সৌভাগ্যশলাকা। ধারাবাহিক উপন্যাস। পর্ব ১৩। লিখছেন অলোক সান্যাল

0

(গত পর্বের পর)

জীবন ছাড়তে নাচার পাদরি নিকোলাসকে নিয়ে বেরিয়ে গেছে দু’জন সদস্য। বাকি দু’জন পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায় দানিয়েলের পেছনে নিষ্প্রাণ পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে। সামিরাকে নতুন করে ইশারা করতে হল না। ফোর্ট সিণ্ডের অধিকর্তা নিজেই স্বর্ণপাত্র হাতে তুলে নিলেন। মুখে অবিশ্বাস্য হাসি ফুটিয়ে তুলে বললেন, ‘আমি আমার অযোগ্যতার কোনো অজুহাত দেব না সামিরা। প্রভু যিশুর দরবারে একদিন তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে। চক্রের পবিত্র উদ্দেশ্য রক্ষিত হোক।’

বলে করে এক নিঃশ্বাসে পাত্রের অমৃতসুধা গলায় উপুড় করে দিলেন। সামিরা জোরে হেসে উঠল।

‘যাওয়ার এত তাড়া কীসের মি. দানিয়েল? সামনের জটিল সমস্যায় আমাকে একা ফেলে পালাতে চাইছেন বুঝি?’

সামিরার চোখের ভাষা পড়তে পারছেন না দানিয়েল। এমন হেঁয়ালির অর্থ কী? অমৃতসুধা আসলে মৃত্যুর পরোয়ানা, সে কথা দানিয়েলও জানেন। আর পাদরি নিকোলাসের অবস্থা তো চোখের সামনেই দেখলেন। হতভম্ব দানিয়েলের মুখ থেকে কেবলমাত্র একটি শব্দই বেরিয়ে এল, ‘মানে!’

উত্তর দেওয়ার আগে সামিরা নিজেকে গুছিয়ে নিল। আগের নেত্রীসুলভ গাম্ভীর্য ফিরিয়ে এনে বলল, ‘চক্র এখনো আপনার ওপরে সম্পূর্ণ আস্থাহীন নয় মি. দানিয়েল। হ্যাঁ, মিলার ভাইবোনের নিয়তি আমাদের কয়েদখানাতেই লেখার কথা ছিল। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাদের সুরক্ষার দায়ভারও ছিল আপনার। এখন আমাদেরই একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য যদি সুরক্ষা ব্যবস্থাকে কম্প্রোমাইজ করে, সেক্ষেত্রে আপনাকে পুরোপুরি দোষ দেওয়া যায় না। চক্রের মাননীয় শীর্ষ সদস্যরা এ বিষয়ে আমার সঙ্গে একমত।’

‘তাঁরা পুরো বিষয়টা জানেন! ফাদার নিকোলাসের মৃত্যু…’

‘আপনি ভুলে যাচ্ছেন মি. দানিয়েল।’ ফোর্ট সিণ্ডের অধিকর্তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিল সামিরা।

‘তাঁরা সর্বদাই আমাদের ঘিরে রয়েছেন। আমাদের প্রতিটি সাফল্য এবং ব্যর্থতার ওপরে তাঁদের তীক্ষ্ণ নজর রয়েছে। এবং হ্যাঁ, এই ঘরের যাবতীয় আলোচনা, দৃশ্য তাঁদের কাছে নিপুনভাবে পৌঁছে গেছে। শীর্ষ নেতৃত্বের হাজারটা চোখ মিঃ দানিয়েল।’

‘ঠিক… যথার্থ। আমারই ভুল।’

ওপর-নিচে মাথা নাচিয়ে বললেন ফোর্ট সিণ্ডের অধিকর্তা। কিছুক্ষণ আগে যে জীবনমোহ হেলায় ত্যাগ করেছিলেন, আশ্চর্যভাবে তা দ্বিগুণ তীব্র হয়ে ফিরে এসেছে! হয়তো সেই তাড়না থেকে কিঞ্চিৎ বেশি উত্তেজিত ঢঙে বলে উঠলেন দানিয়েল, ‘আমাদের তবে দ্রুত কাজে নেমে পড়া উচিত সামিরা। পাখি দুটোকে আবার খাঁচায় পুরতে হবে। এডোয়ার্ড নামের সাক্ষাৎ উৎপাতটা ফোর্ট সিণ্ডে থেকে বেরিয়ে কোন রুট নিয়েছে, জানা দরকার। ওই ব্যাটাকে ট্র‍্যাক করতে পারলেই মিলার ভাইবোন পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া যাবে।’

খুব ধীরে, কেটে কেটে নির্দেশ দিল সামিরা, ‘মিলারদের এবার শরীরের খাঁচা থেকে মুক্তি দেওয়ার সময় এসেছে মি. দানিয়েল। আপনি ঠিকই বলেছেন। এই লোকটাকে অনুসরণ করতে পারলেই মিলারদের কাছে পৌঁছানো যাবে।’

 

ল্যাপটপের খোলা উইন্ডোতে জুম ইন করা ফেদোরা টুপি মাথায় অস্পষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে বলল সামিরা। তারপর সহযোগীর দিকে তাকিয়ে যোগ করল, ‘লোকটা অসম্ভব ধূর্ত মি. দানিয়েল। সেন্ট-মরিস থেকে জাস্ট ভ্যানিশ হয়ে গেছে! জাস্ট ভ্যানিশ। পায়ের ছাপ পর্যন্ত মুছে দিয়ে গেছে। নির্ঘাত এডোয়ার্ড নামটা ভাঁড়ানো। আপনি আমাদের সমস্ত সোর্স কাজে লাগান। ড. মিলারের অতীতের প্রতিটি পাতা আমার টেবিলে চাই। ব্যক্তিগত তথ্য যা আছে, এবং তার বাইরের। বিশেষত তার পেশাদার জীবনের। কার কার সঙ্গে মেলামেশা ছিল। কাদের সঙ্গে কাজ করেছেন। সব আগামী বাহাত্তর ঘন্টার মধ্যে জোগাড় করুন। এত ঝুঁকি নিয়ে লোকটা মিলার ভাইবোনকে উদ্ধার করেছে। নিশ্চয়ই তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পৃক্ততা আছে। আমার অনুমান ড. এমা মিলারের জীবনপঞ্জি ঘাঁটলে লোকটার সম্পর্কে কিছু না কিছু তথ্যসূত্র বেরিয়ে আসবে।’

‘আমি দ্রুত কাজে নেমে পড়ছি সামিরা।’

 

দানিয়েল চেয়ারটা একটু বেশিই জোরে পেছনে সরিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। শান্ত পরিবেশে একটা কর্কশ আঁচড় কাটল চৌপায়া। দরজার মুখে গিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ালেন ফোর্ট সিণ্ডের অধিকর্তা।

‘আচ্ছা… ওই গোলাপি পোশাকের পর্যটকের দলটাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও তো কিছু জানা যেতে পারে। তাই না?’

হেলানো চেয়ারে নিজের শরীরের ভর সম্পূর্ণ ছেড়ে দিল সামিরা৷ নিস্পৃহ সুর খেলা করল তার গলায়।

‘ভাড়ার দল দানিয়েল। কিছু পাবেন বলে মনে হয় না। তবুও দেখুন। আর মনে রাখবেন, বারবার মৃত্যু থেকে বেঁচে ফিরে আসা যায় না।’

শেষের কথায় দৃঢ়চেতা দানিয়েলের শিরদাঁড়া বেয়ে মুহুর্তের জন্য শীতল স্রোত নেমে গেল। কোনোক্রমে আত্মবিশ্বাস আঁকড়ে ধরলেন তিনি।

‘জানি সামিরা। আশাকরি আমার জন্য চক্রকে অনুশোচনা করতে হবে না।’

 

মৃতেরাও ফিরে আসে

………………………………….

লম্বা ডাইনিং টেবিলে মুখোমুখি বসে আছে এমা এলিন। জোনাথন ডারওয়ার্ড জুনিয়র কিচেন টেবিলে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে। দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা মোটা চুরুট কথার মাঝে লাল টকটকে চোখ মেলছে। বদ্ধ ঘরে ঘুরপাক খাচ্ছে পরিণত বয়স্ক তামাকের দামি অ্যারোমা। প্রজেক্ট রিভেঞ্জের নাটকীয় পরিসমাপ্তির পর এই ভয়ংকর মানুষটির সঙ্গে যে আবার সামনা-সামনি হতে হবে, দুই ভাইবোনের কাছেই তা স্বপ্নাতীত ছিল। রহস্যময় কৃষ্ণদ্বীপ থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিলেন বিখ্যাত এই ধনকুবের। এলিনের ঘোরতর আপত্তি সত্ত্বেও এমা একটা খোঁজ করেছিল। ফাদার সাইমন বলেছিলেন, ‘পাপকে ঘৃণা করো, পাপীকে নয়।’

তাই মেনে নিয়েছিল এমা। যদিও তাতে লাভ হয়নি। বিজন কৃষ্ণদ্বীপে কোনো প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি রেসকিউ টিম। সেই দুঃসহ স্মৃতি থেকে বহুকষ্টে বেরিয়ে এসেছিল সে। তারপর আজ আবার, সেই একই দুঃস্বপ্নের মুখোমুখি!

‘আমাকে অবিশ্বাস করার হাজারটা কারণ তোমাদের কাছে আছে। সেখানে আমার কোনো হাতও নেই। আমার অতীত এই রাতের মতোই সত্যি। এবং ফাদার সাইমন আমার জীবনে ফিরে এসেছিলেন সূর্য হয়ে। আমি তখন ক্ষিদে তেষ্টায় আচ্ছন্ন। এক অসম্ভব আতঙ্কের সঙ্গে ব্যর্থ লড়াই করে মানসিকভাবে মৃত্যুর দোরগোড়ায়। ঠিক তখনই ফাদার কৃষ্ণদ্বীপে ফিরে এসেছিলেন। পরের বিয়াল্লিশ দিন তিনি আমার সঙ্গেই ছিলেন। আলোর পাঠ দিয়েছেন আমাকে। এবং একটা দায়িত্ব।’

‘আপনি বলতে চাইছেন ফাদারের সঙ্গ মাত্র বিয়াল্লিশ দিনে আপনাকে আমূল বদলে দিয়েছে! শতাব্দীর সেরা রসিকতা নয় এটা?’

বিদ্রূপ করে উঠল এলিন। জোনাথন মৃদু হাসলেন। ওভেনে মৃদু শব্দ হতে বললেন, ‘এক মিনিট। আওয়ার মিট ইজ রোস্টেড এনাফ।’

ওভেন খুলতে লোভনীয় গন্ধ বেরিয়ে এসে এলিনের নাকে জোরালো ধাক্কা মারল। দুই ভাইবোনকে বিস্মিত নীরব দর্শকের মতো অপেক্ষায় রেখে জোনাথন নৈশাহার প্রস্তুতিতে মনযোগ দিলেন। রোস্টের মাঝেই বিফ স্টক দিয়ে ঝোল তৈরি করে রেখেছিলেন। তিনটে প্লেটে পরিমাণমতো রোস্টেড বিফ, ঝোল মাখানো আলু-গাজর- ব্রোকোলি, এবং এমার পছন্দের ইয়র্কশায়ার পুডিং সাজিয়ে নিলেন। দুটো প্লেট টেবিলে রেখে বললেন, ‘দিনটা যখন রবিবার, তখন রোস্ট ডিনারের বিকল্প কি কিছু হতে পারে? টেস্ট ইট প্লিজ। খেলে বুঝতে পারবে, রান্নাটা আমার হাতে দিব্যি খোলে। ও হ্যাঁ, বিফের সঙ্গে হরসেরাডিস সস জমে বেশি, তবে আপাতত তার স্টক নেই। তাই গ্রিন মিন্ট সস দিয়েই চালাতে হবে। স্বাদের কিঞ্চিৎ ঘাটতি থেকে যাবে বটে, কিন্তু এছাড়া আর কিই-বা করার আছে। প্লিজ হেল্প ইয়োরসেলফ।’

ভদ্রলোকের নিস্পৃহতা দেখে অবাক হচ্ছিল এমা। এলিন ভুল বলেনি। বিয়াল্লিশ দিন কেন, জোনাথন ডারওয়ার্ড জুনিয়র বিয়াল্লিশ বছরেও বদলানোর মানুষ নন।

‘আপাদমস্তক খুনি একটা লোক রাতারাতি ভালো মানুষ হয়ে গেছে, আমাদের পক্ষে এমন ভাবা একটু কষ্টকর মি. ডারওয়ার্ড। মাফ করবেন।’

লোকটার জন্য মনের মধ্যে জমে থাকা অফুরন্ত ঘৃণার সামান্য ভগ্নাংশ উগড়ে দিল এমা। তার কথাগুলো যেন সামনের মানুষটাকে ছুঁতেও পারল না! তিনি নির্বিকার চিত্তে নিজের প্লেট নিয়ে টেবিলের একপাশে জায়গা নিলেন।

‘মিসেস ভ্যালাসের মজুতে ভালো পানীয় আছে দেখছি। আমাকে একটা লার্জ সিঙ্গেল মল্ট দিতে পারবে এলিন? তোমরাও নাও। যথেষ্ট ধকল নিয়েছ দু’জনে।’

বলে এমার কৌতূহলী চোখের তারায় ধরা দিলেন প্রৌঢ় মানুষটি। এর আগে যতবার জোনাথন ডারওয়ার্ডের চোখে চোখ পড়েছে, এমার মনে এক অজানা অস্বস্তি কাজ করেছে। বড্ড শীতল সেই চাহনি। অনুভূতিহীন। কিন্তু এখন সেই চেনা অস্বস্তি এমা টের পেল না। বেশ শান্ত! কথা এবং চলাফেরার মতোই। জোনাথন মাংসের একটা ছোটো টুকরো ফর্কে গেঁথে নরম সুরে বললেন, ‘ইতিহাস বড়ো বিচিত্র এমা। আমি একটা প্রাণ নিয়ে খুনি, আর যারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে হাজার হাজার প্রাণ নিচ্ছে, তার হলো ধর্মের রক্ষক! আই অ্যাডমিট, আই অ্যাম আ সিনার। অগুনতি পাপ করেছি। আর এখন, সেই পাপের আগুনে জ্বলছি। নরকের সেই আগুন আমাকে ঘুমোতে দেয় না এমা! তাড়া করে ফেরে। আরও কত বিনিদ্র রাত আমায় কাটাতে হবে জানি না। এটাই আমার শাস্তি এমা। বিলিভ ইট অর নট।’

আবেগ! জোনাথন ডারওয়ার্ড জুনিয়রের চরিত্রের সঙ্গে একেবারেই বেমানান। নাকি অনুশোচনার থেকেই জন্ম নিয়েছে এই আবেগ? এলিন টেবিল ছেড়ে উঠে গেল। কিচেনের ঠিক পাশটায় একটা কাচে ঢাকা ক্যাবিনেট। বোতলবন্দী উপাদেয় পানীয় সাজিয়ে রাখা। নিচের তাক থেকে তিনটে গ্লাস নিল এলিন। সঙ্গে বারো বছর বয়স্ক ডালমোর হুইস্কির একটা বোতল। সিরকের আধখালি বোতলও ছিল। সেটা নিল নিজের জন্য।

‘আল্পসের ঠাণ্ডাকে টক্কর দিতে ভদকার বিকল্প নেই। তবে আমার আবার ওটি ঠিক রোচে না। একি, তোমরা দেখছি খাবার মুখে ঠেকাওনি! ভয় নেই, ওতে বিষ নেই। রান্না তো তোমাদের সামনেই করলাম। তাছাড়া মারতে হলে বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে ফোর্ট সিণ্ডের কয়েদখানা থেকে তোমাদের উদ্ধার করার কোনো প্রয়োজন ছিল না আমার। তাই না?’

শেষের কথাগুলো সহাস্যে বললেন জোনাথন। দুই ভাইবোনের মধ্যে ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় হলো। যদিও হিটার ঘরের উষ্ণতাকে এক জায়গায় ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে, তবুও সময় গড়ানোর সঙ্গে বাইরের ঠাণ্ডা বাতাস ঠিক ফাঁকফোকর খুঁজে নিচ্ছে। এলিন প্লেটে গ্রিন মিন্ট সস ঢেলে বোনের দিকে এগিয়ে দিল। নিজেও নিল। একটা মাংসের টুকরো তাতে ছুঁইয়ে মুখে পুরে দিল। তারপর এক টুকরো ঝোল মাখানো আলু। মুখে না বললেও তার অজান্তে বন্ধ হয়ে আসা চোখ দুটো রান্নার স্বাদ বলে দিচ্ছে। ভাইয়ের দেখাদেখি খাওয়া শুরু করল এমাও।

‘হাজারবার মগজ ঝাড়া দিয়েও একটা প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাচ্ছি না মি. ডারওয়ার্ড।’

মুখের মধ্যে স্বাদু মাংসের দলা ভাঙতে ভাঙতে বলল এলিন, ‘আপনি কবে থেকে আমাদের ওপরে নজরদারি চালাচ্ছেন, এবং কেন?’

জোনাথন টেবিল ন্যাপকিন দিয়ে আলতো করে ঠোঁট মুছে নিলেন। গ্লাসের অবশিষ্ট সোনালি তরলে একটা চুমুক দিয়ে এতটুকু শব্দ ছাড়া সেটা কাচের টেবিলে নামিয়ে রাখলেন।

‘প্রশ্নটা এমার করা উচিৎ ছিল। না এলিন, তোমার ওপরে আলাদা করে নজর রাখার প্রয়োজন আমার ছিল না। দায়িত্বও নয়। তবে তোমার বোনের গতিবিধি সম্পর্কে আমাকে খবর রাখতে হয়েছিল। কেন, সে প্রশ্নের জবাব দিতে আমি অপারগ। মাফ করো। এছাড়া বাকি যা কিছু প্রশ্ন আছে, শ্যুট মি।’

এমা খাওয়া থামিয়ে আবার সরাসরি তার একদা দুঃস্বপ্নের কারণে চোখ রাখল।

‘ভিয়েনাতে প্রাচীন স্থাপত্য সংগঠনের তরফে আমন্ত্রণের নেপথ্যে আপনি। সেখানে প্রফেসর বরিসের সঙ্গে আলাপের পরিকল্পনা এবং তাঁর অদ্ভুত প্রস্তাব দেওয়াও আপনার মস্তিষ্কপ্রসূত। সামিরার সঙ্গে আমাদের সেন্ট-মরিসে যাওয়া, সেখানে আমাদের কাজ, সবটাই আপনি একেবারে কাছ থেকে দেখেছেন। হয়তো তাই পিছু নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন ফোর্ট সিণ্ডের পার্বত্য গুহায়। এগুলো তো কোনো প্রশ্নই নয় মি. ডারওয়ার্ড। আসল প্রশ্ন তো ওই, কেন?’

জোনাথন গ্লাসের পানীয় শেষ করে রিফিল করে নিলেন। তারপর পেলব সুরে বললেন, ‘আমায় এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন করো না এমা, প্লিজ। আমি কারোর কাছে দায়বদ্ধ।’

তারপর কৌতুকের ঢঙে যোগ করলেন, ‘কিন্তু তোমরা দু-হাত দূরে বসে থাকা বুড়োটাকে চিনতে পারলে না! এটা আমার কাছে অপ্রত্যাশিত। বিশেষ করে এলিনের শ্যেনদৃষ্টি যখন এড়িয়ে যেতে পেরেছি, তখন আমার ক্যামোফ্লাজ যে দুর্দান্ত ছিল, মানতেই হবে। কী বলো হে?’

‘অস্বীকার করছি না। কিন্তু আমরা এখনো গোলকধাঁধা থেকে বেরোতে পারিনি মি. ডারওয়ার্ড। সত্যিটা না জানা পর্যন্ত এখনই ভরসা করার মতো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না যে। অতীত আমাদের সেই শিক্ষাই দিয়েছে।’

‘আই এগ্রি। অতীতের সত্যিটা বর্তমানের চেয়ে ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ মাই ডিয়ার৷ একটা প্রাচীন নিদর্শনকে ঘিরে মাত্রাতিরিক্ত উন্মাদনা লালন করে আসছি আমরা। তার থেকেও বিপজ্জক সত্যি হলো, কিছু অত্যন্ত প্রভাবশালী ধর্মান্ধ সেই নিদর্শনকে রক্ষা করতে গিয়ে, অসংখ্য প্রতিভাবানকে বলি দিচ্ছে অকাতরে। তাদের থামানো দরকার। কাজটা কতটা কঠিন নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ? সুতরাং বর্তমানের আশঙ্কাকে আপাতত সরিয়ে রাখাটাই মঙ্গলের। আমরা সকলেই এখন এমন একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে, যেখান থেকে শত্রুর সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই ছাড়া কিছু করার নেই।’

‘অর্থাৎ আমরা যদি হোলি লেন্স নিয়ে খোঁজখবর থামিয়েও দিই, তবু সামিরা এবং তার দলবল পিছু ছাড়বে না?’

দুপাশে ঘাড় নাড়লেন জোনাথন।

‘ওদের অনেক গুপ্ত তথ্য আমরা জেনে ফেলেছি এলিন। এমাও লংগিনাসের লেন্সের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে। সুতরাং আমরা তিনজনই তাদের মূল লক্ষ্য। যেভাবেই হোক তারা আমাদের কাছে পৌঁছাতে চাইবে। চেষ্টা করেছি পায়ের ছাপ মুছে ফেলার, কিন্তু কোথাও না কোথাও একটা খুঁত হয়তো থেকে গেছে। শিকারী কুকুরের মতো সেই গন্ধ শুঁকে ওরা ঝাঁপিয়ে পড়বে। তার আগেই আমাদের যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়ে ফেলতে হবে এলিন।’

‘কিন্তু কীভাবে? ওরা কী চায়, কারা রয়েছে এতকিছুর পেছনে, কিছুই তো আমাদের জানা নেই মি. ডারওয়ার্ড!’

এমার উত্তেজনার জবাবে মৃদু হাসি ফিরিয়ে দিলেন জোনাথন।

‘আছে এমা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা তথ্য আমরা জানি।’

‘লংগিনাসের লেন্সকে কোথায় লুকিয়ে রাখা?’

উঠে দাঁড়িয়ে বলল এলিন।

‘ইয়েস। ওদের উদ্দেশ্য আমাদের জানা। ওরা আমাদের কাছে পৌঁছানোর আগে সেই উদ্দেশ্যকে অকেজো করে দিতে হবে।’

‘অর্থাৎ হোলি লেন্সকে খুঁজে বের করে পৃথিবীর সামনে নিয়ে আসতে পারলেই বিপদ কেটে যাবে?’

এমার প্রশ্নে চিন্তিত সুরে জবাব দিলেন জোনাথন, ‘আপাতত। তখন যাবতীয় শক্তি লংগিনাসের বর্শাকে নিজেদের কব্জায় আনার জন্য বরাদ্দ করতে হবে। অবশ্য এটা একটা স্ট্র‍্যাটেজি। খাটবেই যে এমন নিশ্চয়তা দিতে পারি না।’

বাইরের নিস্তব্ধতা এবার নৈশভোজের টেবিলেও নেমে এল। কোনো শব্দ খরচ না করে পান পর্ব শেষ করল তিনজনে। আস্কারা না পেয়ে জোনাথনের চুরুট নিভে গিয়েছিল। তিনি উঠে আবার সেটায় অগ্নিসংযোগ করলেন। তারপর সুগন্ধি ধোঁয়ার একটা কুণ্ডলী বাতাসে ভাসিয়ে বললেন, ‘ফোর্ট সিণ্ডের পেটে তোমাদের খুঁজতে গিয়ে প্রথমে অন্য একটা গুহায় ঢুকে পড়েছিলাম। সেখানে চমকে দেওয়ার মতো একটা আবিষ্কার করে ফেলেছি। তোমাদের পাশাপাশি অবশ্য পাদরি নিকোলাসকেও এই আবিষ্কারের ক্রেডিট দিতে হয়। তোমাদের কয়েদখানা থেকে বের করার পর, আবার সেখানেই ফিরে গিয়েছিলাম। বেশ কিছু ছবিও তুলে এনেছি।’

‘এই কারণে উৎকট গোলাপি পোশাকের দলে আপনাকে খুঁজে পাইনি!’

এলিনের কথায় জোরে হেসে উঠলেন জোনাথন ডারওয়ার্ড।

‘উৎকটই বটে। দৃষ্টিকটুভাবে চোখে পড়ে। ঠিক সেই কারণে নজর পিছলেও যায়। তবে তোমাদের সঙ্গে নতুন করে সাক্ষাতের জন্য আমি আল্পসের নিরিবিলি এই পাহাড়ি গ্রামকেই বেছে রেখেছিলাম। ভ্যালোরসাইন। জায়গাটা দারুণ! না?’

‘ছবিগুলো?’

এমার উদ্যগ্রতায় বরফঠাণ্ডা জল ঢেলে প্রৌঢ় ধনকুবের বললেন, ‘আজ রাতে একটা লম্বা ঘুম দাও তোমরা। শরীরের সঙ্গে মগজেরও বিশ্রাম দরকার। আগামীকাল না-হয় পুরো বিষয়টা নিয়ে চর্চা করা যাবে।’

………………………………………

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *