সৌভাগ্যশলাকা। ধারাবাহিক উপন্যাস। পর্ব ১৯। লিখছেন অলোক সান্যাল

আশ্চর্য অভিনেতা
……………………………….
পরপর পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল ডেভিস।
‘টোলগা, বারাক, হালিত। টোলগাকে তুমি আগেও দেখেছ। মনে আছে নিশ্চয়ই?’
হেসে হাত বাড়িয়ে দিল এলিন। বছর পাঁচেক আগে দেখেছে। তখন ডেভিস অন্ধকার জগতের মানুষ। ছোটোখাটো একটা দলও ছিল তার। এসব ক্ষেত্রে যা হয়। দখলদারির লড়াইয়ে হামেশাই জড়িয়ে পড়তে হয়। ডারউইনের নিয়ম মেনে প্রকৃতির মতো অপরাধ জগতেও কেবল যোগ্যরাই টিকে থাকে। ডেভিসের অবশ্য টিকে থাকার কথা ছিল না। পরিবার সমেত গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যেত। দিনের আলোয়। ভরা রাস্তায় কেউ এগিয়ে না এলেও এলিন নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেনি। সম্পূর্ণ অপরিচিত একজনের জন্য নিজের জীবনকে বাজি রেখেছিল। না, ডেভিসের স্ত্রীকে বাঁচানো যায়নি, তবে তিন বছরের মেয়েটার কোনো ক্ষতি হতে দেয়নি সে। অন্ধকার জগতে সেটাই ছিল ডেভিসের শেষ দিন। এখন প্রাইভেট সিকিউরিটির একটা কোম্পানি চালায়। ভালোই চালায়। শুধু এক্স আর্মি নয়, তার জন্য অনেকেই অন্ধকারের অনিশ্চিত জীবন ছেড়ে আলোর পথে এসেছে। টোলগা সেই দুর্লভ সুযোগ পাওয়াদের একজন।
‘আমার স্মৃতি ততটা পলকা নয় ব্রাদার। তবে শেষ বারের তুলনায় এখন বেশ পরিণত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। নাকি মুখ বোঝাই দাড়ির জন্য এমন লাগছে জানি না।’
একসঙ্গে হেসে উঠল সকলে।
‘শুধু চেহারায় নয় ব্রাদার, নিশানাতেও। আর এই যে হালিত, এক্সপ্লোসিভ এক্সপার্ট। ঝামেলা আটকানোর সঙ্গে সঙ্গে এমা যদি আবার কোথাও ডিনামাইট লাগাতে বলে, হালিত আছে। বারাক এখানকার মাটির ছেলে। জায়গাটা হাতের তালুর মতো চেনে। টোলগা ওর ব্যাপারে আমাকে ভরসা দিয়েছে৷ কী তাই তো?’
একমুখ দাড়ি নিয়ে জোরে জোরে ঘাড় নাড়ল দীর্ঘদেহী তুর্কি। স্বচ্ছ ইংরেজিতে সমর্থন জানাল, ‘নির্ভাবনায় থাকুন স্যার। বারাক আমার সৎ বোনের স্বামী। টার্কিস আর্মড ফোর্সে ছিল। পি-কে-কে (কুরদিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি)-এর সঙ্গে লড়াইয়ে ডান চোখ হারিয়েছে। তবে বারাক টেলিস্কোপে এক চোখ রেখেও হাজার মিটার দূরে নিখুঁত আঘাত করতে পারে।’
এলিন হাত দুটো ছড়িয়ে কাঁধ ঝাকাল।
‘ডেভিসের ওপরে আমি দুই চোখ বন্ধ করে ভরসা করি। বারাক যখন ওর টিমে আছে, তখন অনর্থক ভেবে সময় নষ্ট করব না। আমরা বরং জরুরি জিনিসপত্র কী লাগবে, সেসবের ব্যবস্থা কীভাবে হবে, তাই নিয়ে আলোচনা সেরে ফেলি।’
‘একটা প্রাথমিক সংগ্রহ প্রস্তুত সে তো দেখতেই পাচ্ছ।’
টেবিলে দু’হাতের ভর রেখে ঝুঁকে বলল ডেভিস। চলটা ওঠা টেবিলে সাজিয়ে রাখা একটা রাশিয়ান মেইড এস-ভি-ডি স্নাইপার রাইফেল। বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীরা ব্যবহার করে। হেকলার অ্যান্ড কচ-এর তৈরি পঞ্চাশের দশকের জি-৩ রাইফেল। অতি ব্যবহারের দরুন তাদের অবস্থা দেখে হাতে তুলতে ভয় লাগবে। তিনটে .৪৫ ক্যালিবারের কোল্ট অটোমেটিক পিস্তল। গোলাগুলিও আছে। যদি মি. ডারওয়ার্ডের অনুমান খেটে যায়, তবে এইসব মান্ধাতা আমলের অস্ত্র নিয়ে তারা কতটা লড়াই দিতে পারবে, সন্দেহ আছে। নিরাপত্তার ব্যাপারে এলিন বরাবর খুঁতখুতে।
‘আপাতত এগুলো দিয়ে কাজ চালিয়ে নেওয়া যাবে। আমাদের হাতে কতদিন আছে এখনো জানি না। দিন তিনেক বা তারও বেশি হতে পারে। সময় যাই থাকুক, দ্রুত এগুলোর রিপ্লেসমেন্ট চাই ডেভিস।’
‘জানি ব্রাদার। পুরোপুরি সেজেই মাঠে নামব। এখন দেখার, বারাক আমাদের এ বিষয়ে কী সাহায্য করতে পারে। কী হে, পারবে তো?’
‘যা চাইবেন, পেয়ে যাবেন। আর-পি-জি চাইলে তাও জোগাড় হয়ে যাবে। শুধু পেমেন্ট হবে ডলারে।’
‘সাব্বাশ!’
একটা কোল্ট অটোমেটিক কক করার ফাঁকে বলে উঠল এলিন। সেফটি অফ করে ট্রিগারে আঙুল ছোঁয়াতেই ‘ক্লিক’ শব্দ হল। পিস্তল হিসেবে তার স্প্রিংফিল্ড এক্স ডি বরাবরের পছন্দ। না হলে নিদেনপক্ষে সিগ স্যোয়ার। সেসব যখন নেই, তখন আপাতত একেই কাছে রাখা যাক। ইটস বেটার টু হ্যাভ সামথিং, দ্যান নাথিং।
‘অন্তত জনা পঞ্চাশের দলকে অর্ধেক বেলা থামিয়ে রাখার মতো সরঞ্জাম চাই ভায়া। ডলারে কম পড়বে না। শুধু জিনিসগুলো যেন খাঁটি হয়।’
আগারনাস। মালিকগাজি জেলার মধ্যে ছোটো একটা শহুরে এলাকা। চকচকে রাস্তা, পাশেই পড়ে ব্যস্ত ফুটপাত, দোকানঘর এবং মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বহুতল। সেসবের মাঝে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বেঁচে থাকা মধ্যবিত্ত জীবন। আগারনাসে এসবের ছোঁয়া লেগে আছে বটে, তবে দূরের ছাই রঙা উঁচু ঢেউ খেলানো প্রকৃতির দিকে তাকালে, পেছনের শহরকে ভ্রম বলে মনে হয়। আগারনাসের প্রান্তসীমায় একটা পরিত্যক্ত জীর্ণ দশাগ্রস্ত বাড়ি। পাথরের খণ্ড জুড়ে তৈরি। এটাই আপাতত এলিনদের ঠিকানা। ওপর-নিচ মিলিয়ে সাকুল্যে পাঁচটা ঘর। তার মধ্যে থেকে তিনটে সাফসুতরো করে নেওয়া হয়েছে। এমা এলিন থাকবে ওপরে। নিচের দুটো ঘর বরাদ্দ বাকিদের জন্য। মাঝখানে বেশ ছড়ানো উঠোন। উঠোনের একপাশে ছোট্ট রসুইঘর। দিন তিন-চার থাকায় অসুবিধা হবে না। একটেরে অবস্থানের কারণে আশপাশে নজর রাখাও সুবিধাজনক। সমস্যা একটাই। বাড়িতে বিদ্যুতের সংযোগ নেই। ডেভিসরা আজ সকালেই নেমেছে। তারপর হোটেল থেকে এলিনদের নিয়ে সোজা মালিকগাজির এই ঠিকানায়। তাই পরিকল্পনা মাফিক সবকিছু গুছিয়ে ওঠার সময় পাওয়া যায়নি। কেবল জল এবং শুকনো খাবার কিছু নেওয়া হয়েছিল। তাদের অবশ্য কায়সারি যাওয়া আসা করতে হবে। জোনাথন হাসপাতালে রয়েছেন। সকালে দেখা না পেলেও খবর নিয়েছিল। ভদ্রলোক ধাক্কা কাটিয়ে উঠেছেন। ডাক্তার তাঁকে আরও কিছুদিন অবজারভেশনে রাখবেন। তিনি ছাড়া পাওয়া না পর্যন্ত, আগারনাস-কায়সারি শহর যাতায়াত চলবে। সুতরাং দরকারি যা কিছু, যোগানে অসুবিধা হবে না।
‘আশ্চর্য!’ দোতলার খোলা সিঁড়ি বেয়ে নামছিল এমা। অর্ধেক নেমে থমকে দাঁড়াল সে।
‘লোকটার সব কথায় এত গুরুত্ব দেওয়ার কী আছে? আমরা কোনো যুদ্ধে যাচ্ছি না এলিন।’
এলিন হেসে বোনের দিকে এগিয়ে গেল।
‘যুদ্ধে এসব অস্ত্র অচল ডিয়ার সিস্টার। যদি তোর সামিরা টিসডেল দলবল নিয়ে সত্যিই হামলা করে, ঘণ্টা খানেকও ঠেকাতে পারব না।’
‘এবার তবে সাঁজোয়া গাড়ি জোগাড় কর।’
এমা বাকি সিঁড়ি ভেঙে নেমে এল।
‘আমাকে একবার ওই শুকুন বুড়োটার সঙ্গে দেখা করতে হবে। সামনে এগোনোর জন্য কিছু অস্ত্র আমারও দরকার।’
ফোর্ড কোম্পানির একটা ট্রাক এবং একটা র্যাঙ্গলার জিপ। দুটি বাহনই বেশ বয়স্ক। রোদ জলে তাদের নিজস্ব রং হারিয়েছিল আগেই। পরে তার ওপরে নতুন প্রলেপ পড়লেও আগের মতো সুন্দরী করে তোলা যায়নি। ডেভিস ছাড়া বাকি সকলেই বেরিয়ে এল। কোনো একজনের দূর্গ পাহারায় থাকা দরকার। হালিত তার পুরনো ঠিকানায় ঢুঁ মারবে। সুরক্ষার যাবতীয় সরঞ্জামের ব্যবস্থা রাতের আগেই সেরে ফেলতে চায় সে। কিছুটা বাধ্য হয়েই এলিনকে তার সঙ্গ নিতে হলো। ঝাড়াই বাছাইয়ের কাজে নিজের বিশ্বস্ত চোখ জোড়া ছাড়া অন্য কারোর ওপরে তার ভরসা নেই। এমাকে নজর ছাড়া করাতেও তার আপত্তি ছিল। উপায় নেই। টোলগা আর বারাক অবশ্য তার সঙ্গে থাকবে। বিশেষত টোলগার ভরসায় বোনকে কাছ ছাড়া করতে রাজি হলো সে। দুটো দল যাবে দু’দিকে। এমারা হাসপাতাল হয়ে কায়সার থেকে দরকারি জিনিসপত্র তুলে নেবে। এলিনরা জ্বালনি এবং অস্ত্র।
কায়সারি শহর হাসপাতাল। সামনে গাড়ি পার্ক করার খোলা জায়গায়। গতকাল যখন এখানে এসেছিল, উৎকণ্ঠায় চারিদিক ভালো করে দেখার সুযোগ পাওয়া যায়নি। এরকিলেট ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে হুটার বাজিয়ে ছুটতে শুরু করেছিল অ্যাম্বুলেন্স। থেমেছিল সোজা হাসপাতালের গেটের মুখটায়। স্ট্রেচারে প্রৌঢ় ধনকুবের। স্থির, শান্ত দেহভঙ্গিমা। কেবল বুকের ধীর ওঠা-নামা এবং প্যারা কার্ডিয়াক মনিটরে ঢেউ খেলে যাওয়া জীবনরেখা মানুষটার ‘নেই’ হওয়ার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিচ্ছে। একটু আগের দারুণ চঞ্চল, উৎসাহী লোকটা মৃতবৎ পড়ে! একই সঙ্গে নিজেদের প্রয়োজনের কথাও ঘাই মারছিল মাথায়। জোনাথন ডারওয়ার্ডের অবর্তমানে দ্য হোলি লেন্স পর্যন্ত পৌঁছানো কঠিন হয়ে যাবে। অর্থ তো বটেই, প্রভাব-পরিচিতি থাকা এক্ষেত্রে ভীষণ জরুরি। এমার কোনোটাই নেই। হোক না পৃথিবীর সবচেয়ে অপছন্দের মানুষ, তবুও তাঁর এমন অবস্থায় নিজের কথা ভাবছে! সে যে এতটা স্বার্থপর, এমা নিজেও জানত না। শেষমেশ যাবতীয় উৎকণ্ঠা পেরিয়ে চোখ মেলেছিলেন জোনাথন ডারওয়ার্ড জুনিয়র। অবসন্ন দৃষ্টিতে।
না, জোনাথনের চিকিৎসা নিয়ে এতটুকু ঝক্কি পোহাতে হয়নি এমাদের। ইনফিনিটি লাইনস হয়ে বৃটিশ কনস্যুলেটে বিদ্যুৎগতিতে খবর পৌঁছে গিয়েছিল। সেখান থেকে তুরস্কের প্রশাসনিক ভবন। গতকাল হৈচৈ-এর মাঝেই এমাকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল। সঙ্গে বারাক এবং আরও দু’জন। আজ সকাল থেকে অবশ্য বারাকের সঙ্গীদের দেখা যাচ্ছে না। সম্ভবত ডেভিসরা আসায় তাদের ছুটি হয়ে গেছে।
ভিজিটার্স রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে এমা। ফ্লোরের চকচকে টাইলস মুছে আরও ঝকঝকে করে তুলছে এক সাফাইকর্মী। নিকটজনকে দেখতে আসা কালো বোরখার ভিড়। এক সমর্থ মহিলা, বোরখাহীন, পিঠে করে হয়তো তার স্বামীকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে! লোকটার বাঁ পায়ে হাঁটু পর্যন্ত প্লাস্টার। সদ্য ভাঙা হার জোড়া দেওয়া হয়েছে। কায়সারি শহরের কেতাদুরস্ত হাসপাতালে এমন দৃশ্য বিস্ময়ের জন্ম দেয়। সেদিক থেকে নজর ফেরাতেই এমা চেনা মুখকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখল। ডা. আলি দিনসার। ইনিই গতকাল জোনাথন ডারওয়ার্ডের চিকিৎসার দায়িত্বে ছিলেন। তাকে দেখে ডাক্তারবাবু যেন দাঁতের বিজ্ঞাপন দিলেন!
‘সকালে আপনার ভাই ফোন করেছিলেন।’
‘জানি। আইসিইউ থেকে ট্রান্সফার করেছেন বলেই দেখতে এলাম। একবার দেখা করা যায় কি?’
হাতঘড়িতে সময় ঝালিয়ে নিলেন ডা. দিনসার। ভাবার জন্য সামান্য সময় নিয়ে বললেন, ‘আসুন।’
ভিজিটিং আওয়ার শুরু হয়নি এখনো। অর্থবানদের জন্য জগতের নিয়ম কবে আর এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকেছে। এমা কোনো কথা খরচ না করে ডা. দিনসারের পিছু নিল। টোলগা আর বারাক সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। হাসপাতালের মধ্যেও দু জোড়া অস্থির চোখ অস্বাভাবিকতা খুঁজে ফিরছে। তাকে দেখে ওরাও নড়ে উঠেছিল।
‘তোমরা এখানেই অপেক্ষা করো। কেবিনে বেশি ভিড় করার দরকার নেই।’
‘আমরা কেবিনের বাইরেই থাকব।’
দৃঢ় শোনাল টোলগার কণ্ঠস্বর। এলিনের হুকুম। তার বোনকে দৃষ্টিসীমার আড়াল করা যাবে না। এমা ঘাড় ঝাঁকিয়ে হতাশা প্রকাশ করল।
(ক্রমশ)