সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ৫৬। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

0

(গত পর্বের পর)

রাজা থিব ২: গুপ্তধন

মিনদন মারা যান ১৮৭৮-এর পয়লা অক্টোবর। তাঁর মৃত্যুর পরপরই রাজকুমারদের আবার আটক করে গারদে ঢোকানো হয়। এরপর রাজপরিবারের সমস্ত রাণি ও রাজকুমারিদেরও গ্রেপ্তার করা হয়, তাঁদের যাবতীয় গয়নাগাটি কেড়ে নেওয়া হয়। সুপাইলায়াত ইতিমধ্যে থিব-র প্রধান মহিষী হয়ে উঠেছেন, সেসবের মালিক তিনিই হলেন। বহুমূল্য এই অলঙ্কারাদি ও রাজপরিবারের রত্নভান্ডারের প্রায় সব কিছুই ব্রিটিশ সৈন্যরা কয়েক বছর পরেই লুট করে। অনেক অনেক দিন বাদে, লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরির ইন্ডিয়া অফিস রেকর্ডস-এ কর্মরত সহ-সংরক্ষক, বা কিউরেটরিয়াল সাপোর্ট অফিসার, ক্রেইগ ক্যাম্পবেল সেই রত্নভান্ডারের সন্ধান নিতে গিয়ে দেখছেন, দেড়শো বছর আগে লুট করা রত্ন কোথায় গেছে কেউ জানে না, এ বিষয়ে সমসাময়িক সরকারি নথিতে আশ্চর্য নীরবতা। শুধু, নির্বাসিত রাজা থিব ব্রিটেনের রাজা পঞ্চম জর্জকে চিঠি লিখে জানতে চাইছেন তাঁর রত্নমালা কোথায় গেলো? কর্নেল স্লেডনকে তিনি রাখতে দিয়েছিলেন, এবং স্লেডন যে বলেছিলেন যুদ্ধবিগ্রহ থামলে তিনি সব ফিরিয়ে দেবেন, সেই প্রতিশ্রুতি তিনি রাখলেন না কেন?

ক্যাম্পবেল বলছেন, বার্মার রাজকীয় সোনাদানা নিয়ে গুজব ছড়াচ্ছিলো। কিছু দুষ্টু ব্রিটিশ সৈন্য নাকি সেসবের একটা অংশ নিয়ে মান্দালে প্রাসাদের মধ্যেই কোথাও বস্তাবন্দী করে পুঁতে রেখেছে। পুঁতে রাখা অংশের মধ্যে ছিলো, একটা সোনায় তৈরি বাছুর, সোনার ময়ুরের ওপর বসানো হীরে ও রুবি বসানো মুকুট, অসংখ্য দামি রত্ন, এবং গৌতম বুদ্ধের বিরাট স্বর্ণমূর্তির কপালে বসানো বিপুলাকার একটা রুবি। ১৮৯৩ সালের ৮ই জানুয়ারি, জন মবস নামের সাউদহ্যাম্পটন নিবাসী জনৈক জমিবাড়ির কারবারি ইন্ডিয়া অফিসে চিঠি লিখে জানাচ্ছে, উইলিয়ম হোয়াইট ওরফে জ্যাক মার্শাল নামের এক ব্রিটিশ সৈন্য, এবং আরো একজন সেপাই নাকি রাজা থিবর রত্নরাজি ও রাজকীয় তৈজসপত্র লুকিয়ে রেখেছে। হোয়াইট জনৈক চার্লস বেরিকে এই খবর দেয়, বেরির কাছ থেকে মবস শোনে। মবস হোয়াইটকে খুঁজে বার করে, হোয়াইট বলে গল্পটা সত্যি। অতঃপর, সরকারি তরফে, মবসের মারফত হোয়াইটকে বলা হয়, সে যদি এই গুপ্তধন ফিরিয়ে দিতে পারে, মোটারকমের পুরস্কার তো পাবেই, উপরন্তু, রত্নচুরির অভিযোগে জেল খাটতেও হবে না। সরকার গুপ্তধন খুঁজে বার করার কাজে ঢুকবে না, মবস যদি সত্যি সত্যিই খুঁজে আনতে পারে, তাকে এবং হোয়াইটকে নিশ্চয় একটা অংশ দেওয়া হবে। এরপর গল্পটা গুলিয়ে যায়। হোয়াইট একা একাই বার্মা পাড়ি দেয়, আর তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। সরকারের অর্থাৎ ইন্ডিয়া অফিস আদৌ বিশ্বাস করেনি, তাদের না জানিয়ে হোয়াইট গুপ্তধন উদ্ধার করতে পারবে। মবসের মত ছিলো, কিছুটা তো পারবেই। ক্যাম্পবেল বলছেন, কি হয়েছিলো কে বলতে পারে, রাজা থিবর গুপ্তধনের মতো, গুপ্তধন খোঁজাটাও একইরকমভাবে ধোঁয়াটে, রহস্যাবৃত। হোয়াইট কোথায় গেলো? মবস কী মান্দালে পোঁছেছিলো? গুপ্তধনেরই বা কী হলো? সরকার রত্নের দখল নিয়ে লুকিয়ে রাখলো? নাকি সৈন্যরা খুঁজে পেয়েছিলো, কিম্বা প্রাসাদের কর্মচারীরা? নাকি সে গুপ্তধন এখনো সেখানে, সেভাবেই পোঁতা আছে?

থিব-র গুপ্তধনের এ গল্পটা পাওয়া গেলো ব্রিটিশ লাইব্রেরির ব্লগ থেকে। ইন্ডিয়া অফিসে রাখা পুরোনো কাগজপত্র ঘেঁটে ক্যাম্পবেল সে গল্প আবার তৈরি করেছেন। হারানো রাজপুত্রদের নিয়েও তাঁর একটা গল্প আছে, যে কথা ইতিমধ্যেই বলা হয়েছে। তবে থিব-র রাজা হওয়া ও মান্দালে প্রাসাদ আর একটা বিখ্যাত বা কুখ্যাত গল্প আছে। সে গল্পে প্রচুর রক্তারক্তি, নিষ্ঠুরতা, লোভ। এবং রহস্য, বহু অমীমাংসিত ধাঁধার, তথ্যের বিকারের। সে গল্পও খানিক বলি।

রাজা থিব ৩: প্রাসাদ হত্যাকান্ড ও অন্যান্য খুনজখম

থিব-র আনুষ্ঠানিক অভিষেক হয় ১৮৭৯ সালের মাঝামাঝি। অভিষেকের আগেই, প্রথা অনুসারে তাঁর নামের আগে যে দীর্ঘ স্তবকবদ্ধ উপাধিমালা বসে, তাতে যুগপৎ বৌদ্ধ ও হিন্দু, এবং বর্মী ও ভারতীয় দেবতাদের উল্লেখ। সুধা শাহের বইয়ে সে উপাধিস্তবকের খানিক অনুবাদ আছে:

সমুদ্র ও ভূমির শাসক, উদীয়মান সূর্যের প্রভু…সকল ছত্রধারী প্রধানের রাজা, স্বর্ণ, রৌপ্য, রুবি, তৈলস্ফটিক আদি খনির প্রভু…বহু শ্বেত হস্তির প্রভু, ধর্মের রক্ষক…বর্জ্রের অধিকারী, সূর্যজাত সম্রাট, জীবনমৃত্যুর অধীশ্বর, ন্যায়পরায়ণতার পরাকাষ্ঠা প্রধান, রাজাধিরাজ, অসীম অঞ্চল ও অনন্ত জ্ঞানের অধিকারী, অস্তিত্বের নিয়ামক….

১৮৭৯-র জুন মাসে থিব-র অভিষেক। ওই বছরেরই ফেব্রুয়ারি মাসে মান্দালের প্রাসাদের মধ্যেই কয়েদ করা যাবতীয় রাজকুমার, রাজকুমারি ও রাণিদের তিন দিন ধরে খুন করা হয়। ছেলেদের মাথার পিছনে পাথরের ঘা মেরে থেঁতলে দেওয়া হয়, মেয়েদের গলায় কোপ মারা হয়। রাজপরিবারের ভিতরে খুন করবার সনাতন পদ্ধতি এইরকমই ছিলো, সুতরাং যা করা হয়েছিলো, সনাতন প্রথা অনুসারে। হত্যালীলার পুরো সময়টা জুড়ে প্রাসাদের ভিতরে সঙ্গীত ও বাদ্য মুখর জমজমাট বর্মী নাটক চলছিলো, যাতে সমস্ত আর্তচিৎকার চাপা পড়ে যায়।

এই হত্যাকান্ডের পিছনে কার ইচ্ছা বা মস্তিষ্ক কাজ করেছিলো, ঠিক করে বলবার উপায় নেই। খুনোখুনির খবর বাইরে পৌঁছতেই ব্রিটিশ রেসিডেন্ট চিঠি লিখে আপত্তি জানান, এবং সরকারিভাবে ঠিক করে ফেলাই হয়, থিবকে সরিয়ে ব্রিটিশদের আশ্রয়ে থাকা কোনো রাজপুত্রকে সিংহাসনে বসাতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে যাবতীয় সায়েবী ইতিহাস ও নথিপত্রে থিবকে রক্তলোলুপ নরপিশাচ এবং সাক্ষাৎ শয়তান বলে দেখানো হতে থাকে। তবে, সমসাময়িক সাহেবি বৃত্তান্তের সর্বত্র এই বয়ান ছিলো না, এবং, বর্মা স্বাধীন হবার পর থেকে দিশি ঐতিহাসিকরা মোটামুটি একবাক্যে বলেছেন, প্রাসাদকান্ডের জন্য থিবকে দায়ী করা যায় না, সম্ভবত তিনি এর বিন্দুবিসর্গ জানতেন না। সুধা শাহ, অমিতাভ ঘোষ ও বিভিন্ন ঐতিহাসিকরা এই ঘটনার জন্য দায়ী করছেন সিনবায়ুমাশিনকে,  একাধিক মন্ত্রীকে, এবং কিছুটা সুপাইলায়াতকেও। দেখলাম, আধুনিক মায়ানমারের সরকারি  ভাষ্যও ওই গোছের। ১৮৮৫-র সায়েবদখলের সময় মান্দালের অপরূপ বিলাসবহুল প্রাসাদে ব্রিটিশ সৈন্য ও ভারতীয় সিপাহীরা যথেচ্ছ লুটপাট ভাঙচুর করে, প্রাসাদে আগুনও লাগিয়ে দেয়। তার পরেও যেটুকু বেঁচে ছিলো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জাপানি বোমায় সেটুকুও যায়। যুদ্ধের পরে স্বাধীন বার্মায় নতুন করে সে প্রাসাদ তৈরি করা হয়।

মান্দালে শহরের এই প্রাসাদ এখন ঘুরবার বেড়াবার মনোরম জায়গা, মায়ানমারের অন্যতম প্রধান পর্যটনস্থল। সেখানে প্রাসাদ হত্যাকান্ডের বিশদ বিবরণ সহ একটি স্থায়ী প্রদর্শনী আছে, যাতে দেখানো হয়েছে, প্রাসাদহত্যার জন্য দায়ী ছিলেন সিনবায়ুমাশিন ও মন্ত্রীরা। কোনবং রাজবংশ ও বিশেষ করে প্রথম রাজা আলাউংপায়া আজকের বার্মায় পূজনীয় জননায়ক, আরাকান থেকে শুরু করে চিন সীমান্ত অবধি বিস্তীর্ণ পাহাড়বনে ওই এলাকার আদি বাসিন্দারা বহুদিন ধরে যে স্বাধীনতাযুদ্ধ চালাচ্ছেন, তা দমন করার জন্য সে দেশের সামরিক শাসকেরা হামেশা পুরোনো রাজগৌরব স্মরণ করেন। সরকারপন্থী ঐতিহাসিকরা দেখাতে সচেষ্ট থাকেন, কারেন,চিন, কাচিন, মন ও রাখিন আদি জনজাতিরা আদতে বিচ্ছিন্নতাবাদী, কোনবং বংশের বিরুদ্ধে তাঁরা নিয়মিত ষড়যন্ত্র চালাতেন, ব্রিটিশ বা অন্য বর্হিশত্রুর( যথা চিন) সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। মায়ানমারে সম্প্রতি যে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়, তখনো দেশের সরকার তথাকথিত দেশবিরোধীদের ওপর বোমা ফেলা বন্ধ করেন নি। এবং, রাখাইন এলাকায় বাংলা ভাষাভাষী রহিঙ্গাদের যেভাবে নির্বিচারে নিকেশ করা হয়েছে, ভেবে নিতেই হয় যে সময় বদলায় এবং বদলায় না, সমরশক্তি ও সাম্রাজ্যগর্ব দেশকাল ডিঙিয়ে দুর্বলতর লক্ষ্যবস্তু খুঁজতে, খুঁজতেই থাকে।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply