দীনেন্দ্রকুমারের সমাজ-কথকতা। শতঞ্জীব রাহা সম্পাদিত দীনেন্দ্রকুমার রায়ের ‘সেকালের চিত্র চরিত্র’ পড়ে লিখছেন গোবিন্দ বিশ্বাস

0

দূর ভবিষ্যৎ তো দূর অস্ত, আমার মস্তিষ্ক একহস্ত দূরত্বের ভবিষ্যৎ ভাবতে পারে না। আর বর্তমান নিয়ে তেমন সন্তুষ্টি  আমার নেই , কাজে কাজেই একটু অতীতচারী হয়ে ভালো থাকার একটা অভ্যেস আমার ভিতরে গড়ে উঠেছে। পুরাতন পু্ঁথি-দলিল দস্তাবেজ, পুরাতন আসবাব, পুরাতন মানুষ ও তাকে ঘিরে থাকা গল্প আমার মনের খোরাক জোগায়— ‘সেকালের’ কথা কোনো আসর থেকে উঠে এলে পা দুটোকে ক্ষণকাল বিশ্রাম দিই সেই আসরের মাটিতে। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, লেখক দীনেন্দ্রকুমার বিষয়ে আমার পূর্বজ্ঞান ছিল না৷ শুধু বিষয়ের ঝোঁকেই বইটি সংগ্রহ। লেখক সম্পর্কে আমার পূর্বজ্ঞান না থাকার যে ঘাটতি সেটা  সম্পাদক  শতঞ্জীব রাহা  পূরণ করে দিয়েছেন গ্রন্থের মুখবন্ধে (চিত্র, চরিত্র ও সমাজ-কথকতা)। সম্পাদকের কলম লেখক এর কাছে পৌঁছানোর পথটি সহজ করে দেয়। যে পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সেকালের নানা চিত্র চরিত্র ঘেরা গ্যালারিটি খুব সহজেই প্রদক্ষিণ করতে পারি। বুঝতে পারি দীনেন্দ্রকুমার কলমকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু অন্তরে ছিল কাঙাল হরিনাথের আদর্শ। স্বভাবতই পেশাগত বাধ্যবাধকতা, পরবশ্যতা সত্বেও কাঙাল হরিনাথের জীবন ও সাহিত্যের কতগুলি মূল নির্দেশক নীতির প্রতি নিষ্ঠাবান থেকেছেন দীনেন্দ্রকুমার তাঁর রচনায়। থেকেছেন বলেই কোনো কল্পনার আড়াল না রেখে, কোনো দূরত্ব রচনা না করে দেশ-কাল-সময়ের পল্লীকেন্দ্রিক এক জীবন্ত ছবি আঁকতে সমর্থ হয়েছেন৷ বর্ণিত প্রতিটি বিষয় লেখকের পরিচিত, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতালব্ধ। লেখকের সেই অভিজ্ঞতার সঙ্গে পাঠকের অভিজ্ঞতা কোথাও একাত্ম হয়ে গেলে অতীত যেন ঘটমান বর্তমান হয়ে ওঠে — ‘স্বায়ত্তশাসনের সুখ’ রচনায় দুর্নীতির চিত্রটি সমকালের বহুচর্চিত ‘কাটমানি’ শব্দটিকে স্মরণে এনে দেয়— “তুমি পনেরো হাজার পাকা ইটের দর দশ টাকা হিসেবে দেড় শত টাকা পাইবে, ঝামা ইটের দর সাত টাকা হিসেবে দশ হাজারে সত্তর টাকা পাইবে ; সর্ব সমেত এই দুইশত কুড়ি টাকা পাইবে। কিন্তু তুমি বিল করিবে বিশ হাজার পাকা ইটের বাবদ চারি শত টাকার। দুইশত বাবদ এক শত আশি টাকা আমাকে ফেরত দিবে, বুঝিয়াছ? ” সমাজের রন্ধ্রে  দুর্নীতি প্রবেশ করেছিল সেকালও, সেই দুর্নীতি আজও বহমান— সেকারণেই সেই সময়ের চরিত্র,অভিযোগ ক্ষোভ-বিক্ষোভ  সমকালীন মনে হয়— দীনেন্দ্রকুমার চিত্রিত ঘনশ্যাম চরিত্র যেন এই সময়ের তুলিতে আঁকা— ” যত চোর মিউনিসিপালিটিতে এসে জুটেছে, ছশো টাকা দিয়ে সেদিন রাস্তা মেরামত হলো— রাস্তার অবস্থা দেখ— পা-খানা একেবারে ভেঙে গিয়েছে।” অনুমান করা যায় এই অকপট চিত্র নির্মাণের জন্য দীনেন্দ্রকুমারকে যথেষ্ট প্রতিকূলতা সহ্য করতে হয়েছিল। সম্পাদক তাঁর কথামুখে (চিত্র, চরিত্র ও সমাজ-কথকতা) যথার্থই বলেছেন, ‘একটি পদানত দেশের প্রাদেশিক ভাষার লেখক, যাঁর জাতি ও ভূমি-পরিচয়ে অনার্জিত আভিজাত্য বা বনেদীয়ানার দাক্ষিণ্য নেই, তাঁর পক্ষে একটি সমগ্র ব্যবস্থা বা তন্ত্রকে যতটা খুলে দেখানো সম্ভব, দীনেন্দ্রকুমার ততটাই সবিক্রম বিস্তারে সেসব উপস্থাপিত করেন। এজন্য একজন পেশাদার লেখক হিসেবে যতটা দায় নেওয়া সম্ভব তার থেকে অনেক বেশি দায় গ্রহণ করেন তিনি।’ ‘গ্রাম্য দলাদলি’ , পল্লী পলিটিক্স ‘ রচনাগুলির বিষয়বস্তুও অকপট, নির্ভীক।দীনেন্দ্রকুমারের রচনাগুলি  ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’ গোছের বহু প্রচলিত ভাবনার বিপরীতে এসে দাঁড়ায়। সেকালের শিক্ষকদের সম্পর্কে আমাদের যে উচ্চ ধারণা, তাঁদের ঘিরে থাকা যে প্রবাদপ্রতিম নীতি – আদর্শের বলয় তাতে আঘাত হানে।

—”বস্তুত গদাই পন্ডিত সকল কার্যেই হেডমাস্টারের দক্ষিণ হস্ত ছিলেন; সুতরাং তিনি ছুটি চাইলেই হেডমাস্টারের অনুগ্রহে পূর্ণ -বেতনে ছুটি পাইতেন; হেডমাস্টার তাহার সকল আবদার বিনা প্রতিবাদে সহ্য করিতেন এবং কেহ গদাই পন্ডিতের বিরুদ্ধে কোন কথা বলিলে হেডমাস্টার সেই সকল অভিযোগে কর্ণপাত করিতেন না।… তিনি ক্লাসে প্রায়ই কোন কাজই করেন না, স্কুলের পাঁচ ঘণ্টাই ফাঁকি দিবার চেষ্টা করেন।” ( গদাই পণ্ডিত) সেকালের বিচারে ও একালের বিচারে, শিক্ষার আঙিনায় এই চিত্র অধিকমাত্রায় বাস্তব।
গ্রামীণ সমাজের আচার -বিচার, প্রথা- প্রকরণ, সংকীর্ণতা, বিধি – বিধান খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন দীনেন্দ্রকুমার। কোনো কষ্টকল্পনার আশ্রয় নেই, রচনায় কোনো আড়ষ্টতা নেই। সেই কারণেই গ্রামীন জীবনের খুটিনাটি তাঁর কলমে ধরা পড়েছে— “গৌরীর মা কাদি কৈবর্তিনী সিক্ত বস্ত্রে, সিক্ত কেশে উঠানে বসে তিনটা জিউলি কচার ডালের উপর একটা মালসা রাখিয়া হড়হর কাষ্ঠের অগ্নিতে হবিষ্যি পাকাইতেছিল। —মহেশ দাস দিঘিতে স্নান করিয়া আসিয়া তাহার গলার কাছাখানি পরিধান করিল এবং পরিহিত কাছাখানি প্রসারিত উভয় বাহুর ওপর ছড়াইয়া দিয়া পাখির ডানা ঝাড়ার  মতো করিয়া তাহা সবেগে আন্দোলিত  করিতে করিতে গৌরীর মাকে বলিল— ‘দেখ, দেখতে দেখতে দশ দিন তো কেটে গেল। আঃ শীতকালে মা-বাপ  মরা কি ফ্যাসাদ; জাড়ের( শীতের) ঠ্যালায় বুকের ওপর য্যানো ঢেঁকিতে পাড় পড়চে!  জলের য্যানো দাঁত বেড়িয়েচে,কি জাড় রে, বাবা।” —এ যেন শব্দ সাজিয়ে সাজিয়ে ছবি গড়ে তোলা৷ ( গৃহহীন)
এই রচনার গোপীনাথ পোদ্দার  একজন ভণ্ড বৈষ্ণব ভক্ত সমাজের প্রতিনিধি রূপে উঠে এসেছে। পাশাপাশি সে একজন নিষ্ঠুর- কৌশলী মহাজন। —দাড়ি গোঁফ কামানো, নাকের উপর সুদীর্ঘ তিলক আঁকা, কণ্ঠে তিনকণ্ঠী স্থূল মালা পরিহিত বৈষ্ণব গোপী মহাজনী কারবারে একেবারে ঝুনো –“সোনা- দানা কিছু এনেছে? আমি কিন্তু টাকায়  চার পয়সার কম সুদে টাকা ধার দিইনে। মহাজনী কারবার— ঝকমারি কত?  নালিশ ছাড়া আজকাল টাকা আদায় করা মুশকিল!—আর নালিশ করতে গেলেই, বুঝেছ কি না, উকিল বেটারা রাঘব বোয়ালের মতো হাঁ করে আছে! উকিলের মুহুরি বলে ‘তহরি’ দাও, হাকিমের পেস্কার বলে ‘দখিলী’ দাও ; সুদ তো চুলোয় যাক, আসল নিয়ে টানাটানি। যেন টাকার জলছত্র খুলে বসেছি!—মহাজনী কারবারে আর সুখ নেই!”

তাঁর রচনায় গ্রামীণ প্রবাদের ব্যবহার পল্লীবাংলার  ছবিকে আরও জীবন্ত করে তোলে— ‘মোর বুদ্ধি তোর কড়ি, ফলার করি আয়’,’বানরের হাতে খন্তা’ , ‘কুকুরের মাথা হওয়া ভালো,  সিংহের লেজ হওয়া ভালো নয়’, ‘মরদ কি বাত, আর হাতি কি দাঁত ‘— এমন বহু প্রবাদ ছড়িয়ে আছে তাঁর রচনায়। সাবলীল সাধু গদ্যের মাঝে প্রয়োজনে গ্রামীণ কথ্যবুলির ব্যবহার বেশ মানানসই  ও জীবন্ত —”আ মোলো শগুন, যত বড়ো মুখ নয় তত বড় কথা!  আমার বাপ তুলছিস?  আমার বাপের ছেরাদ্দ করতে চাস!  মুখে নুড়ো জ্বেলে দেব। অলপ্পেয়ে ড্যাকরা মিনসে!”

সমাজের প্রতি তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গবাণ নিক্ষেপে দীনেন্দ্রকুমারের রচনায় হুতোমি ঢং- এর সঙ্গে মিশে আছে বঙ্কিমী মেজাজ —”অনিল কুমার তাহার একমাত্র পুত্র অসিত কুমারের বিবাহে যেমন ঘটা করিয়াছিলেন, গ্রামবাসীদের বিশ্বাস, দিল্লির দরবারে পূর্বে তেমন ঘটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আর কখনো হয় নাই! সেই ঘটার চোটে ভুবন মালি ও তস্য ভাগিনেয় নিতাই মালি  আতশবাজির বারুদের আগুনে পুড়িয়া মরিয়াছিল এবং এই আগুন গ্রাম্য বাজারের খড়ের দোকানে লাগিয়া এমন ‘রোশনাই’য়ের সৃষ্টি করিয়াছিল যে, বহু পল্লীবাসীকে জগৎ অন্ধকার দেখিতে হইয়াছিল। সে বড় সহজ ঘটা নহে! “(পল্লী-পলিটিক্স)
দীনেন্দ্রকুমারের কলম অত্যাচারিত, বঞ্চিতের পক্ষ অবলম্বন করেছে এবং পল্লী সমাজের নির্মম সত্যকে তুলে ধরেছে। সম্পাদক যথার্থই লক্ষ করছেন, সামাজিক স্বাভাবিক ন্যায়ের প্রতি দীনেন্দ্রকুমার পক্ষপাত। তবে দীনেন্দ্রকুমারের কলমে রসবোধেরও অভাব নেই। আর সেই কারণেই পাঠে ক্লান্তি আসে না।
—”একাদশী চক্রবর্তী জনার্দনপুরের স্বনামধন্য পুরুষ। ‘কঞ্জুষে’-র অগ্রগণ্য বলিয়া গ্রামের লোক প্রভাতে তাঁহারা নাম করিতো না। গ্রামে তাঁহার নাম ছিল ‘বোগনো ফাটা’ উকিল। তিনি মাসের অধিকাংশ দিন একাদশী করিতেন বলিয়া,  কি প্রভাতে তাহার মুখ-দর্শনে একাদশী করিতে হইতো বলিয়া তাহার নাম একাদশী হইয়াছিল, তাহা জনার্দনপুরের ‘ প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণব’ ভবকিঙ্কর দত্ত দেববর্মাই আবিষ্কার করিতে পারে।”(পল্লী পলিটিক্স)  অথবা গদাই পণ্ডিতের পরিচয় প্রসঙ্গে রসবোধের পরিচয় মেলে—” গোবিন্দপুরের গদাই পন্ডিত বিখ্যাত লোক। তাঁহার পূর্ব নাম গদাধর দে। কিন্তু গদাই পন্ডিত না বলিয়া গদাধর দে বলিলে কেহ তাহাকে চিনিতে পারে না। গদাই পন্ডিতের বেতখানি গদারই সূক্ষ্ম সংস্করণ। তিনি যখন স্কুলের ছোট ছোট ছেলেদের ওপর কারণ – অকারণে সেই ভীষণ গদা উদ্যত করিতেন, তখন অনেক বালকের মূর্ছার উপক্রম হইত। “( গদাই পণ্ডিত)
পল্লীবাংলার চিত্র চরিত্র রচনায় দীনেন্দ্রকুমার গ্রামীণ শব্দভাণ্ডারকে যথাসম্ভব ব্যবহার করেছেন, ব্যবহার করেছে প্রচলিত প্রবাদ। সঙ্গে কথ্য বুলির যথাযথ প্রয়োগে রচনা ক্লান্তিহীন স্রোতের মতো বয়ে গেছে। পাঠক হিসেবে সেই ক্লান্তিহীন  স্রোতে ভাসিয়েছি  আদরের নৌকা। তারপর এক আনন্দময় ভ্রমণ— পাঠক হিসেবে এই ভ্রমণের সঙ্গী হতে পারেন আপনারাও।রচনাগুণে ‘সেকালের চিত্র চরিত্র’গুলি পাঠকদের খুব চেনা মনে হবে, নিশ্চিত৷

বইয়ের শেষে অপ্রচলিত শব্দের প্রয়োগ ও অর্থ নিয়ে যুক্ত হয়েছে সম্পাদক দ্বারা সংযোজিত ‘নির্বাচিত গ্রাম্য-শব্দ, শব্দার্থ ও টীকা’৷ বিপুল পরিশ্রমে বিস্মৃতির কবল থেকে রক্ষা করে দীনেন্দ্রকুমারের অসংকলিত রচনার এমন একটি সংকলনের জন্য সম্পাদক ও প্রকাশক উভয়েই বাঙালির কাছে ধন্যবার্দাহ হয়ে রইলেন৷ কেননা, ‘ধার-করা প্রযুক্তির কোপে, ভোগবিশ্বের ক্লেদাক্ত স্রোতের মুখে নিরনুভব ধ্বস্ততায় হারিয়ে যাওয়া আমাদের গ্রাম-তার প্রাকৃত বিশ্ব, তার পথঘাট, যাতায়াতের ব্যবস্থা, জলপথের খোঁজখবর, তার মেলা, ব্রত-পার্বণের সকাল-সন্ধ্যে-দীনেন্দ্রকুমারের রচনায় জীবন্তরূপে থেকে যায়-যা পরম্পরার খাতিরে একালের পাঠকের কাছে অথবা সামগ্রিক-অর্থে একটি আত্মবিস্মৃত জাতির কাছে পূর্বাধিকারের প্রয়োজনীয় উপাদানরূপে পরিগণিত হতে পারে। এবং সেখানেই এইসব রচনা সেকালকে পেছনে ফেলে একালেও পাঠযোগ্যই শুধু থাকে না, সেইসঙ্গে কোথাও কোথাও পরিমাপযোগ্যরূপে প্রাসঙ্গিকও হয়ে ওঠে।’ (সম্পাদকীয়, চিত্র, চরিত্র ও সমাজ-কথকতা, সেকালের চিত্র চরিত্র)

……………………………………………………….

দীনেন্দ্রকুমার রায় লিখিত ‘সেকালের চিত্র চরিত্র’
সংকলন, সম্পাদনা, টীকা ও ভূমিকা : শতঞ্জীব রাহা
প্রচ্ছদ ও অ্লংকরণ : সৌজন্য চক্রবর্তী
মুদ্রিত মূল্য : ৫৪০ টাকা
প্রকাশক : সুপ্রকাশ

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *