সৌভাগ্যশলাকা। ধারাবাহিক উপন্যাস। পর্ব ৭। লিখছেন অলোক সান্যাল

0

(গত পর্বের পর)

নতুন সন্ধি, নতুন সঙ্গী

……………………………………

ভদ্রমহিলার উপস্থিতি এমার অস্বস্তি ক্রমশ বাড়িয়ে তুলছে। প্রফেসর তার সম্পর্কে ভদ্রমহিলার সঙ্গে এতকিছু আলোচনা করেছেন, অথচ এমাকে কিছুই জানাননি! সামিরা টিসডেল। একটু আগে প্রথম শুনেছে নামটা। সম্ভবত এমার মনের দোলাচলতা অনুমান করে সামিরা বলল, ‘আমি জানি ড.মিলার, চারপাশে যা কিছু ঘটেছে, ঘটে চলেছে, তারপর হঠাৎ কাউকে বিশ্বাস করা কঠিন। দোষ আপনার নয়। বিষয়টা গোপনীয় এবং সম্ভবত আপনিও তা জানেন। প্রফেসর সে কারণেই পরিকল্পনায় আমার যুক্ত থাকার কথা এড়িয়ে গিয়েছিলেন। ড. লুডল্ফ এবং তাঁর সঙ্গিনীর মৃত্যু সম্পর্কে আপনার ধারণা আছে নিশ্চয়ই?’

এমা নিজেকে সতর্ক করল।

‘শুনেছি। প্রফেসর বলেছেন। দু জনেই আত্মহননের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।’

‘ঠিক। এই কথাটাই ফেডারেল পুলিশের নথিতে লেখা আছে। আমিও জানি। কিন্তু প্রফেসর লিখিত রিপোর্টের সত্যতা নিয়ে কোনো ধোঁয়াশার কথা আপনাকে বলেননি? আমার মনে হয় প্রফেসর নিজেও বিশ্বাস করতেন মৃত্যু দুটো কোনো অসতর্ক মুহুর্তে ঘটে যাওয়া মস্তিষ্ক বিকৃতির ফল নয়। অন্তত তাঁর সঙ্গে কথা বলে তেমনটাই মনে হয়েছে।’

এরপর সামিরা টিসডেলকে অবিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পেল না এমা। অন্তত শেষের কথাটা শোনার পর প্রফেসর বরিসের সঙ্গে তার যোগাযোগ অস্বীকার করার উপায় নেই। ক্রিস্টোফ লুডল্ফ এবং ডায়ানার হত্যা সংক্রান্ত নিজস্ব সিদ্ধান্ত প্রফেসর হাটে বাজারে চর্চা করেননি নিশ্চয়ই। এমা তবুও অপেক্ষা করাই স্থির করল।

‘আপনি প্রফেসরের শেষকৃত্যে এসেছিলেন?’

‘না। সত্যি বলতে, প্রফেসরকে শেষবারের মতো দেখার সুযোগ হারাতে আমাকে নিজের সঙ্গে কম লড়াই করতে হয়নি।’

‘কেন?’

এমা বিস্ময় প্রকাশ করল।

‘কারোর চোখে পড়তে চাইনি। ড. মিলার, আমার অনুমান আপনাকেও নজরবন্দী করে রাখা হয়েছে। বস্তুত ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও এই কারণে আমি উইলেনডর্ফে এসেছি।’

‘একটু খুলে বলবেন প্লিজ।’

কনুই দুটো হাঁটুতে রেখে সামান্য ঝুঁকে বসল সামিরা। গলাকে যথাসম্ভব খাদে নামিয়ে বলল, ‘ড. মিলার, আমার দ্বিতীয় অনুমান- প্রফেসর বরিসের মৃত্যুও স্বাভাবিক নয়। হাসপাতাল কিংবা পুলিশ বিভাগের রিপোর্টকে ম্যানুপুলেট করা হয়েছে। এই গোটা ঘটনার নেপথ্যে যারা রয়েছে, তারা কোনো সাধারণ ষড়যন্ত্রকারী নয়। হয় তারা দ্য হোলি লেন্সকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির কাজে লাগাতে চায়, নতুবা চায় তার আবিষ্কারকে প্রতিহত করতে।’

এমা চেয়ার ছেড়ে উঠে টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। একটু খুঁজতেই জিনিসটা পেয়ে গেল সে। ছোট্ট একটা ক্রশ। পুরোনো, তবে যত্নের কারণে বয়সের ছাপ পড়েনি সেভাবে। ক্রশের মাঝ বরাবর একটা আধফোটা গোলাপের কুঁড়ি। ঠিক যেমনটি প্রফেসর বরিস তাঁর বন্ধু ক্রিস্টোফ লুডল্ফের ঘরে দেখেছিলেন। গত দিন রাফায়েল চলে যাওয়ার পরপরই জিনিসটা সে লাইব্রেরিতে খুঁজে পেয়েছিল। ক্রশটা বার তিনেক নাচিয়ে এমা বলল, ‘প্রফেসরের মৃত্যু নিয়ে আমার মনে কোনো সংশয় নেই মিস টিসডেল। তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। এবং হ্যাঁ, দ্য হোলি লেন্স নিয়ে আগ্রহই তাঁর মৃত্যুর কারণ।’

উত্তেজনা বুঝি সামিরাকেও ঠেলে তুলল।

‘সেক্ষেত্রে ড. মিলার, আপনিও ঘোর বিপদের মধ্যে বাস করছেন! যে কোনো সময় আপনার ওপরেও…’

‘হয়ে গেছে।’

সামিরাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে হেসে বলল এমা, ‘দিন কয়েক আগেই আমাকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। যে বা যারাই করুক, সফল যে হয়নি সে তো দেখতেই পাচ্ছেন।’

‘সেকি! এরপরেও আপনি হাসছেন! তারা একবার বিফল হয়েছে। বারবার নাও হতে পারে। ড. মিলার, দয়া করে নিজের দেশে ফিরে যান। কবেকার নিছক একটা মিথকে তাড়া করতে গিয়ে এতগুলো প্রাণ চলে গেল! প্রফেসর বরিসকেও আমি অনুরোধ করেছিলাম। শোনেননি। আপনি অন্তত আলেয়ার পেছনে ছুটবেন না।’

ভদ্রমহিলার একটানা বলে যাওয়ার মাঝে এমা নাগাড়ে মুচকি হাসছিল। তাকে ওভাবে হাসতে দেখে সুর বদলে চোখে চোখ রাখল সামিরা।

‘বুঝেছি। আপনিও শেষ না দেখে ছাড়বেন না। বেশ, তবে একটা অনুরোধ অন্তত রাখুন।’

তার কথায় কান খাড়া করল এমা।

‘উইলেনডর্ফ, না, শুধু এখানে নয়, ভিয়েনাতেও আপনার থাকা যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। আপনি আমার সঙ্গে সেন্ট-মরিস চলুন। বাকি কাজ না হয় ওখান থেকেই শেষ করবেন। মাঝে কোনো দরকার পড়লে আমিও আপনাকে সঙ্গ দিতে পারব। একা মানুষদের বিপদের ভয় বেশি ড. মিলার।’

জায়গার নাম শুনেই চমকে উঠল এমা। আগুয়ানামের সেন্ট-মরিস! প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের আউট পোস্ট সেন্ট-মরিস! এমাকে নিজের কৌতূহলের কাছে আত্মসমর্পণ করতেই হলো।

‘আপনি ওয়ালাইস ক্যান্টনের ক্যাপিটাল সিটি সেন্ট-মরিস থেকে এসেছেন?’

‘হ্যাঁ।’

নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে জানাল সামিরা।

‘আমি সেন্ট মরিস ডা’আগাউনম চার্চের ট্রেজার সেকশনের ইনচার্জ। নিতান্তই যদি দ্য হোলি লেন্সের খোঁজ চালিয়ে যেতে চান, তবে সেন্ট-মরিস চার্চ আপনার আদর্শ ঠিকানা ড. মিলার। আশাকরি ঈশ্বরের গৃহে আততায়ী প্রবেশ করার চেষ্টা করবে না।’

না, অদৃশ্য আততায়ীর ওপরে এমন ভরসা এমা করে না। বিবেক বিসর্জ্জন দিয়ে যারা প্রাণ কাড়ে, স্থান-কালের মোহ তাদের বাঁধতে পারে না। নিজের নিরাপত্তা নয়, এমার আকর্ষণ কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিল সেন্ট-মরিস ডা’আগাউনম চার্চের নাম। হতভাগ্য ক্রিস্টোফ লুডল্ফ সময়ের পলি সরাতে সরাতে এই চার্চের সামনে গিয়েই দাঁড়িয়েছিলেন! সম্ভবত সামিরার সঙ্গে প্রফেসরের ঘনিষ্ঠতার এটাই একমাত্র কারণ। সামিরাকে নিয়ে যতটুকু দ্বিধা অবশিষ্ট ছিল, একটা নাম সেটুকু থেকেও এমাকে নিষ্কৃতি দিল।

চারশো ছিয়ানব্বই হর্সপাওয়ারের চার লিটার টুইন টার্বো ভি-এইট ইঞ্জিন। এক্সেলেটরে চাপ বাড়ানোর সাহস থাকলে নিমেষে কাঁটা একশোর ঘর ছুঁয়ে ফেলতে পারে। সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় আড়াইশো কিলোমিটার। এলিনের মনে হচ্ছিল সে যেন কালো আরবী ঘোড়ায় বসে আছে। মসৃণ রাস্তায় স্টিয়ারিং ধরে রাখা হাতের কাঁপুনি টের পাওয়া যাচ্ছে না। চাইলেও সে পায়ের চাপ বাড়াতে পারছিল না। সোজা রাস্তা ছেড়ে গ্রামের ভেতর ঢুকে পড়েছে। পাহাড়ের কোলে ছোট্ট বসতি। দুদিকে আঙুরের ক্ষেত। কাছাকাছি, গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িগুলো পেরিয়ে এলিন গ্রামের শেষ মাথায় পৌঁছে গেল। গাড়ির ভেতর যান্ত্রিক মহিলা কণ্ঠস্বর তাকে জানিয়ে দিল, গন্তব্যে পৌঁছে গেছে।

যদিও বাগান লাগোয়া বড়ো গেটখানা দু’হাত প্রসারিত করে আহ্বান জানাচ্ছে, এলিন তবুও গাড়িটা বাইরেই দাঁড় করাল। একটা উড়ো চিঠি পেয়ে সে চলে এসেছে। হয়তো পুরো ব্যাপারটাই ভিত্তিহীন। ছেলেমানুষি করে ফেলেছে। দোষ তার নয়, বোনের। এমাকে গত বারো ঘণ্টায় কম করে হলেও বাহাত্তর বার ফোন করেছে। প্রতিবার এক জবাব! এলিনের কাছে দুঃশ্চিন্তা করার যথেষ্ট কারণ আছে। চিঠির কথাগুলো চেয়েও মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিতে পারেনি। তার একটা কারণ যদি বোনের প্রতি ভালোবাসা হয়, অপরটি চিঠির আংশিক সত্যতা। ভিয়েনায় গানম্যানের আতঙ্ক সংশ্লিষ্ট গোটা কুড়ি ক্লিপ ইউটিউবে দেখেছে সে। তাছাড়া ডেভিসের ইনফরমেশনকে অগ্রাহ্য করার বোকামি এলিন কখনো করতে পারবে না। এবং এত সবের পর চুপচাপ বসে ডকের নিরাপত্তা দেখাশোনা করা নিয়ে প্রশ্নই ওঠে না। ইতিমধ্যেই তার হঠাৎ ডিউটি অফ করা নিয়ে কর্তাদের সঙ্গে একপ্রস্থ ঝামেলা হয়ে গেছে।

‘চুলোয় যাক চাকরি’ বলে ফ্লাইট ধরেছিল এলিন। যে বা যাঁরাই তাকে ফোন করুক, নিছক ঠাট্টা করেনি। পার্সেলে চিঠির সঙ্গে ভিয়েনার টিকিটও তার কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। অস্ট্রিয়া শেনগেন এরিয়ার অন্তর্ভুক্ত। জরুরি দরকারে ভিসা ছাড়া প্রবেশে এলিনের বাধা নেই। ভিয়েনার টিকিটের সঙ্গে সেই ‘জরুরি দরকার’ এর ব্যবস্থাও করে রাখা ছিল! এলিন জ্ঞানত কখনো প্রফেসর বরিস গ্রইসম্যানের নাম শোনেনি, পরিচিতি তো দূরস্থান। অথচ সেই বন্ধু মানুষটির অকাল প্রয়াণ অস্ট্রিয়ায় তার ইমার্জেন্সি এন্ট্রির পাস! সুব্যবস্থা দেখে এলিনের কপালে ভাঁজ পড়তে শুরু করেছিল। এবং তাকে ভিয়েনা থেকে উইলেনডর্ফে পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটা মার্সিডিজ সাজিয়ে রাখা দেখে সেই ভাঁজের সংখ্যা কিঞ্চিৎ বেড়েছে মাত্র।

পাঁচিল ঘেরা বড়ো বাগান। দুপাশের সবুজ ঘাসেরা বিনা শাসনে বড়ো হচ্ছে। মাঝে মাঝে ব্ল্যাকথর্ন গাছের ঝোপ। সাদা পাপড়িতে ঢেকে যেন নববধূবেশে নিজের উপস্থিতি জাহির করছে। বাগানের মাঝামাঝি কিছুটা জায়গা পরিষ্কার করা। বড়ো একটা কাঠের টেবিল এবং তাকে ঘিরে বসার জন্য বেঞ্চ রয়েছে সেখানে। পাশে ঝোপঝাড় মাড়িয়ে পাশাপাশি দুটো গাড়ি। রং চটা ট্রাকের পাশে একটা স্কোডা স্কাউটের উজ্জ্বল নীল উপস্থিতি বড়োই বিসদৃশ ঠেকছে। তাকে গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়তে দেখে এক ভদ্রমহিলা তড়িঘড়ি ছুটে এলেন। সম্পূর্ণ অপরিচিত কেউ শিষ্টাচার ভুলে বাড়ির চৌহদ্দি পেরিয়ে সোজা ভেতরে ঢুকে পড়লে বিরক্তির সঙ্গে খানিক উদ্বেগও জন্মায়। ভদ্রমহিলার ছুটে আসার ধরন দেখে এলিনের তেমনই মনে হলো।

‘কাউকে খুঁজছেন?’ সতর্ক ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলেন মহিলা।

‘প্রফেসর বরিস গ্রইসম্যান…’

‘তিনি মারা গেছেন।’ বিষণ্ণ সুরে জানালেন মহিলাটি।

‘জানি। আমি আসলে এমা… আচ্ছা ড. এমা মিলার কি এখন এখানেই আছেন?’

ভদ্রমহিলার চোখে কিঞ্চিৎ বিস্ময়ভাব লক্ষ্য করল এলিন।

‘মিস মিলার! হ্যাঁ, আছেন। আপনি?’

‘আমি এলিন মিলার। এমার দাদা। ওকে একটা খবর দেওয়া যায় কি?’

‘ওহ্… আপনি মিস মিলারের দাদা! দয়া করে ভেতরে আসুন। বড্ড ভালো মেয়েটা। নরম মনের। আপনি যে আসতে পারেন মিস মিলার আগে বলেননি তো!’

‘জানলে তো বলবে।’

এলিন অস্ফুটে শেষের কথাটা বলল।

‘আমি বেলা। প্রফেসর এই বাড়ির দেখাশোনার ভার আমাকেই দিয়ে গেছেন। আহা, বড়ো ভালো মানুষ ছিলেন গো। এত তাড়াতাড়ি চলে যাবেন আমরা আশা করিনি।’

পকেট থেকে রুমাল নিয়ে মুখে চেপে ধরলেন মিসেস বেলা। ‘ফোঁৎ’ শব্দ এল দু’বার। এলিনের সামনে স্বজন হারানোর শোক আরও জোরালো ভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো। পরমুহূর্তেই পূর্বের স্বাভাবিক সুরে প্রশ্ন করলেন তিনি, ‘আপনিও বুঝি মোটা মোটা বইয়ের ভাঁজে দিন রাত কাটান?’

এলিন অনেকক্ষণ পর উৎকণ্ঠা ভুলে হেসে উঠল।

‘একেবারেই না বেলা। ওইসব নিরস কাজ আমার জন্য নয়। এমা এই বাড়িতেই আছে তো?’

‘ওমা, কোথায় আর যাবেন! গত দু সপ্তাহ ধরে লাইব্রেরি ছেড়ে নড়েননি।’

বলেই নিজেকে সংশোধন করে নিলেন মিসেস বেলা, ‘মাঝে দুটো দিনের জন্য বেরিয়েছিলেন অবশ্য। তার মাঝেই তো প্রফেসর…’

বলে আবারও বার দুই ফোঁৎ করলেন। এবারে অবশ্য রুমালের প্রয়োজন পড়ল না।

দু’জনে মেহগিনি কাঠে প্রাচীন কারুকাজ করা পেল্লায় দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। আধ বোঁজা দরজায় মৃদু শব্দ করে ভেতরে আলতো স্বর ছুঁড়ে দিলেন মিসেস বেলা, ‘মিস মিলার, আপনার জন্য একটা দারুণ চমক আছে।’

ভেতরের গুরুতর আলোচনা চলছে বাইরে থেকেই টের পাচ্ছিল এলিন। সে মিসেস বেলাকে পাশ কাটিয়ে দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল। কোনোরকম সৌজন্য ছাড়াই।

মুখোমুখি বসে। এমা এবং অন্য এক অপরিচিত মহিলা। কোনো বিষয়ে আলোচনায় এতটাই ডুবে রয়েছে দু’জনে, যে ঘরের মধ্যে তৃতীয় জনের উপস্থিতি তাদের মনোযোগে ফাটল ধরাতে পারল না। বোনকে সামনা-সামনি দেখার পর এতক্ষণের ধরে রাখা উৎকণ্ঠা প্রলম্বিত শ্বাসের সঙ্গে বেরিয়ে এল। মিসেস বেলাও লাইব্রেরিতে ঢুকে পড়েছেন। তিনি এবার গলাকে কিছুটা ওপরে তুলে ধরলেন।

‘মিস মিলার…’

চমকে ঘুরে তাকাল মুখোমুখি বসে থাকা দু’জনে।

‘এলিন! তুই কী করে…! হঠাৎ কিছু না বলেই…!’

বিস্ময়ের ধাক্কায় নিজের কোনো কথা সম্পুর্ণ করতে পারল না এমা। শুধু ছুটে এসে দাদাকে জড়িয়ে ধরল। দুই ভাইবোনের সম্পর্কের রসায়নই এমন। পুঁজি বলতে শুধু ভালোবাসা, নির্ভরতা। বাহ্যিক প্রকাশ না থাকলেও লংগিনাসের লেন্সকে ঘিরে ঘনিয়ে আসা দুর্যোগের ঘন মেঘ এমার মানসিক স্থিরতাকে ক্রমে ঢেকে ফেলছিল। পাশে ভরসা যোগ্য একটা মুখের ভীষণ অভাব বোধ করছিল সে। এলিনের চেয়ে বড়ো ভরসার পাত্র এ দুনিয়ায় আর কে আছে?

‘কোনো মানে হয়! তোকে ফোনে পাচ্ছি না কেন?’

বোনের আদর ছাড়িয়ে প্রথম প্রশ্ন করল এলিন। তারপর একে একে, ‘এত কিছু হয়ে গেছে, আমাকে জানাসনি! এই প্রফেসর বরিস গ্রইসম্যান লোকটি কে? মারা গেলেন কীভাবে? তুই তো ভিয়েনায় একটা সেমিনারে এসেছিলি, আবার একটা রহস্য জোটালি কোত্থেকে?’

এলিনের প্রশ্নের তোড়ে সজোরে হেসে উঠল এমা। আশঙ্কার মেঘে এবার চিড় ধরেছে। মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা আলো তার মুখে হাসি হয়ে উপছে পড়ল।

‘ধীরে ব্রাদার, ধীরে। এখানে যে আরও একজন ভদ্রমহিলা আছেন, সে কথা দেখছি ভুলে গেছিস! সভ্যতা ভব্যতা সব ডকেই রেখে এসেছিস দেখছি।’

এলিনকে খুঁটিয়ে দেখছিল সামিরা। বেশ স্বাস্থ্যবান। ড. মিলারের একজন দাদা আছে জানা ছিল, কিন্তু একসঙ্গে থাকে না বলে সেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এমা মিলারের মতো স্বাবলম্বী এবং সাহসী একজন মেয়ের নিজস্ব চলার পথ থাকাই স্বাভাবিক। জবাবদিহি করার মতো কেউ নেই। না চাইলে, এমনকি চাইলেও হুটহাট কেউ সাহায্যে ছুটে আসবে না। সরলীকৃত সিদ্ধান্ত। সে কারণে চক্রের নবীন সদস্য রাফায়েলকে উইলেনডর্ফ ছাড়ার আগে এমার ফোন সম্পর্কে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছিল। নিলেও যে তাতে কোনো লাভ হয়নি, এখন দেখাই যাচ্ছে। ডক নিরাপত্তার আধিকারিক সমস্যা বাড়িয়ে দিতে সশরীরে হাজির! সম্পর্কের জটিল সমীকরণে দ্বেষ- হিংসা- ঈর্ষা ছাড়া নিখাদ ভালোবাসার রূপ কখনো দেখার সুযোগ পায়নি সামিরা। মধ্য তিরিশের দুই ভাইবোন যেন এই মুহুর্তে কৈশোরে ফিরে গেছে! বুকের বাঁ দিক অকারণে খিমচে ধরল চক্রের কেন্দ্রীয় টেবিলের প্রতিনিধি। এলিন তার দিকে ফিরতে দ্রুত নিজের চঞ্চল হয়ে উঠতে চাওয়া স্নায়ুকে শাসন করল সে। তারপর বাড়িয়ে দেওয়া হাতে হাত রেখে বলল, ‘হাই, আমি সামিরা টিসডেল। এখনো ড. মিলারের বন্ধু হয়ে উঠতে পারিনি, তবে চেষ্টায় আছি। সুতরাং নিজের ঠিক কী পরিচয় দেব বুঝতে পারছি না।’

‘তবেই হয়েছে। এই মেয়ের বন্ধু হওয়া অতোটাও সহজ নয় মিস টিসডেল। আর হলে তো অবস্থা আরও কঠিন।’

বোনের আদুরে ঘুষি থেকে নিজেকে বাঁচানোর ফাঁকে এলিন নিজের পরিচয় দিল, ‘এই অসহায়ের নাম এলিন মিলার। গতকাল পর্যন্ত পোর্ট ফ্যালমাথে ডকের নিরাপত্তা বিভাগে কাজ করতাম। অবশ্য এতক্ষণে হয়তো আচরণবিধি অমান্য করার দায়ে পোর্ট সিকিউরিটি কর্পস আমাকে বরখাস্ত করে দিয়েছে।’

‘মানে! কেন?’

প্রায় আঁতকে উঠল এমা। এলিন বোনের প্রশ্নকে এড়িয়ে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মিসেস বেলাকে বলল, ‘প্রফেসরের বাড়িতে বই ছাড়া কোনো পানীয়ের আশা করা কি বাড়াবাড়ি হবে?’

বরিস গ্রইসম্যানের মৃত্যুর পর এই বাড়ির মধ্যে একটা গুমোটভাব তৈরি হয়েছিল। মিলার ভাইবোনের সৌজন্যে একটু একটু করে তা যেন কেটে যাচ্ছে। তড়িঘড়ি জবাব দিলেন মিসেস বেলা।

‘অবশ্যই মি. মিলার। কী আনব… চা, কফি?’

এলিন জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি ছুঁড়ে দিল। আকাশে অস্তরাগের ছোঁয়া।

‘অস্ট্রিয়ান হুইস্কি কিছু পাওয়া যাবে?’

মিসেস বেলার দেওয়া প্রথম দুটো বিকল্প বাতিল করে জিজ্ঞেস করল এলিন।

‘অবশ্যই। গোলস্ চলবে?’

‘দৌড়বে। সঙ্গে তিনটে গ্লাস এবং বরফ প্লিজ।’

মিসেস বেলা মন্থর পায়ে বিদায় নিতে এমা তার প্রশ্নে আবার ফিরে এল, ‘তোকে কে বলল আমি এখানে? রহস্যের কথাই বা কীভাবে জানলি?’

লাইব্রেরির কোণে একটা উইসবোন চেয়ার রাখা ছিল। সেটা টেনে নিল এলিন।

‘বসে কথা বলা যাক। আপাতত তোর প্রশ্নের কোনো উত্তর আমার কাছে নেই। শুধু জানি বিপদ আশেপাশে আছে। সোর্স- জনৈক শুভাকাঙ্ক্ষী।’

‘কোনো মানে হয়!’

এলিনকে নকল করে এমা বলল। তারপর একসঙ্গে হেসে উঠল দুই ভাইবোন। সামিরা তাদের হাসি থামার জন্য অপেক্ষা করল। ড. মিলারের ভাইকে কেউ সতর্ক করেছে! কে সে? তবে কি সত্যিই চক্রের অস্তিত্বের কথা আর গোপন নেই! নাকি সর্ষের মধ্যেই ভূত? অজান্তেই তার হাতের মুঠো শক্ত হয়ে এল। অবশ্য ক্ষণিকের জন্য। আবেগ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিশেষ ক্লাস করতে হয়েছে তাকে। এ বিষয়ে সে দক্ষ। মুখে হাসি ফিরিয়ে এনে সামিরা বলল, ‘বিপদের কথাই হচ্ছিল মি. মিলার। আপনার বোনকে…’

এলিন হাত তুলে সামিরাকে থামিয়ে দিল।

‘আমাকে এলিন বললেই চলবে সামিরা। স্যার, মিস্টার এইসব সম্ভ্রান্ত সম্বোধন আমি কেবল ডকে শুনে অভ্যস্ত।’

তাদের কথার মাঝে মিসেস বেলা একটা ট্রলি নিয়ে এসেছিলেন। এলিন একই কথা তাঁকেও বলল। তারপর ধন্যবাদ জানিয়ে গ্লাসে পানীয় ঢালতে শুরু করল।

‘হোলি লেন্সের কোনো মিসটিক্যাল পাওয়ার আছে বলে আমিও মনে করি না। তুই বলছিস ভিয়েনার মিউজিয়ামে রাখা লেন্স আসল নয়, নকল!’

‘ইয়েস ব্রাদার৷ তবে জিনিসটার প্রাচীনত্ব নিয়ে সন্দেহ নেই।’

‘আশ্চর্য! তাহলে হাজার বছর আগে কে নকল জিনিসটা দ্য হোলি লেন্স বলে চালাতে চেয়েছিল? কেনই-বা চেয়েছিল?’

সদ্য খালি গ্লাসে পরিমান মতো অস্ট্রিয়ান হুইস্কি ঢেলে নেওয়ার ফাঁকে প্রশ্ন করল এলিন।

‘এত বছর পরে তার উত্তর খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তাছাড়া এমন নকল লেন্স তো একটা ছিল না। ফার্স্ট ক্রুসেডের সময় অ্যান্টিওক, গ্রিক সেল্যুসড সাম্রাজ্যের রাজধানীতে ইসলামিক আগ্রাসনকারীদের দাপটে ক্রুসেডেররা যখন কোণঠাসা, এমনই এক হোলি রিলিক তারা খুঁজে পায়। ফলাফল জানিস?’

দু পাশে ঘাড় নাড়ল এলিন। ইতিহাসে তার প্রবল অনীহা। মাঝে হঠাৎ পুরোনো দিন নিয়ে অত্যুৎসাহী হয়ে উঠেছিল, তবে তার পেছনে কারণ হিসেবে ইতিহাসের চেয়ে সমুদ্র শয়তানকে বেশি দায়ী করা যায়। ব্ল্যাকবিয়ার্ড মানুষটাই এমন ছিলেন। প্রজেক্ট রিভেঞ্জ-এর সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে সেই উৎসাহ ধোঁয়া হয়ে গেছে। (দ্রষ্টব্য : নষ্ট চাঁদের আলো)

‘হেরে যাওয়া একটা যুদ্ধ ক্রুসেডেররা জিতে গিয়েছিল।’

সোনালি তরলে আলতো চুমুক দিল এলিন। তারপর ভীষণ দার্শনিকের মতো বলল, ‘ক্রুসেড…। ধর্মযুদ্ধ…। আমার যুদ্ধে মৃত শরীরগুলোকেই বড়ো বেশি উদার আর মানবিক মনে হয়। যতক্ষণ বেঁচে ছিল, জাত-ধর্মের নামে অস্ত্রে শান দিতে কসুর করেনি। মৃত্যুর পরে তারাই সেসব ফেলে বিধর্মীদের সঙ্গে গলাগলি করে শুয়ে থাকে। তাই না?’

দীর্ঘ সময় ধরে সামিরা মুখের পরিবর্তে কানকে বেশী সজাগ রেখেছে। ভেবেছিল ড. মিলারকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করাতে পারলে ভিয়েনা থেকে রাতের ফ্লাইট ধরবে। মঞ্চকে প্রায় সেভাবে তৈরিও করে ফেলেছিল। মাঝে হঠাৎ এলিন ঢুকে পড়ে নাটককে দীর্ঘায়িত করে তুলেছে।

এলিন মিলার। ছেলেটার মধ্যে অদ্ভুত অদৃশ্য আকর্ষণ আছে! মাঝেমধ্যে নিজের মুগ্ধতাবোধ শাসন সত্ত্বেও নিষেধরেখা ভাঙতে চাইছে। কেন? উত্তর খুঁজে পাওয়ার আগেই এলিন সোজা হয়ে বসে সরাসরি তার চোখে চোখ রাখল। সামিরার বুকের ভেতর মৃদু কম্পন ফিরে এল আবার।

‘সামিরা, এমাকে নিয়ে আপনার এত চিন্তার কারণ জানতে পারি? প্রশ্নটাকে দয়া করে অন্যভাবে নেবেন না। আসলে পরিচিত মুখকে অহরহ বদলে যেতে দেখার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাই…’

সামিরার ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসি পিছলে গেল।

‘সঙ্গত প্রশ্ন। কিছুক্ষণ আগে ড. মিলারকে এ নিয়ে কিছু তথ্য দিয়েছি। অবশ্য তা কতটা সন্তোষজনক জানি না। প্রফেসর, আমি, লুডল্ফ, সকলে একই উদ্দেশ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ঘটনাচক্রে আপনার স্নেহের বোনটিও এর সঙ্গে নিজেকে জুড়ে ফেলেছেন। সুতরাং ড. মিলারের সুরক্ষা নিয়ে আমাকে ভাবতে হচ্ছে।’

‘আর আপনার সুরক্ষা? উদ্দেশ্য যখন এক, এমার মতো আপনিও নিশ্চয়ই প্রতিপক্ষের নিশানায় আছেন?’

‘আমি এতদিন প্রকাশ্যে ছিলাম না। একটা ছদ্মবেশ আমার আছে। এবং সেটা বেশ শক্তপোক্ত। তাছাড়া আমার বেশিরভাগ সময় কাটে চার্চের ভেতর। সেখানে অস্ত্রধারীর আক্রমণের সম্ভাবনা কম।’

‘চার্চ! আপনি কি…?’

প্রশ্ন শেষ করতে পারল না এলিন। এমন হৃদয় দুর্বল করে দেওয়া উপস্থিতি, সম্মোহনী চাহনি, সব ব্যর্থ! দাদার মনে ভাব আন্দাজ করে খোঁচা মারার সুযোগ ছাড়ল না এমা,

‘ভয় নেই ব্রাদার, সামিরা মিস নাকি মিসেস জানি না, তবে উনি চার্চের সন্ন্যাসিনী নন। ট্রেজারার।’

দুই ভাইবোনের সম্পর্ক এমনই। দূরে থাকলে সময়ে অসময়ে উদ্বেগে প্রাণপাত করে, আবার কাছাকাছি হলেই চকমকি পাথরের মতো। ঠোকাঠুকি লাগবেই।

‘কোনো মানে হয়! এতে আমার ভয়ের কী দেখলি শুনি?’

‘দুটো কারণ। প্রথম দর্শনেই তোর ‘মিস সামিরা সম্বোধন। এবং এখন চার্চের কথা শুনে আঁতকে ওঠা।’

হাসতে গিয়ে এমার হাতে ধরা গ্লাস থেকে ঝাঁঝালো তরল পোশাকে কিছুটা চলকে পড়ল।

‘ইতিহাস ছাড়া অন্য বিষয়ে তোর মগজ একেবারে অসাড় এমা।’

অপ্রস্তুত ভাব কাটিয়ে বলল এলিন। দু’জনের কথার চুলোচুলি বেশ উপভোগ করছিল সামিরা, তবুও তার নিয়ন্ত্রিত মস্তিষ্ক সজাগ করল।

‘ড. মিলার, আমার প্রস্তাব নিয়ে কিছু ভাবলেন?’

এলিন বোনের দিকে প্রশ্নভরা চাওনি মেলে দিল।

‘মিস সামিরা আমাকে সেন্ট-মরিস নিয়ে যেতে চাইছেন। নিরাপত্তার জন্য।’

‘ডোন্ট ওরি ডিয়ার, হোয়াইল এলিন ইজ হিয়ার।’

বলে সামিরা দিকে নজর ফেরাল এলিন, ‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। এমা যে কিছু ঘোঁট পাকিয়েছে জেনেই আমি এসেছি। এবং কিছুটা প্রস্তুতি নিয়েই এসেছি।’

সামিরার চোয়াল শক্ত হলো। একটু আগে ছেলেটার প্রতি জন্ম নেওয়া নির্বোধ মোহ, উধাও হয়ে গেল ত্বরিতে। অবশ্য তাকে বিশেষ পরিশ্রম করতে হলো না। এমাই তার কাজটা সহজ করে দিল।

‘আমি যেতে চাই ব্রাদার। সেন্ট-মরিস চার্চে কিছু উত্তর জমা আছে বলে আমার ধারণা। এখন প্রশ্ন হলো তুই কি আবার আমার বডিগার্ড হতে রাজি হবি? গতবার যা ঝামেলা পোহাতে হয়েছে তার পরেও?’

‘কোনো মানে হয়!’

কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল এলিন। এক চুমুকে গ্লাসের অবশিষ্ট তরল নিঃশেষ করে যোগ করল, ‘ডকের কাজটা তো গেছে বলে মনে হয়। নতুন কাজের সন্ধানে নামতেই হতো। সুতরাং এমন প্রস্তাব আসলে মেঘ না চাইতেই জল গোছের ব্যাপার হবে একটা।’

সশব্দে হেসে উঠল দুই ভাইবোন। পরস্পরকে আলিঙ্গনে ব্যস্ত চোখেরা খেয়াল করল না, পাশে বসে সামিরা টিসডেল তার লোভনীয় ঠোঁট কামড়ে ধরেছে। মসৃণ কপালে ভাঁজ দেখা দিয়েছে।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *