সৌভাগ্যশলাকা। ধারাবাহিক উপন্যাস। পর্ব ১৫। লিখছেন অলোক সান্যাল

এমা মুগ্ধ দৃষ্টিতে জোনাথনের দিকে তাকাল। দারুণ পর্যবেক্ষণ এবং সিদ্ধান্ত! লোকটার জ্ঞান নিয়ে কোনোদিনই সন্দেহ ছিল না। ডারওয়ার্ড ভিলার বিরাটা লাইব্রেরি সে নিজের চোখেই দেখেছে। রাশি রাশি বইগুলো যে কেবল আভিজাত্য প্রদর্শনের জন্য নয়, রীতিমতো ব্যবহার করা হয় দেখে বোঝা যায়। আক্ষেপ জোনাথন ডারওয়ার্ড তাঁর জ্ঞানকে ভালো কাজে লাগাতে পারেননি। লোকটা কি সত্যিই বদলে গেছে? প্রশ্নটা মাথায় ঝিলিক মারতেই তাকে তাড়িয়ে দিল এমা। জীবনের প্রায় শেষ অধ্যায়ে এসে নিজেকে বদলানো সহজ কথা নয়। সুতরাং যতই তাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করুন, লোকটাকে বিশ্বাস করার মতো মূর্খামি দ্বিতীয়বার করবে না সে। তাদের সাহায্য করার পেছনে জোনাথন ডারওয়ার্ড জুনিয়রের নির্ঘাৎ কোনো কূট উদ্দেশ্য আছে। সাহায্য নয়, আসলে তিনি এমাদের ব্যবহার করতে চাইছেন। এমাও একই ভাষায় জবাব দেবে।
‘মেনে নিলাম। আর পরের ছবিটা সম্পর্কে আপনার কী মতামত মি. ডারওয়ার্ড?’ মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বলল এমা।
‘পরের ছবিতে যাওয়ার আগে মাঝের অংশটুকু বোঝা দরকার মনে হয়। এটা কি গ্রিক ভাষা?’
‘কাছাকাছি, তবে না। গ্রিক নয়। ফ্রিজিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ। এলিন, আমাকে চটপট একটা খাতা পেন দে তো। দেখি কিছু বোঝা যায় নাকি।’
‘আমি দিচ্ছি।’
বলে জোনাথন আবার ঘরে ঢুকে গেলেন। ফিরেও এলেন তৎক্ষনাৎ। হাতে একটা প্রিন্ট আউট এবং পেন নিয়ে।
‘মিসেস ভ্যালাসের চুক্তিপত্র। এটাই সামনে পেলাম। এখানে আর দরকার লাগবে বলে মনে হয় না। লাগলেও পেছনের সাদা অংশ ব্যবহারে অসুবিধা নেই।’
এমা কোনো শব্দ খরচ না করে ডুবে গেল হাজার বছর আগে হারিয়ে যাওয়া এক ভাষা থেকে অক্ষর তুলে আনার কাজে।
min dokimazeis ton theo sou (গ্রিক)
(মিঁ ডকিমাজ-ইস ট থেও সো)
ফ্রিজিয়ানে লেখা।
‘মাঝের কয়েকটা অক্ষর চিনতে পারছি না। গ্রিক ভাষায় যা দাঁড়াচ্ছে মিঁ ডকিমাজ… তারপর ট… থেও সো।’
‘কোনো মানে হয়!’ বিরক্তির সঙ্গে বলল এলিন। এমা জোনাথনের দিকে তাকাতে ঘাড় উঁচু করলেন তিনিও। অর্থাৎ গ্রিক তাঁরও অজানা। এমা ফ্রিজিয়ান, গ্রিক হয়ে এবার ইংরেজিতে এল,
‘ডু নট পুট, তারপর কী বুঝতে পারছি না। তারপর ফাদার টু দ্য, শেষেরটুকুও আমার বোঝার বাইরে।’
‘শেষেরটুকুই তো আসল! ধুস্… পিতাকে রেখ না। কোথায় রাখতে নিষেধ করছে সেটাই বোঝা না গেলে জায়গাটা খুঁজে পাওয়া যাবে কীভাবে?’
‘এমা!’
অস্ফুটে বলে উঠলেন জোনাথন। কিছু একটা আবিষ্কারের উন্মাদনায় হাত কাঁপছে। চুরুট নিভে গিয়েছিল আগেই। মাথার পোড়া অংশটুকু ছাই হয়ে ঝরে পড়ল মেঝেতে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপও করলেন না জোনাথন!
‘কোনো জায়গা নয়। পিতাকে কোনো পরীক্ষার সামনে দাঁড় করিও না। তোমার ঈশ্বর, পিতার পরীক্ষা নিও না। ম্যাথুর গসপেল। চ্যাপ্টার ফোর, ভার্স সেভেন- ডু নট পুট দ্য লর্ড ইয়োর গড টু দ্য টেস্ট।’
‘আপনি বসুন মি. ডারওয়ার্ড।’
শান্তভাবে বলে পাশের চেয়ারটা ঠেলে দিল এমা।
‘নাও ঠেলা সামলাও। আমি ভাবছিলাম কোন জায়গায় আসল সৌভাগ্য শলাকা রাখা আছে তার ইঙ্গিত দিতে এসব লেখা। তা নয়, নিউ টেসটামেন্টের ভার্স!
জোনাথন দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়েছেন। এখন আর তিনি সচরাচর উত্তেজিত হন না। ফাদার সাইমনের দেখানো পথ ধরে হেঁটে একটা স্থৈর্য ভাব এসেছে। তবে কখনো-সখনো তাল কেটে যায়। যেমন একটু আগেই চমকে উঠেছিলেন।
‘তোমরা কি ম্যাথুর গসপেল পড়েছ?’
এলিন জোরে ঘাড় নাড়ল। এমাও ভাইয়ের কাছাকাছি একটা জবাব দিল, ‘সেভাবে পড়া নেই। দ্য হোলি লেন্স এবং নাজরাতীয় জিশুর সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে গিয়ে কিছুটা নাড়াচাড়া করেছি মাত্র। আপনি নিশ্চিত, লেখাটা ম্যাথুর গসপেল থেকে উল্লেখ করা?’
‘একশো শতাংশ।’
‘তাহলে তো হিসেব আরও গোলমেলে হয়ে গেল।’
‘না, বরং হিসেব মনে হচ্ছে মিলে যাচ্ছে।’
কৌতূহলে দুই ভাইবোন নড়েচড়ে বসল।
‘ম্যাথুর গসপেল প্রথম শতাব্দীর শেষ দিকে লেখা বলে ধারণা করা হয়। কম-বেশি ফ্রম সিক্সটি টু এইট্টি। খ্রিস্টধর্ম তখন সবে ছড়াতে শুরু করেছে। সুতরাং সেই সময় বা তার কাছাকাছি সময়ে কেউ নিশ্চয়ই ভার্সের কথাগুলো নিখুঁতভাবে গুহার সমাধিতে লেখেনি।’
‘আপনি বলতে চাইছেন পরে কেউ বাইরে থেকে এসে লিখে গেছে?’
এমার প্রশ্নে টেবিলে ঝুঁকে বসলেন জোনাথন। ডানহাতের আঙুলের ফাঁকে ধরা চুরুটখানা চাপে পরে হাঁসফাঁস করছে।
‘নিশ্চিতভাবে তাই-ই। সেন্ট আগাউনাম চার্চ তৈরি হয় ৫১৫ খ্রিস্টাব্দে। সেন্ট-মরিস ফোর্টেস তো সেই হিসেবে সদ্যজাত। চার্চের খুঁটিনাটি আমার জানা। কোথাও এমন কিছুর নামোল্লেখ নেই। পাহাড়ের গায়ে এত বড়ো একটা স্থাপত্য তৈরি হলো, অথচ গুহাটা, সমাধি মন্দির, কারোর চোখে বাঁধল না! সুতরাং হিসেব মোতাবেক ওই গুপ্ত সমাধি ৫১৫ খ্রিস্টাব্দের পরে কোনো এক সময় তৈরি করা হয়। তারপর সেন্ট-মরিস ফোর্টেস নির্মান। দ্য গ্রোট অক্স ফিস আবিষ্কার। গুহাটা কিন্তু সকলের নজর এড়িয়ে গেছে! কীভাবে?’
‘হয়তো নজর ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।’
এলিনের কথায় উল্লসিত হয়ে বললেন জোনাথন,
‘ঠিক তাই। অর্থাৎ, যারা জায়গাটা লোকসমক্ষের আড়ালে রেখেছে, তারা চার্চ এবং তারপর ফোর্টেস তৈরির মাঝামাঝি সময় থেকে এখানে ছিল। এবং এখনো আছে। কোনো গুপ্ত সংঘ।’
‘শেষের অংশটুকুর সঙ্গে আমিও সহমত।’
শান্ত অথচ প্রত্যয়ী শোনাল এমার কণ্ঠস্বর।
‘সমাধি বেদীর ডানদিকে, একেবারে কোণায় তারা নিজেদের স্বাক্ষর রেখে গেছে। একটা আধফোটা গোলাপ। প্রফেসর বরিস গ্রইসম্যান একই স্বাক্ষর খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর বন্ধু ড. লুডল্ফের স্টাডিতে। আমি পেয়েছিলাম প্রফেসরের মৃত্যুর পর তাঁর বাড়িতে।’
‘আর আমি দেখেছি সামিরা টিসডেলের গলায়।’
উত্তেজনায় প্রায় চিৎকার করে উঠল এলিন।
‘পাদরি নিকোলাসের কবজির উলটো দিকেও ছিল।’
তাঁর সিদ্ধান্তে এমার সমর্থন দেখে স্বস্তিতে জোরে শ্বাস ফেললেন জোনাথন। অবশ্য পরমুহূর্তেই কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হলো তাঁকে।
‘তবুও একটা গুরুতর খটকা থেকে যাচ্ছে মি. ডারওয়ার্ড।’ এমা বলল, ‘ফ্রিজিয়ান ভাষা চার্চ তৈরির এক-দেড়শ বছর আগেই পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। তাহলে ৫১৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সেই লুপ্ত ভাষাটিকে কোনো প্রাচীন গুপ্ত সংঘ খুঁজেপেতে বের করল কীভাবে? সমাধির গায়ে কীভাবে লিখল- ঈশ্বরকে পরীক্ষার সামনে দাঁড় করিও না?’
জোনাথন কোনো উত্তর খুঁজে পেলেন না।
‘চার্চের আগে বিশপ থিওডর মোটামুটি ৩৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এখানে ব্যাসালিকা নির্মাণ করেন। সেই সময় টিমটিম করে হলেও প্রাচীন ভাষাটি বেঁচে ছিল। আমার মনে হয় ৩৫০ থেকে ৪০০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে ডু সেক্স ক্লিফের ওই গুহায় সমাধি মন্দির তৈরি করা হয়। এবং তখনই এই দেয়াল চিত্র এবং সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে থেবান লিজিয়নের অমর কীর্তিগাথার সৌজন্যে আগাউনামের নাম ছড়িয়ে পড়েছিল। এবং হ্যাঁ, পরের অংশ নিয়ে আপনার সঙ্গে আমি সহমত। তখন বাইরে থেকে আসা কোনো ধর্মীয় দল এই কাজ করে। একই সঙ্গে তারা এই জায়গাকে গুপ্ত রাখার কাজও চালিয়ে যায়। সম্ভবত চার্চের মধ্যে থেকেই।’
‘নিশ্চিত তাই।’
বোনের কথায় তাল ঠুকল এলিন,
‘তার প্রমাণ আমাদের সামনেই রয়েছে। সামিরা টিসডেল এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গরা। কিন্তু মূল প্রশ্ন ছেড়ে তোরা কেবল সময় ভ্রমণ করছিস। সমাধির গায়ে এসব লেখার উদ্দেশ্য কী?’
‘দ্য হোলি সিটি।’
জোনাথনের কথায় দুই ভাইবোন একসঙ্গে চমকে উঠল। টেবিল ছেড়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন প্রৌঢ় ধনকুবের। হলুদ-কমলা পাতার লার্চ গাছেরা এদিকের জায়গা দখল করে আছে। একটু কষ্ট করলে, তাদের ফাঁকফোকড় দিয়ে নজর এই অতিথি নিবাসের কত্রী শ্যারন ভ্যালাসের ঘর পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে। জোনাথন কিছুক্ষণ সেদিকে চেয়ে রইলেন। এই মুহুর্তে তাঁর একমাত্র বন্ধুর কথা মনে পড়ছে। খুব অল্প দিনের জন্যই তাঁকে পেয়েছিলেন। হাতে গোনা সেই ক-দিনেই আদ্যন্ত স্বার্থপর, হৃদয়হীন একটা মানুষকে বদলে দিয়েছিলেন ফাদার সাইমন। ম্যাথুর গসপেলের এই ভার্স, তাঁর চেয়ে সুন্দর করে তুলে ধরতে পারত কিনা সন্দেহ। শয়তান তার যাবতীয় প্রচেষ্টা নিয়ে প্রভু জিশুর মনে ঈশ্বরের প্রতি অবিশ্বাস জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিল। মানুষ যত উচ্চতায় পৌঁছায়, তার পায়ের নিচের জমি তত মসৃণ থেকে মসৃণতর হতে থাকে। লোভ, ঘৃণা, হিংসায় পিছলে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়তে থাকে। পৃথিবীর বুকে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাওয়া মানুষটির ওপরে শয়তানের দৃষ্টি সবার আগে পড়ে। পাপের জালে বেঁধে ফেলতে চায় তাকে। তাই প্রতিটি ধাপ ওঠার পর, সকলকে নিজেদের চারপাশে প্রহরা বাড়িয়ে নিতে হবে। দ্বিগুণ, তিনগুণ, চতুর্গুণ…। বারবার প্রশ্ন করে জাগিয়ে রাখতে হবে নিজেকে। সাফল্যের মোহ যেন শয়তানকে ডেকে না আনে। জোনাথন নিজের জীবন দিয়ে এই সারসত্যকে উপলব্ধি করেছেন। ফাদার সাইমনের কণ্ঠস্বরের পিছু নিয়ে লার্চগাছ, শ্যারন ভ্যালাসের কুঠি ছাড়িয়ে দূর আল্পসের চুড়ায় পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। এলিনের হাঁকাহাঁকিতে ফিরতেই হলো।
‘আপনার ঠিক কী হয়েছে বলুন তো? মাঝেমধ্যেই দেখছি হাওয়া হয়ে যাচ্ছেন! সেই পবিত্র শহর কোথায় মিঃ ডারওয়ার্ড? ভারতের বেনারস, নাকি মধ্য ইরাকের কারবালা? না না, খ্রিস্টধর্ম নিয়ে চর্চা হচ্ছে যখন, নিশ্চয়ই জেরুজালেম?’
‘প্রশ্ন করতে করতে নিজেই উত্তরে পৌঁছে গেছ এলিন। শেষেতম স্থানটিই দ্য হোলি সিটি। অর্থাৎ জেরুজালেম।’
এমার নজর টিভির স্ক্রিনে আটকে। বাঁ দিকের ছবির সঙ্গে জেরুজালেমের সম্পর্ক খুঁজে বের করার চেষ্টা করে চলেছে। কী করে একটা স্তম্ভের ওপরে দুটো মানুষের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকার ছবি, এবং ম্যাথুর গসপেলের একটা ভার্স থেকে জোনাথন এমন একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন? উত্তর খুঁজছে, কিন্তু পাচ্ছে না।
‘দেখে মনে হচ্ছে আমার উত্তর এমাকেও সন্তুষ্ট করতে পারেনি। না? বেশ আমি চেষ্টা করছি।’
জোনাথন টেবিলের কাছে ফিরে এলেন।
‘নিউ টেস্টামেন্টে আছে ব্যাপ্তাইজ হওয়ার পর যেমন ঈশ্বরের আত্মা আকাশ ফুঁড়ে নেমে এসেছিল, ঠিক তেমনই এসেছিল দ্য প্রিন্স অব ইভিল। সে নানা পন্থায় জিশুকে অবিশ্বাসী করে তুলতে চেয়েছিল। উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল পবিত্র শহরে, মন্দিরের সুউচ্চ শিখরে। হ্যাঁ এলিন, পবিত্র শহর, এমনকি মন্দিরেও শয়তানের আনাগোনা অবাধ। গ্রেট মঙইয়ামের সেই যুব সেবকের কথাই ধরো। ঈশ্বরের পায়ের নিচে থেকেও লোভের ফাঁস থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারেনি।’
শেষের কথাটা বলে আচমকা থেমে গেলেন জোনাথন ডারওয়ার্ড। কেন থেমে গেলেন তার উত্তর দুই ভাইবোনই জানে। এমার ইচ্ছে করছিল পুরোনো ঘা খুঁচিয়ে দেওয়ার। ইচ্ছে করছিল চিৎকার করে বলতে,
‘তাই আপনি ঈশ্বর হয়ে বেচারাকে শাস্তি দিয়েছিলেন বুঝি? আপনি একজন জঘন্য মানুষ জোনাথন। হত্যাকারী।’
ভীষণভাবে চাইলেও শব্দগুলো অনুচ্চারিতই থেকে গেল। লোকটা কাঁদছে! অনুশোচনা? নাকি নতুন নাটকে তুখোড় অভিনয়? এলিন টেবিলে রাখা ন্যাপকিন এগিয়ে দিল। জোনাথন অসহায় দৃষ্টিতে তাকালেন। তারপর দ্রুত নিজের আবেগের লাগাম টেনে ধরলেন।
‘ধন্যবাদ। এবং দুঃখিত। যা বলছিলাম, শয়তান মন্দিরের চুড়ায় দাঁড়িয়ে জিশুকে ঝাঁপ দিতে বলেছিল। বলেছিল সত্যিই ঈশ্বর তাঁর পিতা হলে, নিশ্চয়ই মাটি ছোঁয়ার আগেই তিনি জিশুকে রক্ষা করবেন। এর প্রত্যুত্তরে জিশু কী বলেছিলেন জানো? ইট ইজ রিটিন, ডু নট পুট দ্য লর্ড ইয়োর গড টু দ্য টেস্ট।’
‘অর্থাৎ শিল্পী এই দৃশ্যকে ফুটিয়ে তোলার মধ্যে দিয়ে দ্য হোলি সিটি, জেরুজালেমের দিক নির্দেশ করতে চেয়েছে!’
এলিনের কথায় ধীরে ধীরে হ্যাঁ সূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন প্রৌঢ় ধনকুবের।
‘এছাড়া অন্য কোনো কারণ অন্তত আমার চোখে পড়ছে না। তাছাড়া হোলি সিটি বলতে তখনকার পাশ্চাত্যের মানুষ জেরুজালেমকেই জানত।’
‘আরও একটা উল্লেখযোগ্য কারণ আছে মি. ডারওয়ার্ড।’
এমা উত্তেজনায় উঠে দাঁড়াল।
‘নাহ্, আমি একটা বোকার হদ্দ। অনেক আগেই কথাটা মাথায় আসা উচিৎ ছিল!’
‘গুড। প্রত্যেকের নিজের সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার।’
ছদ্ম গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলল এলিন। দুই ভাইবোনের সম্পর্কের রসায়নই এমন। একে অপরকে চোখে হারায়, আবার কাছাকাছি থাকলে চকমকি পাথরের মতো। ঠোকাঠুকি চলতেই থাকে।
‘আর তুই একটা গর্দভ।’
পালটা ফিরিয়ে দিল এমা। জোনাথন দুই ভাইবোনের খুনসুটি বেশ উপভোগ করছিলেন। এমা এলিনের দাবিহীন সম্পর্ক কেবলমাত্র স্নেহ ভালোবাসার ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে। তাই অটুট। নইলে দেওয়া-নেওয়ার ভিতে গড়া সম্পর্ক বড়ো নড়বড়ে হয়। আলতো টোকাতেই মুখ থুবড়ে পড়ে।
‘বেশ বেশ। বোঝা গেল কে কী। এবার এমাকে তার যুক্তির ব্যাখ্যা দিতে দাও।’
‘যুক্তি খুব সহজ। ভাষা। ফ্রিজিয়ান ভাষা এশিয়া মাইনর থেকে পাহাড় সমুদ্র ডিঙিয়ে সুইজারল্যান্ডে পৌঁছাল কীভাবে?’
এমা যেন প্রশ্নটা নিজেকেই করল। টেবিলের এ-মাথা ও-মাথা ঘুরে উত্তরও দিল নিজেকে,
‘সময়ের কথা মাথায় রাখলে এর কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা পাওয়া মুশকিল। হ্যাঁ, প্রথম পর্বে ফ্রিজিয়ান ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষাই ছিল। কিন্তু সেই ভাষা জিশুর জন্মের আনুমানিক চারশো বছর আগেই পৃথিবী থেকে মুছে যায়। পরে পরিবর্তিত ফ্রিজিয়ান ভাষা, যার সঙ্গে গ্রিক ভাষার মিল রয়েছে, জিশুর মৃত্যুর পর মোটামুটি তিনশো বছর পর্যন্ত টিকে ছিল। টিকে ছিল একমাত্র আনাতোলিয়ার আনাচেকানাচে গুটিকয়েক জনগোষ্ঠীর মধ্যে। সেই মিশ্র ভাষার নিদর্শন সেন্ট-মরিসে কীভাবে? সাম্ভাব্য উত্তর হতে পারে আমাদের থিওরি। সাড়ে তিনশো থেকে চারশো খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সুদূর আনাতোলিয়া থেকে বিশেষ জনগোষ্ঠীর কিছু মানুষ আগাউনামে পা রেখেছিল। বিশপ থিওডরের ব্যাসালিকা নির্মাণ হয়তো তাদের টেনে এনেছিল।’
‘দারুণ পর্যবেক্ষণ!’ জোনাথন বললেন।
‘তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? আমাদের পরবর্তী গন্তব্য হওয়া উচিৎ জেরুজালেম?’
‘সর্বনাশ! ওদিকে এখন যাওয়ার অর্থ গরম চাটুতে উঠে বসা। ইজরায়েল, প্যালেস্টাইন, দু পক্ষই তেতে রয়েছে। আর কারণও তো এক। দ্য হোলি সিটি।’
উদ্বগের ছোঁয়া টের পাওয়া গেল এলিনের কণ্ঠস্বরে।
‘খুব ভুল বলোনি এলিন।’ জোনাথন বললেন, ‘তবে আমার কিছু যোগাযোগ আছে। চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। অবশ্যই তোমাদের যদি ঝুঁকি নিতে আপত্তি না থাকে।’
‘মিলারদের অভিধানে ঝুঁকি মানেই ঝাঁপিয়ে পড়া। কী বল ব্রাদার?’
উৎসাহের চোটে এলিনের কাঁধে একটু বেশি জোরেই চাপড় দিয়ে ফেলল এমা। সেখানে হাত বোলাতে বোলাতে খানিক দোনোমোনো সুরেই জবাব দিল এলিন,
‘হ্যাঁ… মানে…তাই… বটেই তো।’
(ক্রমশ)