সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ৫২। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ
ধর্মোদয় বিহারের ভিতরে
ঘাসে ঢাকা রাস্তা ধরে এগিয়ে একটা লোহার দরজা পাওয়া গেলো, পুরোনো দরজা নয়, হালের, যেমন হয় আরকি, সার সার লোহার গ্রিল দিয়ে তৈরি। তা নয় কিছু একটা হলো, কিন্তু দরজাটা বন্ধ, ঢুকি কি করে? পাশেই ওই চৌকো বাড়িটা, সেখান থেকে বাচ্চাদের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। নেটে কোথাও একটা দেখেছিলাম, ধর্মোদয় বিহার নামের একটা ইস্কুল আছে, নিশ্চয় সেইটাই, ভেবে নিলাম। কিন্তু, তথাপি, বিহার কোথায়? কাউকে ডাকবো, জিজ্ঞেস করবো? কাকে? চতুর্দিকে জনমনিষ্যির চিহ্ন নেই। ভাবতে ভাবতে, এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে দেখি, সামনের দরজার ভিতরে একটা ছোটো পাল্লামতো আছে, সেটা খোলা, একটু নিচু হয়ে দিব্যি ঢুকে যাওয়া যায়। সঙ্ঘরক্ষিতাকে স্মরণ করে ঢুকে পড়লাম। খাড়াই সিঁড়িপথ যেখানে শেষ হচ্ছে, সেখানে একটা ছোট মাঠ, মাঠের ঠিক মধ্যিখানে একটা পুরোনো দোতলা বাড়ি। মনে পড়লো, লিংউড-সঙ্ঘরক্ষিতা উল্লেখ করেছিলেন, তাঁদের বিহার তৈরি হয়েছিলো একটা পুরোনো য়ুরোপীয় ধাঁচের বাড়িতে। সামনে যে বাড়িটাকে দেখছি, সেটাই কি? কিন্তু কি করেই বা? একে তো বাড়ির সামনে একটা ফলকে লেখা নার্সারি, ১৯৮৪, তায় মেটে হলুদ রঙের পাথরের বাড়িটা চারদিক থেকে বন্ধ, বাড়ি ঘিরে, বাড়ির সঙ্গে লাগানো টিনের ছাদ-ওলা কাঠের একচালা সমেত। কাঠগুলো রংচটা, জীর্ণ, ছাদের টিনের অবস্থাও তথৈবচ। সামনের মাঠে বড় বড় ঘাস গজিয়েছে, ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে নানান রকমের ছোট গাছ, তাদের মধ্যে এক জাতীয় গাছে হালকা বেগুনি ফুল, তুলো তুলো, সুন্দর। পাহাড়ের বহু জায়গায় এ ফুল আগে দেখেছি। সামনের বন্ধ হলুদ বাড়ি, মাঠের গাঢ় সবুজ ঘাস, ফিকে বেগুনি রঙের বনফুল, মাথার ওপরের আকাশে শ্লেট রঙা মেঘ, সন্ধ্যা নামবো নামবো করছে, এতক্ষণ পরে মনে হলো, বিহার খুঁজে পাই বা না পাই, এসে ভালো করেছি।
পাহাড়ের যে ধাপে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তার কিছু ওপরে আর একটা ধাপ, সেখানে বৌদ্ধ মন্দির গোছের কিছু একটা দেখা গেলো। ঘাসের মধ্য দিয়ে পায়ে চলা সরু একটা পথ সেদিকে গিয়েছে। সেটা ধরে উঠতে উঠতে নিচে তাকিয়ে দেখি, শিলিগুড়ি যাবার বড় রাস্তা, গাড়িটাড়ি লোকজন যাতায়াত করছে, রাস্তার ওপারে দশ বাড়ি সমান একটা বিশাল বিজ্ঞাপনে লেখা, ট্রেন্ডস। রাস্তা থেকে বেশ কিছুটা উঠে এসেছি, নিচের আওয়াজ তত আসে না, এবং, দূর থেকে দেখলে সবটাই বেশ ছবি ছবি লাগে, খারাপ লাগলো না, যেমন সচরাচর লাগে।
ওপরে উঠে দেখি, বৌদ্ধ মন্দির গোছের ছোটোখাটো গোটা দুয়েক সাদা রঙের বাড়ি, দুটোই বন্ধ, তবে বাইরে থেকে উঁকি মেরে দেখি, একটার ভিতরে প্রদীপ জ্বলছে, আধো অন্ধকারে হলুদ-সোনালি বুদ্ধ বসে আছেন। ব্যাস। কিছু লেখা নেই, মানুষজন পাখি কুকুর কিচ্ছু নেই। মন্দিরের পিছনে পাহাড় ধাপে ধাপে উঠছে, কিছু গাছপালা দেখা যাচ্ছে বটে, তবে বেশিটাই বাড়ি। মন্দিরের চাতালে দাঁড়িয়ে নিচে তাকালে দেখা যাচ্ছে হলুদ বাড়িটা, মাঠ, নিচের রাজপথ। পাহাড় কোথায়, পাহাড়, কালিম্পঙ পাহাড়, যার চুড়োয় কাঞ্চনজঙ্ঘার দিব্যবিভা, তিস্তা অবধি ধাপে ধাপে নেমে যাওয়া যার প্রত্যেক স্তরে পুষ্প ও শস্যের বর্ণচ্ছটা?
ধর্মোদয় বিহারের জানলা থেকে দেখা নিসর্গ এবং বিহারের বাড়ি নিয়ে লিংউড যা বলেছেন, এখানে বলি:
…বাড়ির লন, ফুলের বাগান তৈরি হয়েছে পাহাড়ের কাঁধের ওপর, পাহাড় কেটে তৈরি করা একটা চাতালে। নিচে, কিন্তু চোখের আড়ালে রাস্তা, পিছনে, পাহাড়ের আরো খাড়া ধাপ, তাদের কোন কোনটায় সদ্য চাষের চিহ্ন। বিহারের যে দিকটায় বাজার, বড় বড় গাছের জটলা, গাছের ফাঁক দিয়ে পাশের বাড়ির ঢেউ খেলানো লাল চাল দেখা যায়। অন্য দিকটায় একটা ঝোরা, যেটা বিহারের পশ্চিম সীমানাও বটে। ঝোরা ঘিরে সুঠাম সুন্দর বাঁশগাছের ঝাড়, এক একটা গাছ তিরিশ-চল্লিশ ফুট উঁচু। ঝাড়টা এত ঘন যে মনে হতো সবুজ পর্দা, ভেদ করে দৃষ্টি যায় না। ভালোভাবে বানানো হলেও, বিহারের বাড়ি খুব একটা বড় নয়। ওপরে ও নিচে দুটো দুটো করে বেশ বড়সড় ঘর, আর চারটে ছোটো ঘর। বাড়িটার সবচাইতে মন ভালো করা ব্যাপার হচ্ছে খুব সুন্দর কাঠের কাজ। নিচের ছোট ঘরগুলো পুরোটাই ঘন বাদামি রঙের কাঠ দিয়ে বানানো, ওপরের তলা ঘিরে থাকা বারান্দাটাও তাই।
(ক্রমশ)
