বিবেকচাঁদ লিখিতেছেন– পরিবেশক ও ছোটো প্রকাশনা
আমি ভাবিতেছিলাম–
গত এক দশকে বইপাড়ার অভিমুখগত অজস্র পরিবর্তনের মধ্যে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন অবশ্যই ছোটো পত্রিকা ও প্রকাশনার বিপণন ব্যবস্থায় আসা বেশ কিছুটা পরিবর্তন। আজ থেকে দশ বছর আগেও পত্রিকার জন্য ছিল শুধুমাত্র পাতিরাম বুকস্টল। যাঁহারা ছোটো প্রকাশনা করিতেন, অধিকাংশ সময়েই বই ছাপার আগে কোনো এক প্রতিষ্ঠিত প্রকাশককে ধরে করে পরিবেশক হিসেবে ঠিক করে তারপর বই প্রেসে দিতেন, তার পরের কাহিনী দু-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে আদৌ আশাপ্রদ ছিল না। সে বই বিক্রি করায় না থাকত পরিবেশকের গরজ, না থাকত পরিবেশকের তরফে পেশাদার ব্যবহার। কলেজস্ট্রীট বা বইপাড়া বলতে নস্টালজিয়ায় চলে এসেছে যে, বইপাড়া মানে কফিহাউস, বইপাড়া মানে হৈ হৈ, এর অপর প্রান্তের সত্যি সম্বন্ধে নিন্দুকেরা যা বলে থাকেন, তা অবশ্য কহতব্য নয়। তাঁহারা বলেন, সবই নিজেদের পরিচিতি-বাড়ানোর ধান্দা, একটু একটু করে প্রতিষ্ঠানের কাছে ঘেঁষা, কেননা কফি হাউসে এমন বহু লোকই পায়ের ধুলো দিয়ে থাকেন, যাহাদের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের দহরম-মহরম। সে-সব করতে না-পারা মানুষদের কাছে বইপাড়া কতটা নস্টালজিয়া, তা নিয়ে নিন্দুকেরা রীতিমত সন্দিহান। বরং তাদের কাছে একখানা বিকল্প অভিমতও উঠে আসে, বইয়ের ভাষা বাংলা, শুধু যদি পশ্চিমবঙ্গের কথাও ভাবা যায়, তাহলে এত বড় বাংলা ভাষাভাষীদের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে প্রকাশনা করতে গেলে কলকাতার বইপাড়ার কাছে এসেই বা ভিক্ষুকের হাত বাড়াতে হইবে কেন? এ কেন-র উত্তর নাই জেনেও তাঁহারা করে থাকেন। এখন অপর পক্ষের কেহ বলিতেই পারেন, চিরকালই প্রতিষ্ঠানের ছায়ায়ই লেখা-পত্র হইয়াছে, কৃত্তিবাসকেও রাজ-দরবারে যাইতে হইয়াছিল বলিয়া কথিত, আর যাহা পুরাতন ক্লাসিক, সবই তো রাজ-পৃষ্ঠপোষকতাতেই তো সৃষ্ট।
তা সেসব নিন্দুক চিরকালই ছিল, নিন্দুকদের বাদানুবাদও চিরকালই ছিল, চিরকালই থাকবে। আসল কথা হইলো ইহাই যে, এইভাবে পরিবেশক খুঁজে বই ছাপতে গিয়ে কত মফস্বলীয় লোক যে ভিটে-মাটি-চাঁটি করে ফেলেছেন– তাহার গল্প করিতে বসিলে মহাভারত হইয়া যাইবে।
আশার কথা ইহাই যে, গত এক দশকে কয়েকটি বাংলা বইয়ের বিকল্প ঠেক জন্মিয়াছে কলেজস্ট্রীটে ও কলকাতার বাহিরেও। বইপাড়ার ভূগোলেও তাহাতে কিছু মজা আসিয়াছে। যেমন পাতিরাম হইয়া কলেজ রো, বেনিয়াটোলা লেন, নবীন কুণ্ডু লেন যে বইপাড়ার ঠাঁইহীন প্রকাশকের বইয়ের প্রাপ্তিস্থান ছিল, সেই ভূগোল পরিবর্তিত হইয়া আসিয়া পড়িয়াছে কলেজ স্কয়ার চত্বরে নবীন কুণ্ডু লেন ও সূর্য সেন স্ট্রীটে। তাহার পর মালদা, কৃষ্ণনগর, সোদপুর–সব জায়গায় তৈরী হইয়াছে বিকল্প বইপড়ার ঠেক। তাহারা সবাই মিলিয়া নতুন প্রকাশনা-ছোটো পত্রিকাকে আশ্রয় দিতেছেন।
হঠাৎ বিবেকচাঁদ বলিয়া উঠিল, ”কী বলিলেন? আশ্রয় দিতেছন? তাহা একপক্ষে সত্য বটে, তবে তাহাও গোষ্ঠতন্ত্র! কাহাকে রাখিবেন ও প্রোমোশান করিবেন-এর থেকেও কাহাকে ঘরে স্থান দিয়াও দুয়োরানীর মতো উপেক্ষা করিবনে—ইহাই আসল!” সত্যই আজ একটি পত্রিকা উল্টাইতে উল্টাইতে নজরে পড়িয়াছিল যে, কেহ একজন প্রতিষ্ঠানেরই বিরুদ্ধে ‘পাল্টা প্রতিষ্ঠান’ দিয়াছেন– পড়িয়া ও শুনিয়া কথাখানার দাপটে রক্ত-গরম হইয়া উঠিয়াছিল। তাহার পর ডাবের সরবৎ সেবন করিয়া রক্তচাপ নিম্নগামী হইবার পর মনে হইল, ইহা কী পদার্থ বটেক! এই যে একখানা ভয়ঙ্কর রকমের ইতিবাচক কথাবার্তাকে এই পাঁকে আনিয়া ফেলিল, এই হেতুই আমি বিবেকচাঁদকে সহ্য করিতে পারি না, উহার মতো বেরসিক ও লোকের ভালো দেখিতে না-পারা লোক আমি আর দুটো দেখি নাই।