সৌভাগ্যশলাকা। ধারাবাহিক উপন্যাস। পর্ব ৯। লিখছেন অলোক সান্যাল

ইঁদুরের কল
…………………
অ্যাবের এই অংশে এলিন আগেও বার দুয়েক এসেছে। সামিরার সঙ্গে। তখন অবশ্য জনা কয়েক দর্শনার্থী ছিল। এখন কেউ নেই। বন্ধ দরজার বাইরে ‘কাজ চলছে’ বোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়া। তাই হুট করে কেউ ঢুকে পড়ার সম্ভাবনাও নেই। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে বিশেষ ধরনের জেমস স্টোনে নির্মিত ভাস, পরে যার পা এবং গলায় সোনার বেষ্টনী পরানো হয়েছিল, সেটাই সম্ভবত সেন্ট-মরিস ডা’আগাউনম চার্চের সবচেয়ে প্রাচীন সংগ্রহ। সেন্ট সিগিসমেন্ডের বিখ্যাত শ্রাইন, বেলজিক গলে বসবাসকারী মেরোভিনঞ্জিয়ানদের একটা দুর্মূল্য কাসকেট, আরও অনেক প্রাচীন ইতিহাসের অবশিষ্টাংশে ভরা এই সংগ্রহশালা। এবং সময়ের অজস্র দলিলের মাঝে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো সামিরা টিসডেলের উপস্থিতি। হয়তো এতসব আকর্ষণ পেরিয়ে এলিনের সন্ধানী নজর ভূ-গর্ভস্থ কোষাগারের দেয়ালে আলাদা কোনো প্রবেশপথ খুঁজে পায়নি। তবে একথাও ঠিক, যেভাবে আলো এবং অন্ধকারকে এই লম্বাটে ঘরটায় ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে দেয়ালে তৈরি বিশেষ ব্যবস্থা এড়িয়ে যাওয়া স্বাভাবিক।
‘দেয়ালের এই গুপ্ত পথ কিন্তু একেবারে শুরুর দিকের।’
সামিরার কথায় অবাক হলো দুই ভাইবোন।
‘বার্গান্ডিদের রাজা সিগিসমেন্ডের তৈরি!’
এমার কথায় হেসে জবাব দিল সামিরা, ‘রাজার অর্থানুকূল্যে ঠিকই, তবে এই বিশেষ ব্যবস্থার কথা সম্ভবত তিনিও জানতেন না। এমনকি তৎকালীন অ্যাবট মোস্ট রেভারেন্ড জিন সিজার স্কারসেলা এই গুপ্ত পথের অস্তিত্বের কথা জানলেও, ঠিক কোন উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল, সে সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিলেন।’
কথা বলার সঙ্গে হাত দুটো সচল রেখেছিল সামিরা। একেবারে শেষ মাথায় ডিসপ্লে কেসের সঙ্গে যুক্ত সিকিউরিটি প্যানেলে নির্দিষ্ট সংখ্যাগুলো পরপর দিতেই অতিস্বচ্ছ পুরু কাচের পাল্লা খুলে গেল। অপলকে চেয়ে ছিল এলিন। একটা প্রাচীন রোমান ড্যাগার স্ট্যান্ডে দাঁড় করানো। সামিরা নির্দ্বিধায় সেটা বের করে নিয়ে এল! তার হতবাক অবস্থা দেখে হেসে ফেলল সামিরা।
‘ঘাবড়াবেন না মশাই। এটা বর্তমান শতাব্দীর সাধারণ একটা ছুরি। মোড়কের ওপরে মোড়ক বোঝেন? এটা সেই দ্বিতীয় মোড়কের চাবি।’
ডিসপ্লে কেসের পেছনের দেয়ালে জ্বলজ্বল করছে একটা অতি পরিচিত বাক্য। প্রভুর দুনিয়ায় সকলকে স্বাগত। বাক্যের ঠিক শেষে ইস্পাতের ফলা নিখুঁতভাবে ঢুকিয়ে দিল সামিরা। দেয়ালের গায়ে সেই ছিদ্রপথ এতটাই সঙ্কীর্ণ যে খালি চোখে দেখা অসম্ভব প্রায়। আলোর কারসাজির কারণ বুঝতে এলিনের অসুবিধা হলো না। চাবির মুখ আড়াল করতে এদিকটায় আলোর পরিমাণ ইচ্ছাকৃতভাবেই কম রাখা। যে কথাটা তার মাথায় ঢুকছে না তা হলো, অ্যাবের এই গুপ্ত পথকে নতুন করে গোপনীয়তার মোড়ক পরানোর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে? সামিরা যেভাবে কোনোরকম প্রচেষ্টা ছাড়াই ছুরিটা ব্যবহার করল, বোঝা যাচ্ছে এতে সে অভ্যস্ত। অস্বাভাবিক নয়। এই সংগ্রহশালার রক্ষক হিসেবে খুঁটিনাটি তার জানারই কথা। উদ্দেশ্য জানে কি? প্রশ্নটা করার আগেই মৃদু শব্দে দেয়ালের একটা অংশ সরে গিয়ে ভেতরের প্রাচীন গাঁথনিকে উন্মুক্ত করে দিল।
‘আসুন। আপনাদের আগে খুব কম জনই এই পথ ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছে।’
বলে গাঁথনির একপাশে জোরে চাপ দিল সামিরা। নিজেকে প্রকাশের ব্যগ্রতায় চার্চের সহস্রাব্দ বয়সি স্থাপনা এবার কিঞ্চিৎ বেশি শব্দ তৈরি করল। ফাঁকটা বড়ো নয়, তবে ভুঁড়ি মাটিতে লুটিয়ে পড়া একজন মানুষও কষ্টেসৃষ্টে দিব্যি গলে যেতে পারে। প্রথমে সামিরা, তারপর এমা, দ্রুত চোখের আড়াল হতে এলিনও নড়ে উঠল।
‘আমরা গির্জার এপস্-এর ঠিক নিচে রয়েছি, না?’
এমার প্রশ্নে ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলল সামিরা। যদিও তা কেউ-ই দেখতে পেল না। চোখের সামনে শুধু একটাই রং- কালো।
‘চার্চের এই ক্রিপ্টগুলো চতুর্থ থেকে অষ্টম শতাব্দীর মধ্যে তৈরি করা হয়েছিল। এই অংশটা অবশ্য একেবারে প্রথম দিকের।’
অন্ধকার ফুঁড়ে ছুঁড়ে দেওয়া কথাগুলো অনুসরণ করতে চাইল এলিন। পারল না। অবশ্য একটু পরেই খিলানের পেছনে মৃদু আলো ফুটে উঠল। একটা হাত বাতি নিয়ে আড়াল থেকে বেরিয়ে এল সামিরা। অদ্ভুত গড়নের বাতির আলো তার শরীরের নিম্নাংশকে যতটা ভেজাতে পেরেছে, বুক থেকে বাকি অংশকে ততটা পারেনি। সামিরার ছায়া ছায়া মুখ এলিনের মনে কৌতূহলের পারদকে আরও চড়িয়ে দিচ্ছে। সে আর এবার নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারল না।
‘সামিরা, আপনি বলছিলেন এই পথে খুব কম মানুষ আসার সুযোগ পেয়েছে। ভাগ্যবানদের তালিকা এতো ছোটো হওয়ার কি বিশেষ কোনো কারণ আছে? মানে, এই গুপ্ত ব্যবস্থাকে এতগুলো বছর ধরে টিকিয়ে রাখার কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য?’
‘হয়তো আছে। এক্ষেত্রে প্রশ্নের উত্তর আপনাকে নিজেই খুঁজে নিতে হবে এলিন।’
ধোঁয়াটে পরিস্থিতিতে এক মুঠো ধুনো ফেলে তাকে আরও অস্বচ্ছ করে তুলল সামিরা।
‘আমার মনে হয় ড. মিলারের সবার আগে লিপিগুলো দেখা উচিৎ।’
চারপাশে অজস্র প্রশ্ন ছড়িয়ে থাকলেও এমার সমস্ত সত্তা সময়ের চোরাবালিতে আটকে। অ্যাবের এই ভূ-গর্ভস্থ অংশ প্রাচীনত্বের গন্ধ এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে! বুক ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল সে। ইতিহাসের গন্ধ! তার কাছে এর চেয়ে বড়ো নেশা পৃথিবীতে নেই।
‘লিপিগুলো কোথায়?’ ব্যগ্রতা ঝরে পড়ল এমার কণ্ঠে।
‘এদিকে। আসুন।’
‘ডেক্সট্রোভার্স। অক্ষরগুলো বাঁদিক থেকে ডান দিকে লেখা! একেবারে শেষে একটা বিন্দু? না না বিন্দু নয়, সূর্যের মতো কোনো চিহ্ন। অক্ষরগুলো গ্রিক ধাঁচের, তবে গ্রিক নয়। প্রথম শব্দে যেমন- ডেল্টা এবং গামার মাঝে অক্ষরটা, এপসাইলন নয়। আবার তার পরের দুটো রো এবং কাপা।’
যেন দু’পাশে দুই শিক্ষার্থীকে পাঠ দিচ্ছে এমা। পাথরের শরীর কেটে বানানো অদ্ভুত আঁকাবাঁকা ছবিগুলো এলিনের কাছে সম্পূর্ণ অজানা। ফ্রিজিয়ান তো আলোকবর্ষ দূরের কথা, গ্রিক অক্ষরের সঙ্গেই তার পরিচিতি নেই। তবুও অদৃশ্য কোনো কারণে তার চোখ আটকে রয়েছে পাথরের দেয়ালে।
‘ল্যাম্বডা উলটো করে লেখা, নাকি এটা ল্যাম্বডা নয়? নাহ্, বাকি অক্ষরগুলো আপারকেস ফর্মে রয়েছে যখন…। ধুস্, ফ্রিজিয়ান ভাষা নিয়ে কেন যে চর্চা করিনি!’
আফসোসে নিজের উরুতেই চাপড় মেরে বসল এমা।
‘তারমানে এগুলো কী লেখা তুই বুঝতে পারছিস না!’
প্রশ্নের চটজলদি কোনো উত্তর পেল না এলিন। তার বোনের হয়ে সাফাই গাইল সামিরা।
‘ড. মিলারকে দোষ দিয়ে লাভ নেই এলিন। রোমান যুগে এই ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিংবা বলা যায় গ্রিক ভাষায় মিশে গেছে। ফ্রিজিয়ান ভাষায় লেখা খুব কম লিপি এখনো পর্যন্ত আবিষ্কার হয়েছে। সব অক্ষর বোঝা গেছে তাও নয়। কিছুটা অনুমান করে নেওয়া৷’
সামিরার কথার সূত্র ধরেই এমা বলে উঠল, ‘আমিও কিছুটা অনুমান করেছি।’
তার কথায় উৎসুক হয়ে উঠল এলিন। সামিরাও।
‘জাজ নট লেস্ট ইয়ে বি জাজড।’
‘কোনো মানে হয়! আমি কি তোদের মতো সকাল-বিকাল ইতিহাস গুলে খাওয়া ছাত্র?’
এমা হেসে ফেলল। সামিরাও।
‘ম্যাথুর গসপেল, ৭:১ ভার্স। অনলি গড ক্যান জাজ হোয়াট সামওয়ান ডাস্। এবার দেখা যাক ঈশ্বর আমাদের কীভাবে বিচার করেন।’
কথাটা শেষ করেই এমা শেষের সূর্যকে ডান হাতের তালু দিয়ে ঢেকে ফেলল। বেশি জোর দিতে হলো না তাকে। চাপ পড়তেই প্রথমে পাথরে পাথরে ঠোকা লাগার মতো একটা অস্পষ্ট শব্দ কানে এল সবার। তারপর একটানা সেই শব্দটা চলতেই থাকল। এলিনকে দৃশ্যতঃ হাঁ করে দিয়ে ধীরে ধীরে গম্ভীর শব্দ তুলে পাথরের দেয়াল মাধ্যাকর্ষণ তত্বকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে উঠতে শুরু করল।
‘কার্টন কল!’
মস্তিষ্কের জড়তা কাটিয়ে শুধুমাত্র দুটো শব্দই খরচ করতে পারল এলিন।
‘চল দ্য হোলি লেন্সকে ঘিরে থাকা রহস্যের ওপর থেকে পর্দা ওঠানো যায় কিনা দেখি।’
বলল এমা। পাথুরে পর্দা অবশ্য ফুট দেড়েক উঠেই আবার নিথর হয়ে গেল। মাথা মেঝেতে ঠেকিয়ে ভেতরে নজর ছুঁড়ে দিল এলিন। বৃথাই। নামিয়ে রাখা হাত বাতির আলো ফাঁকা জায়গাটুকু দিয়ে দু-তিন হাতের বেশি এগোতে পারেনি।
‘লেপার্ডস ক্রল করতে হবে।’
মাথা না তুলেই বলল এলিন। আর তখনই শুনতে পেল তার কথাগুলো গমগমে আওয়াজে দূরে গড়িয়ে যাচ্ছে। সামনে একটা লম্বা রাস্তা চলে গেছে। কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সে নিজেকেও একইভাবে ভেতরে গড়িয়ে দিল।
‘আলোটা ঠেলে দিন সামিরা।’
ভেতরের জমাট অন্ধকার যেন এলিনের কণ্ঠস্বর শুষে নিল। প্রথমে বুঝতে না পারলেও হাত বাতি নিতে গিয়ে দেখা গেল পাথরের দেয়ালটা বেশ চওড়া৷
‘তোরা এখানেই দাঁড়া। জায়গাটা নিরাপদ কিনা আগে দেখে নিই। আমি ডাকলে ভেতরে আসবি।’
ওপারে অপেক্ষারত দুই সঙ্গীকে সাবধান করে এলিন হাত বাতিটা ওপরে তুলে ধরল। একটা ঢালু টানেল! কয়েক মিটার এগিয়ে বেঁকে গেছে। পাথরের অমসৃণ ছাদ প্রায় মাথা ছুঁইছুঁই। পাশাপাশি দু’জন হেঁটে যেতে পারে। ভেতরটা অনেক বেশি ঠাণ্ডা। পরনের জ্যাকেট থাকা সত্ত্বেও কাঁপুনি ধরিয়ে দেওয়ার মতো। এলিন এবার গলা উঁচু করে বলে উঠল, ‘ক্লিয়ার।’
প্রথমে সামিরা, তারপর হাঁচড়পাঁচড় করে এমা অন্ধকারের দুনিয়ায় প্রবেশ করল।
‘এবার ফিরে গিয়ে তোর কাছে আর্মির ট্রেনিং নিতে হবে দেখছি!’
‘শুধু বইয়ে মুখ গুঁজে থাকলে এমনই অবস্থা হবে ডিয়ার সিস্টার। সামিরাকে দেখ, কেমন চিতা বাঘের মতো হামা দিতে জানে! আবার এদিকে ইতিহাসও গুলে খেয়েছে।’
যাকে বলল, তার দৃষ্টি তখন বাঁকের মুখে থমকে থাকা আঁধারে আটকে।
‘মনে হচ্ছে পাহাড়ের পেট ফুঁড়ে এই সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছিল। এবার এগিয়ে দেখা যাক ঈশ্বরের ঠিকানা মেলে কিনা।’
এমাদের প্রথমে উতরাই, তারপর চড়াই ভাঙতে হলো। মিনিট দশ-বারো হাঁটল তারা। আঁটোসাটো সুড়ঙ্গ পথ একটা প্রশস্ত গুহায় এসে থেমেছে। এখান থেকে পাশাপাশি কতগুলো মুখ নতুন কোনো গন্তব্যের দিকে হাঁটা দিয়েছে হয়তো। দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে না। মুখগুলো যেন হাঁ করে অন্ধকার বমি করবে বলে মুখিয়ে আছে! দুটো মুখে আবার ইস্পাতের মোটা রড দিয়ে তৈরি দরজা।
‘কয়েদখানা! এখানে তার কী প্রয়োজন?’
প্রশ্নটা এমার মগজে আঁচড় কাটল। বোঝাই যাচ্ছে গুহাটার অবস্থান পাহাড়ের ঢালে। একেবারে মাথায় পাথর কেটে নিখুঁত বৃত্তাকার গর্ত তৈরি করা। লম্বাটে সেই গর্ত দিয়ে কোণাকুণি দৃষ্টি আকাশকে ছুঁতে পারে। এলিন বলল,
‘বাইরে আলো মরে আসছে। এত তাড়াতাড়ি!’
‘দিনের খুব কম সময়ের জন্য সূর্য উপত্যকার এদিকে পা রাখতে পারে।’
সুড়ঙ্গে প্রবেশের পর থেকে সামিরা প্রায় পুরো রাস্তা নিজের উপস্থিতি জাহির করেনি। দুই ভাইবোনও বিস্ময় এবং রোমাঞ্চের আধিক্যে তার উপস্থিতি ভুলেই বসেছিল। এতক্ষণে বুঝি তাদের মনে পড়ল অভিযানে তৃতীয় একজনও আছে।
‘আপনি কি আগেও এই পথ ব্যবহার করেছেন?’
সামিরা এলিনের প্রশ্ন এড়িয়ে গেল।
‘গুহার পাঁচটা মুখ। কোন মুখ নেওয়া উচিত হবে বলুন তো ড. মিলার?’
এমার চোখও হাত বাতির স্বল্প আলোয় গুহার ইতিউতি ঢুঁ মারছিল। দু পা এগিয়ে মাটি থেকে কিছু কুড়িয়ে নিল সে। বাঁ হাতের আঙুলে ধরা জিনিসটা এলিনেরও পরিচিত। এর নেশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে সে। মাঝেমধ্যে ইচ্ছেকে আস্কারা দিতে ধরায়। সিগারেট। এমার আঙুলে ধরা সিগারেটের ফিল্টার। টাটকা!
‘পঞ্চম থেকে অষ্টম শতাব্দীর মধ্যে এই বস্তুটির আবিষ্কার হয়নি নিশ্চয়ই, কী বলেন মিস সামিরা?’
এমার কথা শেষ হওয়া মাত্র দরজা বিহীন গুহার মুখ থেকে জোরালো ফ্লাশলাইট এসে দুই ভাইবোনকে অন্ধ করে দিল।
‘সাবধান এমা।’
আলোর ফলা থেকে বোনকে হাত দিয়ে আড়াল করার ফাঁকে চিৎকার করে উঠল এলিন। মুহুর্তের মধ্যে ছিটকে জায়গা বদলে নিল সে। এমাকেও টেনে নিল পাশে। তারা ফাঁদে পড়েছে! বিপদের আভাস পাওয়া মাত্র জ্যাকেটের মধ্যে হাত গুঁজে দিয়েছিল এলিন। উপযুক্ত কারণ খুঁজে না পেলেও প্রতিদিন বুকের কাছে ঝোলা হোলস্টার থেকে সাহস জুগিয়ে গেছে প্রিয় স্প্রিংফিল্ড এক্স ডি পিস্তল। হাতের তালুতে ধাতব স্পর্শ পাওয়া মাত্র তাকে চমকে দিয়ে অস্বাভাবিক স্বরে চেঁচিয়ে উঠল সামিরা, ‘সাবধান এলিন। আমার দিকে তাকিয়ে দেখুন। ওটা বের করার আগেই আপনার কপালে মৃত্যুর টিকা পরিয়ে দিতে পারি আমি।’
ফ্লাশলাইটের আলো আবার তাদের বেঁধে ফেলেছে। অন্ধকার গুহার গর্ভ ফালা ফালা করে দিচ্ছে। সেই আলোতে এলিন নতুন করে সামিরাকে চিনল। থর থর করে কাঁপতে থাকা মুখ। দুটো পা সামান্য ফাঁক করে দাঁড়িয়ে। পেশাদার আক্রমণের ভঙ্গি। ডান হাতটা সোজা। এতটুকু কাঁপছে না। বাদামি রঙের গলাবন্ধ ম্যাকিনটস কোটের বোতাম এখন ঘর হারা। গলার কাছটায় একটা ট্যাটু আঁকা। সম্ভবত গোলাপের। হাতের মুঠোয় বিষধর সাপের মতো ছোবল মারতে প্রস্তুত সিগ স্যোয়ার পি২২৬। এলিন ধীরে ধীরে সোজা হয়ে দাঁড়াল। এমার হাতের মুঠো তার বাইসেপসকে কামড়ে ধরেছে। বাঁ হাত দিয়ে বোনকে নিজের বুকের কাছে টেনে নিল সে।
‘লক্ষী ছেলের মতো জিনিসটা এদিকে ছুঁড়ে দিন এলিন। চালাকির চেষ্টা বৃথা। শুধু আমার নয়, আরও তিনজনের নিশানায় রয়েছেন আপনারা। এখানে কোনোরকম রক্তারক্তি চাই না।’
অসহায় বোধ করছে এলিন। চাইলেও এখন কোনো হঠকারিতা করতে পারবে না। একা হলে একটা চেষ্টা করে দেখা যেত। কিন্তু এমার প্রাণের বিনিময়ে কোনো ঝুঁকি নিতে পারবে না এলিন। জ্যাকেট থেকে ধীরে ধীরে হাত বের করে প্রিয় সঙ্গীকে সামিরার দিকে ছুঁড়ে দিল সে।
‘ধন্যবাদ এলিন।’
বলে পা দিয়ে পিস্তলটা এক সঙ্গীর দিকে গড়িয়ে দিল সামিরা। বন্ধ একটা দরজা দেখিয়ে ইশারা করতে, বন্দুকধারী সতর্ক পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেল।
‘আর একটু সহযোগিতা করুন প্লিজ।’
খুলে দেওয়া ইস্পাতের দরজার দিকে ইঙ্গিত করে সামিরা বলল।
‘এছাড়া আপনি আমার কাছে আর অন্য রাস্তা খোলা রাখেননি ড. মিলার। আমি দুঃখিত, কিন্তু ঈশ্বরের পবিত্র চিহ্নকে রক্ষা করার জন্য যা করনীয়, আমাদের সে সবই করতে হবে।’
‘দ্য লেন্স অব লংগিনাস কি তবে…’
এমার কথা শেষ করতে দিল না সামিরা।
‘এখানেই আছে। এই সিন্ডে দুর্গে সুরক্ষিত চেম্বারে দেড় হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে আমরা পবিত্র চিহ্নকে রক্ষা করে চলেছি।’
‘মার্জনা করবেন, কিন্তু আপনাকে দেখে তো অতোটাও প্রাচীন বলে মনে হয় না!’
কথার ছলে আরও কিছুটা সময় বের করে নেওয়ার চেষ্টা করল এলিন। কাজটা সে ভালো পারে। এই মুহুর্তে তারা যেখানে দাঁড়িয়ে, ঠিক পেছনেই ফুট দশেক দূরে সুড়ঙ্গ পথ। সংকীর্ণ হওয়ায় দু’জন পাশাপাশি ছোটা মুশকিল। এমার ক্ষিপ্রতা ভরসা যোগ্য নয়। দরকারে সে এমার পেছনে থাকবে। গুলি ছুঁড়বে ওরা? ছুঁড়ুক। বোনের পেছনে ঢাল হয়ে থাকবে সে। কল্পনায় দৃশ্যটা দ্রুত ছকে নিচ্ছে এলিন।
‘এখানে এই মুহুর্তে যাদের দেখছেন এলিন, আমরা প্রত্যেকে বংশপরম্পরায় একটা প্রতিশ্রুতি বহন করছি। পৃথিবীর পাপী নজর থেকে দ্য হোলি লেন্সকে সুরক্ষিত রাখার প্রতিশ্রুতি।’
‘আশ্চর্য!’
তির্যক বিদ্রুপে হেসে উঠল এমা।
‘পাপী নজর থেকে পবিত্র চিহ্নকে বাঁচিয়ে রাখার কথা বলছেন, এদিকে মানুষ খুন করতেও আপনাদের বাধছে না!’
উচ্ছিষ্ট আলোতে সামিরার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠতে দেখল এলিন। তার পরেই কঠিন স্বর ভেসে এল তাদের উদ্দেশে, ‘না ড. মিলার। আমরা শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করি নিজেদের পরিস্কার রাখার। দুর্ভাগ্য যে লুডল্ফ, প্রফেসর বরিস কিংবা আপনার মতো কিছু অত্যুৎসাহী মানুষের বোকামির কারণে না চাইলেও হাতে রক্তের দাগ লেগেই যায়।’
আবেগ চুঁইয়ে পড়ছিল সামিরার কণ্ঠস্বরে। এই প্রথম নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা ভীষণ কঠিন মনে হচ্ছে তার!
‘এলিন, ওহ্ এলিন, তুমি কেন এলে? এই নির্বান্ধব জগতে এতদিন কোনো পিছুটান ছিল না। তুমি এসে শুধু নিজের নয়, আমারও সর্বনাশ করেছ।’
সামিরার বুকের ভেতর কথাগুলো তোলপাড় করছে। চার্চের নির্জন ক্লোয়েস্টারে, ডুবন্ত সূর্যকে সাক্ষী রেখে এলিনের ঠোঁট ছুঁয়েছিল তার কুমারী সত্তাকে। একবার, মাত্র একবার, সেই মুহুর্তে জন্য পৃথিবীর যেন স্থির হয়ে গিয়েছিল! আহ্লাদী ফুলেরা তাদের দোলা থামিয়ে দিয়েছিল। ঘর ফেরা পাখিদের দলটা ডানা ঝাপটানো বন্ধ করে দিয়েছিল। গত সন্ধ্যার সেই মুহুর্তে ফিরে যাচ্ছিল সামিরা, এলিনকে বাঁ পা সামান্য পেছনে নিয়ে যেতে দেখে তৎক্ষনাৎ সে মনের লাগাম টেনে ধরল। হাতের পেশি শক্ত হয়ে উঠল আবার।
‘কথা এবং সময় অনেক খরচ হয়ে গেছে। এবার ঢুকে পড়ুন।’
ভাইয়ের হাতে চাপ বাড়াল এমা। ব্যর্থ প্রতিরোধের রাস্তায় হাঁটা বোকামি। তার চেয়ে এরা আপাতত যা বলছে, চুপচাপ মেনে নেওয়া যাক। সেক্ষেত্রে অন্তত এখনই প্রাণহানির সম্ভাবনা নেই। আর যতক্ষণ বেঁচে থাকবে, বিপদ কাটিয়ে ওঠার সুযোগ পাবে। এই বন্দীনিবাস ভেঙে পালানোর একটা উপায় তারা ঠিক বের করতে পারবে। অতীত তাদের এই শিক্ষাই দিয়েছে।
কেউ দেখে না তাদের
……………………………………..
পাশাপাশি বসে আছে। মাসাদা এবং ব্যাসিলাইডাস। সকালের প্রার্থনা শেষ হয়েছে। কপটিক উপাসনালয়ের সামনে এক ফালি জমি। উর্বর বুকে ধরে রেখেছে বেগুনি সাদা আইরিশ সুন্দরীদের। বাতাসের ডানায় ভর করে তাদের সুগন্ধ ছড়িয়ে দিচ্ছে।
‘অনেকক্ষণ হলো।’ ব্যাসিলাইডাস বলল।
‘মনে হয় না আর অপেক্ষার প্রয়োজন আছে। তোমার নতুন বন্ধুটি হয়তো ভুলে গেছেন।’
একটা শুকনো ভাঙা গাছের ডাল দিয়ে মাটিতে আঁচড় কাটছিল মাসাদা। একটা বৃত্ত। তাকে কেন্দ্র করে পরপর আরও কতগুলো। নিজে এবং পাশের সঙ্গীটি এই চক্রের ঠিক কোথায় এসে পৌঁছেছে, এখনো অজানা। কয়েকটা ধাপ পেরিয়েছে জানে মাত্র।
‘আরও একটু অপেক্ষা করা যাক?’
মাসাদার কথায় ম্লান হাসি ফুটিয়ে সঙ্গীটি বলল, ‘দেশে ভাইয়ের জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছ মনে হচ্ছে!’
উত্তরে কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে সংযত করল মাসাদা। চক্রের পথে চলতে চলতে সে আর ব্যাসিলাইডাস ভিন্ন দু’দিক থেকে এসে মিশেছে। উদ্দেশ্য সম্পর্কে তারা দু’জনেই সম্যকভাবে অবহিত। নিজেদের ঊরুসন্ধিতে সেই চূড়ান্ত গোপনীয় লক্ষ্যের চিহ্নও বহন করছে। তা সত্ত্বেও নির্দিষ্ট দায়িত্ব নিয়ে, এমনকি চক্রের সদস্যদের মধ্যেও আলোচনায় কঠোর নিষেধ রয়েছে। এমন অনেক প্রতিশ্রুতি নিয়েই চক্রের প্রথম স্তরে প্রবেশের অনুমতি মেলে। কেবলমাত্র রক্তের অধিকার নয়, অনেক মানসিক এবং শারীরিক পরীক্ষা পেরিয়ে এই পবিত্র লক্ষ্যের অংশীদারত্ব জোটে। কখনো কখনো প্রতিশ্রুতি রক্ষায় মাসাদা এবং ব্যাসিলাইডাসের মতো একাধিক সদস্য একত্রিত হয়। একই লক্ষ্যে কাজ করে। পাশাপাশি। মাসাদার পরিবারের সিজারিয়া মাজাকা ছেড়ে আলেকজান্দ্রায় পরিগমণ থেকে শুরু করে ব্যাসিলাইডাসের সঙ্গে তার পরিচয়, পুরোটাই চক্রের পরিকল্পনা ও নির্দেশ অনুযায়ী ঘটেছে। একসঙ্গে দুটো বছর জ্ঞানের এই আশ্চর্য নগরীতে কাটিয়েছে দুই সহযোদ্ধা। বন্ধুও বটে।
আলেকজান্দ্রিয়া। এক অদম্য যোদ্ধার অসাধারণ পর্যবেক্ষণের ফসল। পৃথিবীর সমস্ত গুণী দার্শনিক, জ্যোতির্বিদ, গণিতবিদ, সাহিত্যিকদের স্বপ্নের ঠিকানা। আজ, ছশো বছর পেরিয়েও বিশ্বের মাথায় জ্ঞানের এক উজ্জ্বল মুকুট!
ব্যাসিলাইডাস তার উত্তর পাওয়ার আগেই দূর রাস্তায় একটা সচল বিন্দু চোখে পড়ল। দূরত্ব আরও কিছুটা কমলে অস্পষ্ট শরীরকে দেখিয়ে সে প্রশ্ন করল, ‘ইনিই কি তোমার সেই পণ্ডিত বন্ধু?’
মাটি থেকে নজর সামনে ছড়িয়ে দিল মাসাদা। দ্রুত চলার কারণে দূরত্ব কমেছে। শরীরের ছাপ এখন কিছুটা স্পষ্ট। ডান হাত দিয়ে সে মাটিতে কাটা আঁচড় মুছে দিল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘অবশেষে। হ্যাঁ, ইনিই নাজিয়ানজাসের গ্রেগরি। চিকিৎসা শাস্ত্র থেকে দর্শন, দর্শন থেকে ধর্মতত্ত্বে অবাধ আনাগোনা করেন! পণ্ডিত মানুষই বটে।’
বলে সামনে রাস্তা ধরে এগিয়ে গেল। দুই সদ্য পরিচিতের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘন হয়েছে। সামনা-সামনি হতেই দুজনে পরস্পরকে আলিঙ্গন করল। তারপর নিজেকে ছাড়িয়ে সহযোদ্ধার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল মাসাদা,
‘আলাপ করিয়ে দিই, ইনি হলেন ব্যাসিলাইডাস। আমাদের ধর্মভাই। অত্যন্ত গুণী মানুষ একজন।’
‘বরং জ্ঞানের সমুদ্র থেকে বঞ্চিত বলো। তোমাদের মতো দার্শনিক এবং তাত্বিকদের সঙ্গে মত বিনিময়ের সুযোগ পাচ্ছি, এই বোধহয় আমার পূর্বপুরুষদের পূণ্যফল।’
সঙ্গীর কাঁধে হাত রাখল মাসাদা। আলেকজান্দ্রিয়ার অতুলনীয় মুসিয়ন-এ প্রবেশের অনুমতি জোটাতে পারেনি বেচারা। হতাশ হওয়া ব্যাসিলাইডাসের সাজে।
ব্রুসিয়েন, যেখানে একসময় বিরল প্রতিভাধর টলেমি(প্রথম) বাস করতেন, তার আবাস সংলগ্ন স্থানে গড়ে তোলা হয়েছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাদুঘর। জাদুঘরই বটে! কিংবা বিশ্বের একমাত্র আধুনিক শিক্ষালয়ও বলা যেতে পারে। শিক্ষাই তো সেই জাদুদণ্ড যা দৃষ্টিকে বদলে দেয়। মুসিয়নে কী নেই? বিরাট গ্রন্থাগার। পৃথিবী ছেঁকে তুলে আনা লক্ষ লক্ষ পুথি এবং প্যাপিরাস সংরক্ষিত রয়েছে সেখানে। শয়ে শয়ে অনুবাদক কাজ করছেন। কত পণ্ডিত গ্রন্থচর্চা করছেন। সমবেত নৈশভোজের স্থান, আলোচনা কক্ষ, বক্তৃতা কক্ষ। অ্যারিস্টটল, প্লেটোর মতো বিজ্ঞান ও দর্শনের পথপ্রদর্শকেরা সেখানে শিক্ষার্থীদের সামনে তাঁদের বক্তব্য রেখেছেন। পাঠকক্ষে হোমার ও অন্যান্য গ্রিক সাহিত্য, কিংবা বৈরাগ্যবাদ নিয়ে পড়াশোনা করে অসংখ্য শিক্ষার্থী। এমনকি বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত পণ্ডিতদের নিখরচায় থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে মুসিয়নে। সুতরাং বিনা প্রয়োজনে সাধারণের সেখানে নিয়মিত প্রবেশের অধিকার নেই। কেবলমাত্র রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা মেরামতের দরকার পড়লে ব্যাসিলাইডাসরা অবাক হওয়ার কিছুটা সুযোগ পায়।
‘ব্যাসিলাইডাসের কথায় দ্রুত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছিও না গ্রেগরি। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, আশ্চর্য নগরীতে এই দুটো হাতের বিকল্প খুঁজে পেতে তোমাকে যথেষ্ট শ্রম দিতে হবে।’
দৃঢ়ভাবে কথাগুলো বলে সঙ্গীর দিকে তাকাল মাসাদা।
‘তোমার মতো পাথরের বুকে প্রাণ সঞ্চার করতে পারি না আমরা। প্রকৌশলে অপ্রতিদ্বন্দ্বী বলেই তো আজ তুমি আমাদের মাঝে ব্যাসিলাইডাস।’
মাসাদা ভুল বলেনি। যদিও স্থাপত্যে তার নাম সেভাবে শোনা যায় না। সে সাধারণ শ্রমিকদের ভিড়ে মিশে চলে। তেমনই নির্দেশ রয়েছে। প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে ব্যাসিলাইডাস। তবুও, এই আশ্চর্য নগরীর বিস্ময়কর সৃষ্টিকে কাছ থেকে, আরও সুক্ষ্ণভাবে দেখার লোভ সামলানো বড়ো কঠিন কাজ। সুযোগ একটা এসেছিল অবশ্য। পুরোনো জাদুঘরে নতুন অংশ সংযোজন করা হবে। সেরাপিউম নির্মান শুরু হতে চলেছে। দক্ষ সব গ্রিক স্থপতিদের তুলনাহীন পরিকল্পনায় অংশগ্রণের সুযোগ। অথচ ঠিক এমনই দুর্লভ মুহূর্তে ব্যাসিলাইডাসকে আলেকজান্দ্রিয়া ছেড়ে রোমে যেতে হচ্ছে। ঠিক কোথায় তা সে এখনো জানে না। মাসাদা জানে নিশ্চয়ই। বলেনি। যেমন ব্যাসিলাইডাসও বলেনি ঠিক কোন প্রস্তুতি নিয়ে সে রোমে যাচ্ছে। নির্দিষ্ট কিছু দায়িত্ব, এমনকি সদস্যদের কাছেও গোপন রাখা চক্রের প্রতি অঙ্গীকার। সেই অঙ্গীকার পালন করছে উভয়েই।
‘আমাদের দ্রুত প্রধান উপাসনালয়ে পৌঁছাতে হবে মাসাদা। সম্মানীয় প্রধান যাজকের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় কাছে চলে এসেছে প্রায়।’
গ্রেগরির কথায় দুই উৎসাহী বন্ধু চঞ্চল হয়ে উঠল।
প্রধান যাজক অ্যাথানাসিয়াস দ্য অ্যাপোস্টলিক সময়ের বিষয়ে ভীষণ কৃপণ। এক্ষেত্রে তাঁকে দোষারোপও করা যায় না। সারাদিন প্রচুর ব্যস্ততার মধ্যে কাটাতে হয়। দার্শনিক এবং তাত্ত্বিক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ধর্মালোচনা ছাড়াও নিজের পড়াশোনা রয়েছে। এমন মানুষ যে সময়ের ব্যাপারে হিসেবী হবেন, তাতে আর আশ্চর্য কি?
‘যথার্থ বলেছ। আমাদের দ্রুত পা চালানো উচিৎ।’
মাসাদার কথা শেষ হতেই তিনটে শরীর পথের ধুলো উড়িয়ে প্রায় ছুটতে শুরু করল।
হাত দুটো দেহের সামনে পরস্পরকে ধরে রেখেছে। মাথা সামান্য ঝুঁকে। আলেকজান্দ্রিয়ার অ্যাথানিয়াস পাশের দুই শিক্ষার্থীকে চেনেন। তাঁর প্রিয় পাত্রদের মধ্যে মাসাদা এবং গ্রেগরি উল্লেখযোগ্য দুটো নাম। তাদের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা সুঠাম দেহের যুবকটির ওপরে নিজের অভিজ্ঞ দৃষ্টি মেলে রেখেছিলেন অ্যাথানাসিয়াস দ্য অ্যাপোস্টোলিক। কপটিকদের মধ্যে এই নামেই বেশি জনপ্রিয় তিনি। বয়সের সঙ্গে দক্ষতার সরল সম্পর্ককে অ্যাথানাসিয়াস অতোটাও গুরুত্ব দেন না। কারণ তিনি নিজেই। মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে আলেকজান্দ্রিয়ার প্রধান যাজকের গুরুভার তাঁর কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল! নিছক খেয়ালের বশবর্তী হয়ে নয়। আরিয়ানবাদের বিরুদ্ধে ত্রিতত্ত্ববাদের সমর্থক হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন যুবক অ্যাথানাসিয়াস। হ্যাঁ, শুরুতে জটিলতা ছিল। সকলকে ছাপিয়ে স্বল্পবয়সী এক যুবা নীতিনির্ধারক হয়ে উঠলে তা মেনে নেওয়া কষ্টকর। তবে সেই সমস্যা হার মেনেছে জ্ঞানের কাছে। সুতরাং সামনে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে থাকা যুবক স্থপতিকে দেখে তিনি হতাশ নন। মাসাদা কী যেন নাম বলেছিল ছেলেটার? মনে পড়েছে, ব্যাসিলাইডাস।
‘তোমাকে একটা দায়িত্ব দেওয়ার অনুরোধ এসেছে ব্যাসিলাইডাস। কী মনে হয়, পারবে? আমাদের ঐতিহ্যশালী প্রতিষ্ঠানের সম্মান জড়িয়ে এই কাজের সঙ্গে। কথাটা মাথায় রেখে উত্তর দিও।’
ধীরে ধীরে মুখ তুলল ব্যাসিলাইডাস। বুকের ভেতর সচল মাংসপেশির শব্দ বুঝি তার কানেও ধাক্কা মারছে। একই অবস্থা বাকি দু’জনেরও। বিশেষত মাসাদা ভীষণ উদ্বেগে মেপে চলেছে প্রধান যাজকের শরীরীভাষা। যেভাবেই হোক ব্যাসিলাইডাসকে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতেই হবে।
গত বসন্তে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে খবরটা আলেকজান্দ্রিয়ায় পৌঁছে গিয়েছিল। নিম্ন রোন উপত্যকার আগাউনামে ধার্মিক শহিদদের সমাধি আবিষ্কার করেছেন অক্টাডার্মের বিশপ সেন্ট থিওডর। সম্রাট ম্যাক্সিমিয়ানের বর্বর কীর্তির সাক্ষী বহন করছিল অসংখ্য মস্তকহীন দেহাবশেষ। মাটির তলায় চাপা পড়েছিল তাদের অস্ত্র, বর্ম, শিরোস্ত্রাণ। অকুতোভয় থেবান লিজিয়নের বিস্ময়কর আত্মাহুতির কাহিনী অবশ্য তারও আগে পৌঁছে গিয়েছিল আলেকজান্দ্রিয়ায়। বিশপ থিওডর সেই পবিত্র স্থানে ব্যাসালিকা নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এমন পূন্যযজ্ঞে খ্রিস্ট ধর্মের পীঠস্থান আলেকজান্দ্রিয়ার কোনো অবদান থাকবে না! বিষয়টার গুরুত্ব প্রধান যাজক পর্যন্ত পৌঁছে দিতে কিছুটা সময় নিয়ে ফেলেছিল মাসাদা। গ্রেগরি তার মতকে সমর্থনের পর অবশ্য দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মাননীয় অ্যাথানাসিয়াস। আগাউনামের প্রার্থনাস্থল নির্মাণে সাহায্য করতে দক্ষ গ্রিক স্থপতিদের প্রেরণের সিদ্ধান্ত। তবুও মাঝে একটা বছর কেটে গেছে। এই বসন্তও শেষের মুখে দাঁড়িয়ে। এরপর হয়তো সুযোগ পেলেও তা কাজে লাগানো যাবে না। প্রবল উৎকণ্ঠা নিয়ে মাসাদা এবার তার সঙ্গীর দিকে তাকাল। প্রধান যাজকের চোখে স্পর্ধিত চোখ মেলে দাঁড়িয়ে ব্যাসিলাইডাস!
‘নিজের ওপরে বিশ্বাসে এতটুকু ঘাটতি নেই হে ঈশ্বরের সেবক। যদিও এখনই তার কোনো প্রমাণ দাখিল করতে আমি অক্ষম। সেই সুযোগ এখনো পাইনি। তবে যদি পাই, আলেকজান্দ্রিয়ার সুনামে সামান্যতম আঁচও লাগতে দেব না। প্রভু জিশু জানেন।’
আত্মবিশ্বাস। সাফল্যের প্রথম সিঁড়ি। অ্যাথানাসিয়াসের ঠোঁটে মৃদু হাসি খেলা করেই মিলিয়ে গেল।
‘বেশ। সে সুযোগ তোমাকে দেওয়া হল ব্যাসিলাইডাস। মাসাদা এবং গ্রেগরির আস্থায় আমিও আস্থা রাখলাম। আগামী সপ্তাহে কুড়ি জন দক্ষ স্থপতিকে নিয়ে একটা বিশেষ জাহাজ রোমের অস্টিয়া বন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে৷ গ্রীষ্মের শুরুতে পালে সামুদ্রিক বাতাসের অভাব হবে না। আশাকরি তৃতীয় সপ্তাহের আগেই তোমরা পৌঁছে যাবে। এই দলের প্রধান হিসেবে তোমাকে নিয়োগ দেওয়া হলো।’
মুহূর্তের জন্য থেমে মাসাদার উদ্দেশে বললেন,
‘ব্যাসিলাইডাসের হাতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনামা আজই তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করো। চার্চ আলেকজান্দ্রিয়ার পক্ষ থেকে বিশপ থিওডরকে অভিনন্দনসহ কিছু সোনা পাঠাতে ভুলো না। এই দুনিয়ায় প্রভু জিশুর মাহাত্ম্য ছড়িয়ে দিতে হলে আমাদের সকলকে হাত হাত মিলিয়ে কাজ করতে হবে। যাবতীয় প্রয়োজনে পাশে দাঁড়াতে হবে।’
‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি এবং গ্রেগরি, ব্যক্তিগতভাবে পুরো ব্যবস্থা করব। কোথাও সামান্যতম ত্রুটি থাকবে না।’
প্রত্যয়ের সুরে বলল মাসাদা। ব্যাসিলাইডাসের যাত্রা এখানে শেষ। আগাউনামে তার নতুন যাত্রা শুরু। তবে মাসাদার কাজ এখনো শেষ হয়নি। নাজিয়ানজাসের গ্রেগরি যতদিন আলেকজান্দ্রিয়ায় রয়েছে, তারও ঠিকানা এই আশ্চর্য নগরী। তারপর গ্রেগরির সঙ্গেই সে ফিরে যাবে জন্মভূমিতে। সিজারিয়া মাজাকাতে। সেখানে তৈরি করবে নতুন পরিবার। প্রিয় সন্তানদের মধ্যে দিয়ে বাঁচিয়ে রাখবে পবিত্র অঙ্গীকার।
(ক্রমশ)