সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ৪৯। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ
মহাপ্রজ্ঞাকথা
মহাপ্রজ্ঞার আত্মজীবনী অনুসরণ করে গেলনার ও লেভিন বলছেন, নেপাল থেকে নির্বাসিত হবার পর শেরিং ও তাঁর শিষ্যরা গেলেন বোধগয়ায়। মহাপ্রজ্ঞা জানাচ্ছেন, শুধু তিনি এবং তাঁর শিক্ষানবিশ বন্ধুরা নন, স্বয়ং শেরিং নরবুও বোধগয়ায় পৌঁছে এক বর্মি সাধুর কাছে নতুন করে দীক্ষা নেন, হলুদ-কমলা কাষায় বস্ত্র ধারণ করেন। এর অর্থ, নিংমাপাপন্থী তিব্বতি বৌদ্ধবাদ ছেড়ে তাঁরা থেরাবাদে দীক্ষা নেন, প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন, বর্জ্রযান থেকে হীনযানে প্রবেশ করেন।
বোধগয়া থেকে মহাপ্রজ্ঞারা পৌঁছে যান কলকাতায়। সেখানকার মহাবোধি সোসাইটিতে ধর্মাদিত্য ধর্মাচার্যের সঙ্গে তাঁদের দেখা হয়, তিনি প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে ভিক্ষুদের পক্ষ নেন, নেপাল সরকারের নিন্দা করেন। চারপাশে এত সব ঘটছিলো বটে, অথচ মহাপ্রজ্ঞার মন সেই পড়ে আছে সুদূর তিব্বতে। ফলে, শেরিং নরবু যখন তাঁকে তিব্বতে গিয়ে তিব্বতি বৌদ্ধবাদ শেখার জন্য নিমন্ত্রণ করলেন, কোথায় পড়ে রইলো থেরাবাদ ও কাশায় বস্ত্র, নরবুর পিছু পিছু মহাপ্রজ্ঞা লাসা পোঁছে গেলেন, সেখানে গিয়ে আবার লামা হলেন, শিক্ষানবিশ নয়, পুরোদস্তুর সাধু হিসেবে। ধর্মপ্রচারক ও শিক্ষক হিসেবে তাঁর নামডাক হলো, তবু লাসাতে মন বসলো না, ভবঘুরে ভিক্ষু সাধু হয়ে তিনি তিব্বতের হিমশীতল মরুকান্তারে ঘুরে বেড়াতে থাকলেন। সমুদ্রতল কিম্বা কাঠমান্ডু উপত্যকা থেকে বহু বহু উঁচু মধ্য তিব্বতের মালভূমির চরম আবহাওয়া, এবং খাবার বলতে শুধু সাম্পা, এ সবের ধাক্কায় মহাপ্রজ্ঞা গুরুতর অসুস্থ হলেন, লাসায় ফিরে যেতে হলো।তাতে কি আসে যায়, ঝাড়ফুঁক মন্ত্রতন্ত্র করে যে দিশি বৈদ্য তাঁকে ভালো করে তুললেন, তাঁকেও তিনি ঘরসংসার স্ত্রীপুত্র ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে উৎসাহিত করলেন, দুজনে মিলে চলে এলেন সিগাৎসে(লাসার পর তিব্বতের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ধর্মস্থল ও শহর, পাঞ্চেন লামার জায়গা), একটা পাহাড়ি গুহায় থেকে তপস্যা করতে শুরু করলেন। প্রায় বছর খানেক থাকার পর মহাপ্রজ্ঞার মন আবার উচাটন হলো, তিব্বত ছেড়ে হিমালয় ডিঙিয়ে তিনি ও তাঁর সঙ্গী আবার ভারতের সমতলে নেমে এলেন। নামতে নামতে, দীর্ঘ কঠিন পথ হাঁটতে হাঁটতে, বোধগয়া ও কলকাতায় যে শিক্ষা হয়েছিলো তা স্মরণে এলো, অর্থাৎ তিনি পুনরপি থেরাবাদে আকৃষ্ট হলেন। আরো জানতে হবে, শিখতে হবে, সুতরাং তাঁরা কুশিনগরে এলেন। কুশিনগরে প্রখ্যাত বর্মি সাধু চন্দ্রমণি বহুকাল ধরে বসবাস করছেন, তাঁর কাছে নাড়া বেঁধে আবার, আর একবার, থেরাবাদে দীক্ষা নিলেন। থেরাবাদী সন্ত হিসেবে নেপালে যাঁদের নাম বহুশ্রুত, তাঁদের প্রায় প্রত্যেককেই দীক্ষা দিয়েছিলেন চন্দ্রমণি। আর যাঁদের দীক্ষা দিয়েছিলেন, তন্মধ্যে অন্যতম ডি পি ই লিংউড ওরফে সঙ্ঘরক্ষিতা, এবং স্বয়ং ডাক্তার আম্বেদকার।
মহাপ্রজ্ঞার প্রব্রজ্যা সমাপ্ত হলো না। পুলিশের নজর এড়িয়ে, মহিলার ছদ্মবেশে তিনি আবার নেপালে ফিরলেন, কাঠমান্ডুও গেলেন। সেখানে বেশিদিন থাকা হলো না, থেরাবাদ সাধনার উচ্চমার্গের আহ্বান, উপসম্পদা লাভ করতে হলে অন্তত দশ জন সন্তের উপস্থিতি প্রয়োজন, কাঠমান্ডুতে থাকলে যা সম্ভব নয়। সুতরাং আবার হাঁটা, আবার পাহাড় ছেড়ে নিচে নামা, নামতে নামতে বর্মা অবধি পোঁছে যাওয়া। বর্মায় তাঁর উপসম্পদা লাভ হলো, তিনি থেরাবাদী মতে পূর্ণ প্রব্রজক ভিক্ষু হিসেবে স্বীকৃত হলেন। ১৯৩১ সালের কথা। ওই সময় থেকে শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগার প্রাকমুহূর্ত পর্যন্ত, মহাপ্রজ্ঞা ক্রমাগত বর্মা ও নেপালের মধ্যে যাতায়াত করছেন, যে সময়টা পথে কাটছে না, বনে গিয়ে ধ্যান করছেন। যুদ্ধ যখন চলছে, তিনি পাহাড়তলির তরাইতে কিম্বা ভারতের ভোজপুরে। যুদ্ধশেষের পর তিনি কালিম্পং গেলেন, অপেক্ষা করতে থাকলেন কবে নেপালে ফেরা যায়।
(ক্রমশ)
