সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ৫৫। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ
কালিম্পং-এর বর্মারাজার খোঁজে
কালিম্পং-এর আরো অনেক জানা আধজানা অজানা কথার মতো, এ বাড়ির কথা প্রথম পড়ি মনিলার লেখায়। বাড়ি সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলা ছিলো না, বাড়িতে যিনি বা যাঁরা থাকতেন, তাঁরা পরে প্যানোরামা নামের আর একটা বাড়িতে উঠে আসেন। চল্লিশের গোড়া থেকে ষাটের প্রথম দিক অবধি যেসব আন্তর্জাতিক ও বিচিত্র চরিত্র কালিম্পংকে বর্ণময় ও গল্পমুখর করে রেখেছিলেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন বর্মারাজা। বর্মাদেশ থেকে রাজা রাজত্ব সব উৎখাত হয়ে গিয়েছিলো উনিশ শতকের শেষদিকে, দেশের শেষ স্বাধীন রাজা থিবকে বন্দী করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিলো সুদূর মধ্য ভারতের সমুদ্রতটে, আরব সাগর থেকে খাড়া উঠে যাওয়া পাহাড়চূড়ায়, রত্নগিরি দুর্গের কাছাকাছি তাঁকে বাকি জীবন কাটাতে হয় গৃহবন্দী হয়ে। তাহলে কালিম্পং-এর বর্মারাজাটি কে? সে গল্প জানার জন্য বর্মী ইতিহাসের খাসমহলে উঁকি দিতে হলো।
বর্মাদেশ, অর্থাৎ যাকে এখন মায়ানমার বলে ডাকা হয়, সেখানে কি করে সায়েবশাসন কায়েম হলো, তা নিয়ে প্রচুর লেখাপত্র আছে, এখানে সে প্রসঙ্গে অনেক কিছু বলবার দরকার নেই। যেটুকু না বললেই নয়,সেইটুকু বলি। সায়েবসময় থেকে শুরু করে হাল আমল অবধি, বর্মা বা মায়ানমারের ইতিহাস নিয়ে যারা লিখেছেন, তাঁদের মধ্যে সাহেবরা যেমন আছেন, দিশি বা আধা-দিশিরাও আছেন। একটা দুটো লেখার কথা বলবো। তবে সেসব ঐতিহাসিক-লেখকদের বাদ দিলেও, আমাদের বাংলাতেও ওদেশ নিয়ে অনেক গল্প-উপন্যাস-ভ্রমণকাহিনী জাতীয় লেখা আছে, যথা শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত দ্বিতীয় পর্ব বা পথের দাবি, হরিনারায়ণ চটোপাধ্যায়ের বিভিন্ন লেখা, উমাপ্রসাদের বর্মা ভ্রমণকথা, গীতা বন্দোপাধ্যায়ের ববির বন্ধু। ভৌগোলিক নৈকট্যের কারণে হোক বা সায়েবশাসন ও সাম্রাজ্যবিস্তারের অমোঘ তাড়নায়, বাংলাদেশের সঙ্গে বর্মা বা বার্মা অঞ্চলের বহুদিনের যোগাযোগ, বহু বাঙালি ওদেশে বহুদিন ধরে থেকেছেন এককালে, কিছু হয়তো এখনও আছেন। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গোড়ার দিকে জাপানি সৈন্যবাহিনী বর্মাতে ঢুকে আসবার সঙ্গে সঙ্গেই অধিকাংশ বাঙালি সে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন, অনেকেই পাহাড়-বন ডিঙিয়ে, প্রায় পথহীন দীর্ঘযাত্রা সেরে উত্তর-পূর্ব ভারত হয়ে বাংলায় ফেরেন, কিম্বা ফেরেন না। উত্তরবাংলার যে শহরে এই লেখকের বাস, সেখানেও বহু বর্মাফেরত উদ্বাস্তু বাঙালি নতুন করে ডেরা বাঁধেন। বর্মা থেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে একবস্ত্রে পালিয়ে আসবার ভয়াবহ স্মৃতি আজীবন তাঁরা ভুলতে পারেন নি, প্রতিবেশী বন্ধুদের মধ্যে অনেকের পরিবারেই দেখেছি, বর্মি ভাষায় লেখা ছবির বই, কাগজ, সে দেশ থেকে নিয়ে আসা খেলনা।
অর্থাৎ, সায়েবসময় বা তার পরেও, বাংলা বা বাঙালিদের কাছে, বার্মাদেশ খুব দূরের কিছু ছিলো না। তা সত্ত্বেও, বার্মার ইতিহাস বাঙালিদের পড়তে হতোনা, ঘরের পাশের কালিম্পং-এ যে বার্মার রাজা স্বয়ং এসে থেকেছেন অতদিন, এবং মারাও গেছেন ওখানে, কে জানতো? মনিলা এবং লিংউড-সঙ্ঘরক্ষিতা দুজনের লেখাতেই বার্মারাজা ও তাঁর কালিম্পংপ্রবাস নিয়ে অনেক গল্প আছে। সেসবে ঢুকবার আগে, বার্মাদেশের শেষ রাজা ও তাঁর পরিবার নিয়ে ঐতিহাসিক তথ্য যা পাওয়া যাচ্ছে, সংক্ষেপে বলি। তথ্যও গল্পের মতো হয়ে যায়, বা গল্পের চাইতেও বেশি, থিব-র সিংহাসন আরোহণ, রাজ্যপাট ও পরিবার, এবং ইংরেজদের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ ও তৎপরবর্তী নির্বাসনবাস নিয়ে অমিতাভ ঘোষের বিখ্যাত লেখা, গ্লাস প্যালেস, অনেকেই পড়ে থাকবেন। এই লেখা এবং অপেক্ষাকৃত হাল আমলের গুটি কয়েক বই (প্রধানত, সুধা শাহের অনবদ্য লেখা, দীর্ঘ সাত বছরের তন্নিষ্ঠ গবেষণার ফসল, দি কিং ইন এক্সাইল, ভারতের হার্পার কলিন্স থেকে ২০১২ সালে প্রকাশিত), ও অন্য তথ্যসূত্র অনুসরণ করে, একেবারেই চুম্বকাকারে, রাজা থিব ও তাঁর গল্পটা বলা যাক।
বর্মাদেশের শেষ রাজা থিব ১
থিব ছিলেন বর্মার শেষ রাজবংশ কোনবউং বা কোনবং বংশের শেষ রাজা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহেবরা যখন বাংলা বিহার দখল করে ভারতবর্ষের ভিতরে ঢুকে আসছে, আঠেরো শতকের মাঝামাঝি সেই ঝোড়ো সময়ে আধুনিক বর্মা রাষ্ট্রেরও জন্ম হচ্ছে। কোনবং বংশের প্রথম বা প্রতিষ্ঠাতা শাসককে ডাকা হতো আলাউংমিনত্যাগি(আলাউংপায়া বলে পরিচিত, তবে বর্মী ভাষার শব্দের উচ্চারণ বাংলায় ঠিক মতো আনা প্রায় অসম্ভব), অর্থাৎ ন্যায়পরায়ণতার পরাকাষ্ঠা, মহান রাজা বলে। শরীরে রাজরক্ত না থাকলেও, একের পর এক রাজ্য, এলাকা দখল করে আলাউংপায়া বর্মার অর্ধেক এলাকার প্রভু হয়ে ওঠেন, বাকি এলাকা দখল করেন তাঁর পুত্র সিনবিওশিন। রাজ্য আকারে ও ক্ষমতায় বাড়তে থাকে, সেই সঙ্গে বাড়ে একের পর এক পরাক্রান্ত বর্হিশত্রুর আক্রমণ, চিন, ফ্রান্স, পর্তুগাল। কোনবং বংশের ষষ্ঠ ও শেষ শক্তিশালী রাজা বোদাপোওয়া-র মৃত্যুর কয়েক বছরের মধ্যেই, উনিশ শতকের গোড়ায়, ব্রিটিশ সৈন্যরা বর্মা আক্রমণ করে, রাজ্যের সীমান্তবর্তী এলাকা, কোম্পানিভারতের লাগোয়া আরাকান ও অন্যান্য অঞ্চল কোম্পানির দখলে চলে যায়। সিপাহি বিদ্রোহের কিছু আগে, রাজা মিনদনের আমলে, ১৮৫২-য় দ্বিতীয় ইঙ্গ-বার্মা যুদ্ধ, কোম্পানির দখলে পেগু ও সংলগ্ন এলাকা, তৎসহ টিক বা সেগুন গাছের বহুমূল্য জঙ্গল। তৃতীয় যুদ্ধ যখন হচ্ছে, কোম্পানিরাজ শেষ হয়ে রাণি ভিক্টোরিয়ার শাসনকাল শুরু হয়েছে, অর্ধেক পৃথিবী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ। অন্যদিকে, ক্রমে ছোট হতে থাকা স্বাধীন, প্রাক-ব্রিটিশ বর্মা কুঁকড়ে গুটিয়ে রাজধানী মান্দালের আশপাশের এলাকায় সীমিত, সিংহাসনে কোনবং বংশের শেষ ও সম্ভবত দুর্বলতম রাজা, থিব।
সমসাময়িক ও পরবর্তী ঐতিহাসিকরা বলছেন, বর্মার বিভিন্ন রাজবংশের সাধারণ প্রথা ছিলো, রাজার প্রথম পুত্রসন্তান ও তাঁর সন্তানেরা যথাক্রমে রাজা হবেন। এ ছাড়া, রাজবংশের রক্তের শুদ্ধতা বজায় রাখার প্রয়োজনে বিয়েথা হতো বংশের ভিতরেই, প্রচলিত প্রথা অনুসারে রাজারা নিজেদের সৎবোনেদের বিয়ে করতেন। এর অর্থ, রাজভ্রাতারা এবং তাঁদের সন্তানেরা সরাসরি বঞ্চিত হতেন, ফলে রাজত্ব রাজপাট নিয়ে ঝগড়া মারামারি রক্তপাত লেগেই থাকতো। কোনবং বংশেও সেই পরম্পরা জারি, হিসেবমতো থিব-র সিংহাসনে বসার কথা নয়, অথচ তিনি খুব দ্রুত রাজা হয়ে গেলেন। শোনা যায়, রাজা মিনদনের অন্যতম স্ত্রী রাণি সিনবায়ুমাশিন থিবকে সিংহাসনে বসানোর জন্য নানান কূটকৌশল করেন, ছলের আশ্রয় নেন। মিনদনের পুত্রসংখ্যা চল্লিশের ওপর, এবং উত্তরাধিকারি হিসেবে তাঁর প্রথম পছন্দ ছিলেন তাঁর ভাই। থিব সেসময় প্রথা অনুযায়ী বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর জীবন কাটাচ্ছিলেন, যুদ্ধবিগ্রহ বা রাজ্যশাসন কোনটাতেই তাঁর আগ্রহ ছিলো না। এছাড়া, সম্ভবত, তিনি লোকটাও বেশ ভালোমানুষ গোছের ছিলেন, সিনবায়ুমাশিন রাজার বড়মন্ত্রীদের গিয়ে বোঝালেন, থিবকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া যাবে। থিবকে রাজা বানানোর পিছনে রাণির প্রত্যক্ষ স্বার্থ ছিলো, তিনি চাইছিলেন তাঁর বড় মেয়ের সঙ্গে থিবর বিয়ে দিতে। ব্যাপারটা ঠিক সেরকম দাঁড়ালো না, সিনবায়ুমাশিনের মেজ মেয়ে রাজকুমারী সুপাইয়ালাত থিবর প্রেমে পড়লেন, কিম্বা তাঁর রাণি হবার আকাঙ্ক্ষা জন্মালো।
মিনদন যখন মৃত্যুশয্যায়, সিনবায়ুমাশিন মন্ত্রীদের সঙ্গে ষড় করে রাজাকে মানিয়েগুছিয়ে নিলেন, প্রধান উত্তরাধিকারী হিসেবে থিব-র নামে সিলমোহর পড়লো। রাজার ভাই ইতিমধ্যে মারা গেছেন, অন্য তিন প্রধান রাজপুত্রকে রাজা তাঁর রাজ্যের তিন টুকরোর শাসক বানিয়ে দিয়েছেন, রাজাজ্ঞা অনুসারে তাঁদের সবার জলপথে নিজেদের রাজ্যের দিকে রওয়ানা হবার কথা। এর আগেই সিনবায়ুমাশিন তাঁদের ও রাজপরিবারের সমস্ত রাজপুত্র ও রাজকন্যাকে ডেকে পাঠিয়েছেন, মৃত্যুর আগে রাজা তাঁদের সবাইকে দেখতে চেয়েছেন, এই বলে। সবাই যেই এলেন, তাঁদের গ্রেপ্তার করা হলো। শোনা যায়, রাজা মিনদন এই গ্রেপ্তারির কথা জানতে পেরে সবাইকে ছেড়ে দেবার আদেশ দেন। দুজন রাজপুত্র প্রাসাদ থেকে পালিয়ে মান্দালের এক মঠে আশ্রয় নিলেন(এটা ঠিক কখন ঘটেছিলো সে বিষয়ে তথ্য নেই—মান্দালেতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পর পালিয়ে যাওয়া রাজকুমারদের খুঁজে পাওয়া যায়)।
(ক্রমশ)
