পাশের দোকানে দশটা বিড়িবড়ার দামও ওই একটাকা, পকেট থেকে দু টাকা বের করে জীবনে প্রথম মহুয়ায় চুমুক দিল অবিনাশ–বাহ! বেশ খেতে তো, টলটলে জলের মতো, কার্তিকের সন্ধ্যায় দূর থেকে ভেসে আসা ছাতিম সুবাসের মতো অশরীরী এক গন্ধ লেগে রয়েছে…আরও একবার, দুইবার, তিনবার নিল, সামনে জলমোছা হলুদ শাড়ি পরে উবু হয়ে বসা যুবতি দারিয়ানি অবিনাশকে দেখে খিলখিল হাসছে, আরেকবার দোনা চাইতে চিবুকের ডৌলে ঢেউ তুলে অপরূপ ভ্রুভঙ্গি করে অবিনাশকে বলল, ‘আর না খাউন্তু, বেশি পিইবাকু ভালা না অছি!’
ঝাল বিড়িবড়া মুখে দিয়ে কিছু না বলে অবিনাশ এক টাকার কয়েন পকেট থেকে বের করে যুবতির সামনে রেখে হাতের দোনাটি বাড়িয়ে দিল, মুখে কুসুম কুসুম হাসি, জল ছাড়া মহুয়া অর্থাৎ কিনা নিজান তখন মাথার ভেতর দ্রিমিদ্রিমি মাদল-ঢেউ তুলেছে, ঝলসানো চৈত্র-বাতাস তেমন আর গায়ে লাগছে না, মনে মনে নিজেকেই জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, ওই যে ফার্স্ট ইয়ার, খুব ভালো বায়োকেমিস্ট্রি জানে, কী যেন নাম মেয়েটার? লম্বা চুল, নাকে ফিনফিনে নথ আর পাতলা গড়ন!’
জিপের জানলা দিয়ে ভেসে আসা ধু ধু বাতাসে চোখ লেগে এসেছিল অবিনাশের, ঘাটির পথ এখন চড়াই, জিপের চাকার লাল ধুলায় আচ্ছন্ন চারপাশ, দুপাশে দ্বিপ্রহরের ঝিম-ধরা অরণ্য, শীর্ণ পথের বামদিকে গোপন আহ্বানের মতো অতল খাদ, খর আতপে জগত কেমন যেন নিঝুমগড় হয়ে উঠেছে, মাঝে মাঝে ময়ূর কি ঢ্বাং ঢ্বান শব্দে শম্বরের ডাক ভেসে এলেই চোখ খুলে উঠে বসে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে পরেশের দিকে তাকাচ্ছে অবিনাশ, পরেশ স্টিয়ারিঙে হাত রেখে মুখ ফিরিয়ে বলছে, ‘ভয় নেই, ওটা ময়ূর!’, আবার কখনও হেসে আশ্বস্ত করছে, ‘আরে ও তো শম্বর!’
শাল আর মহুয়া গাছের মিছিল পথের দুদিকে, মাঝে মাঝে বুনো কুল, গামহার, খয়ের, অর্জুন, শিমুল চোখে পড়ছে, কোথাও কোথাও শুধুই রক্ত-উৎসব মুখর কুসুম গাছ, অবিনাশের মনে পড়ল, কলকাতার ব্রিগেডে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সভা থাকলে এমনই লাল হয়ে যায় পথঘাট, তবে কমিউনিস্টদের পতাকা কুসুম গাছের মতো এত মায়াচ্ছন্ন তো নয়! পাহাড়ি পথ এখন নিচু হয়ে নামছে সমতলে, সহসা বিস্ময়াভিভূত অবিনাশ দেখল, ডানদিকে ভয়াল খাদের ওপারে একটি পাহাড় থেকে শ্বেতকায় গজরাজের মতো রাজকীয় ভঙ্গিমায় নেমে আসছে জলপ্রপাত, সঙ্গে বাতাসে ডাক তুলেছে গুমগুম মেঘস্বর, পরেশ গাড়ি থামিয়ে সেদিকে ইশারা করে বলল, ‘ওই যে বরেহিপানি ফল্স আর একটু এগোলেই বরেহিপানি বাংলো!’, তারপর এক মুহূর্ত থেমে চারপাশ ভালো করে দেখে নিচু স্বরে বলল, ‘বিকেল হলেই এখানে পাল পাল হাতি আসে!’
দিগন্তপ্রসারী থমথমে অরণ্য, অস্ত অপরাহ্নের আকাশ ভাঙা আলো, মহুয়া ফুলের উথালিপাতালি সুবাস আর প্রেমিকার আহ্বানের মতো শীর্ণা সুঁড়িপথ পার হয়ে বহু চড়াই-উৎরাই, ঘাটির পথ বেয়ে যখন চাহালা বনবাঙলোর পরিখার সামনে এসে পরেশের গাড়ি দাঁড়াল তখন ক্লান্ত দিনমণি তাঁর গেরুয়া উত্তরীয়খানি দিনান্তের আকাশে বিছিয়ে সাত ঘোড়ার রথে পশ্চিমপথগামী, অরণ্য থেকে ভেসে আসছে পাখ-পাখালির ঘরে ফেরার কোলাহল, মধু বাতাসে সকল উষ্ণতা মুছে গেছে, অলীক আলোয় ভরে উঠেছে জগত উঠান, জিপগাড়ি দুবার ভোঁ দিতেই বাংলো থেকে ছুটে এল একজন মাঝবয়সী লোক, পরনে সবজে জামা আর পাৎলুন, সম্ভবত পরেশের পূর্বপরিচিত, একগাল হেসে বলল, ‘আইয়ে! ম্যয়নে সোচা থা আপকো আনে মে সাম হো যায়েগা!’
বাংলোটি আয়তনে যথেষ্ট বড়ো, কাঠের জোড়সাঁকোর উপর দিয়ে পরিখা পার হয়ে হাতা, ঝলমলে ইউক্যালিপটাস আর রাধাচূড়া গাছে সাজানো, বামদিকে বনদপ্তরের আপিস, কর্মিদের সবুজ টিনের চালের বনাবাস, সামনে একখানি ঢালু চালের একতলা বাংলো আর তার পাশেই চিতল ভিলা! ডানদিকে একপেয়ে ওয়াচ-টাওয়ার, অদূরে গাছপালায় ঘেরা একখানি ছোট মাঠের মতো ঘাসি জমির উপর নুনী, তারপর দৃষ্টিপ্রসারী ছমছম অরণ্য–অস্ত আলোয় গাছগুলিকে আলাদা করে এখন চেনা যাচ্ছে না, একদল মানুষ যেন আবছা আঁধার-চাদরে আত্মগোপন করে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাদের মাথায় আলোর মুকুট, একটি প্রকাণ্ড ধনেশ বাংলোর পেছনে শিমুল গাছ থেকে উড়ে নুনীর দিকে পাখা মেলে চলে গেল, ঠিক তখনই অনেকটা কুকুরের আর্তনাদের মতো কোটরা হরিণের ডাকে বনবাংলো চমকে উঠতেই অবিনাশের কেন জানে না মনে হল, ময়ূরভঞ্জের রাজাদের এই শিকার-বাড়ি অতীতের বহু অশ্রুত আখ্যান নিজের অন্তরমহলে এখনও সযত্নে জমিয়ে রেখেছে!
(ক্রমশ)