সৌভাগ্যশলাকা। ধারাবাহিক উপন্যাস। পর্ব ৬। লিখছেন অলোক সান্যাল

0

(গত পর্বের পর)

পলাতক খলনায়ক 

……………………………..

গলদেশ। দীর্ঘ রক্তক্ষয়ের মধ্যে দিয়ে এই দেশে রোমান আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গভর্নর ক্যাসিয়াস মারিসাস দৃঢ়তার সঙ্গে শহরে রোমান আইন কার্যকর রেখেছেন। সেনেটের তরফে জারি হওয়া নতুন নির্দেশিকা তাঁর কাছে সবেমাত্র এসে পৌঁছেছে। বার্তাবাহক নির্ঘাৎ পথমধ্যে কোথাও সময় অপচয় করেছিল। নইলে যে উদ্দেশ্যে তড়িঘড়ি রোম থেকে নির্দেশিকা পাঠানো হয়েছে, তা শহরের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হওয়ার আগে গভর্নর ক্যাসিয়াস মারিসাস উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতেন।

জনা চারেক ইহুদি ভৃত্য ঘিরে রয়েছে এক বৃদ্ধকে। দৃশ্যতঃ ক্লান্ত এবং বিধ্বস্ত। যেন কোনোক্রমে নিজেকে বয়ে চলেছেন। মাঝারি উচ্চতার শরীরটা সামান্য বাঁকানো। গত কয়েক মাসে মুখের বলিরেখা এবং মাথার ধুসর চুলের সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় বার্ধক্য বুঝি সময়ের আগেই উপস্থিত হয়েছে। পুরু ভুরু জোড়ার নিচে তাঁর চোখের মণি পায়ের কাছে আটকে। পরনের পোশাক বলে দিচ্ছে বৃদ্ধ আদতে জুডেয়ার বাসিন্দা। ভৃত্য পরিবেষ্টিত বৃদ্ধের ঠিক পেছনেই তিনজন অশ্বারোহী প্রহরী। শহরের মুখ পর্যন্ত সকলেই অশ্বারূঢ় ছিল। দিনের আলোয় অভিজাত পোশাকে সেই অবস্থায় শহরে প্রবেশ করলে নজরে পড়ার সম্ভাবনা বেশি। বৃদ্ধটি তাই তাঁর বাহনকে শহরের বাইরেই রেখে এসেছেন। প্রভুর পথ অনুসরণ করছে ভৃত্যের দল। সতর্কতার পরেও অবশ্য সাধারণের কৌতূহলকে এড়ানো গেল না। সম্রাট ক্যালিগুলা, যিনি নিজে নিপীড়ন এবং অভদ্রতায় সীমাহীন, তিনি যে একই অপরাধে জুডেয়ার প্রাক্তন গভর্নরকে রোম থেকে বহিষ্কার করেছেন, আশ্চর্যভাবে সেই খবর সেনেটের নির্দেশিকার আগেই গলদেশে পৌঁছে গেছে। গলবাসীরা বরাবরই মুক্তমনা। প্রজার অধিকার এবং প্রাচীন ঐতিহ্য পালনে বাধাদানকারী স্বৈরাচারী শাসক তাদের কাছে কেবল ঘৃণার পাত্র। শহরের তোড়নদ্বারে ভৃত্য এবং প্রহরী বেষ্টিত হয়ে স্বয়ং পয়েন্টাস পিলেত উপস্থিত হয়েছেন বুঝতে তাদের কিছুটা সময় লাগলো। ছোটো দলটাকে রাস্তায় দেখে চোখ সরু হলো অনেকেরই। তাদের মধ্যে কারোর কারোর বাণিজ্য কিংবা অন্য ব্যক্তিগত প্রয়োজনে জুডেয়ায় যাওয়া-আসা থাকে। বস্তুত এরাই প্রদেশের বিভিন্ন প্রান্তের খবর গলদেশে বয়ে আনার দায়িত্ব সামলায়। তারা নুইয়ে পড়া মানুষটাকে এক পলক দেখেই চিনতে পারল। এ কান ও কান হয়ে বহিস্কৃত জুডেয়ার প্রাক্তন গভর্নরের শহরে প্রবেশের সংবাদ দ্রুত পৌঁছে গেল আনাচেকানাচে। দু’পাশের কর্মব্যস্ততায় তালা ফেলে সকলের আগ্রহ জড়ো হলো রাস্তা ধরে হেঁটে যাওয়া দলটার ওপরে। শহরে পিলেতের আচমকা উপস্থিতি মুক্তমনা গলবাসীদের সঞ্চিত অবজ্ঞা ও ঘৃণা প্রকাশের একটা সুযোগ করে দিল। ভিড় থেকে চিৎকার করে উঠল কেউ, ‘পথ থেকে সরে যাও। এই অপবিত্র লোকটার ছায়াও যেন তোমাদের ছুঁতে না পারে।’

‘মায়েরা সবাই সাবধান। ছেলে-পুলেরদের আগলে রাখ। শহরে একটা শেয়াল ঢুকেছে।’

অন্যপাশ থেকে কথাটা ছুঁড়ে মারল কেউ। এক বণিক তার পসরা ফেলে দলটার মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। সুতীব্র শ্লেষে প্রাক্তন প্রশাসককে লক্ষ্য করে গলার শিরা ফুলিয়ে বলে উঠল, ‘শুধুমাত্র বহিষ্কার এই পাপী মানুষটার উপযুক্ত শাস্তি হতে পারে না। ঈশ্বরই জানেন এই শয়তান বুড়ো কতজনকে লুঠ করেছে, কতজনকে শূলে চড়িয়েছে! কত শত নিরাপরাধী মানুষের রক্ত লেগে আছে এর হাতে!’

বৃদ্ধ পিলেত লজ্জা এবং গ্লানিতে দগ্ধ হয়ে চলেছেন। মাটিতে মিশে গিয়েছে তাঁর মাথা। জমাট পাপবোধের ভার তাঁকে সোজা হতে দিচ্ছে না। চারিদিক থেকে ছুঁড়ে দেওয়া ধারালো কথাগুলো নাগাড়ে ক্ষত-বিক্ষত করে চলেছে। একটা আশঙ্কা ছিলই। ভিনদোবনে(ভিয়েনা) এসে তা যে আতঙ্কে পর্যবসিত হবে, অনুমান ছিল না। পিলেত দু হাতে মুখ ঢেকে নিজের নগ্নতা আড়াল করতে চাইলেন। ভিড়ের চড়া মেজাজ দেখে সঙ্গের ভৃত্যেরা দূরত্ব তৈরি করেছে। প্রহরী তিনজন সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে বটে, তাতে বিশেষ কাজ হচ্ছে না। থমকে গেলেও গলবাসীরা আজ মনের যত ক্রোধ উজাড় করে দিতে বদ্ধপরিকর। হঠাৎ সামনে, রাস্তার ডান পাশে একটা সরু গলি পিলেতের নজরে পড়ল। একটু আগে পথ আটকে দাঁড়ানো বণিক প্রবরকে প্রহরীরা সরিয়ে দিয়েছিল। রোমের কাছে ব্রাত্য মানুষটি কতকটা জোর করেই নিজেকে ঠেলে তুললেন। তারপর শরীরের অবশিষ্ট শক্তিকে জড়ো করে গলিমুখের উদ্দেশ্যে ছুটতে শুরু করলেন। মুহুর্তের বিমূঢ়ভাব কাটিয়ে পেছনে ভৃত্যেরাও।

মানব-বর্জ্য এবং আবর্জনায় ভরে রয়েছে সংকীর্ণ গলিপথ। তাঁর নিজের নৈতিকতা বিবর্জিত, উৎকোচে ভরা এবং অজস্র অযোগ্য বিচারে কলুষিত জীবনের মতোই দুর্গন্ধময় পথটুকু পিলেত নিঃসংকোচে পার করলেন। শহরের দুই প্রধান রাস্তার সংযোগকারী সংকীর্ণ গলির অপরপ্রান্তে পৌঁছে বিদ্রোহী ফুসফুসকে শান্ত হতে কিছুটা সময় দিলেন তিনি। উদ্বিগ্ন দৃষ্টি মেলে জরিপ করে নিলেন এ প্রান্তের পরিবেশ। স্বাভাবিক। কয়েক পা দূরে রাস্তার পাশে পরপর কয়েকটা দোকান। এক বৃদ্ধা সম্ভবত তাঁর বংশজকে নিয়ে কেনাকাটায় ব্যস্ত। ব্রোঞ্জের তৈরি একটা ছোট্ট ঘোড়া নিয়ে দোকানীর সঙ্গে দরকষাকষি করছেন। স্বস্তির শ্বাস নিলেন বর্তমানে রোমের সবচেয়ে চর্চিত মানুষটি।

‘তোমরা এখানেই অপেক্ষা করো।’

সন্ত্রস্ত ভৃত্যদের নির্দেশ দিয়ে পিলেত গলিমুখ ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। তারপর ক্লান্ত পায়ে দরদামে নাছোড় দোকানীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। সম্ভ্রান্ত পোশাকে উঁচু দরের ক্রেতা ভেবে দোকানী সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল।

‘আমি কি এখানে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিতে পারি?’

ভেঙে পড়া স্বরে অনুরোধ জানালেন একসময়ের আদেশকারী জুডেয়ার প্রশাসনিক প্রধান। দোকানীকে প্রথমে হতাশ দেখাল। কয়েক মুহুর্ত সে নিষ্পলকে চেয়ে রইল মুনাফার মোটা দাঁও ভেবে বসা সম্ভ্রান্ত পোশাকের মানুষটির দিকে। তারপরেই প্রবল উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠল,

‘পিলেত! জুডেয়ার পয়েন্টাস পিলেত! তা হলে খবরটা মিথ্যে নয়!’

যে বৃদ্ধা এতক্ষণ ধরে সাজিয়ে রাখা পসরা থেকে সঙ্গের শিশুটির নতুন পছন্দ খোঁজায় ব্যস্ত ছিলেন, দোকানীর আচমকা চিৎকারে চমকে উঠলেন। আতঙ্কিত নজরে ধূসর চুলের বৃদ্ধ পিলেতকে আপাদমস্তক মেপে পাশের অত্যুৎসাহী শিশুকে কোলে তুলে নিলেন। তারপর যেন ভয়ংকর কোনো জান্তব শক্তি তাঁকে তাড়া করেছে এমনভাবে ছুটতে শুরু করলেন। একইসঙ্গে পয়েন্টাস পিলেতের নাম ঘৃণা ভরে দু পাশে ছড়িয়ে দিতে ভুললেন না।

‘হা ঈশ্বর!’

হাহাকারের মতো শোনাল পিলেতের কণ্ঠস্বর। ‘নিশ্চিতভাবে পৃথিবীর সমস্ত ইহুদিদের কাছে আমি নরপিশাচ। সকলের কাছে অস্পৃশ্য।’

‘কাজই এমন করেছেন।’

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা কিছুদিন আগেও রোমের একজন উচ্চপদস্থ আমলা ছিলেন ভুলে গিয়ে দোকানী নির্দ্বিধায় বলে উঠল, ‘নাজরাতীয় জিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করার কথা জানতে কারোর বাকি নেই। আপনি যে এখনো অক্ষত শরীরে রয়েছেন এই ঢের। শহরের রাস্তায় এমন পাপীদের প্রায়শই পাথর ছুঁড়ে মারার জন্য অনেকগুলো হাত মুখিয়ে থাকে।’

‘কিন্তু জিশুর মৃত্যুতে আমার দায় সামান্যই। সব ওই শয়তান কাইয়াফাসের কারসাজি। অ্যাপেলোর দিব্যি।’

চিৎকার করে নিজের সাফাই পেশ করলেন পয়েন্টাস পিলেত। দোকানী সম্ভবত তাঁর ব্যবহারে কিছুটা অবাক হলো। জুডেয়ার প্রাক্তন গভর্নর উগ্র মেজাজের। কাউকে সমীহ করেন না। এমনটাই সে শুনে এসেছে। অথচ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কাতর মানুষটিকে দেখে তা মনে হচ্ছে না তো! ভাবনার মাঝেই রাস্তার হট্টগোল আবার জেগে উঠল। একসময়ের দাপুটে প্রশাসকের দু চোখে আতঙ্ক গাঢ় হতে দেখে দোকানি বলল, ‘দোকানের ভেতরে ঢুকে পড়ুন। চটপট। শহরে ইহুদিদের সংখ্যা যথেষ্ট। তাদের চোখে পড়লে পাথর বৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে। আপনার সঙ্গে তো রক্ষীরাও নেই দেখছি। সম্রাট ক্যালিগুলা শুধু পদ নয়, যাবতীয় সম্ভ্রমটুকুও ফেরত নিয়েছেন!’

দোকানের ভেতরে ঢুকে আড়াল নিলেন পিলেত। দোকানীর কথার কোনো জবাব তাঁর কাছে নেই। কীই-বা বলবেন? সম্রাটের প্রতি দারুণ নিষ্ঠাবান থাকা সত্ত্বেও চুড়ান্ত অবহেলা এবং অসম্মান নিয়ে রোমের এক কোণে পচে মরতে হয়েছিল পিতামহকে। পিলেতের বাবা, অকুতোভয় যোদ্ধা, পার্থিয়ানের যুদ্ধে নৃশংসভাবে নিহত। ভাইও সেই যুদ্ধে আর্মেনিয়াসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রাণ দিয়েছে। রোমের জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করার পরেও সম্রাটের কাছে তিনি ব্রাত্য! একজন অপরাধী! এ যেন এক অভিশাপ যা তাঁর পরিবারকে গিলে নিয়েছে। মাথা নিচু করে একমনে এলোমেলো কথাগুলো ভেবে চলেছিলেন জুডেয়ার প্রাক্তন প্রশাসক। ইতিমধ্যে রাস্তার শোরগোল মরে এসেছিল। পিলেত এবার আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। অবসন্ন কণ্ঠে দোকানীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ফ্যাব্রেসিয়াস অ্যালবিনাসের বাড়িটা কোথায় বলতে পারেন?’

দোকানীর মুখে ক্ষীণ ভ্রুকুটি উঠেই মিলিয়ে গেল। ফ্যাব্রিয়াস অ্যালবিনাস ভিনদোবনের সর্বত্র অতি পরিচয় এক নাম। অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি বলেই সকলে জানে।

‘তাঁর কাছে আপনার কী প্রয়োজন?’

‘সে আমার বাল্যবন্ধু। ছোটোবেলার খেলার সঙ্গী। এই দুঃসময়ে অ্যালবিনাস আমার একমাত্র অবলম্বন। আশা। আপনি অনুগ্রহ করে তার ঠিকানা দিন।’

‘এই কি সেই পয়েন্টাস পিলেত যার দৌরাত্ম্যের কথা জুডেয়া ছাড়িয়ে গলদেশ, এমনকি রোমেও পৌঁছে গেছে?’

মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করল দোকানী। লোকটার সম্পর্কে যা শুনেছে, দেখে তা মনে হচ্ছে না। তাছাড়া সজ্জন ফ্যাব্রিয়াস অ্যালবিনাসের বাল্যবন্ধু। কিছুটা দ্বিধান্বিত কণ্ঠে এবার সে বলল, ‘রাস্তার ওপারে ওই সরু গলি ধরে চলে যান। গলির মুখেই মাননীয় অ্যালবিনাসের আবাস। দ্রুত যান। শোরগোল আবার ফিরে আসার আগেই।’

‘সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ।’

সংক্ষেপে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গলির মধ্যে ঢুকে পড়লেন পিলেত। সজোরে পা চালিয়ে উপস্থিত হলেন ছেলেবেলার খেলার সঙ্গী, বর্তমানে ভিয়েনার অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং সম্ভ্রান্ত ফ্যাব্রিয়াস অ্যালবিনাসের ঠিকানায়। তাঁকে দেখে যুগপৎ উচ্ছ্বসিত এবং চিন্তিত সুরে পুরোনো সঙ্গী বলে উঠলেন, ‘বহুদিন পর আমাদের আবার দেখা হলো বন্ধু। ভিয়েনায় তোমাকে স্বাগত।’

‘সত্যিই অনেকদিন পর। যে বছর ভ্যালেরিয়াস গ্রেটাসকে সরিয়ে আমাকে জুডেয়ার প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়েছিল, সেবারই আমাদের শেষ দেখা। তারপর আজ। সেদিন আর আজকের দিনের মধ্যে কত ফারাক বন্ধু!’

বলতে বলতে পিলেতের শরীর ঝুঁকে পড়ল। তাঁর পিঠে সান্তনার হাত রেখে অ্যালবিনাস বললেন, ‘আমি জানি বন্ধু। এতে তোমার কোনো দোষ খুঁজে পাইনি। সব ওই সিরিয়ার কুচক্রী প্রশাসক ভিসেলিয়াস এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গদের কারসাজি। ওরাই ইহুদিদের ওপরে নিপীড়ন এবং জুডেয়ায় অপশাসনের দোহাই দিয়ে তোমার বিরুদ্ধে সম্রাটের কান ভারী করেছে।’

‘না বন্ধু। আমার মানসিক অবক্ষয়ের কারণ তোমার এই ভাবনার চেয়ে অনেক বড়ো। হ্যাঁ, সম্রাটের ব্যবহার আমাকে ব্যথিত করেছে। বংশানুক্রমে আমার পরিবার রোমের সেবা করে আসছে। বিনিময়ে লাঞ্ছনা ছাড়া আর কিছু পায়নি। কিন্তু এসবের চেয়েও আমাকে বেশি বিড়ম্বনায় ফেলেছে আমার বিবেক।’

কথাটা শুনে সামনে বসে থাকা সজ্জন ফ্যাব্রিয়াস অ্যালবিনাস যতটা চমকে উঠলেন, বলে তার চেয়ে বেশি অবাক হলেন পিলেত নিজে। বিবেক! বিবেক, অনুতাপ, নৈতিকতা এসব তুচ্ছ বিষয় কবে থেকে তাঁর কাছে এত বড়ো হয়ে উঠল? প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে পিলেতের চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা মুখ। যেন স্বর্গের দেবতা। উজ্জ্বল তার উপস্থিতি।

‘হা ঈশ্বর! এ আমি কী করেছি!’ ভাঙা ভাঙা স্বরে বলে উঠলেন জুডেয়ার প্রাক্তন প্রশাসক।

 

 

কুয়াশার আড়ালে

……………………………….

মোরগ ফুলের মতো লাল রঙের টিপ পড়েছে আকাশ। কুয়াশা ঘোলাটে ঘোমটা পরিয়ে দিয়েছে পাহাড় চুড়োগুলোয়। সময় আরও কিছুটা গড়িয়ে গেলে, ধোঁয়ার অবগুণ্ঠন গলে যাবে। লজ্জা সরিয়ে তখন সবুজে ঢাকা পাহাড় স্পষ্ট ধরা দেবে চোখে। অনেকদিন পর একটা গোটা রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে এমা। আর এসব রাতে যেমনটা হয়, ঘড়ির কাঁটার শ্লথ গতির কাছে বাঁধা পড়ে থাকে সময়। ব্রহ্মাণ্ডের যত অলসতা ভর করে তার দুটো পায়ে। খোলা জানালা দিয়ে হিম হিম বাতাস ঢুকে ভরিয়ে রেখেছে লাইব্রেরি। আস্ত একটা রাত কাটিয়েও চিন্তাগুলো নাগাড়ে আঁচড় কেটে চলেছে এমার মনে। স্বস্তি দিচ্ছে না। ক্লান্তিকেও আশেপাশে ঘেঁষতে দিচ্ছে না। এ অনুভব এমার নতুন নয়। ভাবনার রসদ পেলে সে বিশ্রামের খিদে টের পায় না। সেখানে বিগত দুটো দিন তাকে চিন্তার সমুদ্র তটে এনে দাঁড় করিয়েছে। সুতরাং ঘুম কিংবা খিদে, কোনোটাই এখন তার কাছে বেঁচে থাকার মৌলিক শর্ত নয়।

প্রথমে ভিয়েনায় তাদের ওপরে হামলা। অবশ্য ডেভিডের মতে এমাই আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিল। সেই ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই প্রফেসর বরিসের আচমকা ‘নেই’ হয়ে যাওয়া। সরকারি মতে সাধারণ মৃত্যু। বয়স হয়েছিল। হৃদযন্ত্রের সমস্যাও ছিল। কার্ডিয়াক ফেইলিউর অত্যন্ত স্বাভাবিক। ডাক্তারি পরীক্ষাতে হৃদযন্ত্রের ছন্দপতনে মৃত্যু প্রমাণিত। কিন্তু প্রমাণিত সত্য আর প্রকৃত সত্যের মাঝে কখনো-সখনো ফারাক থাকে। এমার হর্স সেন্স সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। প্রফেসর বরিসের হঠাৎ চলে যাওয়ার পেছনে নিয়তি ছাড়াও তৃতীয় কেউ থাকতে পারে কি? উত্তর হাতড়ে চলেছে সে, এখনো নাগাল পায়নি।

রাতে লাইব্রেরির প্রতিটি কোণা রীতিমতো চিরুনি তল্লাশি করেছে এমা। অনভ্যস্ত হাতে ভীষণ বেগোছ এই ঘর থেকে প্রয়োজনীয় কিছু খুঁজে পাওয়া আর ঈশ্বর দর্শন, প্রায় সমার্থক। যদিও চিরতরে চলে যাওয়ার আগে প্রফেসর কিছু তথ্য তাকে দিয়ে গেছেন। লুডল্ফের সমাধান করা ধাঁধার অর্ধেক তার কাছে আছে। অন্যের দেখানো পথে চোখ বন্ধ করে সে চলতে পারবে না। কথাটা খোলাখুলিভাবে জানিয়েছিল প্রফেসরকে। সুতরাং লুডল্ফের রিসার্চ খুঁটিয়ে দেখে ধীরে সুস্থে এগোতে চেয়েছিল এমা। সেভাবে অর্ধেক পথ হেঁটে সেন্ট-মরিসে পৌঁছেছে। প্রফেসর বাকি অর্ধেক পথের সুলুক দেওয়ার সুযোগ আর পেলেন না।

‘কাজটা কঠিন হয়ে গেল।’

নিজের কানে কানে বলল এমা।

‘ঠিকই বলেছেন ড. মিলার। মনে হয় আমিও আর কাজটা শেষ করতে পারব না।’

চমকে ঘুরে তাকাল এমা। রাফায়েল। রহস্যের কুয়াশা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছিল, তাই প্রফেসরের সহকারী ছাত্রটি কখন ভেতরে ঢুকে এসেছে, টের পায়নি। ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে সুদীর্ঘ শ্বাস ছাড়ল ছেলেটা। দিন শুরুর আলতো আলোয় তার মুখের বিষন্নতা আরও ঘন মনে হচ্ছে। ফুলে ওঠা লাল চোখ দুটো বিনিদ্র রাতের সাক্ষী দিচ্ছে। অনেক ধকল নিয়েছে ছেলেটা। হাসপাতাল থেকে পুলিশ, তারপর প্রফেসরকে শেষ বিদায়। সম্পূর্ণ পর্ব দারুণ দক্ষতায় সামাল দিয়েছে। প্রফেসর তার ওপরে অকারণ নির্ভরশীল ছিলেন না। এমা স্নেহের হাত রাখল তার পিঠে।

‘কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। প্রফেসরের দেখানো পথে হাঁটতে থাক। দেখবে শেষ খুঁজে পাবেই। হাল ছেড়ো না।’

রাফায়েলের চিবুক এবার বুকে মিশল। বিষাদ গম্ভীর স্বরে বলল, ‘হয়তো। কিন্তু প্রফেসরের মতো একজন মানুষের দিক নির্দেশ পাওয়া সৌভাগ্যের ড. মিলার। কাউকে এমন দরদী মন নিয়ে সাহায্য করতে দেখিনি। এরপরের রাস্তাটুকু আমার জন্য সত্যিই কঠিন হয়ে গেল।’

বলে এমার দিকে ঘুরে দাঁড়াল রাফায়েল। শরীরকে টানটান করে যাবতীয় আফসোস এবং অনিশ্চয়তাকে ঝেড়ে ফেলে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি এখন কী করবেন ড. মিলার? যে কাজ নিয়ে এসেছিলেন, মিটেছে?’

এমা উত্তর দিতে গিয়েও নিজেকে আটকাল। প্রফেসর রাফায়েলকে বিশ্বাস করতেন। এমাও এ কয়দিনে তাকে অবিশ্বাস করার মতো কোনো কারণ খুঁজে পায়নি। ছেলেটা মেধাবী এবং কর্মঠ। তবুও তার এখানে আসার কারণ নিয়ে প্রফেসর নিজে সকলের কাছে গোপনীয়তা বজায় রেখেছিলেন। নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য ছিল। প্রফেসরের অবর্তমানে এমা সেই শর্ত ভাঙবে না।

‘পুরোপুরি মিটল কই! তার আগেই এমন ঘটনা…। আমাদের দুজনেরই এক অবস্থা রাফায়েল।’

জানালা দিয়ে মিসেস বেলাকে দেখতে পেয়ে এমা যোগ করল, ‘রাতে তোমার পেটেও কিছু পড়েনি মনে হচ্ছে। চলো দেখি, মিসেস বেলা আমাদের চায়ের সঙ্গে কিছু খাবারের ব্যবস্থা করে দিতে পারেন কিনা।’

কফির সঙ্গে কোল্ড মিট এবং চিজ্ দিয়ে ব্রেড রোল। তার যে খিদে পেয়েছিল, ব্রেড রোলে কামড় বসাতেই এমা বুঝতে পারল। খাবার শেষ করে ধোঁয়া ওঠা কফিতে তৃপ্তির চুমুক দিল সে। আর ঠিক তখনই পেছন থেকে কেউ বলে উঠল, ‘এই যে, আপনারা এখানে! সকাল সকাল বেরিয়ে পড়তে চলেছেন বুঝি? ভালো… ভালো। মিস মিলার না হয় আরও কটা দিন থেকে যেতে পারতেন। সেভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগই পাওয়া গেল না।’

রাফায়েল এবং এমা, দুজনের বক্তার দিকে মুখ ঘোরাল। প্রফেসর বরিসের দূর সম্পর্কের ভাই। মিসেস বেলার কথানুযায়ী, প্রফেসর জীবদ্দশায় এই সম্পর্কটিকে এড়িয়ে চলেছেন। জুয়া থেকে মাদক হয়ে নারী, ভদ্রলোকের(অবশ্য যদি তা বলা যায়) আসক্তির তালিকা লম্বা। বাজারে নাকি ধার-দেনাও বিস্তর। বছর দুয়েক আগে একবার উইলেনডর্ফে কিছু প্রাপ্তির আশায় এসেছিলেন। প্রফেসর কানাকড়িও ঠেকাননি বলে যাওয়ার আগে স্বর্গত পূর্বপুরুষদেরও টেনে নামিয়েছিলেন। তারপর গতকাল আবার হাজির হয়েছেন। উদ্দেশ্য স্পষ্ট। সম্পত্তির ওপরে নিজের অধিকার কায়েম। বাড়িটা পুরোনো হলেও অনেকটা জায়গা নিয়ে। ছড়ানো। তাছাড়া পারিবারিক ভিনইয়ার্ড থেকে আঙুর বেচে কম আমদানি হয় না। মোটা দাঁও।

‘অ্যাটর্নিকে খবর দেওয়া হয়েছে। সম্ভবত দুপুরের আগেই আপনি সবকিছু জানতে পারবেন।’ কফি মাগ টেবিলে নামিয়ে রাফায়েল বলল।

‘সবকিছু! মানে?’

‘প্রফেসরের ব্যক্তিগত ইচ্ছে ছিল এই প্রপার্টি ভিয়েনা ইউনিভার্সিটিকে দিয়ে যাওয়ার। মাস তিনেক আগে অ্যাটর্নিকে ফোনে তেমনই বলতে শুনেছিলাম। সেক্ষেত্রে…’

কথাকে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে অসমাপ্ত রেখে দিল রাফায়েল। তবে যতটুকু সে বলল, তাই-ই যথেষ্ট ছিল। প্রফেসরের দূরসম্পর্কের ভাইটি যাবতীয় ভদ্রতা মাড়িয়ে খরখরে মেজাজে বলে উঠলেন, ‘এ বিষয়ে বাইরের কোনো ছুঁচোর সঙ্গে আমি আলোচনা করব না৷ অ্যাটর্নিকে কী জবাব দিতে হবে, এ বান্দা সেসব ভালো বোঝে। অনেকদিন হলো এ বাড়ির অন্ন ধ্বংস করছ। এবার মানে মানে কেটে পড় দেখি বাছা।’

এমার ইচ্ছে করছিল লোকটার ফোলা গালে কষিয়ে দুটো থাপ্পড় মারে। এমন ভাব করছেন যেন ছেলেটা তার অনুকম্পাপ্রার্থী! অবশ্য কথাগুলো যাকে উদ্দেশ্য করে বলা, তার গায়ে ফোসকা পড়েছে বলে মনে হলো না। রাফায়েল ধীরে সুস্থে নিজের কফি শেষ করল। তারপর মুখের হাসি অবিকৃত রেখে উঠে দাঁড়াল।

‘যেতে তো হবেই। প্রফেসর যখন নেই, তখন আমার এখানে থাকার প্রয়োজনও ফুরিয়েছে। জিনিসপত্র গতকালই গুছিয়ে রেখেছিলাম।’ বলে এমার দিকে তাকাল, ‘ড. মিলার, আপনি কখন বেরুচ্ছেন?’

সন্তর্পণে উত্তর দিল এমা, ‘হয়তো দুটো দিন থাকতে হতে পারে। কিছু পড়াশোনা বাকি আছে। প্রফেসরের লাইব্রেরিটা কাজে লাগবে। আশাকরি আপনার তাতে আপত্তি নেই?’

কুতকুতে চোখের দিকে তাকিয়ে এমা শেষের কথাগুলো বলল।

‘কিছুমাত্র নয় মিস মিলার। আপনি এ বাড়ির অতিথি। থাকুন না যতদিন খুশি।’

‘একটু সাবধানে থাকবেন ড. মিলার। বিলাপের ছদ্মবেশ নিয়ে একটা দুটো করে হায়েনা দেখা দিতে শুরু করেছে।’

জব্বর খোঁচা। এমা হাসতে গিয়ে কোনোমতে নিজেকে সংবরণ করল।

রাফায়েল ভুল শোনেনি। দুপুরের পরপরই ভিয়েনা থেকে অ্যাটর্নি হাজির হয়েছিলেন। ধোপদুরস্ত পোশাকের ভেতর ভীষণ রাশভারী মানুষ। প্রফেসর বরিস তাঁর পৈতৃক সম্পত্তি ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়কেই দান করে গেছেন। তবে কিছু শর্ত রেখে। এই বাড়ি কিংবা আঙুরক্ষেত বিক্রি করা যাবে না। এখান থেকে যা আমদানি হবে, বিশ্ববিদ্যালয় নিজের গুরুত্ব অনুযায়ী খরচ করতে পারবে। আকর্ষণীয় শর্ত হলো, ভিনইয়ার্ডে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে যারা কাজ করছে, কিংবা মিসেস বেলার মতো যাঁরা এতদিন প্রফেসরের সেবা করে এসেছেন, তাঁদের ছাঁটাই করা যাবে না। প্রপার্টি থেকে পাওয়া অর্থের একটা অংশ তাদের পারিশ্রমিক হিসেবে ব্যয় করতে হবে। মিসেস বেলার জন্য বরাদ্দ থাকা পাশের একটুকরো জমি সমেত ঘরখানি, এখন থেকে তাঁর নিজস্ব। অ্যাটর্নি উইলের প্রতিটি অংশ নির্ভুলভাবে বিশ্লেষণ করছিলেন। শুনে বৃদ্ধ প্রফেসরের প্রতি এমার শ্রদ্ধাবোধ আরও গভীর হয়েছে। ঠিক বিপরীত মেরুতে বাস করছেন প্রফেসরের গুণধর ভাইটি। প্রথমে মেজাজ, তারপর আইনকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি, এবং শেষে সকাতর প্রার্থনা। কোনো অস্ত্রই পরীক্ষা করতে বাদ রাখেননি ভদ্রলোক। তবে মোক্ষম ঘা খেয়েছেন অ্যাটর্নিকে ‘আপনাকেও খুশি করে দেব’ বলাতে। শুনে কালো কোটের রাশভারী মানুষটা তো পারলে তখনই ফাঁসিতে ঝোলাবেন! একদলা তুলোর মতো ফোলা থলথলে চেহারা নিয়ে খানিক আগে তর্জন-গর্জন করা লোকটার, চোখের জলে ভিজে চুপসে যাওয়া অবস্থা।

সাক্ষী হিসেবে সই-সাবুদ সেরে ঘর থেকে বেরিয়ে এল এমা। পেছনে মিসেস বেলা। বয়স্ক ভদ্রমহিলা এখনও যারপরনাই ঘাবড়ে আছেন। প্রফেসর তাঁর জন্য এতটা ভেবে রেখেছিলেন, সম্ভবত এমন আশা ছিল না। আকস্মিক প্রাপ্তির সঙ্গে তা পেয়েও হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা মিলেমিশে বেশ জটিল মানসিক অবস্থায় বেচারিকে দাঁড় করিয়েছে। মিসেস বেলার কাঁধে ভরসার হাত রেখে এমা বলল, ‘আমি লাইব্রেরিতে যাচ্ছি। একটু চা পাঠিয়ে দেবেন প্লিজ? আর হ্যাঁ, ওই আপদটাকে নিয়ে অতো ভাবার কিছু নেই। যতই লাফালাফি করুক, সুবিধা হবে না। প্রফেসর পুরো কাজ একেবারে নিখুঁতভাবে করে রেখে গেছেন। আপনার অধিকার কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না। নিশ্চিন্ত থাকুন।’

মিসেস বেলা কথার জবাবে একগাল হাসি উপহার দিলেন। চোখে জমাট বাঁধা আতঙ্কের মেঘ ফিকে হলো কিছুটা।

পোর্ট সিকিউরিটি কর্পস-এর কন্ট্রোল রুমে বসে তিনটে জায়ান্ট স্ক্রিনে ক্রমান্বয়ে সতর্ক নজর বুলিয়ে নিচ্ছে এলিন। প্রতিটি স্ক্রিনে ছোটো ছোটো ভাগে বন্দর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার লাইভ ফিড দেখা যাচ্ছে। এখানে, পোর্ট অব ফ্যালমাথের নিরাপত্তা দেখাশোনা করে সরকারি সংস্থা পি-এস-সি। এছাড়াও লিভারপুল, ডোভার, ব্রিস্টলের মতো বড়ো এবং গুরুত্বপূর্ণ বন্দরের নিরাপত্তার ভারও পি-এস-সি সামলায়। পোর্ট অব ফ্যালমাথে ডক সিকিউরিটির মূল দায়িত্ব এলিনের৷ ফ্যাল নদীর মোহনায় তৈরি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম এই প্রাকৃতিক বন্দরটি ইংলিশ চ্যানেল দিয়ে যাওয়া-আসা পণ্যবাহী জাহাজগুলোর জন্য আদর্শ। বিশ্রাম এবং ছোটোখাটো মেরামতির পাশাপাশি দিনভর পণ্য ওঠানামার কাজও চলে। প্রযুক্তি তার সদা সর্বদা দৃষ্টি বিছিয়ে রাখে বন্দরের সর্বত্র। তবে প্রযুক্তিকেও চোখে চোখে রাখতে হয় বই-কি। সেই কাজেই ব্যস্ত ছিল এলিন। একঘেয়ে হলেও ঢিলেমির অবকাশ নেই। দুই তরুন সিকিউরিটি অফিসার, অন্য সময় কিঞ্চিৎ সুযোগ নিলেও, সিকিউরিটি ইনচার্জের উপস্থিতিতে নিজের উদ্যম দেখানোয় কসুর করছে না।

‘ভালো কাজ করছ ছেলেরা। এভাবেই নজরদারি চালিয়ে যাও।’

বলে কন্ট্রোল রুম ছেড়ে বেরিয়ে এল এলিন। লাল রঙের উঁচু কনটেইনার ক্রেনগুলো যেন স্পর্ধায় আকাশকে ফুঁড়ে চাইছে। পারছে না। সূর্য আজ নতুন বৌয়ের বেশ ধরেছে। সকাল থেকে সেই যে মেঘের ঘোমটা পরেছে, সরানোর নাম নেই! সমুদ্র থেকে নাছোড় বাতাস বেগে ছুটে আসছে। একটা দুটো জলের ফোঁটা এসে পড়ল এলিনের মুখে।

‘স্যর।’

সে সিঁড়ির দিকে নজর ঘোরাল। পোর্ট সিকিউরিটি লেখা হলুদ উইণ্ডব্রেকার পরনে ছোকরা কর্মচারী উঠে এসছে।

‘আপনার পার্সেল।’

‘পার্সেল!’

এখানে তাকে কে উপহার পাঠাল? এমনিতেও এমা ছাড়া গিফট করার মতো এ দুনিয়ায় আর কেউ নেই। অবশ্য সেও কোনোদিন এভাবে কিছু পাঠায়নি। এলিন কৌতূহল ভরে কাগজে মোড়ানো হালকা পাতলা বাক্সটা নিয়ে নির্দিষ্ট কাগজে প্রয়োজনীয় স্বাক্ষর দিল। কন্ট্রোল রুমের ঠিক নিচেই তার নিজস্ব কেবিন। ছোটো, কিন্তু কার্যকরী। কেবিনের আলো জ্বালানোই ছিল। চেয়ারে বসে পার্সেলটা খুলতে উপহার নয়, গুটি কয়েক মুখবন্ধ খাম খুঁজে পেল এলিন। ওপরের খামটা হাতে নিয়ে উলটে পালটে দেখল। কোথাও কিছু লেখা নেই! অবশ্য খামে না থাকলেও প্রেরকের নাম পাওয়ার জন্য খুব বেশি বেগ পেতে হবে না। পোর্ট ক্যুরিয়র সার্ভিস বিভাগ হয়ে এসেছে যখন, চাইলেই সে প্রেরকের ঠিকুজি কুষ্ঠি বের করে ফেলতে পারে। তবে আদৌ তার কোনো প্রয়োজন আছে কিনা আগে তা দেখা দরকার। ডেক্সটপের ঠিক পাশটায় এক তারা চিঠির ওপরে লেটার ওপেনারখানা রাখা ছিল। পরিচ্ছন্নভাবে খাম কেটে বার্তা বের করে আনল এলিন। পত্র প্রেরক কোনো ধানাইপানাইয়ে যাননি, সরাসরি প্রসঙ্গে ঢুকে পড়েছেন! এলিনকে তাই চিঠির শুরুতেই বড়োসড়ো ধাক্কা খেতে হলো।

‘মি. মিলার। আপনার সহোদরা ড. এমা মিলার অজান্তে এক ভয়ংকর বিপদের মুখে এসে দাঁড়িয়েছেন। অস্ট্রিয়ায় তাঁর পাশে বিশ্বস্ত কারোর উপস্থিতি একান্ত প্রয়োজন। গতকাল ভিয়েনায় ফ্রানজেনব্রুক ব্রিজে গুলি চালানোর ঘটনায় এক হতভাগ্য তরুণের মৃত্যু হয়েছে৷ ড. মিলারের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিটিও আহত হয়েছে। সৌভাগ্যক্রমে ড. মিলার বেঁচে গেছেন। পরের আক্রমণে ভাগ্য আপনার বোনকে দ্বিতীয় সুযোগ নাও দিতে পারে। হয়তো আপনি ড. মিলারের ঢাল হয়ে তাঁকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারেন। অস্ট্রিয়া শেনগেন এরিয়ার অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং বৃটিশ নাগরিক হিসেব জরুরি দরকারে ভিসা ছাড়াই আপনার ভিয়েনা প্রবেশে বাধা-নিষেধ নেই। ফ্লাইটের টিকিটের সঙ্গে সেই জরুরি দরকারের প্রমাণপত্রও পেয়ে যাবেন। একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে আপাতত এটুকুই আমি করতে পারি। শুভেচ্ছা রইল।’

হোঁচটের পর হোঁচট খেতে খেতে এলিন চিঠিটা শেষ করল। দু’দিন আগে এমার সঙ্গে তার শেষ কথা হয়েছিল। ভিয়েনায় কোনো একটা সেমিনারে গিয়েছে। ফিরে আসার কথা ছিল, কিছু দরকারি কাজে আটকে পড়েছে। তেমনই জানিয়েছিল দামাল মেয়েটা। এলিনের আঙুল দ্রুত মোবাইল কি প্যাডের নির্দিষ্ট নম্বর ছুঁয়ে গেল। কান খাড়া করে থাকল সে। একটানা বিপ শব্দের পর যান্ত্রিক সুরে জবাব এল ডায়াল করা নম্বরটি আপাতত পরিষেবা সীমার বাইরে রয়েছে। আবার এবং তারপর আবারও এমাকে ফোনে চেয়েও পাওয়া গেল না। এক বিরক্তিকর উত্তর পেয়ে সশব্দে নিজের ফোন টেবিলে প্রায় ছুঁড়ে ফেলল এলিন।

‘আবার নতুন কোন বিপদ জোটালি এমা!’

এলিনের উৎকণ্ঠা কাচের জানালায় ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল। চেয়ারে শরীরের ভর ছেড়ে দিয়ে কিছুক্ষণ নিষ্পলকে চেয়ে রইল বিবর্ণ সিলিংয়ের দিকে। পুরোনো স্মৃতিরা তার মগজের ভেতর শমন জারি করছে। এমা আর এলিন, প্রায় পিঠোপিঠি। দেড় বছরের ছোটো বড়ো। কৈশোরেই ছায়া হারিয়েছে। রোদের কামড় খেয়ে উঠেও দাঁড়িয়েছে। একসঙ্গে। দু’জনের সম্পর্ক ভাইবোন কিংবা বন্ধুর চেয়েও অনেক বেশি। গভীরতা মাপতে গেলে প্রশান্ত মহাসাগরও হার মেনে যাবে। এমার সামান্য ফ্লু হলে সে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে। সেখানে গুলি চালানোর মতো ঘটনা! এলিন ছিলা ছিঁড়ে যাওয়া ধনুকের মতো সোজা হয়ে বসল। মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা ফোনখানা তুলে স্মৃতিতে ধরে রাখা নম্বর ডায়াল করল। ডেভিস কাজের ছেলে। জোনাথন ডারওয়ার্ডের মোকাবিলা করার জন্য সুদূর নাসাউ-তে তাকে দারুণ অস্ত্র জুগিয়েছিল। অস্ত্র হোক বা খবর, ডেভিস এক্ষেত্রে কার্যকরী সোর্স। ফোনের রিং শেষ হতে পরিচিত ভারী কণ্ঠস্বর শুনতে পেল এলিন।

‘ইয়েস৷ বলো বন্ধু, তোমার জন্য কী করতে পারি?’

‘গতকাল ভিয়েনায়  ফ্রানজেনব্রুক ব্রিজের কাছে নাকি গুলি চালানোর ঘটনা ঘটেছে। মারাও গেছে একজন। এ বিষয়ে কিছু জানা যাবে?’

‘আধঘণ্টা পরে ফোন করছি ব্রাদার।’

ডেভিস কম কথার মানুষ। কাজের বেশি। এখনো পর্যন্ত সাহায্য চেয়ে পায়নি, এমন ঘটনা ঘটেনি। মাঝের সময়টুকু বারবার এমাকে ফোনে ধরার চেষ্টা করল এলিন। লাভ হলো না। সেই এক যান্ত্রিক সুর। এখন অপেক্ষা করা ছাড়া তার কিছুই করার নেই। ঠিক উৎকণ্ঠার সময়গুলোতে মিনিটের কাঁটা যেন সহজে ঘর ছেড়ে নড়তে চায় না। নির্ধারিত সময় শেষের আগেই ডেভিসের ফোন এল। যদিও এলিনের কাছে তা এক যুগের সমান।

‘পাকা খবর। গতকাল দানুকান লেকে দু জন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তার মধ্যে কম বয়সের এক তরুণ মারাও গেছে। আরও একটা খবর আছে।’

কয়েক মুহুর্ত থেমে যোগ করল ডেভিস, ‘তোমার ওস্তাদ বোন, এমাও…’

‘ধন্যবাদ ডেভিস। তৈরি থেক। তোমার সাহায্যের প্রয়োজন হতে পারে।’

ডেভিসকে থামিয়ে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলল এলিন। বাকি যা কিছু সে নিজেই জেনে নেবে। চেয়ার ছেড়ে দ্রুত কেবিনের বাইরে এসে দাঁড়াল সে।

কোয়ার্টারে পৌঁছানোর আগে আরও দুটো ফোন করতে হয়েছিল এলিনকে। তার মধ্যে একটা একটা পোর্ট অথরিটিকে। এভাবে হঠাৎ ছুটি পাওয়া যায় না। উত্তর জানাই ছিল। ‘জরুরি’ এবং ‘ব্যক্তিগত প্রয়োজন’ শব্দ যোগ করে তাই মেইল করে দিয়েছে। কর্তারা যা ভালো মনে করে, করুন। কেরিয়ারে একটা দাগের থেকে বিপদে বোনের পাশে দাঁড়ানোর গুরুত্ব অনেক অনেক বেশি তার কাছে। চিঠির প্রেরক কে জানতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু খোঁজাখুঁজির বাড়তি সময় তার হাতে নেই। মিত্র বা শত্রু, যে পক্ষেরই হোক, ভিয়েনার টিকিট পৌঁছে দেওয়ার জন্য এলিন তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে।

 

 

শপথ এবং পথ চলা

……………………………

শেষ রাতে বাতাসের সঙ্গে গাছেরা, আকাশের সঙ্গে মাটি, বুঝি চরাচরে বিশ্বপ্রকৃতির যা কিছু একান্ত নিজের, সকলে ভীষণ তর্কে মেতেছিল। কাঠের তক্তা দিয়ে কোনোমতে তৈরি অস্থায়ী আবাসের প্রতিটি আলগা অংশ, সেই বিতর্ক টেনে আনছিল ঘরের মধ্যে। তামার পাত্রে জ্বালিয়ে রাখা কয়লা আর মোটা পশমের বিছানা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে শরীরকে প্রাকৃতিক দ্বন্দ্ব থেকে বাঁচিয়ে রাখার। তারপর কখন যে অবাধ্য রাতের আয়ু ফুরিয়েছে, প্রবীণ সন্ন্যাসী টের পাননি। দরজা খুলে তিনি যখন বেরিয়ে এলেন, প্রকৃতির থেকে তাঁকে আলাদা করা গেল না। চারিদিক, যতদূর নজর পৌঁছায়, ফটফটে সাদা রঙে মোড়া। অস্থায়ী বসতি ছাড়িয়ে, গুহার মুখে অদ্ভুত বাঁকা শরীরের জুনিপার গাছটিও শুভ্র বসনে সেজে রয়েছে। সন্ন্যাসী কিছুক্ষণ স্থির রইলেন। দুটো চোখ বন্ধ। ডান হাতটা ভাঁজ খেয়ে বুকের বাঁ দিকে, হৃদয়ের কাছাকাছি ধরে রাখা। হয়তো আরও একটা সকাল উপহার দেওয়ার জন্য ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন। তাঁর শঙ্খশুভ্র চুলের গোছা কাঁধের কাছে নেমে এসেছে। দাড়ি বুকে। পর্বত চূড়া টপকে আসা সকালের আলো মেখে দাঁড়িয়ে থাকা সন্ন্যাসীকে এই মুহুর্তে দেখে স্বর্গের দেবদূত বলে মনে হচ্ছে! তাঁর এই বসন, মাথা এবং দাড়ির শুভ্রতা, কিংবা মুখের আশ্চর্য প্রশান্তিভাবের আড়ালে লুকিয়ে থাকা আসল মানুষটা কেউ চেনে না। রোমান সেঞ্চুরিয়ান গায়াস কাসিয়াস গুটিকয়েক পরিচিত ছাড়া বাকিদের কাছে কবেই মৃত। এখন সবার কাছেই তিনি দয়ালু সেন্ট লংগিনাস।

কিছুটা সময় একভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর সন্ন্যাসী মাটিতে নেমে এলেন। পাশাপাশি ঘরগুলো তাঁর আগেই জেগে উঠেছিল। মহিলারা এখন উনুন জ্বালাতে ব্যস্ত। কচি-কাচাদের দল তুষার গোলা বানিয়ে একে অপরকে নিশানা করতে। সন্ন্যাসীকে দেখতে পেয়ে দৌরাত্ম থামিয়ে দিল তারা। বড়োরা, এমনকি বুড়োরাও সমীহ করে এই শান্ত স্থিতধী মানুষটাকে। বরফে ভেড়ার চামড়ায় তৈরি চেটো ঢাকা জুতোর ছাপ ফেলে সন্ন্যাসী এগিয়ে গেলেন চঞ্চল শৈশবের দিকে। ইতিমধ্যে তাঁকে দেখতে পেয়ে মহিলারা সব জড়ো হয়েছে। তুষারের কামড় অগ্রাহ্য করে হাঁটু মুড়ে বসেছে।

‘তোমাদের শত্রুদের ভালোবেসো। যারা তোমাদের নির্যাতন করেছে, তাদের জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করো। তিনি যেন ভালো-মন্দ সকলের ওপরে সূর্যালোক দেন। ধার্মিক-অধার্মিক সকলের ওপরে বৃষ্টি দেন। তাঁর কাছে নিজের জন্য কিছু চাওয়ার প্রয়োজন নেই। পিতা জানেন তোমাদের কী প্রয়োজন।’

একসময় নাজরাতীয় জিশুকে অনুসরণ করে গালীল, দিকাপলি, জেরুজালেম, যিহূদিয়া থেকে যর্দ্দন পর্যন্ত পথ ভেঙেছিলেন রোমান সেঞ্চুরিয়ান। পথের মাঝে জমে ওঠা ভিড়কে এমন কত কথা বলতে শুনেছেন। ধর্মের তত্ত্বকথা নয়, জীবন কথা। নীতি কিংবা মূল্যবোধের শিক্ষাকে কী দারুণ নিপুণতায় ধর্মের মোড়কে বিলি করত আশ্চর্য মানুষ! মাসিহাই বটে। না হলে সাধারণ জীবনশৈলীর পাঠে মানুষের বধিরতা দূর করতে ধর্মের কৌশল নেয়?

‘তোমরা যৌন পাপ না করার কথা শুনেছ। প্রভু বলেছেন কেউ যদি কোনো মহিলার দিকে লালসাপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়, তবে সে মনে মনে যৌন পাপ করে। মনে রেখো, তোমরা সকলেই ঈশ্বরের অংশ। তাই আমি তোমাদের কানে কানে যা বলছি, তোমরা চিৎকার করে বলো। যারা তোমাদের কেবল দৈহিকভাবে হত্যা করতে পারে, তাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’

বিশ্বভাতৃত্ব বোধের, দয়াশীল এবং প্রতিবাদী হওয়ার যে শিক্ষা একদিন পেয়েছিলেন, সেই সমস্ত শিক্ষা ক্যাপাডোসিয়ানের প্রতিটি অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়া অবসরপ্রাপ্ত রোমান সেঞ্চুরিয়ান গায়াস কাসিয়াসের বাকি জীবনের লক্ষ্য। ভুল হলো, এখন তাঁকে আর অবসরপ্রাপ্ত রোমান সেঞ্চুরিয়ান গায়াস কাসিয়াস বলা যাবে না। রঙিন টোগা, ঝলমলে পোশাকের বদলে পরনে তূষার শুভ্র গোড়ালি ঢাকা লিনেনের আলখাল্লা। যে হাতের মুঠোয় ধরা থাকত ধাতব ফলক যুক্ত খাটো বর্শা, সে হাতে এখন মৃত উদ্ভিদ শাখা। গায়াস নন, তিনি এখন সেন্ট লংগিনাস।

‘তোমরা এবার নিজের নিজের কাজে যাও।’

বলে ভিড় ছেড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বিস্তৃত ভূভাগের দিকে এগিয়ে গেলেন সেন্ট লংগিনাস। ঠিক পেছনেই পাহাড় শ্রেণী। হাত ধরাধরি করে চলে গেছে দৃষ্টি সীমানা ছাড়িয়ে। পাহাড়ের পায়ের কাছে ছোটো বড়ো নানা আকৃতির পাথরের স্তূপ। তাদের ডিঙিয়ে একটু ওপরে উঠলে একটা পাথুরে চাতাল। পাহাড়ের গায়ে একটা বৃত্তাকার ছিদ্র। এখান থেকেই সুরঙ্গপথের শুরু৷ সুরঙ্গ মুখের ঠিক পাশটায় বড়োসড়ো একটা গোলাকার চ্যাপ্টা পাথর। তিন জন পুরুষ ছেনি হাতুড়ি নিয়ে সেই পাথরকে নিখুঁত রূপ দিতে মগ্ন। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে এই বৃত্তাকার পাথরের অংশ আসলে সুরঙ্গ মুখের দরজা। বাইরে থেকে বসিয়ে দেওয়ার পর এমনভাবে মিশে যাবে, যে তাকে পাহাড়ের শরীর থেকে আলাদা করা মুশকিল। সন্ন্যাসীকে দেখে হাতের কাজ ফেলে উঠে দাঁড়াল সকলে। দুটো হাত বুকের কাছে এনে তাদের অভয় দিলেন সেন্ট লংগিনাস। তাঁর চোখ চলে গেল সামনে। পাথুরে শরীর কেটে তৈরি পথ, ব্যদিত মুখে নিঃসীম তমিস্রার মধ্যে তাঁকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। অন্ধকার পেরিয়েই তো আলোর দেখা মেলে। মরিয়ামের ছেলেটা এই সত্যকে কত আগে অনুভব করেছিল! করেছিল বলেই মৃত্যুকে আলিঙ্গনের মুহুর্তে এতটুকু আফসোস করেনি।

সংকীর্ণ পথ, এঁকেবেকে যেন পাহাড়ের গর্ভে ঢুকে গেছে। যাওয়ার পথে ডাইনে বাঁয়ে তৈরি করছে আরও কিছু শাখা। এগুলো অবশ্য ধাঁধা তৈরি করার জন্য বের করা। এমন পরিকল্পনা অ্যাডোনিস ছাড়া কার উর্বর মস্তিষ্কের ফসল হতে পারে? সুযোগ পেলে স্থপতি হিসেবে জেনেরিয়াসের নাম আরও উজ্জ্বল করতে পারত সে। পিতার, নিজের নামকে ইতিহাসের পাতায় খোদাই করার পরিবর্তে অ্যাডোনিস বেছে নিয়েছে অন্য পথ। এক মহান আদর্শকে রক্ষা করার পথ। আর এই পথ নির্মানের নকশা এঁকে দিয়েছেন আরিমাথিয়ার জোসেফ।

‘ঈশ্বরের সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে’- এই কথার মধ্যে দিয়ে বৃদ্ধ জোসেফ আদতে বিশ্বাসকে রক্ষা করার দায়িত্ব সঁপেছেন তাঁদের কাঁধে। পরিকল্পিত প্রচার, জটিলতা, রহস্যের গভীরতা সেই বিশ্বাস টিকিয়ে রাখার অন্যতম মন্ত্র। একদিন যেভাবে সকলে প্রভু যিশুর পুনর্জীবনের কথা শুনেছিল, এমনকি কেউ কেউ দেখেওছিল, সেভাবেই মৃত্যুর মুহূর্তে তাঁর পান করা পাত্র, তাঁর পোশাকে কিংবা রোমান সেঞ্চুরিয়ানের বর্শা ফলকে শুকিয়ে লেগে থাকা পবিত্র রক্তের দাগকে অনশ্বর করে যেতে হবে।

প্রধান সুরঙ্গ পথকে মশালের আলো মাখিয়ে রাখা হয়েছে। খুঁজে নিতে ভুল হয় না। অবশ্য আলো না থাকলেও একটানা ভেসে আসা পাথর কাটার শব্দ চিনে এগিয়ে যাওয়া যেত। সেন্ট লংগিনাস সেই পথ ধরে কিছুটা ওপর নিচে হেঁটে একটা প্রশস্ত অংশে এসে থামলেন। ফ্যাকাসে পাথুরে গুহার গায়ে লেগে থাকা স্ফটিকখণ্ড মশালের আলোয় নক্ষত্রের মতো ঝিকমিক করছে। শীতের তীব্রতা শুষে মৃত্যুর চেয়েও কঠিন শৈত্য ধারণ করছে পাহাড়ের এই গর্ভগৃহ। দু’জন প্রশস্ত এই অংশে, গুহার গায়ে ভাষা ফুটিয়ে তুলছে। তাদের ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে অ্যাডোনিস। জেনেরিয়াসের সুযোগ্য পুত্র।

‘কাজ কতদূর এগোল অ্যাডোনিস?’

প্রয়োজন মতো প্রাচীন অক্ষরমালা তৈরির নির্দেশ দিচ্ছিল গ্রিক স্থপতি। পরিচিত কণ্ঠে নজর পেছনে ফেরাল। প্রশ্নের সঙ্গেই স্থব্ধ হয়ে গেল এতক্ষণ ধরে সচল দু জোড়া হাত। তবে শেষ আঘাতের অনুরণন সুরঙ্গ ধরে এগিয়ে ফুরিয়ে যেতে আরও কিছুটা সময় নিল।

‘প্রায় শেষ দিকে। শেষ ধাপে নতুন এক প্রকৌশল অবলম্বন করেছি। এখানে কোনো প্রবেশ দ্বারের অস্তিত্ব দেখতে পাচ্ছেন?’

পাথের গায়ে ফুটিয়ে তোলা অক্ষরমালার দিকে দিকে আঙুল তুলল অ্যাডোনিস। প্রশ্নের জবাবে দু পাশে মাথা নাড়লেন সন্ন্যাসী।

‘অচেনার মাঝে কিছু পরিচিত গ্রিক অক্ষর। এছাড়া অন্য কিছু চোখে পড়ছে না।’

‘অচেনা অক্ষরগুলো ফ্রিজিয়ান ভাষায় লেখা। তিনশো বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিছু কিছু হরফ আমাদের গ্রিক ভাষার মতো। পাথরে ছাপানো এই হারিয়ে যাওয়া ভাষার মধ্যে গুপ্তকক্ষে প্রবেশের ইঙ্গিত রয়েছে। ব্যাপারটা দারুণ, না?’

‘নিঃসন্দেহে অ্যাডোনিস। তোমার এই পাহাড়ের গর্ভে গোটা একটা বসতি গড়ে তোলার পরিকল্পনা দেখলে চমৎকৃত না হয়ে উপায় নেই! এমন বসতি আমাদের দরকার। যেমন আমরা অনুমান করেছিলাম, শাসক এবার তার উদরতার মুখোশ খুলে ফেলছে। প্রভু জিশুর প্রতি মানুষের ক্রমবর্ধমান বিশ্বাস, তাঁর মানবধর্মে দীক্ষিতদের সংখ্যা যত বাড়ছে, শাসকের ফাঁস তত গলায় চেপে বসছে। সামনে আরও সংকটময় সময় অপেক্ষা করছে। অনেকে ঘরছাড়া হতে চলেছে অ্যাডোনিস। তখন তোমার এই ভূ-গর্ভস্থ বসতি নির্মান কৌশল, তাদের সহায় হবে। ইতিহাস ভুলে গেলেও, ঈশ্বর তোমাকে মনে রাখবেন। নিশ্চিত জেনো।’

অদৃশ্য, অদেখা ঈশ্বরকে কল্পনা করে শ্রদ্ধায় মাথা নত করল গ্রিক স্থপতি। মুহুর্ত থেমে আবার যোগ করলেন প্রৌঢ় সন্ন্যাসী,

‘গুপ্তকক্ষে সবকিছু সুরক্ষিত রাখা আছে?’

‘সব সুরক্ষিত। সুরঙ্গ পথের প্রবেশদ্বার খুঁজে পেলেও এই প্রার্থনা কক্ষে পৌঁছানো সহজ হবে না। কেউ যদি পৌঁছেও যায়, এখানে কক্ষের মধ্যে লুকিয়ে রাখা কক্ষের হদিস পাওয়া আরও কঠিন। মাসিহার পবিত্র রক্তে ভেজা বর্শা ফলকের নাগাল পেতে শক্তিশালী মস্তিষ্কের প্রয়োজন। সুরক্ষা আমার চিন্তার বিষয় নয় হে মহানুভব…’

গ্রিক স্থপতির সংকোচ খেয়াল করলেন সন্ন্যাসী।

‘প্রশ্নকে মনের ভেতর চাপা রাখতে নেই অ্যাডোনিস। যদিও আমি অনুমান করতে পারি, তবুও তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই। করো।’

‘মাসিহা আমাদের ছেড়ে যাননি। তাহলে তাঁর স্পর্শধন্য এই বর্শা ফলক, কিংবা পানপাত্র সর্বসমক্ষে রাখাতে অসুবিধা কোথায়? সেগুলোর অবিকল নকল ছড়িয়ে দেওয়ার পেছনে কোন বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে? অনাবশ্যক কৌতূহল প্রকাশ করলে মার্জনা করবেন।’

প্রৌঢ় সন্ন্যাসী মৃদু হেসে বললেন, ‘একদিন, কোনোদিন যদি মানুষ শুধুমাত্র একটা জাতি হিসেবে পরিচয় পায়, তখন এই পচনশীল সভ্যতাকে বদলে দিতে চাওয়া প্রথম মানুষটাকে যেন আমাদের মনে পড়ে। এই বর্শা ফলক, পানপাত্রের সঙ্গে প্রভু জিশুর স্মৃতি জড়িয়ে। তাঁর শিক্ষাকে, যা দাবানলের মতো দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তে চলেছে, সমাজ শাসকরা নিভিয়ে দিতে চাইবে। আর তার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন প্রভু জিশুর সংশ্লিষ্ট প্রতিটি স্মৃতিচিহ্নকে মুছে ফেলা। স্মৃতির সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে বিচারধারা। তারা একথা জানে অ্যাডোনিস। ইতিমধ্যে সেই প্রচেষ্টা করেওছে।’

অ্যাডোনিসের দৃষ্টিতে মুগ্ধতা ধরা পড়ছিল। দীর্ঘ দু দশকের ওপর সাবেকি পোশাকের এই সন্ন্যাসীর সঙ্গ পাওয়ার সৌভাগ্য পেয়েছে সে। অবশ্য একটানা নয়। মাসিহার বাণী ছড়িয়ে দিতে প্রদেশ থেকে প্রদেশে ভ্রমণ করতে হয় তাঁকে। মানবতার আদর্শ ফেরি করার এক দুর্লভ ভার, এতগুলো বছর ধরে নিজের কাঁধে বয়ে নিয়ে চলা সাধারণ মানুষের পক্ষে সাধ্যাতীত। তাই মাঝে মাঝে, যখনই কাছে পাওয়ার সুযোগ পেয়েছে, সন্ন্যাসীর কাছ থেকে জীবনের পাঠ নিয়েছে অ্যাডোনিস। সেন্ট লংগিনাসের মতো স্থির বুদ্ধির কাউকে দেখেনি। বর্তমানে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যৎকে উপলব্ধি করা খুব সহজ নয়।

‘এখানে আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে অ্যাডোনিস। কয়েকদিনের মধ্যে আমাকে সাজারিয়া পৌঁছাতে হবে। মাসিহার কথা শুনতে চাইছে সেখানকার নিগৃহীত দুখী মানুষেরা। তবে তার আগে অ্যাডোনিস, তোমাকে একটা শেষ দায়িত্ব পালন করতে হবে। অবশ্য জোসেফের সেবক মইসও থাকবে তোমার সঙ্গে। এখানে উপস্থিত সমস্ত ভাই-বোন এক পবিত্র শপথ নিতে চলেছে। তোমরা দুজন হবে সেই শপথ যজ্ঞের পুরোহিত। ঈশ্বরের সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার পবিত্র অঙ্গিকার তোমরা সকলে জন্মজন্মান্তর ধরে রক্ষা করবে।’

 

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *