সৌভাগ্যশলাকা। ধারাবাহিক উপন্যাস। পর্ব ৫। লিখছেন অলোক সান্যাল

0

(গত পর্বের পর)

আড়ালে আছে হায়েনা

………………………………..

ভিয়েনা ইমিগ্রেশন অফিসের ব্যবস্থাপনা প্রশংসনীয়। প্রতিটি প্রয়োজনের জন্য আলাদা উইনডো। ব্যবস্থা আলাদা হলেও নিজের দরকারি ডেক্স খুঁজে পেতে অসুবিধা হয় না। এমা এসেছিল রেসিডেন্স পারমিটের জন্য। অস্ট্রিয়া আসার আগে এখানে যে বৃটিশ ভিসা এক্সটেনশন হয় না, তা অজানা ছিল। লাগবে না বলে সিঙ্গল এন্ট্রি ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়েছিল সে। তিরিশ দিনের। সময়টা খুব কম নয়। ইভেন্টের পাশাপাশি দেশের আনাচেকানাচে ঢুঁ মারারও একটা সুপ্ত বাসনা ছিল, তবে তার জন্য তিরিশ দিন অনেক লম্বা সময়। কিন্তু এখন, প্রফেসর বরিসের সঙ্গে যোগাযোগের পর, হিসেব বদলে গেছে৷ এখন হয়তো ভিসার কাগজে লেখা দিন সংখ্যাটা তার কম পড়তে পারে৷ ইতিমধ্যেই সে চোদ্দ দিন খরচ করে ফেলেছে। হ্যাঁ, নিখাদ কৌতূহলে ওয়াকাউ ভ্যালিতে প্রফেসর বরিসের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিল। তারপর থেকে এক সপ্তাহের ওপর হয়ে গেল, উইলেনডর্ফে প্রফেসরের বাড়ি তার ঠিকানা। মাঝে একবার অবশ্য তাকে ভিয়েনায় আসতে হয়েছিল। হপবানহফ সেন্ট্রাল স্টেশনের লকার রুম থেকে লাগেজ নিতে। সামান্য কিছু কেনাকাটাও সেরে নিয়েছে সেই ফাঁকে। এমা দিন দশ-বারো চলার মতো প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিল। প্রফেসর বরিসের কল্যাণে তা দীর্ঘমেয়াদি হতে চলেছে। সুতরাং দৈনন্দিনের প্রয়োজনীয় টুকিটাকি কেনাকাটা না করে উপায় ছিল না। তারপর আজ আবার। নাহ্, সরকারি কাগজপত্রের ব্যাপারটা নিয়ে তেমন সমস্যায় পড়তে হয়নি এমাকে। পড়তে হয়নি প্রফেসরের কল্যাণে। সরকারি মহলের উঁচু তলায় নিশ্চয়ই যোগাযোগ আছে। তাকে মাত্র মিনিট চল্লিশেক অপেক্ষা করতে হয়েছে। অস্ট্রিয়ান গর্ভমেন্টের সিল যুক্ত কাগজটা এবার ক্রেমশ টাউনের সংশ্লিষ্ট আধিকারিকের হাতে তুলে দিলেই একশো আশি দিনের জন্য সে অস্ট্রিয়ার অস্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে প্রফেসর বরিসের ঠিকানা তাঁর বাসস্থান।

 

ইমিগ্রেশন অফিস থেকে বেরিয়ে এল এমা। একটু দূরে পার্কিং লটে কালো গাড়িটা দাঁড়িয়ে। ডেভিড যথারীতি তার গায়ে হেলান দিয়ে। চোখাচোখি হতে এবার সোজা হলো। বাহন সমেত তার সারথির নিয়োগ বাতিল না হওয়ার কারণ এমার জানা নেই। দিন দশেক আগে ইভেন্টের ব্যাপার-স্যাপার সব মিটে গেছে। এরপরে কোনো আমন্ত্রিত সদস্যকে বিশেষ সুযোগ সুবিধা দেওয়ার কথা নয়। অথচ এমার ক্ষেত্রে তাই-ই ঘটছে! ডেভিডকে প্রশ্ন করেও কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। তার কেবল একটাই উত্তর,

‘আমার নির্দেশে এখনো কোনো পরিবর্তন আসেনি মিস মিলার। সংস্থা যতদিন পর্যন্ত না আমাকে রিলিফ দিচ্ছে, ততদিন আমাকে কাজটা চালিয়ে যেতে হবে। চুক্তি ভাঙলে অর্থদণ্ড। তাই দয়া করে সহযোগিতা করুন।’

‘বেশ। আমার জন্য কারোর আর্থিক ক্ষতি হোক, আমি তা চাই না। শুধু সবসময় আপনার সওয়ারি হওয়ার অকারণ অনুরোধ করবেনা না।’

 

উইলেনডর্ফ থেকে ভিয়েনা যাতায়াতে অবশ্য ডেভিডের বাহনের ওপর আস্থা না রেখে উপায় ছিল না। কালো রঙের মার্সিডিজ বেঞ্জ মসৃণভাবে  প্রায় নিঃশব্দে এগিয়ে এসে এমার সামনে দাঁড়াল। দরজা খুলে যেতেই নিজেকে ভেতরে ছুঁড়ে দিয়ে এমা বলল, ‘ব্রিজ পেরিয়ে একটা সুপার মার্কেট আছে৷ দু-একটা জিনিস কিনতে হবে।’

 

নীরবে ঘাড় নেড়ে গাড়িকে রাস্তায় নামাল ডেভিড। সামান্য এগিয়ে গাড়ির মুখ বাঁ দিকে ঘুরতেই ফ্রানজেনব্রুক ব্রিজের ধাতব মাথাটা এমার নজরে এল। দানুকানাল। অনেকে দানিয়ুব কানালও বলে। ব্রিজের শেষে, একটু পাশে রিভারভিউ পয়েন্ট লেখা একটা বোর্ড। সে ব্যস্ত ভাবে বলে উঠল, ‘ডেভিড, ব্রিজ পেরিয়ে একটু দাঁড়াও প্লিজ। কয়েকটা ছবি তুলব।’

 

দানুকানালের দুপাশ বরাবর সবুজ গাছের সারি। মালবেরি, রোয়ান। লাল থোকা থোকা ফলের ছোপ লেগে রয়েছে রোয়ান গাছের সবুজ শরীরে। খাটো উচ্চতার ক্র‍্যাব অ্যাপেল এবং রক চেরি গাছও জায়গা করে নিয়েছে মাঝে মাঝে। গাছেদের সীমানা পেরিয়ে খোলা জায়গা জুড়ে বসার ব্যবস্থা। ব্যস্ত সময়েও অনেকে হাজির একটু আনন্দ খুঁজে নিতে। সন্ধের আগে আগে বসার বাকি জায়গাগুলোও কানায় কানায় ভরে উঠবে। ডেভিড রাস্তার পাশে সুবিধামতো গাড়িটা দাঁড় করিয়েছিল। গায়ে গায়ে লেগে না থাকলেও ড. মিলারকে সে নজর ছাড়া করে না। মেয়েটার নিরাপত্তার ভার তার ওপরে। এখনো দুশ্চিন্তা করার মতো কিছু ঘটেনি। শুধু ক্রেমস-এ প্রথম দিন ড. মিলার কীভাবে স্টেশন ছেড়ে অনেকটা রাস্তা ভিয়েনার দিকে এগিয়ে এসেছিলেন, জিজ্ঞেস করেও সদুত্তর পায়নি। কিছু হয়নি বলেই ডেভিড গা ছাড়া ভাব দেখাতে পারে না। অথরিটি যখন তাকে মেয়েটার নিরাপত্তার কাজে নিয়োগ করেছে, নিশ্চয়ই বিপদের সম্ভাবনা আছে। সুতরাং প্রস্তুত থাকা তার কর্তব্য। তার পেশায় কোনোরকম শিথিলতার এতটুকু জায়গা নেই।

 

বসার জায়গা ছেড়ে সামান্য পেছনে একটা দুটো রেস্তোরাঁ। রঙচঙে পোশাকের কয়েকজন যুবক টেবিল ঘিরে বসে। বিয়ার পান করার সঙ্গে সঙ্গে সজোরে হেসে উঠছে। তাদের একটু সামনেই বসে মেয়েটা৷ হাতের টেলিস্কোপিক ক্যামরা কোণাকুণি তাক করা। ডেভিড দূর থেকেই লক্ষ্যবস্তু অনুমান করল। রোয়ান গাছের ছায়ায় এক বৃদ্ধ দম্পতি গল্পে মশগুল। হাতে বাঁধা তাদের হাত। বেশ রোমান্টিক দৃশ্য সন্দেহ নেই। মেয়েটাকে দেখে তো রসকষহীন বলেই মনে হয়! অবাক হলো ডেভিড। তারপরই সচকিত হয়ে উঠল। আড্ডাবাজ যুবকদের থেকে সাদা টি-শার্ট পরা একজন উঠে মেয়েটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ডেভিডের পা জোড়া সচল হল এবার।

 

‘কোনো সমস্যা মিস মিলার?’

দু’জনের মাঝে গিয়ে দাঁড়াল ডেভিড। অচেনা যুবেকের চোখে কঠিন চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল সে। সম্ভবত একলা সুন্দরীকে দেখে উৎসাহপ্রবণ হয়ে পড়েছে। ছেলেটা ডেভিডকে দেখে মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। তারপর দ্রুত জড়তা কাটিয়ে হেসে বলল, ‘কোনো সমস্যা নেই মিস্টার৷ আমি একসঙ্গে পানের আমন্ত্রণ জানাতে এসেছিলাম মাত্র। আপনিও যোগ দিতে পারেন। আসুন না। ওই তো, আমার সঙ্গীরা বসে আছে।’

পেছনে হাত তুলে নিজের টেবিলটা দেখিয়ে বলল ছেলেটা।

‘ধন্যবাদ। আমাদের কাজ আছে। আপনারা আনন্দ করুন।’

 

এমা নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় অনবধানতাবশত কাঠের চেয়ারে ধাক্কা খেল সে। হাত থেকে ক্যামেরা ফসকে যেতে, ঝুঁকে সেটাকে লুফে নিতে গেল। তখনই একটা অস্পষ্ট পরিচিত শব্দ কানে এল ডেভিডের। মুহুর্ত পরেই, যেন একটা জোরালো ধাক্কা খেয়ে সঙ্গিনী জোটাতে আসা যুবক ছিটকে পড়ল মাটিতে। বসার জায়গা ছাড়িয়ে রেস্তোরাঁ, তার পেছনে ফাঁকা জায়গা, ঠিক তার পরে রাস্তার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলোর দিকে নজরকে ছড়িয়ে দিল ডেভিড। স্নাইপার! গুলির উৎসস্থল ওই গাড়িগুলোর একটা। ক্যামেরা হাতে নিয়ে এমা মাথা তোলার আগেই ডেভিড নিজের শরীরের ভর তার ওপরে চাপিয়ে দিল।

‘নড়বেন না মিস মিলার। শুয়ে থাকুন।’

‘এই অসভ্যতামির মানে কী ডেভিড?’

পিঠ থেকে ঝটকা মেরে শরীরটা সরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে উঠল এমা। নিজেকে সরিয়ে নিলেও বস্তার মতো ভারী ডেভিডের হাতখানা এমাকে উঠতে দিচ্ছে না।

‘ছাড়ুন। ছাড়ুন আমাকে।’

শুয়ে থাকা অবস্থায় বাঁ পা দিয়ে লাথি মারল সে। ডেভিড হাত আলগা করে শান্ত স্বরে বলল, ‘পেছনে দেখুন।’

মাথা ঘোরাতেই দৃশ্যটা দেখতে পেল এমা। একটু আগে যেচে আলাপ করতে আসা ছেলেটা পড়ে রয়েছে। পা দুটো ছড়িয়ে রাখা। থরথর করে কাঁপছে। দুটো হাতও দু’পাশে ছড়ানো। হাতে ধরা বিয়ারের ক্যান গড়িয়ে টেবিলের তলায়। অদ্ভুত এক ঘরঘরে শব্দ বেরিয়ে আসছে মুখ থেকে। কেঁপে কেঁপে উঠছে শরীর। গলার কাছটায় বুড়বুড়ি কাটছে রক্ত। সাদা পোশাক জুড়ে ক্রমশ ছড়িয়ে যাচ্ছে লাল রং। কোনো নির্দেশ নয়, শুধু এই দৃশ্যটাই এমাকে পাথর করে দিল।

 

চারপাশের লোকজন ঘটনাটা বুঝতে সময় নিল কিছুটা। সবকিছুই তো রোজকার মতো ছিল। দুপুরের দিকে সামান্য ভিড়। দানুকানালে লঞ্চের আসা যাওয়া। তাদের হুইসেলের আওয়াজ। আশেপাশের গল্পের মাঝে দু-একটা ছোটো ছোটো বাচ্চার খিলখিল হাসি। ছুটন্ত শৈশবকে সামলাতে চাওয়া কয়েকটা হাত। আচমকা সেসব চেনা দৃশ্য লহমায় বদলে গেল সীমাহীন বিভীষিকায়! কাছেই চিৎকার করে উঠল কেউ, ‘গুলি! গুলি চলছে!’

একজনের কণ্ঠস্বর থেকে ‘গানম্যান’ শব্দটা দ্রুত ভীষণ আতঙ্কের ঢেউ তুলল চত্ত্বর জুড়ে। ভিয়েনার রাস্তায় এক ধর্মোন্মাদের গুলিবর্ষণের স্মৃতি গত চার বছরে প্রায় ফিকে হয়ে এসেছিল। ‘গানম্যান’, এই একটা শব্দ সেই দগদগে ক্ষতকে মস্তিষ্কের কোষে কোষে জাগিয়ে তুলল যেন। অনেকেই নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নিতে চাইছে। একটু সাহসী কয়েকজন, মাথা নিচু করে এমাদের কাছে এগিয়ে এল।

‘আমরা ঠিক আছি।’

বলেই এমাকে পরবর্তী নির্দেশ দিল ডেভিড,

‘মিস মিলার, কোটটা খুলে ফেলুন। দ্রুত। উঁহু, মাথা তুলবেন না।’

তাকে কোট খুলতে হবে কেন এমা বুঝতে পারল না৷ এখন বোঝাবুঝির সময়ও নয়৷ এমা তাই কোনো প্রশ্ন না করে হাঁটুঝুল কোটখানা শরীর থেকে মুক্ত করতে সচেষ্ট হলো।

 

এমার হালকা বাদামী লং কোট পাশে, টেবিলের নিচে রেখে ঝট করে উঠে দাঁড়াল ডেভিড। তাদের গাড়িটা আততায়ীর ধারেকাছেই রয়েছে। সুতরাং ওদিকটা নিরাপদ নয়। এমাকে শক্ত হাতে টেনে তুলেই ডান দিকে কোণাকুণি, একটু আগে বৃদ্ধ দম্পতি যে রোয়ান গাছের নিচে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে ছিল, দ্রুত পা চালাল সেদিকে। গোটা চত্বর প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে। ক্লিন শট নেওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ। পুলিশ এলে আতঙ্কের রেশ কাটিয়ে ভিড় জমবে আবার। অন্তত ততক্ষণের জন্য একটা আড়াল দরকার। গাছের কাছে পৌঁছে এমাকে আড়ালে ঠেলে দেওয়ার সময়ই আবার শব্দটা শুনতে পেল ডেভিড। হঠাৎ মনে হলো কোনো হিংস্র পশু বুঝি শক্ত চোয়াল দিয়ে তার বাঁ কাঁধ খামচে তুলে নিল! ইশারায় এমাকে গাছের গুঁড়ির পেছনে বসে পড়তে বলল ডেভিড। তারপর কোনোমতে জ্যাকেটের চেন খুলে পুরোনো সঙ্গী স্প্রিংফিল্ড পিস্তলটা বের করে মাটিতে শুয়ে পড়ল। অভ্যস্ত বুড়ো আঙুল সেফটি অফ করল। বাঁ হাতের অবশিষ্ট শক্তিকে জড়ো করে কক্ করতেই একটা মৃত্যুদূত হাজির হল ব্যারেলে। আঙুল ট্রিগারে চেপে বসতেই পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে পরপর তিনটে ফুল মেটাল জ্যাকেট বুলেট লক্ষ্যহীনভাবে ছুটে গেল আকাশে। জোরালো ‘ঠাশ… ঠাশ… ঠাশ’ শব্দ নিশ্চিন্ত অবসরের খোঁজে আসা মানুষগুলোর আতঙ্কে হাওয়া দিল আরও। শব্দ প্রতিপক্ষের কানেও পৌঁছেছে নিশ্চয়ই। পরের আক্রমণ নামিয়ে আনার আগে তাকে ভাবতে হবে। একটু বাড়তি সময়। এমন পরিস্থিতিতে একটু বাড়তি সময় অনেকটা সাহায্য করে। যদিও তাদের অবস্থান তেমন সুবিধাজনক নয়। রোয়ান গাছের কাণ্ড এতটা চওড়া নয় যে দুটো শরীরকে আড়াল দিতে পারে। ডেভিড খোলা জায়গায় শুয়ে অভ্যস্ত চোখে মেপে নিতে চাইল শত্রুর সুবিধা অসুবিধার খুঁটিনাটি। রাস্তা এবং তার মাঝে বেশকিছু চেয়ার টেবিল রয়েছে। ফাঁকা জায়গাও রয়েছে কিছুটা। বন্দুকবাজ এই ফাঁকা অংশ বরাবর থাকলে মাটিতে শুয়েও সে বাঁচতে পারবে না।

‘তুমি একটা আস্ত গর্দভ।’

নিজেকেই বলল ডেভিড। অস্থির সময়ে এমাকে বললেও নিজের জ্যাকেটখানা খোলার কথা মাথায় ছিল না। শিকারী সহজেই তাদের খুঁজে নিয়েছে। ডান হাতের শক্ত মুঠিতে ধরে রাখা পিস্তল থেকে পরিচিত বারুদের গন্ধ নাকে আসছে। সামনের উন্মুক্ত অংশ বরাবর রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলোর দিকে স্থির করা সেটা। পুলিশ এতো দেরি করছে কেন? শরীরের বাঁ দিক দ্রুত অসাড় হয়ে আসছে। ভিজে সপসপ করছে পরনের পোশাক। ভীষণ ক্লান্ত লাগতে শুরু করেছে। দ্রুত রক্তক্ষরণ দুর্বল করে তুলছে তাকে।

‘স্টেডি ডেভিড।’

বিরবির করে নিজের বুঁজে আসতে চাওয়া চোখের পাতাকে জোর করে ঠেলে তুলতে চাইল ডেভিড আলাবা।

 

লোকটার দিকে একচোখ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে এমা। আজ চোদ্দ দিন হলো ডেভিডকে দেখছে সে। লম্বা পেশীবহুল শরীর দেখলে সামর্থ্য নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে না। তবে স্বভাবে একেবারেই বিপরীত। ধীর লয়ে কথা বলে। নিচু গলায়। একটু আগের অভিজ্ঞতা বাদ দিলে, লোকটার চলাফেরাতেও শান্তভাব দেখেছিল এমা। দু দুটো সপ্তাহ ধরে যাকে দেখে একরকম অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল, তাকেই একেবারে অন্যরূপে দেখলে অবাক হওয়া স্বাভাবিক। আর হাতের ওই হাড়হিম করে দেওয়া অস্ত্রটা এতদিন লোকটা সঙ্গে নিয়েই ঘুরছিল! ডেভিড যে নিছক একজন ড্রাইভার নয়, বুঝতে বাকি নেই তার। কিন্তু এসবের চেয়েও যেটা বিস্ময়কর, অস্ট্রিয়ায় তার জীবন যে বিপন্ন হতে পারে, কে এমন নিখুঁত অনুমান করল? নিশ্চয়ই ইউরোপীয়ান হিস্টরিক হাউসেস-এর কর্তাব্যক্তিরা ডেভিড আলাবাকে তার নিরাপত্তার দায়িত্ব দেননি। তাঁরা তো এমাকে সেমিনারে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন মাত্র৷ নাকি আমন্ত্রণের পেছনেও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল? এমা যে প্রফেসরের প্রস্তাবে রাজি হতে পারে, এমন একটা ধারণা করে আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করে রাখা? সেক্ষেত্রে প্রফেসর নিজেও নিরাপদ নন। পরপর অনেকগুলো প্রশ্ন এমার মগজে ধাক্কাধাক্কি করছে। হঠাৎ এমার চোখ পড়ল, তার ঠিক পাশেই মাটিতে শুয়ে থাকা ডেভিডের ওপর। লোকটার শরীর থেকে বেরিয়ে আসা রক্ত মাটিকে ভিজিয়ে তুলেছে। ঘাড়টা সোজা ছিল। এখন হাতের ওপরে কাত হয়ে পড়ে। মুঠো আলগা হয়ে যেতে হাতে ধরে রাখা অস্ত্রের মাথা মাটিতে লুটিয়ে। জ্ঞান হারিয়েছে! এভাবে রক্তক্ষরণ হলে মানুষটা বাঁচবে না। এমা নিজের বিপদের কথা ভুলে গেল। ভুলে গেল একটু আগে ডেভিডের করা সাবধানবাণী।

‘গাছের আড়ালে থাকুন মিস মিলার। আততায়ীর একমাত্র লক্ষ্য আপনি।’

 

ঝুঁকি নিল এমা। কোমর ধরে ভারী শরীরকে নিজের কাছে টেনে আনার জন্য আড়াল ছাড়তেই হল তাকে। আর ঠিক তখনই কাছাকাছি অনেকগুলো সাইরেনের আর্তনাদ কানে এল তার। সতর্কতা জানিয়ে ছুটে আসা লাল নীল আলোগুলো নিয়মে.র তোয়াক্কা না করে রাস্তা টপকে বাঁধানো চত্তরে ঢুকে পড়ছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পজিশন নিচ্ছে গাড়িগুলো। দুটো অ্যাম্বুলেন্স আর্তচিৎকার করে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। এমার নজর সেদিক থেকে ফিরে কোলের ওপরে রাখা ডেভিডের মুখে স্থির হলো। নিঃশ্বাস নিচ্ছে এখনো। দু হাত বাঁ কাধের কাছে তৈরি হওয়া ছিদ্রের ওপরে চেপে ধরল সে। তাতে বিশেষ লাভ হচ্ছে না। রক্ত বেরিয়ে আসার গতিবেগে সামান্য তফাত পড়েছে মাত্র। এমা গাছের আড়াল থেকে মুখ বের করে প্রাণপণে চিৎকার করে উঠল,

‘অফিসার… এই যে… এ দিকে। তাড়াতাড়ি প্লিজ।’

 

ইতিমধ্যেই গাঢ় নীল পোশাকে ছয়লাপ হয়ে গেছে দানুকানালের একাংশ। যারা গানম্যানের আতঙ্কে রেস্তোরাঁ কিংবা আশপাশের দোকানে আশ্রয় নিয়েছিল, একে একে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। তাদের ঘিরে অভয় দিচ্ছে ফেডারেল পুলিশ। কয়েকজন হাতের অস্ত্র উঁচিয়ে ধরে চারপাশ মেপে চলেছে। দুজন অফিসারকে তার দিকে ছুটে আসতে দেখল এমা। আবারও চিৎকার করে উঠল সে, ‘অ্যাম্বুলেন্স প্লিজ।’

তার কথায় মাঝপথেই থেমে গেল একজন। কাঁধ থেকে ওয়ারলেস বের করে কিছু বলছে। অপরজন ছুটে এসে হাঁটু মুড়ে এমার পাশে বসল। দ্রুত পরিস্থিতি মেপে নিল অফিসার।

‘গুলিটা কাঁধ ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে। অবস্থা খারাপ।’

‘স্বগোতক্তি করল অফিসার। তারপর সঙ্গীর উদ্দেশে চেঁচিয়ে বলল, ‘ওস্কার… জলদি এদিকে এসো।’

 

ডেভিডকে স্ট্রেচারে করে অ্যাম্বুলেন্সে তোলার সময় তাকে সামান্য নড়তে দেখল এমা। দুর্বল ঘাড় তুলে কিছু বলতে চাইছে।

‘মিস মিলার… মিস…’

এমা কাঁপছিল। শীত শীত করছে ভীষণ। নাকি ভয়ে? নাহ্, এমা মিলার ভয় পায় না। কুইক রেসপন্স টিমের ডাক্তাররা এর মধ্যেই ডেভিডের প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করে ফেলেছে। ক্ষতস্থান থেকে রক্তক্ষরণ এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। ড্রিপ চালু করা হয়েছে। এমা চটপট স্ট্রেচারের পাশটায় গিয়ে দাঁড়াল। তাকে দেখে এই প্রথম গোমড়ামুখো ডেভিডকে হাসতে দেখল এমা।

‘আপনি ঠিক আছেন?’

লোকটার শুধু শরীর নয়, মনের জোরও সাংঘাতিক! বাঁ কাঁধ ফুটো হয়ে গেছে, নড়তে পারছে না, এদিকে জিজ্ঞেস করছে সে ঠিক আছে কিনা! এমা উত্তর দিল না। সস্নেহে ডেভিডের বলিষ্ঠ হাতকে নিজের মুঠোয় ভরল। আলতো চাপে বুঝিয়ে দিল,

‘আমি তোমার সঙ্গেই আছি ডেভিড।’

 

 

তারা আজও আছে

………………………………

‘অপদার্থের দল সব!’

তার শরীর ভীষণ রোষে কাঁপছে। সামিরা টিসডেল। সামিরাকে দেখে তার বয়স আন্দাজ করা বেজায় কঠিন। অতিরিক্ত মেদ বর্জিত চেহারা। কাঁধ পর্যন্ত ঢেউ খেলানো সোনালি চুল। গাঢ় নীল রঙের ডবল ব্রেস্টেড ট্রেঞ্চের নিচে মুক্তো সাদা হাইনেক উলেন টি-শার্ট এবং একই রঙের ফ্লেয়ারড ট্রাউজার। জুতোর উঁচু হিল তার উচ্চতাকে আরও কিছুটা বাড়িয়ে দিয়েছে। ডিম্বাকার ধাঁচের মুখে বলিরেখা জমাট বাঁধার সময় প্রায় এগিয়ে এলেও, চট করে থিতু হওয়ার সুযোগ পাবে বলে মনে হয় না। কেবল দুই ভুরুর মাঝে চামড়ায় ছোট্ট দুটো রেখা ভাঁজ তৈরি করেছে। যেন ইংরেজির দুটো এক পাশাপাশি লেখা। মুখের এই ফ্রন লাইনস অবশ্য বয়সের নয়, বরং তার মেজাজের পরিচয় দেয়। এটুকু বাদ দিলে, সামিরাকে দেখে এখনো বছর তিরিশের যুবকেরা স্বচ্ছন্দে হৃদয় বাজি রাখতে পারে। তার আকর্ষণীয় গড়ন এবং সম্মোহনী চাহনির আড়ালে একটা ভীষণ কঠিন এবং অনুভূতিশূন্য মন রয়েছে। এ কথা অবশ্য বাইরের পৃথিবীর অধিকাংশই জানে না। হ্যাঁ, প্রয়োজনে মাছি এবং মানুষে তফাৎ করে না সামিরা। এসব ব্যাপারে সে নিজেও যথেষ্ট দক্ষ। মাত্র সতেরোতেই সে আই-এস-এস-এফ, ইন্টারন্যাশনাল শুটিং স্পোর্টস ফেডারেশনের এক সম্ভাবনাময় প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিল। এখনো নিখুঁত নিশানা তার। চুড়ান্ত শারীরিক সক্ষমতার সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করে ইস্পাত কঠিন হৃদয়। অযথা আবেগের কোনো ঠাঁই নেই সেখানে। ছোটো ঘুপচি ঘরটায় উপস্থিত সকলেই তা জানে। শুধু জানে না তেরো বছর আগে তুরষ্কের একটা মেয়ে ঠিক কোন পথে সুইজারল্যান্ডে এসে পৌঁছেছিল।

 

অ্যাবের এই ভূগর্ভস্থ ক্রিপ্ট চতুর্থ থেকে অষ্টম শতাব্দীর মধ্যে নির্মিত। পাশাপাশি এমন বেশ কয়েকটা পাথুরে খাটো উচ্চতার গম্বুজাকৃতির ঘর রয়েছে। সুরঙ্গ পথের একেবারে শেষ মাথায় অবশ্য কারোর যাওয়ার অনুমতি নেই। এমনকি অ্যাবের সাধারণ কর্মচারীদের জন্যও নিষিদ্ধ এলাকা। চব্বিশ ঘণ্টা, তিনশো পঁয়ষট্টি দিন বিশেষভাবে নজরবন্দী রাখা হয়। কথিত আছে খ্রীস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতেও সেন্ট-মরিস ডি’আগাউন-এর এই অ্যাবে নাকি দাঁড়িয়ে ছিল! সেই সময় সেন্ট মার্টিন, গল যাওয়ার পথে এখানেই আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে ক্রমে এই মঠের আকৃতি ও পরিধি বদলেছে। বেড়েছে ঐতিহ্য। সামিরা এই সুপ্রাচীন অ্যাবের ট্রেজারার। নয় নয় করে প্রায় বছর নয়েক সে এই দায়িত্ব সামলাচ্ছে। এবং অস্বীকার করার উপায় নেই, বেশ সফলতার সঙ্গে সামলাচ্ছে।

 

‘যথেষ্ট দক্ষ হাতেই দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল।’

কালো সুটান পরিহিত পাদরি নিকোলাস থমথমে গলায় বললেন। তিনি যখন চক্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন, মেয়েটা তখন হয়তো সবেমাত্র হাঁটতে শিখেছে৷ নিজের আনুগত্য, দক্ষতার পরিচয় দিয়ে ধাপে ধাপে একটার পর একটা অ্যানিউলাস পেরিয়ে চক্রের মধ্যবিন্দুতে এসে পৌঁছেছেন পাদরি নিকোলাস। এই পর্যন্ত যারা পৌঁছাতে পারে, তাদের সকলকেই মহান উদ্দেশ্যের স্বার্থে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহন করার ক্ষমতা দেওয়া আছে। অবশ্যই তা যেন চক্রের মহান উদ্দেশ্যকে এতটুকু আঘাত না করে সে সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হয়। প্রত্যেকে স্বাধীন হলেও চক্র পরিচালনার জন্য একটা কেন্দ্রীয় চরিত্র এই মধ্যবিন্দুতে রয়েছে। তিনিই এখানে এই চক্রের প্রধান। জীবনের একটা বড়ো অংশ সঁপে দেওয়ার পর পাদরি নিকোলাস আশা করেছিলেন নিজেকে সেই প্রধানের চরিত্রে দেখবেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় তা হয়নি। মেয়েটাকে তেরো বছর আগে সেন্ট-মরিস অ্যাবেতে প্রথম দেখেছিলেন নিকোলাস। সরাসরি ভাটিকান থেকে সম্মতি পত্র নিয়ে যোগ দিয়েছিল। চার বছর কাটতে না কাটতেই অ্যাবের ট্রেজার সেকশনের হেড। আর তারপর, নিকোলাসেরও!

 

‘মার্জনা করবেন, কিন্তু তার দক্ষতা এবং আপনার বিচক্ষণতার পরিচয় এখন আমাদের সামনেই রয়েছে। তাই না?’

মধ্যবিন্দুর সক্রিয় বাকি তিনজন সদস্যের সকলেই উপস্থিত। সকলের সামনে প্রবীণতম সদস্য হিসেবে কথাগুলো হজম করা যথেষ্ট কষ্টকর। নিকোলাস মেয়েটাকে চেনেন। অযথা বিতর্ক তৈরি করলে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়ে উঠবে। মনের বিদ্বেষ সত্ত্বেও সামিরার নেতৃত্ব দানের সহজাত ক্ষমতা নিকোলাস নিজেও অস্বীকার করতে পারেন না। তার প্রতিটি কাজ ত্রুটিহীন। সুতরাং এই মেয়ে যে দরকারে তার নামে ভাটিকানে রিপোর্ট করতে পারে, সন্দেহ নেই। মহান চক্রের বাইরে তিনদিকে তিনটে বিন্দু আছে। অদৃশ্য ত্রিভুজের তিন শীর্ষবিন্দু। পরস্পর যুক্ত এবং সদা চক্রের সুরক্ষায় নিয়োজিত। পুরো ছবি যোগ করলে অনেকটা ইলুমিনাতি মার্কা বলে মনে হবে। শীর্ষবিন্দুতে কারা রয়েছেন, কেউ জানে না। শুধু জানে, চক্রের প্রতিটি সদস্যের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ আসে ভাটিকান থেকে। সুতরাং সেই তিন শীর্ষ নেতৃত্বের একজন যে সেই ছিটমহলে রয়েছেন, নিকোলাস অনুমান করতে পারেন মাত্র। সেখানে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো নালিশ পৌঁছে গেলে, ফলাফল সুখকর নাও হতে পারে। এবং তা সুদীর্ঘ সময় ধরে তাঁর প্রশ্নহীন আনুগত্যের পরেও।

 

গলা থেকে বিরক্তিভাব মুছে নিলেন নিকোলাস।

‘দুঃখিত সামিরা৷ কিন্তু নিয়োগ করার আগে ছেলেটার কাজের পরিচয় সকলের সামনেই রেখেছিলাম। আমার মনে হয় দেখে-শুনে সকলেরই মনে ধরেছিল। সে যে এভাবে ব্যর্থ হবে…’

‘আমার মনে আছে ফাদার। শুধু কাজটা কাছাকাছি থেকে শেষ করতে হতো। দূর থেকে লক্ষ্যভেদ করা সর্বদাই ঝুঁকির। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত আপনার ছিল ফাদার। দায় আপনাকেই নিতে হবে।’

নিকোলাসের যুক্তিকে উড়িয়ে দিয়ে সামিরা যোগ করল, ‘আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে। এই একটা ঘটনা প্রমাণ করে দিল, আমাদের নজরে ছানি পড়তে শুরু করেছে।’

‘আমিও এক্ষেত্রে সামিরার সঙ্গে একমত। নইলে ডক্টরের ড্রাইভারটি যে কেবল গাড়ি নয়, বন্দুকও সমান চালায়, সেই তথ্য আমাদের কাছে থাকা উচিত ছিল।’ ফোর্ট শিন্ডের অধিকর্তা সঙ্গত করলেন।

‘সেক্ষেত্রে মি. দানিয়েল, ড্রাইভারটির সম্পর্কে খুঁটিনাটি আমাদের জানা দরকার। এমনকি যে তাকে নিয়োগ করেছিল, তার সম্পর্কেও। কোনো ফাঁক রাখা যাবে না।’

‘বুঝেছি…’ বললেন প্রাক্তন সেনাকর্মকর্তাটি,

‘চক্রের অস্তিত্ব আর আড়ালে নেই বলতে চাইছেন তো?’

‘অসম্ভব!’

পাশ থেকে প্রায় চিৎকার করে উঠলেন পাদরি নিকোলাস।

‘চক্রের উদ্দেশ্য, এমনকি পরবর্তী অ্যানিউলাসে কারা রয়েছে তা আগের বৃত্তে থাকা সদস্যরা জানে না। সেখানে বাইরের কারোর কাছে আমাদের অস্তিত্ব…’

তাঁকে থামিয়ে দিল সামিরা।

‘কিছু মনে করবেন না ফাদার, আমার ক্রমশ মনে হচ্ছে আপনার এবার প্রভুর দুনিয়ায় যাত্রা করা উচিত। অমৃতসুধা পানের সময় হয়ে এসেছে।’

 

চক্রের স্বার্থ রক্ষা করতে ব্যর্থ হলে, কিংবা বয়স বা শারীরিক অসুস্থতার কারণে চক্রের উদ্দেশ্যের সঙ্গে যুক্ত থাকার ক্ষমতা হারালে, অমৃতসুধা পান করা এক অলঙ্ঘনীয় নিয়ম। প্রথম দুটি অ্যানিউলাস পেরিয়ে তৃতীয় বৃত্তে প্রবেশের জন্য মনোনীত হলে অনেক প্রতিশ্রুতির মতো সদস্যদের এ বিষয়েও শপথ নিতে হয়। কারণ একটাই। গোপনীয়তা। এমারল্ড, স্যাফায়ারে সুসজ্জিত সোনার পান পাত্রে পৃথিবীর উৎকৃষ্টতম ওয়াইন। তার মধ্যে বৃষ্টির তিন ফোঁটা পরিমাণে আর্সেনিক। প্রথমে জিভের স্বাদ বদলে দেবে, তারপর বমির সঙ্গে খিঁচুনি। অমৃতসুধা পানের দু ঘণ্টার মধ্যে স্বর্গযাত্রা নিশ্চিত। দৃশ্যটা কল্পনা করে মনে মনে শিউরে উঠলেন নিকোলাস। যখন শপথ নিয়েছিলেন, এমনকি তার পরেও এ নিয়ে নিকোলাসের মনে তিলমাত্র দ্বন্দ্ব কাজ করেনি। কিন্তু এখন, যখন বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষার সময় ঘনিয়ে আসছে, নিজের মৃত্যুকে কল্পনা করে আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। পাদরির কণ্ঠস্বরে সেই আতঙ্কই যেন ধরা পড়ল, ‘আমরা তো যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করে চলি সামিরা। তা সত্ত্বেও এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর পেছনে কোনো যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা আছে কিনা জানতে চেয়েছি মাত্র৷ আশাকরি এটা আমার অপরাধ নয়।’

‘প্রশ্ন করার স্বাধীনতা আমাদের আছে ফাদার। তাছাড়া সিদ্ধান্ত নয়, আমি আশঙ্কার কথা জানিয়েছি। সেটা অমূলক কিনা যাচাই করা প্রয়োজন আছে বলেই মনে হয়।’

‘এক্ষেত্রে আমি ফাদারের সঙ্গে সহমত।’ শিন্ডে ফোর্টের অধিকর্তা বললেন, ‘অযথা আশঙ্কাগ্রস্থ হয়ে কোনো ভুল পদক্ষেপ না নিয়ে ফেলি। তার চেয়ে ডক্টরকে আটকালেই সমস্যা মিটে যায়৷ তাকে এখনো হাসপাতালে পাওয়া যাবে। এবার কাজটা আমিই করছি।’

‘সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ভেবে দেখার অনুরোধ করছি মি. দানিয়েল। এত দ্রুত দ্বিতীয়বার আঘাত হানলে লক্ষ্য সম্পর্কে একটা স্থির ধারণা তৈরি হয়ে যাবে না? দানুক্যানেলের ঘটনা কোনো উন্মাদ গানম্যানের নয়। ড. মিলার ছিলেন আসল লক্ষ্য। তখন তাঁর হত্যাকারী এবং হত্যার কারণ সম্পর্কে অনেকেই কৌতূহলী হয়ে উঠতে পারে। আমার মত আপাতত এই জায়গা থেকে সরে আসা। নজর থাক। আগে যেমন ছিল। দেখা যাক প্রফেসর বরিসের সাহায্য ছাড়া ড. মিলার কতদূর এগোতে পারেন। প্রফেসর বরিসের মুক্তির ব্যবস্থায় কোনো ফাঁক নেই নিশ্চয়ই?’

‘একেবারেই নেই।’

হাত ঘড়িতে চোখ রেখে দানিয়েল যোগ করলেন, ‘আশা করছি কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা সুসংবাদ পেয়ে যাব।’

 

ড. বরিস গ্রইসম্যানের নিজস্ব একটা সমুদ্র আছে। কত শত হাজার বছর ধরে লক্ষ-কোটি মণিমুক্তো এখনো লুকিয়ে রেখেছে সেই সমুদ্র। ইতিহাস পাগল মানুষেরা দিন রাত ভুলে নিরন্তর সেই রত্ন তুলে আনার চেষ্টা করে চলেছেন। রোজকার মতো প্রফেসর বরিস নিজের সেই সমুদ্রে ডুব দিয়েছিলেন। ট্রু ক্রশ তাঁর সমুদ্র, এবং তার তল খুঁজে পাওয়া কঠিন। লোককথায় বলে জিশুকে যে বধকাষ্ঠে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল তা অলৌকিক। পবিত্র রক্তের স্পর্শ সেটাকে অবিনশ্বর করে তুলেছে। তাই তো সেই মধ্যযুগ থেকে খ্রিষ্ট ধর্ম প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ট্রু ক্রশের অংশ চার্চ কিংবা মঠগুলোতে দান করা হলেও, বধকাষ্ঠের আকৃতি আয়তনে কোনো ফারাক আসেনি। এ যে সম্পূর্ণ অন্ধ বিশ্বাস, তা নিয়ে প্রফেসর বরিসের এতটুকু সন্দেহ নেই। যেমন সন্দেহ নেই জেরুজালেমের দ্য হোলি সেপালকার চার্চে সংরক্ষিত প্রাচীন বধকাষ্ঠটির বয়স বড়োজোর হাজার থেকে বারোশো বছর। অর্থাৎ, অন্তত জিশুর রক্তের ছিটে সেই ট্রু ক্রশের গায়ে থাকার সম্ভাবনা নেই। পরীক্ষা করলেই বিষয়টা নিয়ে যাবতীয় বিতর্কের অবসান হতে পারে। তা যখন সম্ভব নয়, তখন ইতিউতি ডুব দিয়ে নিজের তত্ত্বকে সমর্থন করার মতো যুক্তি তুলে আনতেই হবে। সেই কাজেই মগ্ন ছিলেন প্রফেসর বরিস। প্রিয় বন্ধু লুডল্ফের মৃত্যু এবং দ্য হোলি লেন্সের দায়িত্ব এমার বলিষ্ঠ কাঁধে সঁপে দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত। হ্যাঁ, বন্ধুর মৃত্যু এবং পবিত্র বর্শার মধ্যে পারস্পারিক সম্পর্ক রয়েছে— এই তত্ত্বকে অস্বীকার করার কোনো সঙ্গত কারণ নেই। সুতরাং একটা ধাঁধার সমাধান করতে পারলে, অপরটির মোড়ক উন্মোচনে আলাদা করে শ্রম কিংবা সময় ব্যয় করতে হবে না। তবে এই কাজে প্রাণহানির ষোলো আনা সম্ভাবনা। লুডল্ফ এবং ডায়ানার মৃত্যু তার প্রমাণ। তাই প্রথম দিকে সম্পূর্ণ অজ্ঞাতে কাউকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়ায় প্রফেসর বরিস আপত্তি জানিয়েছিলেন। প্রস্তাবক মি. এডোয়ার্ড, যিনি কিনা আবার লুডল্ফের ঘনিষ্ঠও বটে, তাঁকে দৃঢ় আশ্বাস দিয়েছেন। কুইন অ্যানিস রিভেঞ্জ উদ্ধারে ড. এমা মিলারের দুর্দান্ত ভূমিকার খুঁটিনাটি জানার পর, এবং তার নিরাপত্তার সম্পূর্ণ আশ্বাস পেয়ে নিজের মত বদলেছিলেন প্রফেসর। মেয়েটার সঙ্গে টানা প্রায় দুটো সপ্তাহ কাটিয়ে লুডল্ফের সেই ঘনিষ্ঠকে মনে মনে কৃতজ্ঞতাও জানিয়েছেন। কাজটায় বিপদ যতটা, খরচ তার প্রায় সমান সমান। এই বিষয়ে নিজের সামর্থ্যের কথা প্রফেসর খোলাখুলিভাবেই বলেছিলেন। সেসব যুক্তি অবশ্য খাড়াভাবে দাঁড়াতে পারেনি। এমাকে গাইড করা ছাড়া বাদবাকি সবকিছুর দায়ভার ভদ্রলোক স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিজের কাঁধে নিয়েছেন। এরপরে রাজি না হয়ে উপায় কী? প্রিয় বন্ধুকে মৃত্যু উপহার দিয়েছে যারা, তাদের আইনের ফাঁসে ঝোলানো ঐতিহাসিক সত্যিকে তুলে আনার মতোই কর্তব্যের মধ্যে পড়ে৷ এক সঙ্গে দুটো উদ্দেশ্য পূরণের একমাত্র অস্ত্র ড. এমা মিলার।

 

লাইব্রেরির বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিটি ইন্দ্রিয়কে মাত্রাতিরিক্ত সজাগ করল রাফায়েল। বাড়িতে কাজের লোক বলতে দু’জন। মিসেস বেলা। তিনি রবিবার সকালের দিকটায় ছুটি নেন। চার্চ থেকে ফিরতে তাঁর বিকেল গড়িয়ে যায়। ফাইফরমাশ খাটার লোকটাকে রাফায়েল ক্রেমস-এ পাঠিয়েছে। গত রাতেই একটা লম্বা ফর্দ ধরিয়ে দিয়েছিল তাকে। সেও বিকেলের আগে ফিরতে পারবে না। তবুও যত দ্রুত সম্ভব কাজটা শেষ করতে হবে। রাফায়েল কোটের পকেটে রাখা ছোট্ট কাচের শিশিটা বের করে চোখের সামনে তুলে ধরল। তার অন্য হাতে ধরা ট্রে। সেখানে পোর্সিলিনের টি পট, দুধ এবং সুগার কিউবের বাটি। প্রফেসর ব্রেকফাস্টের থেকে এই নিয়ে তিনবার চায়ের অর্ডার দিয়েছেন। অথচ এখন লাঞ্চের সময় পেরিয়ে গেছে। লাইব্রেরিতে থাকলে খিদে মানুষটাকে বিচলিত করতে পারে না। গত ছ মাস ধরে সে দেখছে। কাচের শিশিটা মুঠোর আড়ালে রেখে দরজায় মৃদু টোকা দিল রাফায়েল। তারপর আলতো ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ল।

 

‘প্রফেসর চা।’

যাকে বলল, তাঁর কানে কথাটা পৌঁছায়নি। রাফায়েল হাসল। আশ্চর্য এক মানুষ বটে! এবং জ্ঞানীও। এমন একজনের মৃত্যুর কারণ হওয়া মোটেও সুখদায়ক নয়। নিতান্ত অপারগ না হলে ঈশ্বরের দেওয়া প্রাণকে তারা ছিনিয়ে নেয় না। মিসেস বেলা এবং ভৃত্যটি তাদের উদ্দেশ্যের অন্তরায় নন। তাই অকারণে তাদের ক্ষতি করতে চায় না রাফায়েল।

 

রাফায়েল টেবিলের ওপরে ট্রে রাখল। দারুণ দক্ষতায় কাচের শিশি থেকে হালকা নীল তরলের শেষ বিন্দুটুকু সোনার জলকাজ করা চায়ের কাপে ঢেলে নিল। এমনভাবে, যে প্রফেসর অক্ষরের ভিড়ে হারিয়ে না গেলেও টের পেতেন কিনা সন্দেহ! অ্যাকোনাইটের নির্যাস। পাঁচ থেকে সাত মিলিগ্রামই যথেষ্ট, কিন্তু রাফায়েল কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না। দশ মিলিগ্রামের শূন্য কাচের শিশি কোটের পকেটে চালান করে এবার গলা তুলল সে, ‘প্রফেসর, আপনার চা।’

‘ওহ্, এনেছ। ধন্যবাদ রাফায়েল। তুমি না থাকলে আমার যে কী অবস্থা হতো…।’

মোটা বইয়ের খোলা পাতায় হাতের মার্কারটা গুঁজে চেয়ার সমেত ঘুরে গেলেন প্রফেসর বরিস।তাঁর পাইপটা ট্রের পাশেই রাখা ছিল। সেটা হাতে নিয়ে এদিক ওদিক খুঁজে হতাশ হয়ে বললেন, টোব্যাকোর পাউচ কোথায় যে রাখলাম!’

 

মৃত্যুর কাছাকাছি দাঁড়িয়েও রাফায়েলের হাসি পেল। অদ্ভুত ভুলো মানুষ! পাইপ, নিজের চশমা কিংবা চেকবুক, প্রয়োজনীয় প্রায় প্রতিটি জিনিস মুহুর্মুহু হারিয়ে ফেলেন। টেবিল, বইয়ের শেলফের ইতিউতি খুঁজেও টোব্যাকো পাউচ না মেলায় রাফায়েল বলল,

‘আপনার পকেটে নেই তো?’

‘পকেটে!’

বলে দুটো হাত ঝোলা হাউস কোটের পকেটে ঢুকিয়ে দিলেন প্রফেসর। তারপর পাউচ সমেত বাঁ হাত বের করে শিশুর সারল্যে হেসে দ্বিতীয়বার বললেন, ‘দেখ কাণ্ড! সত্যি রাফায়েল, তুমি না থাকলে আমার যে কী গতি হতো…’

 

তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রাফায়েলের বুকের ভেতরটা মুহুর্তের জন্য আবার মুচড়ে উঠল। দ্রুত নিজেকে শাসন করল সে। তারা এক মহান উদ্দেশ্যের রক্ষা কর্তা। এমন ছোটোখাটো আহুতি ছাড়া সেই উদ্দেশ্য কখনো সফল হবে না। চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল রাফায়েল। হাতের মুঠো বন্ধ। প্রফেসর অবশ্য তার দিকে ফিরেও তাকালেন না। তিনি যথারীতি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। পাইপে তামাক ভরে পকেট থাবড়াতে দেশলাইটাও পাওয়া গেল। ডান পকেটে। তামাকে অগ্নিসংযোগ করে ধোঁয়ার একটা বড়োসড়ো কুণ্ডলী বাতাসে ভাসিয়ে দেওয়ার পর তিনি নজর ফেরালেন।

‘বুঝলে রাফায়েল, মেয়েটাকে নিয়ে বড্ড চিন্তা হচ্ছে। ওকে এভাবে বিপদের মাঝে টেনে না আনলেই বোধহয় ভালো হতো।’

‘কার কথা বলছেন? ড. মিলার?’

মৃদু ঘাড় নেড়ে জবাব দিলেন প্রফেসর বরিস।

‘তোমাকে বলিনি। বলিনি তার পেছনে অবশ্য সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। আমার মনে হয় বিষয়টা কেউ জানতে পারলে তার নিজেরই ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা।’

‘বিপদ… ক্ষতি! আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন স্যার? ড. মিলার যে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে এসেছেন তা বুঝতে পেরেছি, কিন্তু তার সঙ্গে বিপদের যোগসূত্র রয়েছে! কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান বুঝি?’

দীর্ঘ টানে জ্বলন্ত তামাকের আয়ু এক ধাক্কায় অনেকটা কমিয়ে দিলেন প্রফেসর। পাইপের মাথায় জেগে থাকা আগুনের দলা, ঘোর অন্ধকারে অ্যালিগেটরের চোখের মতো একটু বেশিই জ্বলে উঠল। আবার একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে প্রফেসর বললেন,

‘সৌভাগ্য শলাকা। দ্য লেন্স অব লংগিনাস। কিন্তু এর বেশিকিছু তোমায় বলব না। ইউনিভার্সিটি অব ভিয়েনা একজন সম্ভাবনাময় তরুণ রিসার্চ ফেলোকে হারাক, আমি কখনোই তা চাই না।’

জ্বলতে থাকা পাইপের মুখ ছাইদানিতে বার দুয়েক ঠোকা মেরে রাফায়েলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন প্রফেসর,

‘দাও। চিনি দুটো দিও। জীবন থেকে মিষ্টতা ক্রমশ যেন দূরে চলে যাচ্ছে হে!’

 

ধীরে সুস্থে পট থেকে চা ঢেলে নিল রাফায়েল। চামচে দুধ নিয়ে মিশিয়ে দিল। তারপর সুগার কিউবের বাটিটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ড. মিলার কি ঝুঁকির ব্যাপারটা জানেন?’

‘সাহসী মেয়ে। ইতিহাসের জন্য মৃত্যুকে চোখ রাঙাতে পারে। বিপদের কথা শুনে ঘাবড়ে যাওয়া বান্দা এমা মিলার নয় হে।’

আত্মতৃপ্তির সুরে কথাটা বলেই অধৈর্য্য হয়ে উঠলেন প্রফেসর বরিস।

‘কই… চা দাও।’

মনে মনে ঈশ্বরের কাছে ধন্যবাদ জানালো রাফায়েল। প্রফেসর যে অনেক কিছুই জানেন, তা গত ছয় মাস একসঙ্গে থেকে উপলব্ধি করেছিল। কিন্তু প্রাণহানির আশঙ্কাও করেন, তা জানা ছিল না। অর্থাৎ বন্ধু এবং তার সঙ্গিনীর মৃত্যু নিয়ে মুখে কিছু না বললেও, মনে মনে একটা থিওরি তিনি তৈরি করে রেখেছেন। এখন প্রশ্ন হলো— ড. মিলার পর্যন্ত সেই ধারণার আঁচ পৌঁছেছে কিনা। বিষয়টা ওপরে জানানো স্থির করল রাফায়েল। তারপর চায়ের কাপটা প্রফেসরের দিকে এগিয়ে ধরল।

 

এরপর ঠিক কী কী হতে চলেছে রাফায়েলের জানা। সত্তর পার করা বৃদ্ধের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হবে। তারপর শুরু হবে নাগাড়ে বমি। দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়বে শরীর। এবং শেষে হৃদপেশীগুলো তাদের কার্যক্ষমতা হারাবে। সাধারণ চোখে কার্ডিয়াক ফেইলিওর। লাশকাটা ঘরের মধ্যমেধা সম্পন্ন হাত চটজলদি বিষের হদিস পাবে না। রাফায়েল বুঝেশুনেই অ্যাকোনাইটকে বেছে নিয়েছে। দ্রুত শরীর থেকে নিজের অস্তিত্ব মুছে ফেলে। প্রফেসরকে লাইব্রেরিতে একলা রেখে বেরিয়ে এল সে। তবে তার আগে, কোটের ভেতর পকেট থেকে কাঠের ছোটো ক্রশ বের করে টেবিলে ছড়িয়ে রাখা বইয়ের স্তূপে রেখে দিতে ভুলল না। এটা তাদের প্রথা। মৃত্যুপথযাত্রীকে স্বর্গ পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার জন্য ঈশ্বরের চিহ্ন রেখে দেওয়া।

 

ভারী পাল্লা দুটো পরস্পরের ওপরে চাপিয়ে বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিল রাফায়েল। তার শেষ কাজ এখনো বাকি। অপেক্ষা। ভেতরে বাঁচার আকুতি না থামা পর্যন্ত অপেক্ষা। পালাবে না সে। প্রফেসরের দেহ তাকেই হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। সরকারিভাবে মৃত্যু সুনিশ্চিত জানার পর, প্রফেসরকে দ্রুত সমাধিস্থ করার আয়োজনও তার দায়িত্ব। এক্ষেত্রে সুবিধা হলো, প্রফেসরের নিকট আত্মীয় বলতে প্রভিন্সে কেউ নেই। সুতরাং আজকের রাতটা ফুরোনোর আগেই সে যাবতীয় প্রতিশ্রুতি পূরণ করে ফেলতে পারবে।

 

নির্জন ক্লোয়েস্টারে এসে দাঁড়িয়েছে সামিরা। এদিকটা চার্চের পেছনে। প্রাচীনতম অংশগুলোর একটা৷ যদিও তীক্ষ্ণ রক্ষণাবেক্ষণের দরুন নতুন করে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এদিকটায় এলে সামিরার মন এক অদ্ভুত সুখী সুখী গন্ধে ভরে ওঠে। একটা ছোটো খোলা বাগানকে ঘিরে রেখেছে ছাদে ঢাকা মনেস্ট্রির এই হাঁটা পথ। গোলাপি পাপড়ির ডেইজি, হলুদ জন’স ওর্ট, সাদা ক্লোভার ফুলের ঝোপগুলো যেন শিল্পীর তুলিতে ফুটে ওঠা রং। ইতিহাসের ক্যানভাসে ঠাঁই পেয়ে খুশিতে ঝলমলে। কেবল হাইড্রাঞ্জিয়া গাছদের দল তাদের থেকে খাপছাড়া। বিষন্ন। অবশ্য আর কয়েকটা দিনের অপেক্ষা। বসন্তের আস্কারা পেলে ওরাও কোমল নীল রঙে সেজে উঠবে। ওদেরও তখন আনন্দ ধরবে না। ছোটো করে ছাঁটা ঘাসেরা টিয়াপাখির পালকের মতো সবুজ। বাগানের ঠিক মাঝখানে একটা প্রাচীন নকশা কাটা ফাউন্টেন। এখন বন্ধ্যা, কিন্তু সহস্র বছর আগে তারই গর্ভ থেকে জীবন সঞ্চারিত হতো। যেন এই ছোট্ট সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র সম্রাজ্ঞী! যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী নিজের অধিকার কায়েম রেখেছে।

 

গভীর শ্বাস নিল সামিরা। অন্তত একটা ভালো খবর পাওয়া গেছে। প্রফেসর বরিস গ্রইসম্যান একজন গুণী মানুষ। তিনি অজান্তেই প্রভুর ইচ্ছার পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। এক্ষেত্রে চক্রের সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া অন্য উপায় ছিল না। প্রফেসর মানুষটি আসলে তাঁর বন্ধু লুডল্ফের মতোই গোঁয়ার। সামিরা পরপারে মৃতের শান্তি কামনা করে বুকে ক্রশ আঁকতে যাচ্ছিল, আচমকা পেছন থেকে দুটো বলিষ্ঠ হাত জড়িয়ে ধরল তাকে।

 

‘কী ব্যাপার আমার পরী, একলা এখানে কার প্রতীক্ষায়?’

ঘাড়ে গরম ঠোঁটের ছোঁয়া অনুভব করল সামিরা। হওয়ার্ড লেভি। সেন্ট-মরিস ডি’আগাউনে অ্যাবের ইন্টেরিম হেড। মধ্য চল্লিশের শরীরে অতিরিক্ত ভোগের চিহ্ন স্পষ্ট। মাঝামাঝি অংশ বেঢপ উঁচু। জামার বোতামগুলো কোনোক্রমে ঘর ধরে রেখেছে৷ মাথার চুল পাতলা। চোখের পাতার ওপরে ছোটো হলুদ মাংসপিণ্ড তীব্র কোলেস্টেরল সঞ্চয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে। প্রাচীন ঐতিহ্য বহনকারী এই সুইস মঠ নিজেই একটি আঞ্চলিক অ্যাবেসি এবং ডায়োসিসের নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত। সুতরাং এখানে একজন ইন্টেরিম হেড হিসেবে হওয়ার্ডের প্রভাব যথেষ্ট। এমনকি সামিরাকেও লোকটার নানান অভদ্র আচরণকে মানিয়ে নিতে হয়। মানিয়ে নেয় তার কারণ লোকটা তাদের সর্বোতভাবে সাহায্য করে। পৃথিবীর বুকে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখার মহান যজ্ঞের এক বিশ্বস্ত সৈনিক হওয়ার্ড লেভি। কেবল বাকিদের মতো নিজের ইন্দ্রিয়ের ওপরে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে না। কুৎসিত লালসার মনোভাব লোকটার চোখেমুখে লেপটে। হাজার ধুলেও তা যাওয়ার নয়। প্রথম বলয়ে হলেও, এমন কামুক প্রকৃতির মানুষ চক্রে কীভাবে জায়গা পেল ভেবে কোনো সদুত্তর পায়নি সামিরা৷ এখন নিজেই একটা কারণ তৈরি করে নিয়েছে। সত্যি বলতে শত শত বছর ধরে স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে অনেক আবর্জনা চক্রকে স্বেচ্ছায় তার গায়ে মাখতে হয়েছে। হওয়ার্ড তাতে নবতম সংযোজন মাত্র। এখন অবশ্য ধীরে ধীরে এই ধরনের আবর্জনা তারা ধুয়ে ফেলছে। জার্মান প্রফেসর এবং তাঁর সঙ্গিনী, কিংবা প্রফেসর বরিসের মতো উৎপাত সাফাইয়ের কাজে এখন আর ভাড়ার হিটম্যান ব্যবহার করা হয় না। চক্র নিজেই তার কিছু সদস্যকে একই অনুশাসনে তৈরি করেছে। তারাও শারীরিক সক্ষমতা কিংবা অস্ত্র চালনায় সমানতর দক্ষ। তফাৎ, তাদের কাজের উদ্দেশ্যে। নিছক কিছু অর্থ নয়, এক মহান উদ্দেশ্য রক্ষায় তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

‘একি, আপনি এখনো আমোদের খোঁজে বের হননি! একটু পরেই তারাদের দল আকাশে হাজিরা দিতে শুরু করবে। বিষন্ন প্রার্থনায় ভরে উঠবে অ্যাবে। এখানে আপনার থাকার মেয়াদ তো আজকের মতো ফুরিয়ে যাওয়ার কথা হওয়ার্ড!’

আলতো হাতে নিজেকে ছাড়িয়ে, দু-চোখ আদীম রহস্যে মুড়ে বলে উঠল সামিরা। বেচারা ইন্টেরিম হেড জানে না, কাকে আহ্বান জানাচ্ছে। এমন ইশারা-ইঙ্গিত আগেও পেয়েছে সামিরা। আপত্তি জানায়নি। জানায়নি বলেই তাকে সহজলভ্য ভেবে নিয়েছে। লোকটার আসক্তির কথা অ্যাবের আনাচেকানাচে কান পাতলেই শোনা যায়। অ্যাবটের কাছে এ নিয়ে একটা দুটো অভিযোগও জমা পড়েছে।

‘এতক্ষণে আমার বেরিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তোমার জন্যই দেরি হলো।’

‘দুঃখিত। একজন সাধারণ ট্রেজারারকে এই অবেলায় আপনার দরকার পড়তে পারে ভাবনাটা মাথায় আসেনি। বলুন, আমি কী করতে পারি?’

‘অনেক কিছুই পারো সামিরা।’

ইন্টেরিম হেডের মুখের এবং চোখের ভাষার পার্থক্য পড়তে সামিরার এতটুকু অসুবিধা হলো না। শরীরকে টানটান করে দাঁড়াল সে। বর্শার মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি হেনে বলল, ‘নির্দিষ্ট করে বলুন হওয়ার্ড। কী প্রয়োজন?’

 

দরকারে নিজের ব্যক্তিত্বকে আমূল বদলে নিতে পারে সামিরা। এবং তার বেড়ালের মতো রুখে দাঁড়ানো শরীরী ভাষার সামনে, অনেক তাবড়-তাবড় মানুষকে আড়ষ্ট হয়ে যেতে দেখা যায়। প্রাচীন সুইস মঠের সর্বোচ্চ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাটির ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলো না। যেন সাঁতার না জেনেই জলে নেমে পড়েছে। খাবি খেতে খেতে বলল হওয়ার্ড লেভি,

‘না… মানে… আমাদের দুর্মূল্য নিদর্শনগুলোর সংরক্ষণ যথাযথ হচ্ছে কিনা…’

‘সে বিষয়ে আপনার কোনো সন্দেহ আছে?’

সামিরার ভুরু জোড়া ঘন হয়ে এল।

‘না… মানে… ঠিক আমার নয়। হেরিটেজ বিভাগ থেকে কেউ আসতে পারেন। রুটিন পরিদর্শন আর কি। এই কথাটা জানাব বলেই তোমাকে খুঁজছিলাম। ট্রেজারি সেকশন একেবারে ঝাঁ চকচকে রাখতে হবে।’

‘ধন্যবাদ হওয়ার্ড। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। তারা কোনো খুঁত খুঁজে পাবে না।’

অতিরিক্ত নিস্পৃহ শোনাল সামিরার কণ্ঠস্বর।

 

(ক্রমশ)

 

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *